আমলিঘাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিংবদন্তী ও ইতিহাস
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আনুমানিক ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ শিক পরগনার কৈয়রা গ্রামে শমসের গাজীর জন্ম হয় । ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরারাজ্যের রাজধানী শমসের গাজির অধিকারভুক্ত হয় । তখন থেকে ১২ বছর তিনি ত্রিপুরারাজ্যের সর্বময় কর্তা ছিলেন । শমসের গাজির জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর মৃত্যুর পর শেখ মনুহর গাজি নামে এক পল্লীকবি রচনা করেন গাজীনামা । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালির সেরেস্তাদার মৌলবি খবির মুদ্রিত করেন এই গাজীনামা । ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত কাব্যগ্রন্থ গাজীনামায় শমসের গাজির গড় জগন্নাথ-সোনাপুর গ্রামের বর্ণনায় পাই, 'দক্ষিনে ফেনী নন্দী / পূর্বে গিরি মুড়াবন্দি / উত্তরেতে এহেন জলধি । / পশ্চিমে মলয়া পানি / তার মধ্যে ভদ্রাখানি / মধ্যে যেন খিরুদের দধি ।।
এখানেও শমসের গাজীর গড়বন্দী গ্রামের সীমার উল্লেখ রয়েছে । ফেনীপাড়ের এই বিদ্রোহী বীরের উত্থানে সেদিন ত্রিপুরার রাজসিংহাসন কেঁপে উঠেছিল । ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শমসের গাজীর কিল্লা এবং বিশাল দিঘিটি আজও দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার পশ্চিম প্রান্তস্থ সীমান্ত গ্রাম আমলিঘাটে বিদ্যমান । আমলিঘাট থেকেই ফেনীনদীর নিম্নগতির শুরু এবং প্রশস্ত জলপ্রবাহের রূপ ধরে দক্ষিণাভিমুখী হয়ে বাংলাদেশের সমতল ক্ষেত্রে উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ।
ফেনী নদীপ্রবাহের ভারত ভূখণ্ডের শেষ প্রান্তিক জনপদ আমলিঘাট । সাব্রুম মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম । একসময় আমলিঘাট বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল । ত্রিপুরার প্রায় প্রতিটি নদীপ্রবাহের সীমান্ত অঞ্চলে রাজআমলে গড়ে উঠেছিল বনকর ঘাট । ফেনীনদীর ঘাটের ইজারার সুবাদে আমলিঘাটে গড়ে উঠেছিল ফেনীঘাট নামে বনকর ঘাট । আর তাকে কেন্দ্র করে তহশীল অফিস । ১৮৮৮ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ ও ত্রিপুরার যৌথ সরকারের তরফে একজন অফিসার এই ঘাটের তদারকি করতেন । বনজ সম্পদ আহরণের উপর ত্রিপুরার রাজা ও ব্রিটিশ সরকার ১০ আনা : ৬ আনা হারে কর আদায় করতেন । ১৮৭১ সালে ফেনীঘাটের ইজারা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ২০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২০০০ টাকা হয়েছিল । রিয়াং ও চাকমা গোষ্ঠীর লোকেরা তখন 'কোন্দা' এবং 'লং' নামে বিশেষ ধরনের নৌকা দিয়ে ফেনী ও গোমতী দিয়ে সমতল ত্রিপুরায় পণ্য পাঠাতেন । এসব কারণেই আমলিঘাটের গুরুত্ব ছিল । ১৯১৬ সালে সাব্রুম থেকে আমলিঘাটের রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয় ।
আমলীঘাট ও তার পার্শ্ববর্তী লোকালয় ঘিরে বেশ কিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও লোককাহিনি জড়িয়ে আছে । এখানে অবস্থিত শমসের গাজির দিঘি ও কেল্লাটি আজ জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে । দিঘির বৃহত্তর অংশই কাঁটাতারের ওপারে, যার একাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত । দিঘিটির তেমন সংস্কার নেই । পাড় কেটে অনেকে চাষের জমি বানিয়ে ফেলেছে । এই দিঘিকে কেন্দ্র করে লোককাহিনিও প্রচলিত ছিল একসময় লোকমুখে । দিঘির পাড়ে তালিকা রেখে মানত করলে নাকি বাসনকোশন পাওয়া যেত উৎসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণের কাজ সমাধা করার জন্য । দিঘির এক কোনা থেকে একটা সুড়ঙ্গপথ শমসের গাজির কেল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে যা এখন বনজঙ্গল ঘেরা এবং বাদুড়, চামচিকে, সরীসৃপের আবাসস্থল । লোকপ্রচলিত কথা আছে, এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে শমসের গাজির কেল্লার অভ্যন্তরের পর্দানশীন মহিলারা দিঘির জলে স্নান করতে যেতেন ।
শমশের গাজির এই দিঘিটির চারধারে যে উর্বর নিম্নসমভূমি রয়েছে এবং যা বর্তমানে বাংলাদেশের অংশের চাষের ভূখণ্ড তার নাম 'কালিদহ' । এই কালিদহকে কেন্দ্র করেও একটি পুরানো লোককথা প্রচলিত রয়েছে । সেই অনুযায়ী জানা যায় যে, এই কালিদহে নাকি চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা ডুবেছিল । বছর ৪০ এর আগেও এখানকার ভূমিতে প্রোথিত নৌকার গলুইয়ের মত কিছু একটার উর্ধ্বভাগ দেখা যেত। এটাকে ধারণা করা হত চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া নৌকার গলুইয়ের অংশবিশেষ । এই বস্তুটি ১৯৭৪ সালে এই প্রতিবেদক এবং ত্রিপুরার বিশিষ্ট লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে প্রত্যক্ষ করেছেন । গ্রাম্য ললনারা এখানে দীর্ঘদিন ধূপ দীপ জ্বালাতেন । পাশের বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত গ্রামটির নাম 'চম্পকনগর' । বলা হয় এখানে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি ছিল । আমলিঘাটের প্রায় এক দেড় কিলোমিটার দূরে ফেনীনদীর উজানের দিকে একটি গভীর খাত রয়েছে । এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জলঘূর্ণির সৃষ্টি হয় । জলের এই পাকের মধ্যে কিছু এসে পড়লে কুন্ডলি পাকিয়ে জল তা অনেক দূরে নিয়ে ফেলে । এই স্থানটিতে জলের গভীরতাও প্রচুর । ৫০-৬০ হাত লম্বা বাঁশ ফেলেও ঠাঁই পাওয়া যায় না । এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বলে মৎস্যশিকারিদের জন্য লোভনীয় স্থান এটি । এই জায়গাটির নাম 'মেরুকুম' । সন্নিহিত জনপদের নাম মেরুপাড়া । ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্তের শেষ ভূখন্ড বলেই হয়তো ভৌগোলিক 'মেরু' শব্দটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে । এখানে বিস্তৃত চরভূমি রয়েছে । মেরুকুমের এই চরভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখা বিকেলবেলা সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত নয়নমুগ্ধকর । লোকশ্রুতি আছে, এখানেই নাকি মনসামঙ্গল খ্যাত বেহুলার বাবা সায়বেনের বাড়ি ছিল। একসময় এই মেরুকুম পর্যন্ত সমুদ্রের জোয়ারের জল আসত । ফেনীনদীর বাঁকে অবস্থিতএই মেরুকুম-আমলিঘাট-কালিদহ-চম্পকনগর ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে সত্যিই মনসামঙ্গলে বর্ণিত কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । এই আমলীঘাটের পাশেই ফেনীনদীর পাড়ে একটি নাতিউচ্চ পাহাড়ে রয়েছে একটি প্রাচীন শিবমন্দির । এই পাহাড়টিকে বলা হয় সন্ন্যাসী টিলা । বহুকাল আগে এই টিলাতে একজন সন্ন্যাসী একাকী বাস করতেন বলে এর নাম সন্ন্যাসী টিলা হয়েছে । এখানকার শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করেও রয়েছে মিথ । কথিত আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের বিখ্যাত শৈবতীর্থে যাওয়ার আগে ভক্তরা এখানে বিশ্রাম করতেন । এই পাহাড়টায় প্রচুর বেলগাছ রয়েছে । বলা হয় এই বেলগাছ আপনাতেই গজায় । কেউ লাগাতে হয় না । কেউ কেউ বলেন, এখানে শিবপার্বতী বিশ্রাম করেন । প্রতিবছর শিবচতুর্দশীতে এখানে বিরাট মেলা বসে । এটিও চন্দ্রনাথ শিবতীর্থের ক্ষুদ্র রূপ । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্য দ্বিজ রতিদেবের 'মৃগলুব্ধ'তে যে শিকারির কাহিনি রয়েছে তাতে উল্লেখিত রঘুনন্দন পাহাড়ের শেষ প্রান্ত হল এই সন্ন্যাসী টিলা । মৃগলুব্ধ কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী এই সন্ন্যাসী টিলার সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া যায় । কালের গ্রাসে বহু কিছু হারিয়ে গেছে । হয়তো দ্বিজ রতিদেব কোন কারণে এই অঞ্চল পরিভ্রমণ করে গিয়ে তাঁর মৃগলুব্ধ কাব্য লিখে থাকবেন । সে দিক দিয়েও এ স্থানটির মাহাত্ম্য রয়েছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও আমলিঘাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । এক কথায় আমলিঘাটকে ঘিরে পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে । সরকার এ ব্যাপারে সহৃদয় দৃষ্টি দিতে পারেন ।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস–কৈলাস চন্দ্র সিংহ
২. গাজিনামা–শেখ মনোহর গাজী
৩. ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. জগদীশগণ চৌধুরী
৪. ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম–ড. রঞ্জিত দে
৫. ত্রিপুরার লোক সাহিত্য ও জনজীবন–ড. রঞ্জিত দে
৬. ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
৭. সাব্রুমের ইতিহাস ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
৮. মানিক্যশাসনাধীন ত্রিপুরা–নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী