Friday, May 3, 2024

সরস্বতী ও কুন্তী : কিছু কথা 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সরস্বতী ও কুন্তী দুটোই নদী । পশ্চিমবঙ্গের হুগলির সপ্তগ্রামের কাছে ত্রিবেণীর শ্মশান‌ঘাটের পাশে সরস্বতী নদী গঙ্গায় মিশেছে । একসময় সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল । তেমনি পূর্বভারতে সপ্তগ্রাম বড়ো বাণিজ্যবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল । এই তিন নদীকে কেন্দ্র করে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য । কলকাতার আগেই সপ্তগ্রাম ছিল বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্র । বাংলার প্রাচীন জনপদ ও পবিত্র স্থান হল এই ত্রিবেণী । ব্যান্ডেল জংশন থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত এখানে গঙ্গা-কুন্তী ও সরস্বতীর মিলন ঘটেছে । প্রয়াগের সরস্বতী নদী অন্তঃলিলা । আর হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গা-সরস্বতী মুক্ত । এই স্থানকে বলা হয় মুক্তবেণী ।  সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাই– 'মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে / আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে ।' ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান হিন্দুদের পবিত্র কৃষ্টি । দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত ধোয়ীর  'পবনদূতম' কাব্যে এর উল্লেখ রয়েছে । মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই স্থানকে 'তিরপানি' ও 'ফিরোজাবাদ' নাম দিয়েছেন । ফিরোজ শাহ কিছুকাল এখানে রাজত্ব করেছিলেন । ত্রিবেণীতে মুসলমান আমলের কীর্তি 'জাফরখান মসজিদ' রয়েছে । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখেছেন– 'বামদিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী / যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি ।' হুগলির ত্রিবেণীও প্রয়াগরাজেরই সংস্করণ । তথ্য বলে, ১৩০৯ সালে শেষবার মাঘী পূর্ণিমায় কুম্ভস্নান হয়েছিল এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে মুসলিম আক্রমণের পর বা ইংরেজ আমলে এই ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে কানাডার নৃতত্ত্ববিদ তথা ইতিহাসবিদ অ্যালান মরিনিস ( জন্ম- ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ) অক্সফোর্ডে জমা দেওয়া গবেষণাধর্মী কাজের  সূত্রে এই তথ্য প্রকাশ করেন যে, কয়েকশো বছর আগে ত্রিবেণীতে হত কুম্ভমেলা বা কুম্ভস্নান ( Kumbh Mela in Tribeni ) । হুগলি জেলার কুন্তীঘাট বা চন্দ্রহাটি বিড়লা মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুন্তী নদী । এ নদীও ত্রিবেণীতে মিলিত হয়েছে । কুন্তী দামোদরের একটি শাখা নদী । প্রাচীন ভৌগোলিক তথ্য ব্লেভের মানচিত্র ( ১৬৫০ ) অনুসারে দামোদরের একটি ফ্লোজ মাধ্যম প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ নদী নয়াসরাতে অগ্নি নদীর পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ত্রিবেণীতে যোগদান করেছে । গেস্টাল্ট এর মানচিত্র ( ১৫৬১ ) অনুযায়ী দামোদরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদী কুন্তীনদী, যা মিলিত হয় সাতগাঁওয়ের কাছে । তিনটি নদীর মিলনস্থল বলেই জায়গাটার নাম ত্রিবেণী । একসময়ের বাণিজ্যকেন্দ্র সরস্বতীনদীর সঙ্গমস্থল আজ পরিত্যক্ত । কারণ নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে । শুধু জোয়ারের সময় একটা ক্ষীণধারার সৃষ্টি হয় ।  কুন্তীনদীর স্রোতধারা এখনও বহমান । জোয়ারের সময় তার দুকূল ভরাট হয়ে যায় । তখন নদীকে অনেক বিস্তৃত দেখা যায় ।
এছাড়া দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশেও কুন্তী নামে একটি নদীর অবস্থান জানা যায় । কুন্তীনদী  কেরালার সাইলেন্ট ভ্যালির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।

Thursday, May 2, 2024

সরস্বতী ও কুন্তী : কিছু কথা

সরস্বতী ও কুন্তী : কিছু কথা 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।

সরস্বতী ও কুন্তী দুটোই নদী । পশ্চিমবঙ্গের হুগলির সপ্তগ্রামের কাছে ত্রিবেণীর শ্মশান‌ঘাটের পাশে সরস্বতী নদী গঙ্গায় মিশেছে । একসময় সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল । তেমনি পূর্বভারতে সপ্তগ্রাম বড়ো বাণিজ্যবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল । এই তিন নদীকে কেন্দ্র করে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য । কলকাতার আগেই সপ্তগ্রাম ছিল বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্র । বাংলার প্রাচীন জনপদ ও পবিত্র স্থান হল এই ত্রিবেণী । ব্যান্ডেল জংশন থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত এখানে গঙ্গা-কুন্তী ও সরস্বতীর মিলন ঘটেছে । প্রয়াগের সরস্বতী নদী অন্তঃসলিলা । আর হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গা-সরস্বতী মুক্ত । এই স্থানকে বলা হয় মুক্তবেণী ।  সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাই– 'মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে / আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে ।' ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান হিন্দুদের পবিত্র কৃষ্টি । মহাভারতের 'বনপর্বে' পুলস্ত্যমুনি হুগলির ত্রিবেণীতে কুম্ভস্নানের কথা উল্লেখ করেছেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত ধোয়ীর  'পবনদূতম' কাব্যে এর উল্লেখ রয়েছে । মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই স্থানকে 'তিরপানি' ও 'ফিরোজাবাদ' নাম দিয়েছেন । ফিরোজ শাহ কিছুকাল এখানে রাজত্ব করেছিলেন । ত্রিবেণীতে মুসলমান আমলের কীর্তি 'জাফরখান মসজিদ' রয়েছে । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখেছেন– 'বামদিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী / যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি ।' হুগলির ত্রিবেণীও প্রয়াগরাজেরই সংস্করণ । তথ্য বলে, ১৩০৯ সালে শেষবার মাঘী পূর্ণিমায় কুম্ভস্নান হয়েছিল এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে মুসলিম আক্রমণের পর বা ইংরেজ আমলে এই ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে কানাডার নৃতত্ত্ববিদ তথা ইতিহাসবিদ অ্যালান মরিনিস ( জন্ম- ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ) অক্সফোর্ডে জমা দেওয়া গবেষণাধর্মী কাজের  সূত্রে এই তথ্য প্রকাশ করেন যে, কয়েকশো বছর আগে ত্রিবেণীতে হত কুম্ভমেলা বা কুম্ভস্নান ( Kumbh Mela in Tribeni ) । হুগলি জেলার কুন্তীঘাট বা চন্দ্রহাটি বিড়লা মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুন্তী নদী । এ নদীও ত্রিবেণীতে মিলিত হয়েছে । কুন্তী দামোদরের একটি শাখা নদী । প্রাচীন ভৌগোলিক তথ্য ব্লেভের মানচিত্র ( ১৬৫০ ) অনুসারে দামোদরের একটি ফ্লোজ মাধ্যম প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ নদী নয়াসরাতে অগ্নি নদীর পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ত্রিবেণীতে যোগদান করেছে । গেস্টাল্ট এর মানচিত্র ( ১৫৬১ ) অনুযায়ী দামোদরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদী কুন্তীনদী, যা মিলিত হয় সাতগাঁওয়ের কাছে । তিনটি নদীর মিলনস্থল বলেই জায়গাটার নাম ত্রিবেণী । একসময়ের বাণিজ্যকেন্দ্র সরস্বতীনদীর সঙ্গমস্থল আজ পরিত্যক্ত । কারণ নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে । শুধু জোয়ারের সময় একটা ক্ষীণধারার সৃষ্টি হয় ।  কুন্তীনদীর স্রোতধারা এখনও বহমান । জোয়ারের সময় তার দুকূল ভরাট হয়ে যায় । তখন নদীকে অনেক বিস্তৃত দেখা যায় ।
এছাড়া দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশেও কুন্তী নামে একটি নদীর অবস্থান জানা যায় । কুন্তীনদী  কেরালার সাইলেন্ট ভ্যালির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।