সন্মাত্রানন্দ আমার প্রিয় কথাকার৷ তাঁর কথাভুবন আমাকে প্রবল আকর্ষণ করে ৷ তাঁর জ্ঞানের গভীরতা যে কোন অনুসন্ধিৎসুর ঈর্ষা জাগাায় ৷ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যেও থাকে জ্ঞান ও মননের ছাপ ৷ কদিন আগে তরুণ প্রকাশক তীর্থংকর দাশ আমাকে পড়ার জন্যে দিয়েছেন সন্মাত্রানন্দের ' ধীরে বহে বেত্রবতী ' গল্প সংকলন গ্রন্থটি ৷ এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই তিনি রেখেছেন তাঁর প্রজ্ঞার স্বাক্ষর ৷এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে যেমন রয়েছে রহস্যময় বয়ন শৈলী, তেমনি গভীর জীবনভাবনা ও দর্শনবীক্ষণ ৷মানবিকতার জন্যেও উচ্চকিত গল্পকার ৷
প্রথমটায় একটু রহস্যগন্ধী বয়ন শুরু করলেও গল্পের আঁচল ছাড়িয়ে যখন মননভূমির দিকে এগিয়েছেন, এক মায়াবি লোকঘ্রাণময় ভাষাশৈলী যেন ছড়িয়ে রয়েছে প্রথম গল্প 'উত্তরা বোষ্টমির কড়চা'তে ৷ প্রেমের টানে ঘরছাড়া উত্তরার কুসুমাকরের সঙ্গে নিবিড় প্রণয়সম্পর্ক,সমাজপ্রতিক্রিয়া ও চরিত্রকে মেলে ধরে এক ধ্রুপদী প্রেমের আখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
'নিঝুমঘর' নামের মধ্যেই লুকিয়ে যেন এক অশরীরী রহস্যময়তা ৷গল্পের বুননের মুন্সিয়ানায় পাঠক পৌঁছে যান অধিজাগতিক এক পরিবেশের মধ্যে ৷ ছোট্ট দুটি উপকরণ মশা তাড়ানোর ধূপ আর টিপয়ের উপর সাপের নকশা গল্প কথকের জীবনের দুই ঘটনাকে জুড়ে ভৌতিক জাল সৃষ্টি করে গল্পে ৷
একটা সম্পর্কের টানাপোড়োনোর গল্প 'জে' ৷ দাম্পত্যজীবন থেকে বঞ্চিত দুজন ৷ ভাসুর ও ভাদ্রবৌ ৷ দিগন্ত আর অনমিতা ৷ সমাজের শ্যেনদৃষ্টি আর তীর্যক সন্দেহপ্রবণতা একটা বাধা হয়ে তাদের মনের অভ্যন্তরের কোন নিভৃত অভীপ্সাকে রূপ দিতে ৷ দিগন্ত সিদ্ধান্ত নেয় স্থায়ীভাবে পন্ডিচেরি চলে যাবার৷ এই অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানায় বাবাই ৷ 'জে'কে যেতে দিতে চায় না সে ৷ আর এখান থেকেই শুরু হয় গল্পের নতুন অভিমুখ ৷মানবসম্পর্কের অনন্য উন্মোচন ৷ কমপিউটার গেমসের অনুষঙ্গ এনে বাবাইর মানসঝড়ে বিস্ফোরণের এক নন্দন এনেছেন গল্পকার এখানে ৷ সব পারিপার্শ্বিক নেতিকে জয় করার অর্জনে প্রাণিত হয়েছে সে ৷
অপরাধবোধ থেকে সৃষ্ট মানসপ্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ' মাঝরাতের সেই ফোনকল' গল্পটি ৷ আইন পেশায় যাঁর পশার জমিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের বেআইনি জ্ঞানার্জনের বৃত্তান্তকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরেছেন 'সরগরম পেশা' গল্পে ৷ প্রচলিত উচ্চশিক্ষার প্রতি শ্লেষাত্মক ইঙ্গিত ৷' ভ্রষ্টাচারী ইঁদুর' গল্পে ইঁদুরের প্রতীকে ভ্রষ্ট মানবচরিত্রেরই উদ্ঘাটন করেছেন রম্য বর্ণনায় ৷ 'পাঁচজন মানুষ' গল্পে সমাজেরই পাঁচজন মানুষকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, যাঁদের জীবনধারা থেকে উন্মোচন করেছেন সহজিয়া যাপনকথার ৷
'মৃৎপাত্রজাতক' এক গভীর দর্শনের কথা বলে ৷ 'একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর' কিংবা 'মাটির এই পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রই' অথবা 'মানব দেহ মাটির ভান্ড' ইত্যাদি অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে মানবশরীর ও মানবজীবনের যে নশ্বর উপমা তুলে ধরেন লোককবিরা তার ভেতর সৃষ্টি ও লয়ের যো বার্তা রয়ে গেছে সেটাকে মৃৎপাত্রের আত্মকথনে তুলে ধরেছেন গল্পকার ৷ সিদ্ধার্থের প্রসঙ্গ এনে আসলে দেহভান্ড মাটিতে মিশে যাওয়ার সহজিয়া সাধনকথাকেই তুলে ধরেছেন ৷
'ধীরে বহে বেত্রবতী' ভারতপুরাণকথার বিনির্মান ৷ শুধু বিনির্মানই নয় ৷ গল্পের মাধ্যমে লোকচরিত্র উদ্ঘাটনের প্রয়াসও শিল্পিত হয়েছে ৷ বিষ দুক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল ৷ দানের অহংকারে সৃষ্টি হয় আত্মবিষ বা অস্মিতা ৷ আর খললোকের বিষও বিমোচিত হয় না সাধুসান্নিধ্যেও ৷ প্রভু কিংবা সখার ক্ষতিসাধনে এ বিষ সর্বনাশা শুধু নির্মোহ প্রেমানুভবই পারে সব বিষ নিংড়ে জীবনের গতি সচল রাখতে ৷ অসাধারণ প্রতীকী নির্মান এ গল্প ৷ জীবনের জন্যে জাগেন সন্মাত্রানন্দ ৷
............................................
ধীরে বহে বেত্রবতী/সন্মাত্রানন্দ
মূল্য: ১৪০ টাকা
প্রচ্ছদ: Charu Pintu
নীহারিকা পাবলিশার্স
Monday, February 6, 2017
ধীরে বহে বেত্রবতী
ম্যান্ডেলার সন্ততি
মৃণালকান্তি দেবনাথ এই সময়ের শক্তিমান কবি ৷ তুলসী পাবলিশিং হাউস থেকে সদ্য বেরুলো তাঁর প্রথম কবিতার বই ম্যান্ডেলের সন্ততি ৷ এই প্রজন্মের এই কবির কাব্যভাষায় যেমন সময়ের ছাপ রয়েছে তেমনি বাংলাকাব্যের দীর্ঘপরিক্রমণের মানচিত্রটিও উঠে এসেছে নির্মানে ৷ 'ডোমনির ঘরফেরত পুরুষ হৃদয় জানে/ললিতা-বিশাখা ছিল ৷ ষোলশত গোপিনীও সত্য/ব্যালেন্স রাখতে পারলে সংসার সমৃদ্ধ হয় '৷ ( কৃষ্ণকথা) কিংবা 'নিমাই সন্ন্যাসেতে চলে গেলে/দল বেঁধে হা-হুতাশ, কান্নাকাটি হল খুব/ ফুল ফোটার সময়ে ফুলস্টপ দিয়ে রাতি পোহাইল' (ভোরবেলার কবিতা) অথবা 'সব অঙ্কে ভাগফল শূন্য জেনেও যাপনে চেয়েছি শান্তি/আর একবার লিখে যাই এই সত্য, আমি ছিলাম গোপীচন্দ্র/ আমি মৃণালকান্তি ৷(গোপীচন্দ্রের গান) এই রূপকাত্মক ভাষ্যেই অনুভব হয় কবির চলন বাংলাকাব্যের আব্রহ্মস্তম্ভপর্যন্ত ৷ আর সমুদ্যতসত্যের কাছেও কবি স্বচ্ছ ৷তিনি মূল্যায়ন করেন তাঁর যাপনের দ্বন্দ্বও ৷'যে সব আন্দোলনে নাম লিখিয়ে/মিছিলের সামনে হেঁটে একদা/যা কিছু নিপাত যাবার জন্যে/গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিয়েছি/ সে সব আসলে ছিল আমার নিজের বিরুদ্ধেই' ( শিরোনামহীন) ৷এতো সব ভুল গমন নয়, কবি কবিতাকে নিয়ে সংসার পাততে চান ৷ 'তুমি যদি রেখে থাকো নির্ধারিত টব/আমিকিন্তু হতে পারি মাথুর- যুবক!/ছেঁড়া জিন্স যুবকেরা অনুরাগী জানি, /তবু তোমাকে নিয়ে লিখেছি পাগলামি (বাস্তবিক) ৷ প্রচ্ছদেও সম্ভবত কবির হার্দ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাঙ্কযুবকের ছেঁড়া জিন্স