পৌষের পাঁচালি : হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
'কারো পৌষমাস । কারো সর্বনাশ' । এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ । তার অর্থ পরিস্ফুট করলেই এই মাসটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় । আমাদের ষড়ঋতুবৈচিত্রের মধ্যে শীতঋতুর শুরু পৌষমাস থেকে । অঘ্রাণের শেষেই পৌষমাস আসে । হেমন্তের সাথে শীতের পরশ লাগে সর্বত্র । হেমন্তের শেষভাগে কুয়াশা পড়তে শুরু করে । পৌষমাসে তা আরো গাঢ় হয় । সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশায় ঢেকে যায় চারদিক । রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে চারদিক সাদা আস্তরনে ঢেকে যায় । তা প্রায় পরের
দিন সকাল পর্যন্ত থাকে । সকালে ঘাসের বুকে মুক্তোবিন্দুর মতো শিশির জমে থাকে । প্রভাতী সূর্যের রথআলো তার উপর পড়লে ঘাসের বুকে অজস্র হীরকদ্যুতিবিন্দুতে মাঠ-ঘাট উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । শীতও ধীরে ধীরে সংসার গুছিয়ে নিতে থাকে এই সময়ে । ইংরেজি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আসে পৌষমাস ।
কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে বর্ষাকাল থেকে শুরু হয় খেতখামারের কর্মতৎপরতা । আর এই কর্মযজ্ঞের পরিসমাপ্তি ঘটে হেমন্তের শেষে । অর্থাৎ অঘ্রাণের শেষ নাগাদ । এসময়ে কৃষকের পরিশ্রমের ফসল ঘরে আসে । জীবন-জীবিকা নিয়ে সংবৎসরের স্বপ্ন ও পরিশ্রম সার্থকতা লাভ করে । গৃহস্থের মন আনন্দে ভরে ওঠে । পৌষমাসব্যাপী চলে ধান মাড়াই , ঝাড়াই-বাছাই এবং শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজ । সারাবছরের রসদ এবং অর্থনীতি নির্ভর করে এইসময়ে সংগৃহীত ফসলের উপর । যার ঘরে ধান আছে তার সুদিন আছে । আর যার ঘরে ধান নেই, ফসল নেই , কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে কঠোর পরিশ্রমে ফলানো ফসল । তার দুঃখের অন্ত নেই । পরবর্তী বছরে ফসল আসা পর্যন্ত তাকে কঠিন অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হবে । অনিশ্চিত জীবন তার সামনে । একারণেই প্রাগুক্ত প্রবাদটি ব্যবহার করা হত কৃষিভিত্তিক জীবনে । পরবর্তী সময়ে কারো সুখদুঃখের বৈপরীত্যের তুলনা করতে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয় । কৃষিজীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রবাদের অর্থবিস্তার ঘটে পরবর্তী সময়ে ।
কৃষিভিত্তিক সাংস্কৃতিক জীবনে পৌষমাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।'ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি' । সেই হাসি পৌষমাসে এসে গৃহস্থের ঘর আলো করে ঝরে পড়ে । উঠোনভর্তি সোনার ধান দেখে গৃহস্থের মনে আনন্দ ধরেনা । আনন্দের আবেশে সারামাস ধরে নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে । যার পরিসমাপ্তি ঘটে মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন । কিছুটা ব্যস্ততাহীন জীবনে নানাভাবে উপভোগ করা হয় এই মাসটিকে । ঘরে ধান আছে মানে ধনও আছে । অর্থনীতি সচল আছে । ধনের সঙ্গে লক্ষ্মীর সম্পর্ক । লক্ষ্মী ধনের দেবী । ধানেরও দেবী । তাই পৌষমাসকে লক্ষ্মীমাসও বলা হয় ।
একসময় পৌষের কর্মকান্ড শুরু হয়ে যেত গ়হস্থের উঠোন থেকে । ধানের মরাইয়ে ধানের আঁটি গুছানোর পর উঠোনটাকে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ দিয়ে লেপা হত । ধান মাড়াইয়ের পর এই নিকোনো উঠোনেধান শুকোতে দেওয়া হত । ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার পর শূন্য উঠোনের বুক আবার ভরে উঠত নানা শিল্পকর্মে । ঊঠোনটাকে লেপার সময় সুপারিগাছের ঝরে যাওয়া পাতার খোলটাকে সংগ্রহ করে সেই খোলের একদিকে সুন্দর করে বিশেষ সুঁচালোভাবে কেটে তা দিয়ে ভেজা লেপা উঠোনের মাটির বুকে দাগ টেনে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলা হত । মেটে রঙের এই নকশা উঠোনটাকে একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দিত । এছাড়া নতুন ধান কুটে চাল বের করে সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে উঠোনময় আঁকা হত আলপনা । প্রধানত মহিলারাই এই আলপনা দিয়ে থাকে । ক়ষিজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ের চিত্র থাকত আলপনায় । ধানের ছড়া, ঘট, লক্ষ্মীর পা, ধানের মরাইয়ের চিত্র, পাতা-লতা ইত্যাদি ছিল আলপনার বিষয় । এখন আর আগের মতো বড়ো উঠোন নেই । এক পরিবার ভেঙে দশ পরিবার হয়েছে । মাটির বাড়িঘর হয়ে গেছে দালানবাড়ি । ছোট্ট উঠোনেও সিমেন্ট কংক্রিটের ঢালাই ।তাছাড়া এখন বাজারে স্টিকারের মতো আলপনার সিট কিনতে পাওয়া যায় । কাজেই কে আর আলপনার ঝামেলা করতে যাবে ।
পৌষমাস এলে, ঘরে ধান উঠলে পিঠে পায়েস পুলির তৈরির ধুম লেগে যেত গ্রামের ঘরে ঘরে । গভীর রাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে চাল কুটে গুঁড়ি তৈরি করা হত । অনেকরাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিত । 'ও ধান ভানো রে ভানো রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া ।ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া'―এইসব গান গেয়ে মেয়েরা ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ি করত । এ নিয়ে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে চলত প্রতিযোগিতাও । ঢেঁকির যে অংশে মেয়েরা পা দিয়ে চাপ দিত সেখানটায় ঢেঁকির নিচে একটা পিঁড়ি পেতে রাখা হত । পাড় দেওয়ার সময় ঢেঁকিটা পিঁড়িতে লাগলে জোরালো শব্দ হত । এতে করে তারা পাড়াময় জানান দিত যে তারা ঢেঁকিতে চাল কুটছে । আজকের প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি শুধু গল্পকথা । সকাল হতেই গ্রামের প্রতি ঘরে শুরু হয়ে যেত পিঠে বানানো । বাড়ির মেয়েরা চালের গুঁড়ির সঙ্গে নানা উপাদান মিশিয়ে তৈরি করত নানারকমের উপাদেয় পিঠে । ভাঁপা পিঠে, চিতই পিঠে, মালপোয়া, পাটিসাপটা, পুলি, ঝালপিঠে এবং পায়েস ইত্যাদি । পিঠে সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু করার জন্যে ব্যবহার করা হত গোবিন্দভোগ বা খাসার চাল । তার মধ্যে কালিখাসা বা তিলককচুরির চাল সর্বোত্তম । ধনেপাতা বাটা, পুদিনাপাতা বাটা, সর্ষে বাটা অথবা সিদলের ঝাল ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠে মুখে দিলে ঝালের চোটে কান গরম হয়ে গা থেকে শীত ছেড়ে যেত । আজকের দিনের তরুণ-তরুণীরা মোমো, বার্গার, পিজা,পকোড়া ইত্যাদির মধ্যে কসমোপলিটন খাবারের স্বাদ পায় ঠিকই কিন্তু পিঠে, পায়েসের মিস্টি গন্ধযুক্ত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় । আজকের দিনে মা-বোনেরাও তেমন আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে এতোসব পিঠেপুলি বানায়না ।
পৌষ এসেছে আর খেজুরের রস থাকবেনা, 'রাব' বা 'লালি' থাকবেনা তা কখনো হতনা । খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি এই সময়ের একটা স্বাভাবিক দৃশ্য । গ্রামদেশে সকাল হলেই খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানোর দৃশ্য চোখে পড়ে এইসময় । গাছিরা নিপুণভাবে গাছ কেটে এই রস সংগ্রহ করে । সারা রাত খেজুরের রস জমা হয় হাঁড়িতে । সন্ধ্যাবেলার রসকে বলা হয় 'সন্ধ্যারস' । এই রসের স্বাদ অপূর্ব । সারারাত টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে এই রস ,হাঁড়িতে জমা হয় । মেয়েরা এই রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে পিঠের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে । রসসংগ্রাহক সকালবেলা গ্রামে বেরিয়ে যেত রস বিক্রির জন্যে । খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তা থেকে 'রাব' বা 'লালি' এবং 'তক্তিগুড়' অর্থাৎ নলেনগুড় তৈরি হয় । আজ আর পৌষমাসে গ্রামেগঞ্জে খেজুরের রসের সেই রমরমা ও তাকে নিয়ে অর্থনীতি ও কর্মব্যস্ততা দেখাই যায়না । খেজুরগাছও তেমন নেই আর নেই কুশলী গাছ কাটার লোক । যার ফলে আজকের প্রজন্ম সুস্বাদু এই পানীয় এবং তার উপজাত দ্রব্যের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত ।
পৌষের সকালে ঘুম থেকে উঠে খড়কুটো, নাড়া, লতাপাতা, লাকড়ি জ্বালিয়ে উঠোনে গোল হয়ে বসে আগুন পোহানো বা নিজেদের শরীর গরম করার ফাঁকে ফাঁকে প্রভাতী আড্ডা চলত পৌষের ভোরে । আর আজকের দিনে সেই অলস সময়যাপনের ক্ষণটি কোথায় ? ভোর হতেই ছেলেমেয়েরা পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে ছুটছে মাস্টারবাড়ি । আর একদল ছুটছে স্কুলবাস ধরতে প্রভাতী বিদ্যালয়ে যাবার জন্যে । ব্যস্ততম জীবনে ক্যারিয়ারের পেছনে দৌড়ুতে হচ্ছে এই প্রজন্মকে । অথবা, লেপকম্বলের নিচে হালকা ওমের মধ্যে অলস সকালটা কাটানোর সৌভাগ্য নেই আর তাদের ।
পৌষ এলেই শুরু হয়ে যায় বনভোজনপর্ব । ধানকাটা ফাঁকা মাঠের মাটিতে উনুন তৈরি করে সেখানে চড়ুইভাতির আয়োজন । পৌষমাসের বনভোজন তাই নাম পোষলা । চড়ুইভাতি মানে চড়ুইপাখির মতো অল্প অল্প সংগ্রহের সম্মিলিত প্রয়াসে হত এই বনভোজন । প্রত্যেকের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, সব্জি, কারো পুকুরের মাছ, ঘরে পোষা হাঁস,মুরগি ইত্যাদি এনে করা হত এই বনভোজন বা চড়ূইভাতি । এই খাদ্যদ্রব্যসমূহ সংগ্রহ থেকে শুরু করে রান্নাবান্না ও ভোজন সমাধা পর্যন্ত শিশুকিশোরদের সে কী উন্মাদনা, সে কী আনন্দ তা আজকের দিনে পার্কে আয়োজিত ক্যাটারার পরিবেশিত পিকনিক তার ধারে কাছেও আসেনা ।
পৌষমাসে ছিল কিছু ধর্মীয়সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও । পৌষমাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনের উৎসবের জন্যে প্রস্তুতি চলে সারামাস । পৌষসংক্রান্তির ভোররাতে কোনো জলাশয়ের ধারে আগেরদিন তৈরি করা কুঁড়ে ঘরে আগুন দিয়ে আগুন পোহাত একসময় ছেলের দল । একে বলা হয় 'ভেড়ার ঘর' বা 'মেড়ার ঘর' পোড়ানো । ধানকাটা মাঠের নাড়া বা খড় দিয়ে আগের দিন এই ঘর বানানো , পোড়ানো আর আগুন পোহানোর সেই সম্মিলিত উন্মাদনা এখন আর নেই । মা-বাবারাও এখন আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের শীতের রাতে এজাতীয় অ্যাক্টিভিটিতে ছেড়ে দেননা ।
সংক্রান্তির দিন প্রতি ঘরে তৈরি হত নানারকমের পিঠেপুলি ও খাবার । ভোরবেলা স্নানাদি সেরে সূর্যকে পিঠে নিবেদন করার পর চলত নিজেদের খাওয়া দাওয়ার পালা । এখনো সেই অনুষ্ঠান কোনো কোনো পরিবারে পালিত হলেও নমো নমো করে সারা হয় ।আগেকার সেই এলাহি কান্ডকারখানা আর দেখা যায়না এখন আর । পৌষসংক্রান্তির দিন কীর্তনের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীর্তন করে ফল-বাতাসা -কদমা-তিলাইর লুট দিত গৃহস্থের উঠোনে । কিঞ্চিৎ নিজেদের ভান্ডে নিয়ে নিত কীর্তনের দল । সন্ধ্যার সময় বিশেষ কোনো দৈবী গাছতলায় মিলিত হয়ে কীর্তনের শেষে সংগৃহীত দ্রব্যগুলো প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হত । আজকাল আর সেই কীর্তন দেখা যায়না ।
আর একটি বিরল অনুষ্ঠান করা হত পৌষসংক্রান্তির দিন । গৃহস্থের উঠোনে যে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি দিয়ে গোরু বেঁধে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ধান মাড়াইর কাজ করা হত তাকে বলা হয় 'মেহির পালা/খুঁটা' বা 'মেইর পালা/খুঁটা' । এই খুঁটির চারপাশ লেপে পুঁছে তাকে কেন্দ্র করে আঁকা হত আলপনা । ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে খুঁটির সামনে রাখা হত সারা মরসুমে ব্যবহার করা কৃষিযন্ত্রপাতিসমূহ । এই খুঁটি পুজোর পর তাকে তুলে ফেলা হত । পরবর্তী বছরের জন্যে । গোলায় তোলা হত সংগৃহীত শুকনো ধান । আজ আর তেমন গৃহস্থও নেই । সেই অনুষ্ঠানও আর ,তে দেখা যায়না । 'মেহির পালা বা খুঁটি আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা শব্দ । এখন ধান মাড়াই হয় ট্রাক্টর দিয়ে কিংবা অটোরিক্সাকে উঠোনে বিছানো ধানের উপর চালিয়ে দিয়ে অথবা ধানমাড়াই মেশিনের সাহায্যে । গোরু দিয়ে ধান মাড়ানো আজ ইতিহাস ।
এখনও বছর ঘুরে পৌষ আসে পৌষ যায় । পৌষের মাসব্যাপী জৌলুস এখন আর নেই । ধান্যলক্ষ্মী আজ গৃহস্থঘর থেকে বেরিয়ে কর্পোরেট ধনতেরাসে আশ্রয় নিয়েছে । প্রয়াত সংগীতশিল্পী মান্না দে-র কন্ঠের একটি গানে সে আক্ষেপ আজ ভেসে বেড়ায়―
'পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেইদিন
ফিরে আর আসবেনা কখনো
খুশি আর লজ্জার মাঝামাঝি সেই হাসি
তুমি আর হাসবে কী কখনো.....'