অন্তর্বয়নের আলোকিত উদ্ভাস
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
কাঁটার খোঁচা শরীরের প্রত্যঙ্গে ব্যথার অনুভূতি জাগায় । তেমনি কাঁটাটা খুলে ফেলতে পারলে যন্ত্রণাটারও সমাপ্তি আসে । মনটা মুক্ত হয় অস্বস্তি থেকে । হ্যাঁ, তেমনি একটা অস্বস্তির কন্টক বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছি আর ফেরা অব্দি কাঁটাটা তার তীব্র প্রদাহে জানান দিচ্ছে খাঁচাটার ভেতর বসত করা অস্বস্তির অস্তিত্ব । তবে ঝেড়ে ফেলা যাক, এই আপাত বর্জ্য যন্ত্রণাটাকে । সদ্য সমাপ্ত ৫ম উত্তর-পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলন থেকে ফেরার পর প্রতিক্ষণে বৃদ্ধাতর্জনীমধ্যমা চঞ্চল হয়ে চাইছে ধারালো নিবের সান্নিধ্য । অন্তরীণ বোধের কাছে জবাবদিহি তো করা দরকার । সম্মেলন থেকে কোন অতিদূর রশ্মি আন্তরিকতায় আত্মসমর্পণ করল না শুধু, অধরাই রইল অরূপের মাধুরী ।
সাহিত্যকে সীমানা দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না । এ তো সূর্যের মতো সত্য । তাই তো সচেতন চেতনা থেকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ওঠে । সীমানাকে মানতে চান না কোন ধীমান । তার পরমাত্মা তো বিশ্ব মহাবিশ্ব সমস্তকেই অন্তর্লোকের একই সীমানার মধ্যে পেতে চায় । তবুও বসে যায় সীমানার নির্ধারক স্তম্ভ । তবে এই সীমানা সমাপ্তি নির্ধারক নয় । এ হল পথরেখার সংকেত মাত্র। পরবর্তী পথের প্রবেশের সিংদরোজার নির্দেশচিহ্ন । যে চিহ্নাতিচিহ্ন থেকে এক মহাদীর্ঘসূত্র রচনা হয়ে যাবে গ্রন্থিত মালিকার মতো । চৌকাঠ পেরিয়ে ফটক, ফটক পেরিয়ে মহাসড়ক। এভাবে অতিক্রমণই যে গতি । সাহিত্যের চলাচল । উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলনও সেই মহাজাগতিক পথেরই একটি একটি আলপথ মাত্র ।
তবুও কথা থাকে, কথা হয় । কি পেলাম আমরা এই অতিসাম্প্রতিক পরিভ্রমনে। নিজস্ব কড়চায় কি তুলেছি, ভূতত্ত্ববিদের নির্ধারিত সীমানার এই ভূখণ্ডের অন্তর্শরীর কতটুকু বৃষ্টিপাতে উর্বর হয়েছে । কতটা কাঁপন উঠেছে এই ভূমিভাগের চায়ের কচিপাতায়, গৈরিক কমলাবনে, সুসবুজ বাঁশ আর বেতের অরণ্যে, হরিৎ থেকে স্বর্ণিলবর্ণে রূপান্তরিত শস্যক্ষেত্রে । কি গান শোনায় এর ক্ষীণতোয়া ঝর্ণা থেকে শুরু করে কুলপ্লাবি শ্রোতঃস্বলা নদী ! কোন আমন্ত্রণলিপি অথবা প্রত্যাখ্যানপত্র রচনা করছে এখানের পাথরপ্রতিম দেহসুষমা আর মাখনকোমল অন্তঃকরণের অধিকারী মানুষ মানুষীরা ।
৮-১০ জানুয়ারি '৯৪, তিনদিনের উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলনের ৫ম বার্ষিকীকে একটি মাত্র রূপকল্পে অভিসঞ্চিত করা যায়, এ হল ঐশ্বর্যের মহামিলন । ঐশ্বর্য তার বোদ্ধার উপস্থিতিতে, ঐশ্বর্য তার অন্তর্কল্প, প্রস্তাবনার প্রকাশবৈদগ্ধ্যে, ঐশ্বর্য তার হার্দ্য সংবেদনশীলতায়, ঐশ্বর্য তার সম্মিলিত কন্ঠে উচ্চারিত সামগানে, আরও ঐশ্বর্য তার সৃষ্টিকর্মকে অনিরুদ্ধ রাখার ঐকান্তিক প্রতিজ্ঞাদৃঢ় উজ্জ্বল দৃষ্টিদ্যুতির স্বতোৎসারিত স্ফুরণে ।
তবুও বলা ভালো । সব ঐশ্বর্য সুখের নয় । যেমন দৃষ্টিনন্দন নয় সন্ন্যাসীর ভস্মাবলিপ্ত বাহুতে বদ্ধ স্বর্ণকবচ । কাঞ্চনের ঐশ্বর্য স্থলনই আনে । বণিককুল গোপন স্যাবোটাজে ধ্বংস করে শিল্পের নন্দনোদ্যান । ছিল কি এবার বিগত চার সম্মেলনের বনবিহারসুলভ বৈরাগ্যশোভন উন্মুক্ততা । বৃন্দাবনে মহারাসের উজ্জ্বলরসের মাহাত্ম্য কি জানে নগরগণিকা ? এ সৌখিন মজদুরি ভালো কি মন্দ বিচার করুন, যাঁরা এই সম্মেলনসমূহের সৃষ্টি থেকে নিজেকে নিঃশেষ করে চলেছেন । এমনকি কথা ছিল প্রথম দিন ? যে দীর্ঘ দেহী আন্তরঅভ্যর্থনায়পূর্ণ বন্ধুটি নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে গেছেন সম্মেলনের আসমাপ্তিকাল তার কেন কবিতা পড়ার সুযোগ হলো না ? কেন রবীন্দ্রভবনের বাইরে আলোতেই নিজেকে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস নিয়েছেন তিনি । মনে হয় কারা যেন দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তালিকাশোভন অলংকারই হয়েছিলেন শুধু ।
এবার তবে শুরু হোক ক্ষেত্রকর্ম । তিন দিনের সম্মেলনে যে সমস্ত আলোচ্য বিষয় বারবার উচ্চকিত হয়েছে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উৎস মুখে ফিরে যাওয়ার যে আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে, যে বিদগ্ধ বিদ্বৎমন্ডলী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক এ অঞ্চলের মৃত্তিকা সংলগ্ন সমস্যাসমূহ পরিস্থিতি সাহিত্য শিল্পকর্মের কালানুক্রমিক গতিপ্রকৃতি পারস্পরিক সম্পর্কে একাত্মীকরণ প্রয়াস ইত্যাদি বিষয়ে যে জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতা লব্ধ দিকনির্দেশ দিয়েছেন তা ছড়িয়ে দেওয়া হোক পুষ্প বৃষ্টির মত এ অঞ্চলের প্রতিটি তৃণাগ্রশিখরে । আরও আরও সুদৃঢ়বন্ধনে বেষ্টিত হোক সকলের হৃদয়পল্লব । বিচ্ছিন্নতার কূটকীটের বিরুদ্ধে আরম্ভ হোক তীব্র জীবননাশক সিঞ্চনের ন্যায় আন্তরিক ধারাবর্ষণ ।
আর ভাবা যাক কি অপূর্ণতা রেখে এসেছি আমরা অতিক্রান্ত সোপান নির্মাণে । ছিল কি লোকউপাদানের প্রতি আমাদের আন্তরিক টান ? হয়তোবা মনের ভুলে সহস্র কর্মের প্রবাহে অনুক্তূ রয়ে গেছে লোকশিল্প লোকসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনার অবতারণার নির্ধারিত ব্যবস্থা । তাই হয়তো এ অঞ্চলের প্রখ্যাত লোক গবেষককে দেখেছি ভবন চত্বরে অপান্তেও পদচারণায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখতে । অথচ বক্তাআলোচক প্রত্যেকেই এই মৃত্তিকাগন্ধী আঙ্গিক এর প্রতি হার্দ্য অনুভব জানিয়েছেন আলাপচারিতায় ।
স্মরণ করা যাক, কবিতা পাঠের মর্যাদা কতটা রক্ষিত হয়েছে । কৌলিন্যরক্ষার্থে অশিতিপর বৃদ্ধের কাছে অনুঢ়াদানের মতো দায়সারা আয়োজন কাব্যপাঠের । বাইরে সংগীতানুষ্ঠানমুখর মুক্তমঞ্চের তান্ডবের বিপরীতে প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে শ্রোতাহীন, পাঠকহীন মঞ্চে সভাপতিমন্ডলীর অস্বস্তি, ভাঙা বাজারের ধূসরিত হওয়া বড় বেশি করে বিদ্রুপাত্মক করে তুলেছিল এই পর্যায়কে । একদিকে স্কুলপালানো ছেলের মত বারবার নাম রাখার পরও অনুপস্থিত সব প্রতিভাধর কবিরা অন্যদিকে ভিতরে প্রবেশ না করে স্বতোৎসারিত ক্ষোভে ভ্রাম্যমান অতি তরুণ প্রতিভাবান কবিরা । তারই মধ্যে বিদ্যুৎস্ফুরণের মতো অনর্গল কাব্যবোধে মহাবিশ্ব স্বভাবকবি, সংগীত ময়তায় তন্ময় গায়ককবি, শায়েরী স্রষ্টা কবি আর উটকো ঝামেলার বেড়া ডিঙিয়ে ক্ষেতে ঢুকে পড়া শব্দদূষণের কবির চিৎকার রসপিপাসুকে রস দিয়েছেই । তবুও কবিতার প্রতি যা কিছু প্রস্ফুট অনীহা যত অতলান্তই হোক ডুব দিয়ে খোঁজা দরকার ।
সুখ, তার সবটাই যদি সুখের হয় তাহলেও সুখ নেই । বেদনার দংশন না থাকলে অনুভব হয় না প্রেমার্তি । তাই বোধহয় কিছু কিছু যন্ত্রণাদগ্ধ মুহূর্ত আরো বেশি মুগ্ধকর করে তুলেছে এর অঙ্গসজ্জা । আর বেদনা না জাগিয়ে ইচ্ছে হয় সম্পাদনা করি আগামী পরিশুদ্ধ পরিক্রমার নির্দেশ পঞ্জিকা হিসেবে এক ইপ্সিত ইশতেহার :
অ ) আমরা আমাদের ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধ । আমাদের লোকজ উপাদান আমাদের কম্পাস । লৌকিক সম্মান আমরা দেবই ।
আ) কবিতার জন্য আমরা নিভৃত সাধনপীঠ গড়ে যাবই । ঋষিপ্রতিম মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করব আমাদের আগামী কবিতা ।
ই ) পির ফকির আর বাউলের মননশীল আন্তরিকতা থাকবে আমাদের যাপনে । আলোকিত মুদ্রাক্ষয়ী ঐশ্বর্য আমরা চাই না ।
ঈ ) সম্মিলিত দীর্ঘপদযাত্রায় সমতলীয় কৃষকের খামার থেকে পর্বতোচ্চ জুমের টঙঘর পর্যন্ত সর্ববিস্তৃত নম্র আত্মীয়তা আমরা গড়বই ।
উ ) কেন্দ্র থেকে বিচ্ছরিত আলোকণার মতো আমরা একে অন্যে, অন্যে সকলে, বৃত্তের পরিধিকে বাড়াতে আন্তর প্রচেষ্ট হব । ফাঁক এবং ফাঁকি দুইই অচ্ছুত থাকবে ।
( পঞ্চম উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলন প্রসঙ্গে : দৈনিক সংবাদ ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৪ প্রকাশিত । )