Monday, July 1, 2019

গ র্জ ন

রাজ্য জুড়ে হাহাকার চলছে ৷ খরায় পুড়ছে সারাটা রাজ্য ৷ গত একবছরে মাঠ ঘাট শুকিয়ে ফুটিফাটা ৷ বৃষ্টি হয়নি বহুদিন ৷ খাল-বিল শুকিয়ে গেছে ৷ পুকুর জলাশয়ে জল নেই ৷ নদীর বুকে পড়ে গেছে ধু ধু বালির চর ৷ খেতে ফসলও হয়নি একবছর ৷ রাজার খাজনা দিয়ে যা কিছু ছিটে ফোঁটা সঞ্চয় ছিল তা নিয়ে আধপেটা খেয়ে কেউ কেউ শীর্ণ শরীর নিয়ে রোগে শোকে কাবু রাজ্যের মানুষ ৷ রাজার বাড়িতে খাবার চাইতে গিয়ে তোপের মুখে উড়ে গেছে বহু লোক ৷ ভয়ে মুখ না খুললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে মানুষ ৷

রাজা মারা গেছে অল্প কদিন হল ৷ শ্রাদ্ধশান্তির পর যুবরাজ আবার আপন মূর্তিতে ফিরে এসেছে ৷ ইয়ার বন্ধু নিয়ে বসছে সুরা আর সাকির মৌতাত ৷ লখনৌর দশহাজারি তিজন বাঈ এসেছে ৷ কদিন ধরে বসেছে মেহফিল ৷ ঘুঙুরের শব্দে নাচমহল গমগম করছে ৷ বাইরে খরার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে গভীর রাতে ৷ উড়ছে টাকা ৷ সুরার ফোয়ারা ছুটছে ৷ মেহফিল শেষে নাচমহলেই ঘুমিয়ে পড়েছে তিজন বাঈয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে  কুসুমকুমার ৷
    
রাজকুমারের মর্জি ৷ ভোরবেলাই আচমকা ডেকে তুলল তিজনবাঈকে ৷ তিজন ৷ তিজন ৷ ওঠো ৷ উঠে পড়ো প্রিয়ে ৷ তোমাকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরুব ৷ ঘোড়াশাল থেকে আমার প্রিয় সাদা ঘোড়া দমদমকে বের করে সাজাতে বলেছি ৷ তুমিও তৈরি হয়ে নাও ৷ সাদা চোলি ঘাগরা পরবে কিন্তু ৷ তিজনবাঈ চোখ কচলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ৷ তুমি তৈরি হয়ে নাও ৷ আমি পাশের কোঠায় আছি ৷

সাদা ঘোড়া দমদম ছুটছে সামনের দিকে ৷ পিঠে তার রাজকুমার আর অচিন রাজকুমারী ৷ রাজবাড়ির সীমানা পেরিয়েই একটা খোলা প্রান্তর ৷ সামনে বন ৷ বনের ওপারের মাথা থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে তার রাঙা মুখ নিয়ে ৷
কুসুমকুমার  বনের ভেতর ঘোড়া চালিয়ে দিল ৷ পেছনে তিজনবাঈ ৷ লেপ্টে রয়েছে কুমারের গায় ৷ ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে তিজনের নরম শরীর চাপ দিচ্ছে কুসুমকুমারের পিঠে ৷ বনের একটা বাঁকে এসে ঝরনার ধারে ঘোড়া থামাল কুসুমকুমার ৷ ঘোড় থেকে নেমে দুহাত বাড়িয়ে তিজনকে প্রায় কোলে করে নামাল ৷
এখানে কেন আনলেন আমাকে? কিজন্যে ?
রাজকুমার হাসল ৷ —তোমাকে নিয়ে এই বনের ভেতর প্রাতঃভ্রমণ করব ৷ ঝরনার ধারে বসে তোমার গান শুনব ৷ এসো প্রিয়ে ৷

রাজকুমার তন্ময় হয়ে শুনছে তিজনের গান ৷ প্রকৃতির বুকে তার গান একটা আলাদা আমেজ তৈরি করেছে ৷

হঠাৎ দেখা গেল তাদের ঘিরে ধরেছে কঙ্কালসার একদল মানুষ ৷ ওদের হাতে বুনো গাছের শক্ত ডাল ৷ কারো হাতে ঝরনার পাড়ের বড়ো বড়ো নুড়ি ৷ ওরা চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে ৷ —কে ? কে তোমরা?  রাজকুমার হাঁক পাড়ে ৷
আমরা আপনার  ক্ষুধার্ত প্রজা ৷
কি চাও তোমরা?
—আমরা প্রতিশোধ চাই ৷ প্রজাহত্যার প্রতিশোধ ৷ সারা রাজ্যে খাদ্য পানীয়ের হাহাকার ৷ আর আপনি আনন্দ, উৎসবে মেতে আছেন ৷ রাজকোষ শূন্য করছেন ৷ এই ঝরনাতেই সামান্য জল আছে ৷ এ নিয়ে আমরা কোনোরকমে বেঁচে আপনি এখানেও এসেছেন ফুর্তি করতে?  আপনাকে আমরা কিছুতেউ ছাড়ছিনা ৷
  সংঘবদ্ধ মানুষগুলো খুব কাছে চলে এসেছে ৷ তিজনবাঈ ভয়ে রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে ৷ থরথর করে কাঁপছে সে ৷

   দূরে রাজবাড়ির দিক থেকে তুমুল কোলাহল ভেসে আসতে লাগল ৷ আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে আকাশে ৷ এখানেও যেন কালো ধোঁয়ায় ঘিরে ধরেছে দুজনকে ৷ একটা বিশাল সমুদ্রের গর্জন আছড়ে পড়ছে ওদের শরীরে ৷

গ র্জ ন

রাজ্য জুড়ে হাহাকার চলছে ৷ খরায় পুড়ছে সারাটা রাজ্য ৷ গত একবছরে মাঠ ঘাট শুকিয়ে ফুটিফাটা ৷ বৃষ্টি হয়নি বহুদিন ৷ খাল-বিল শুকিয়ে গেছে ৷ পুকুর জলাশয়ে জল নেই ৷ নদীর বুকে পড়ে গেছে ধু ধু বালির চর ৷ খেতে ফসলও হয়নি একবছর ৷ রাজার খাজনা দিয়ে যা কিছু ছিটে ফোঁটা সঞ্চয় ছিল তা নিয়ে আধপেটা খেয়ে কেউ কেউ শীর্ণ শরীর নিয়ে রোগে শোকে কাবু রাজ্যের মানুষ ৷ রাজার বাড়িতে খাবার চাইতে গিয়ে তোপের মুখে উড়ে গেছে বহু লোক ৷ ভয়ে মুখ না খুললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে মানুষ ৷

রাজা মারা গেছে অল্প কদিন হল ৷ শ্রাদ্ধশান্তির পর যুবরাজ আবার আপন মূর্তিতে ফিরে এসেছে ৷ ইয়ার বন্ধু নিয়ে বসছে সুরা আর সাকির মৌতাত ৷ লখনৌর দশহাজারি তিজন বাঈ এসেছে ৷ কদিন ধরে বসেছে মেহফিল ৷ ঘুঙুরের শব্দে নাচমহল গমগম করছে ৷ বাইরে খরার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে গভীর রাতে ৷ উড়ছে টাকা ৷ সুরার ফোয়ারা ছুটছে ৷ মেহফিল শেষে নাচমহলেই ঘুমিয়ে পড়েছে তিজন বাঈয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে  কুসুমকুমার ৷
    
রাজকুমারের মর্জি ৷ ভোরবেলাই আচমকা ডেকে তুলল তিজনবাঈকে ৷ তিজন ৷ তিজন ৷ ওঠো ৷ উঠে পড়ো প্রিয়ে ৷ তোমাকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরুব ৷ ঘোড়াশাল থেকে আমার প্রিয় সাদা ঘোড়া দমদমকে বের করে সাজাতে বলেছি ৷ তুমিও তৈরি হয়ে নাও ৷ সাদা চোলি ঘাগরা পরবে কিন্তু ৷ তিজনবাঈ চোখ কচলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ৷ তুমি তৈরি হয়ে নাও ৷ আমি পাশের কোঠায় আছি ৷

সাদা ঘোড়া দমদম ছুটছে সামনের দিকে ৷ পিঠে তার রাজকুমার আর অচিন রাজকুমারী ৷ রাজবাড়ির সীমানা পেরিয়েই একটা খোলা প্রান্তর ৷ সামনে বন ৷ বনের ওপারের মাথা থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে তার রাঙা মুখ নিয়ে ৷
কুসুমকুমার  বনের ভেতর ঘোড়া চালিয়ে দিল ৷ পেছনে তিজনবাঈ ৷ লেপ্টে রয়েছে কুমারের গায় ৷ ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে তিজনের নরম শরীর চাপ দিচ্ছে কুসুমকুমারের পিঠে ৷ বনের একটা বাঁকে এসে ঝরনার ধারে ঘোড়া থামাল কুসুমকুমার ৷ ঘোড় থেকে নেমে দুহাত বাড়িয়ে তিজনকে প্রায় কোলে করে নামাল ৷
এখানে কেন আনলেন আমাকে? কিজন্যে ?
রাজকুমার হাসল ৷ —তোমাকে নিয়ে এই বনের ভেতর প্রাতঃভ্রমণ করব ৷ ঝরনার ধারে বসে তোমার গান শুনব ৷ এসো প্রিয়ে ৷

রাজকুমার তন্ময় হয়ে শুনছে তিজনের গান ৷ প্রকৃতির বুকে তার গান একটা আলাদা আমেজ তৈরি করেছে ৷

হঠাৎ দেখা গেল তাদের ঘিরে ধরেছে কঙ্কালসার একদল মানুষ ৷ ওদের হাতে বুনো গাছের শক্ত ডাল ৷ কারো হাতে ঝরনার পাড়ের বড়ো বড়ো নুড়ি ৷ ওরা চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে ৷ —কে ? কে তোমরা?  রাজকুমার হাঁক পাড়ে ৷
আমরা আপনার  ক্ষুধার্ত প্রজা ৷
কি চাও তোমরা?
—আমরা প্রতিশোধ চাই ৷ প্রজাহত্যার প্রতিশোধ ৷ সারা রাজ্যে খাদ্য পানীয়ের হাহাকার ৷ আর আপনি আনন্দ, উৎসবে মেতে আছেন ৷ রাজকোষ শূন্য করছেন ৷ এই ঝরনাতেই সামান্য জল আছে ৷ এ নিয়ে আমরা কোনোরকমে বেঁচে আপনি এখানেও এসেছেন ফুর্তি করতে?  আপনাকে আমরা কিছুতেউ ছাড়ছিনা ৷
  সংঘবদ্ধ মানুষগুলো খুব কাছে চলে এসেছে ৷ তিজনবাঈ ভয়ে রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে ৷ থরথর করে কাঁপছে সে ৷

   দূরে রাজবাড়ির দিক থেকে তুমুল কোলাহল ভেসে আসতে লাগল ৷ আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে আকাশে ৷ এখানেও যেন কালো ধোঁয়ায় ঘিরে ধরেছে দুজনকে ৷ একটা বিশাল সমুদ্রের গর্জন আছড়ে পড়ছে ওদের শরীরে ৷

ঝ ড়

ঝড়

মার কাছে জবাবদিহি করতে করতে জেরবার ৷ একটা ভয়ংকর অপরাধ বোধহয় সে করে ফেলেছে ৷ সংসারটা শুরু না করতেই যেন বজ্রাঘাত ৷ আত্মজনও এতো পাষন্ড হয়?  তার আশ্রয়ের জায়গাটা কোথায়?  নিরাপত্তা কী আছে?
বল বল কে করেছে তোর এ দশা?  আজ তার উপর মারধরও করা হয়েছে ৷ মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনে মনোবল ভেঙে গেছে ৷ বলা যায় কী এ পাপের কথা!
কদিন ধরেই ক্রমশ বিষন্নতা গ্রাস করছিল তাকে ৷ ঘরের থেকে বের হতনা বিশেষ একটা ৷ হলেই সবার চোখ পড়ত তার দিকে ৷ আর কটু কথার বান ডাকত ৷ আর মা সময় করে অনবরত জেরা করত ৷ সে নিরুত্তর থাকত ৷
আর সহ্য হয়না ৷ নিজের চারদিকে একটা ঘোর অন্ধকারের বলয় তৈরি ৷ হাত-পা ছুঁড়ে সে চায় বলয়টা ভাঙতে ৷ পারেনা ৷ পেট মোচড় দিয়ে বমির দলা উঠে আসে ৷ বমির শব্দ হলে মার খিস্তি বেড়ে যায় ৷
ঘরের এমাথা থেকে সেমাথা একগাছা নাইলন দড়ি টানা বাঁধা ৷ টুকটাক কাপড়চোপড় ঝুলিয়ে রাখার জন্য ৷ ধীরে ধীরে উঠে দড়িটা খুলে একমাথা আবার সিলিং ফ্যানের ফাঁস দিয়ে লাগাল ৷ পড়ার টুলটাকে এনে ঝোলানো দড়ির নিচে  রাখল ৷ তারপর উঠে দাঁডাল টুলটার উপর ৷ দড়িটাকে টেনে গলা সমান মেপে একটা মালার মতো করে একটা গিঁট দিয়ে গলায় পরে নিল ৷ বাড়িতে ঠাকুরের ফটোটাতে প্রায়ই মালা পরাত ৷ নিজে কখনো গলায় মালা পরেনি ৷ মালার মতো দড়ির বৃত্তে একটা নিষ্পাপ শিশুর মুখ ভেসে ওঠে ৷ অনেকটা ফটোর নাড়ুগোপালের মতো ৷ কিন্তু ভীষণ সন্ত্রস্ত সে মুখ ৷ তার পেছনে জল্লাদের মতো খাঁড়া নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এক ভয়ংকর মূর্তি ৷  যেন এক্ষণই শিশুটার গায়ে কোপ বসাবে ৷ মুখটা হুবহু তার বাবার মতো ৷
শিশুটিকে রক্ষা করার জন্যে সে হুঙ্কার দিয়ে সামনে ঝাঁপ দিল ৷ পায়ের ধাক্কা লেগে টুলটা কাত হয়ে পড়ে গেল ৷ তার সামনে একটা প্রচন্ড ঝড়ের রাতের দৃশ্য জেগে উঠছে ৷ ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও ৷

Friday, June 21, 2019

কেন চেয়ে আছো গো মা

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তর ৷ সে কী স্বপ্ন দেখ ছিল ! স্বপ্ন কী এতো স্পষ্ট হয় ৷ বয়স্কা এক আদিবাসী মহিলা যেন  ৷ যাকে বলে লোলচর্ম ৷ ঠিক ততোটা না হলেও সারামুখে স্পষ্ট বলিরেখায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ৷ হলে কী হবে কালো চাদরে প্রায় আধেকঢাকা শরীর দেখে বোঝা যায় এখনও ভেঙে পড়েনি একসময়ের কর্মজীবী দেহ ৷ একদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মুখে এক ঐশ্বরিক হাসি ৷ কোনোদিন একে দেখেছে বলেও মনে হয়না ৷ এমনিতে এটা পার্বত্য এলাকা ৷ ছোটো ছোটো টিলার উপরে ছড়ানো ছিটানো সব টংঘর ৷ কাল বিকেলে এখানে এসেই কাছাকাছি একটু ঘুরে দেখেছে ৷ রাত্তিরের আশ্রয়টা নিয়েছে এই ফরেস্ট বাংলোতে ৷ কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কিছু কিছু তথ্য ৷ ত্রিপুরি এবং মগ জনগোষ্ঠীর মানুষজন এখানে পাশাপাশি বাস করে ৷ ত্রিপুরিরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ৷ মগরা বৌদ্ধ ৷ তবে এই জায়গাটা সম্বন্ধে তার একটা পূর্ব ধারণা ছিল ৷  তার বাবাও সাতের দশকের শেষ দিকে  এখানকার রামরতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছেন ৷ আশি সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তাঁকে রাতারাতি এলাকা ছেড়ে আসতে হয় ৷ যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সে বাড়ির লোকেরাই রাতের অন্ধকারে বনের পথ ধরে আসাম-আগরতলা সড়কে উঠিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তিনি আর এগ্রামে আসেননি কোনোদিন ৷ মাঝেমাঝে তিনি গল্প করতেন ৷ এই জায়গার কথা ৷ এখানকার লোকজনের কথা ৷ পাহাড়ের উপরের প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরের কথা ৷ ভাবতে ভাবতে আর ঘুম এলোনা ৷ বাংলোর পাশের গাছগাছালিতে পাখিদের বৃন্দগান শুরু হয়েছে ৷ স্বপ্নটা দেখার পর আর ঘুম আসেনি ৷ উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে দূরে কুয়াশাঢাকা পাহাড়ের মাথায় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে লালচে আভা ছড়াচ্ছে ৷

মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বেরোনোর পরপরই চাকরিটা পেয়ে যায় ৷ পোস্টিংও এই তাকমপাড়াতেই ৷ কদিন আগেই বাবা চলে গেছেন ৷ ক্যান্সারটা থার্ড স্টেজে ধরা পড়ে ৷ দীপ্তদের আর কিছু করার তেমন সুযোগ ছিলনা ৷ মা কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন ৷ ছেলেকে কাছে কোথাও পোস্টিং হয় কিনা চেষ্টা করতে বললেন ৷ কিন্তু দীপ্ত জানে সরকারি সুযোগ নিয়ে এমডি করতে গেলে অন্তত তিনবছর গ্রামীন এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৷ তাই সে মাকে রাজি করিয়ে এখানে পোস্টিং নেয় ৷ ধীরে ধীরে এলাকায় একটা পরিচিতিও হয়ে যায় তার ৷ হৃদয়বান চিকিৎসক হিসেবেও ৷ গরীব ও বয়স্ক রোগীদের সঙ্গে মা-মাসি, কাকা-জেঠু বলে ডেকে অসুবিধার কথা জেনে নিত ৷ চিকিৎসা করত ৷

একদিন বিকেলের শিফটে আউটডোরে বসেছে অর্ক ৷ সারিতে রোগী তেমন নেই ৷ মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে বারো থেকে চোদ্দোজন হবে ৷ রোগি দেখতে দেখতে সে সারিবদ্ধ রোগিদের দিকে তাকাচ্ছিল ৷ পরিচিতির সুবাদে দুএকজনের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করাসহ কুশলও জেনে নিচ্ছিল ৷ সে লক্ষ করছিল একেবারে শেষের দিকের একজন বয়স্ক মহিলা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই রয়েছে ৷ আর হাসছে মিটিমিটি ৷ শেষসময় যখন সে এগিয়ে এল দীপ্তর মনে হল একে যেন সে কোথাও দেখেছে আগে ৷ কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা ৷ বুড়িকে জিজ্ঞেস করল , তামঅ অংখা নিনি আমা ৷ মা তোমার কী অইছে? ইতোমধ্যে স্থানীয় ভাষাও শিখে নিয়েছে সে ৷
—কী আর আর অইবো ৷ লুমজাক ৷ জ্বর হইছে ৷
দীপ্র গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুড়ির প্রচন্ড জ্বর ৷ এটা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা ৷ কনফার্ম না হয়ে চিকিৎসা করা ঠিক হবেনা ৷ দুটো পাঁচশো এমজি প্যারাসিটামোল দিয়ে বলল, রাত্রে একটা খাইয়া লাইও খাইবার পরে ৷ জ্বর থাকলে সকালে আর একটা খাইবা  ৷ সকালে এখানে আইয়া রক্ত পরীক্ষা কইরা যাবে ৷ তারপর দরকার অইলে অষুধ দিব ৷
বুড়ি যেন দীপ্রর কথা শুনছেইনা ৷ অপলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ৷ হাসিটি লেগে রয়েছে মুখে ৷
—কি অইছে বুঝছেনি?
—ইঁ ৷ সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় বুড়ি ৷ দাক্তর, তুই কী অসিত মাসতর পোলা নি?  আচমকা প্রশ্ন করে বসে বুড়ি ৷ দীপ্রও হতচকিত হয়ে যায় ৷ তার বাবার নাম কী করে জানল বুড়ি? 
দীপ্রও জবাব দেয়, হ ৷ তুমি আমার বাবার নাম কী কইরা জানলা?
—জানে জানে ৷ নিজের মানুর নাম জানতো লাগে ৷ আমার তো ভুল অইছেনা তাইলে ৷ তুমার বাবা ভালা আছেনি?
—না ৷ তাইনে তো মারা গেছে কয়েকমাস আগে ৷
অ..অ.. ৷ লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর দেখা হইলনা ৷ খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল বুড়ি ৷ দীপ্র লক্ষ্য করল যে হাসিমুখ নিয়ে সে এতোক্ষণ দীপ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল সেই মুখশ্রী যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ৷ চোখজোড়া ছলছল ৷ দুটো অশ্রুবিন্দু দুগাল বেয়ে নেমে আসছে ৷ বাইরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে ৷ সে আঁধার যেন জীবনের শেষবেলায় উত্তীর্ণ এই বয়স্ক মহিলার মুখটাকেও ঢেকে ফেলছে ৷
—হক্কলে আমারে থকাইলো ৷ হক্কলে ৷ বলতে বলতে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধা ৷ দীপ্র হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সেদিকে ৷
ডাকবাংলোর বারান্দায় একাকী বসে রয়েছে দীপ্র ৷ সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ৷ দূরে টিলার উপরে কিছু দূরে দূরে ক্ষীণ আলোর সারি ৷ ওগুলো পার্বত্যপল্লীর টংঘরগুলোর আলো ৷ কতো দূরে অথচ কত উজ্জ্বল ৷  আজ বিকেলের ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা বারবার তার মনে উঁকি দিচ্ছে ৷ ভাবছে কাল বুড়ি রক্তপরীক্ষা করতে এলে ভালো করে জেনে নেবে সব ৷ এরমধ্যেই কেয়ারটেকার কুসুমকুমার কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ৷
—স্যার আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?  বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
—না ৷ ওসব কিছুনা ৷ বসো ৷ বলছি ৷ বৃদ্ধার চেহারা বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি চেন এই মহিলাকে?  হ্যাঁ বাবু ৷ ওতো আমাদের তিরুপতি আমা ৷ ওই যে  আলো জ্বলছে দূরে ৷ রামরতন পাড়া ৷ ওখানেই থাকে ৷ তিনকুলে কেউ নেই তার ৷ বিয়েও করেনি ৷ গ্রামের মানুষই সাহায্য সহায়তা ৷ সামান্য লেখাপড়া জানে ৷ গ্রামে ট্যুইশানি করে যা পায় তা দিয়ে চালিয়ে নেয় ৷ শুনেছি দাঙ্গার সময় তাদের বাড়িতে এক মাস্টার থাকত ৷ সে তাকে পড়াত ৷ তাদের মধ্যে একটা ভাবও হয়েছিল ৷ কিন্তু সমাজ মেনে নিতে চাইছিলনা ৷ দাঙ্গার সময় একরাতে উগ্রপন্থীরা মাস্টারকে তুলে  নিয়ে যায় ৷ তারপর আর মাস্টারের খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷ তিরুপতি আমা আর বিয়ে থা করেনি ৷ চলুন আপনার খাবার দিই ৷
— হ্যাঁ, চলো ৷

মাঝরাতে আবার স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল ৷ সেই প্রথম রাতে দেখা সেই মুখ সেই পোষাক ৷ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ আজ মনে করতে পারল তিরুপতি আমাকে কেন চেনা চেনা লাগছিল ৷ সেই তো স্বপ্নে দেখা দ্য়েছিল সেদিন ৷ আজও আবার ৷ চমকে উঠল সে একই স্বপ্ন আবার দেখে ৷
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল ৷ রাত গভীর ৷ চারদিক সুনসান ৷ গাঢ় রাতের দরজা ভেঙে একটা করুণ পাহাড়ি বিলাপ রামরতনপাড়ার অন্ধকার আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে ৷

Wednesday, June 19, 2019

চরণ ধরিতে দিয়ো গো

   দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন  বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷

সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷

একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আননোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা  অনুকূলবাবু ৷

খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
   অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷

অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন?  মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷

অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়াল ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷

চরণ ধরিতে দিয়ো গো



   দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন  বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷

সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷

একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আমনোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা বললেন অনুকূলবাবু ৷

খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
   অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷

অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন?  মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷

অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়ালো ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷