Showing posts with label অণুগল্প. Show all posts
Showing posts with label অণুগল্প. Show all posts

Tuesday, October 11, 2022

নিপাট সজ্জনের গল্প

নিপাট সজ্জনের গল্প

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মহামারীর কালে শান্তিপল্লীর মানুষেরা কত ই না কষ্ট করেছে । দুবেলা খাবার জোটেনি । প্রতিবেশীরাও কাছে আসে না কেউ কারো । অসুখে ঘরে পড়ে মরে যায় । চিকিৎসা হয় না । মৃতের সৎকারের লোক আসে না ।

এই দুঃসময়ে এক নিপাট সজ্জন মানুষ আসে পল্লীতে । তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ভদ্র সভ্য মানুষ । সজ্জনের কথাবার্তায়, চলনে বলনে মার্জিত রুচির ছাপ আছে । মুখের ভাষায় যেন মধু ঝরে । এই দুর্দিনে তার কথায় সব দুঃখ ভুলে যেতে হয় ।  মানুষটি কি জাদু জানে ! দুঃখী মানুষগুলোর খোঁজখবর নেয় । পাশে এসে দাঁড়ায় । তার সঙ্গীরাও এগিয়ে আসে । তারা একেক সময় একেক রঙের মোমবাতি নিয়ে আসে । ওদের হাতের নানারঙের মোমবাতি জ্বলে ওঠে আর নানা রঙ ছড়ায় । ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ।

 সেই নিপাট সজ্জন মানুষটি আর তার সঙ্গীরা তাদের সামনে মোমের রঙিন আলো মেলে ধরে । তাদের আলোর গল্প শোনায় । তাদের গাঁয়ের কথা বলে । সে এক স্বপ্নের গাঁ । স্বপনপুর যার নাম । শান্তিপল্লীর অভাবী মানুষদের নিয়ে যেতে চায় সেখানে । সুখ আর সুখ ! তাদের সুখের দেশে পৌঁছে দেবার হাজারো প্রতিশ্রুতি দেয় । তাদের রহস্যময় ভাষায় সম্মোহিত হয় শান্তিপল্লীর মানুষ । 

শহরতলী থেকে উঠে আসা প্রান্তিক মানুষেরা অচিন গন্তব্যের পথে পা বাড়ায় । রঙিন মোমের আলো ঝলমল করে তাদের পথ । গ্রাম ছাড়িয়ে অরণ্যের অভ্যন্তরে আঁকাবাঁকা পথের দু'ধারে অলৌকিক সব ব্যানার সাজানো । স্বপনপুরের তোরণের ছবি তাতে সাঁটা । দুধারে এত সজ্জা । অথচ সারাটা পথ কাঁটা ঝোপে ঘেরা । শ্বাপদ-সরীসৃপস সংকুল ।  সরল মানুষ হাঁটতে থাকে কন্টকময় পথেই । পা থেকে রক্ত ঝরে । গা থেকে ঘাম ঝরে । তবুও সামনে আরো আলো আছে । এই ভেবেই ।

 সেই সজ্জন মানুষটির আরেক দল অনুগামী তাদের পেছন পেছন চলে । তাদের দ্বিচক্রযানের শব্দে বনভূমি কম্পিত হয় । তারা এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন মুছে ফেলে । তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেইসব স্বপ্নকাম মানুষদের । আর ক্লান্ত মানুষদের সরিয়ে ফেলে পথ থেকে । চলতে চলতে একসময় এক শূন্যতার সামনে মানুষগুলো এসে দাঁড়ালে সজ্জন মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে, হে গণদেবতাগণ ! আমরা সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ফেলেছি । সামনে দেখো বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর । খোলা আকাশ । মুক্ত বায়ু । স্বপ্নকাতর পথচলা মানুষের দল গুঞ্জন তোলে, কোথায় স্বপনপুর ! দেখছি নাতো কিছুই ! এ যে মরুভূমি  সামনে ! 

নিপাট সজ্জনের চোখ লাল হয়ে ওঠে । কে বলে এই কথা ? আমাদের একশো শতাংশ কাজ শেষ । এবার মরুভূমিকে নিয়ে প্রকল্প হবে । দূর্বিনীত সব ! 

হে দ্বিচক্রযানারোহীগণ ! চালাও চাবুক ! হিসফিসিয়ে উঠে একশ চাবুক ।গর্জে উঠে একশো দ্বিচক্রযান ।

'ঘুরে দাঁড়াও'...'

 সবাই মুহূর্তে হাজারো কন্ঠে প্রতিধ্বনি করে ঘুরে দাঁড়ায় । শূন‍্যভূমি কেঁপে ওঠে জনগর্জনে ।

Monday, February 14, 2022

ভ‍্যালেন্টাইন ডে

ভ‍্যালেন্টাইন ডে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

রোজ বাগানে গিয়ে টুকিটাকি কাজ করা অলক্তর অভ‍্যেস ‌‌। টবে বসানো নতুন গোলাপ গাছটায় কিছুতেই ফুল টিঁকছেনা । কলি আছে অনেকগুলো ‌‌‌। কেনার সময় নার্সারির ছেলেটা বলেছিল, একদম টকটকে লাল ফুল হবে স‍্যর । আর বড়োও যথেষ্ট । অলক্ত ফুটন্ত ফুলওয়ালা গোলাপচারাই কেনে । নিশ্চিন্ত হওয়ার জন‍্য । নার্সারির সবাই দীর্ঘদিনের পরিচিত । বিশ্বাস করে ঠকল নাতো ! বউ সিঁথিও বলেছে, দেখো, ঠিক ঠকিয়েছে ওরা তোমাকে । জংলি গাছ গছিয়ে দিয়েছ । জংলি হলেও তো ফুল ফোটার কথা । অলক্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে ।

 সিঁথি...সিঁথি.... দেখে যাও ‌‌। দেখে যাও ।
কি শুরূ করলে সকালবেলা !
আরে এসোনা । দেখে যাওনা ‌‌।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে সিঁথি । চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছো যে !
দেখোনা , গোলাপ গাছটায় ফুল ফুটেছে একটা ।
তাই নাকি? দেখি , দেখি ।
 সিঁথি কাছে গিয়ে অবাক চোখে ফুলটা দেখে । একদম টকটকে লাল, গোলাপটা ।
অলক্ত টুপ করলে ছিঁড়ে নেয় গোলাপটা ।
আহ্হা ! ছিঁড়লে কেন ফুলটা ? 
অলক্ত ফুলটা নিয়ে সিঁথির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । আজ অনেকদিন বাদে ফুলটা ফুটেছে গাছটায় ‌। এটা তোমার খোঁপাতেই মানাবে  তাই ।  
ছাই মানাবে । সিঁথি বলে ওঠে । 
আর আজতো ভ‍্যালেন্টাইন ডে । অলক্ত মনে করিয়ে দেয় । তাই ফুটেছে বোধহয় ।
আর বুড়ো বয়সে আদিখ‍্যেতা করতে হবেনা । সিঁথি বলল । অথচ শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে পেছন ফিরেই দাঁড়াল ।

একটা মৌমাছি গুণগুণ করে উড়ে এসে বসল ফুলটার ওপর ।

Tuesday, July 6, 2021

দুধের প্যাকেট

দুধের প্যাকেট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আজ কতদিন হল ঘরবন্দী ৷ প্রথমে লকডাউন ৷ তার কদিন পরই আবার কঠোর লকডাউন ৷ কি কঠোর কে জানে ৷ আগে যেমন এখনও তেমন ৷ কে মানে কার আইন ৷ পুলিশ নিরীহ লোকদের ধরে ধরে পেটায় ৷ বাইক আটকে মাস্কের জন্যে আর সহযাত্রীর হেলমেটের জন্যে জরিমানা আদায় করে ৷ টেনে হিঁচড়ে থানায় ঢোকায় ৷ হুজ্জতি করে ৷ সরকারি দলের মিছিল হলে মাস্ক লাগেনা ৷ সামাজিক দূরত্বও লাগেনা ৷ হাটে বাজারে ঢুঁসোঢুসি, গাড়িতে গাদাগাদি ৷ পুলিশ ওসব দেখেনা ৷ 

 আজ একমাস হল রামু বাড়ি থেকে বেরোয়না ৷ রাজমিস্ত্রির যোগালি কাজ করে সে ৷ ওই দিনহাজিরার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালায় ৷ বুড়ো মায়ের ঔষধ আর চার বছরের মেয়েটার দুধের প্যাকেট নিয়ে আসে ৷ আজ একমাসের উপর রুজি নেই একটাকাও ৷ কাজেই কোনো খরচাপাতি তেমন করে করতে পারছেনা ৷ এদিকে আবার বউটার পেটে বাচ্চা এসেছে ৷ পাঁচমাস পেরিয়েছে ৷ ভালোমন্দ খাওয়ানো দরকার ৷ তাও জুটছেনা ৷ দুঃসময়ের জন্যে জমানো সামান্য টাকা ভেঙেই চলছে লকডাউনের সংসার ৷ সরকারি সাহায্যও জোটেনি ভাগ্যে ৷ সরকার থেকে নাকি দেয়া হয়েছে ত্রাণ ৷ সে নাকি ক্যাটাগরিতে পড়েনা ৷ রেশনশপে গিয়ে ফিরে এসেছে ৷ মারধরের ভয়ে তর্ক করেনি ৷ রেশনদোকানের সামনে মাতবর গোছের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে ৷ গতবছর কোভিডের সময় ত্রাণের জন্যে মিছিলে যাওয়ায় তাকে বেদম পিটিয়েছিল ওরা ৷ এবারেও লকডাউনের মধ্যে ওরা বাইরের আরো কিছু ছেলেসহ বাইক নিয়ে পাড়ার অনেকের বাড়িতে হামলা করেছে ৷ ভাঙচুর করেছে ৷
রামু চলে আসে ৷ সে কিছুটা ভীতুও ৷ লকডাউনের মধ্যে অনেকে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে কাজ যাচ্ছে ৷ ও সাহস করেনি ৷

কমল তার কজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দুস্থদের ত্রাণ দিচ্ছে ৷ নিজেরাই চাঁদা তুলে দিচ্ছে সব ৷ কিছু কিছু সহৃদয় লোকও তাদের সাহায্য করছেন ৷ বেশির ভাগ তাদের ট্যুইশানির আয় থেকে বাঁচিয়ে ৷ যারা কোনোরকম সরকারি সাহায্য পায়নি এমন পরিবারকেই ত্রাণ বিলি করছে তারা ৷ আর দিচ্ছে কোভিড আক্রান্ত গরিব পরিবারকে ৷ যারা কোয়ারেন্টাইনে ঘরবন্দী ৷

ঘরের এক কোনায় ত্রাণের প্যাকেটটা নিয়ে রাখল রামু ৷ ছেলেরা এখনো ফিরে যায়নি ৷ উঠোনে দাঁড়িয়ে দূরত্ব বজায় রেখে রামুদের আর কি অসুবিধা রয়েছে জেনে নিচ্ছে ৷ এই অবসরে রামুর মেয়েটা প্যাকেটের ভেতর হাতড়াতে শুরু করেছে ৷ কতক জিনিসপত্র ব্যাগ থেকে বের করে মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলছে  ৷

 ওরা চলে যেতেই রামু ঘরে ঢুকে দেখে মেয়ে আটার পুটলি খুলে মেঝেতে, হাতে, মুখে একাকার করে ফেলেছে ৷ রামু হায় হায় করে ওঠে, মা একি করছিস তুই?  প্যাকেটটা নেড়ে ঘেঁটে ঘেমে নেয়ে মেয়ে চিৎকার করে বলে  প্রশ্ন করে, আমার দুধ কই বাবা? দুধের প্যাকেট?
রামু থমকে যায় ৷ মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ত্রাণের ছেলেরা জাতীয় সড়কের দূরের মোড়টা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে ৷

Thursday, July 16, 2020

বাঁ ধ ন

অণুগল্প

বাঁধন

এয়ারপোর্ট ৷সিকিউরিটি জোনে ঢুকে যাবার মুহুর্তে ছোট্ট শিশুটি দাদুর কোল থেকে কিছুতেই নামতে চাইছে না ৷ অনেক কষ্টে শিশুটির মা অর্থাৎ ভদ্রলোকের মেয়ে শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো ৷ পুরোটা জায়গায় ফাইবার গ্লাসের বিভাজন ৷কাজেই একে অন্যকে দেখছে ৷কোলের শিশুটা বারবার দাদুর দিকে তাকাচ্ছে ৷আর মুখে অদ্ভুত শব্দ করে মার কোলে ছটফট করছে ৷ বোর্ডিং পাস নেওয়া এবং প্রথাগত কাজ সারার পর শিশুটির মা শেষবারের মতো বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্যে পার্টিশানের কাছাকাছি এসে দাঁড়লো ৷ ভদ্রলোক পার্টিশানে হাত রেখে নাতিকে ডাকছেন, দাদু,দাদু়়়়়়়়৷ কিন্তু কথা তো ওপারে পৌঁছুচ্ছে না৷ বাচ্চাটা কাঁচের দেয়ালের ওপারের দাদুর হাতটা ধরতে চাইছে ৷ ছুঁতে পারছে না ৷নিষ্ফল আক্রোশে আঘাত শুরু করছে কাঁচের দেয়ালে ৷ ঠাট়়়়়়়ঠাট়়়়়়়়়ঠাট়়়়়়়৷এই শব্দে ভদ্রলোকের বুকের দেয়ালেও যেন আঘাত হচ্ছে থাক়়়়়়়থাক়়়়়়়থাক়় ৷ভদ্রলোক ফাইবারের দেয়াল হাতড়ে নাতিকে ছুঁতে চাইছেন ৷ ওদিকে বিশাল গর্জন করে একটা বিমান রানওয়ে স্পর্শ করলো ৷

Saturday, March 14, 2020

রি পু দ ল ন



    ছুটছে ৷ছুটছে ৷ একটি শিশু ছুটছে ৷ একটি কিশোরী ছুটছে ৷ একটি যুবতী ছুটছে ৷ এক প্রৌঢ়া ছুটছে ৷ এক বিগত জরতী  ছুটছে ৷ আফটার অল একটি নারী ছুটছে ৷ 

'অপনা মাসে হরিণা বৈরী', 
আপন যোনিতে নারী ৷

একবিংশ শতাব্দীতে একদল শ্বাপদ পথে বেরিয়ে পড়েছে ৷
তারা সব বিপরীত লিঙ্গের ৷ বিকৃত লিঙ্গেরও ৷ তাদের বাড়বাড়ন্ত মহল্লায় ও মলে ৷ তাদের রাজত্ব আসমভূমিপর্বত ৷ তাদের লিঙ্গের উল্লাসে আকাশ ফাটে বাতাসে কাঁপন ধরে ৷ পশুরা লজ্জা পায় ৷ পুরুষরা দেখেও দেখেনা ৷ ধার্মিক চোখ বুঁজে ইষ্টনাম জপে ৷ জননায়ক স্বগোত্রের গন্ধ খোঁজে ৷ রমণীকুল ফুঁপিয়ে কাঁদে ৷ চিৎকার করে কেঁদেও থই পায়না ৷ দ্রৌপদীর শাড়ি খুলতেই থাকে খুলতেই থাকে ৷ পুরুষোত্তম লুকিয়ে পড়ে নিকুঞ্জবনে ৷

গবেষণাগার ৷ আসে শিশুটি ৷ আসে কিশোরী ৷ আসে যুবতী ৷ আসে প্রৌঢ়া ৷ আসে জরতী ৷ মূলত আসে নারী ৷ অষ্টাদশ দিবসরজনী অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী দ্বিতীয় লিঙ্গের প্রাণপাত চলে ৷ রিরংসাদমনের প্রতিষেধক পেয়ে যায় গোপন গবেষণায় ৷

ছুটছে ৷ছুটছে ৷ একটি শিশু ছুটছে ৷ একটি কিশোরী ছুটছে ৷ একটি যুবতী ছুটছে ৷ এক প্রৌঢ়া ছুটছে ৷ এক  জরতী  ছুটছে ৷ আফটার অল একটি নারী ছুটছে ৷
 
এবারে আর প্রাণভয়ে নয় ৷ সুর্পনখার মতো ইন্দ্রজালে ৷ নকল প্রাণভয়ে ৷ গোপন লুকোচুরি খেলায় ৷ রিরংসুকদলের আগে আগে ৷ ধরা পড়ে যায় ওরা ৷ শুয়ে পড়ে তারা ৷ হাজারো নখরের আঁচড় শরীরে ৷ চরমক্ষণের অপেক্ষা ৷ উত্তেজনা চরমে ৷ হাজারো উচ্ছৃত লিঙ্গ ও অন্ডকোষ এগোতে থাকে ৷ গুপ্তধনের দিকে ৷ কোষাগারের দরজায় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে......৷ গগনভেদী চিৎকার ৷ কুরুক্ষেত্রের কোলাহল ৷ ছিটকে যায় হাজারো লিঙ্গ আর অন্ডকোশের কার্তুজ ৷ ইতিউতি ছড়ানো লিঙ্গহীন পুরুষের লাশ ৷ শিশুকিশোরীযুবতীপ্রৌঢ়াজরতী একসঙ্গে উঠে আসে ৷ গলা মিলিয়ে হাসে ৷ প্রাণ খুলে ৷ লাশপ্রান্তরে ৷ বলির বাজনা বাজনা বেজে ওঠে আকাশমন্ডপে ৷

কোথায় যেন গুমরে কাঁদে তেমন একটা দিন! !

Wednesday, March 11, 2020

দা ঙ্গা



এত রাতে কাকে পাবে সে ৷ কদিন ধরে চারদিক থেকে যা খবর আসছে ৷ পাড়ার সবাই তটস্থ হয়ে আছে ৷ দিনের বেলাও ঘর থেকে কেউ বেরুচ্ছেনা ৷ রাতে তো অসম্ভব ৷ কেলাব ঘরে বিকেলে একটা মিটিন হয়েছিল পাড়ার সবাইকে নিয়ে ৷ বউয়ের এই অবস্থার কথা জানিয়ে যায়নি মিটিনে ৷ তবে সবার যা মত তাতে সে সহমত পোষণ করে বলে জানিয়েছে ৷ পাড়ার অনেকেই জানে তার সমস্যার কথা ৷ তাই তাকে রেহাই দেওয়া হয়েছে ৷

মিটিনে বয়স্ক দুএকজন সম্প্রীতির কথা বললেও কয়েকটা উটকো বহিরাগতের উস্কানিতে পাড়ার কয়েকটা ছেলে হৈ হল্লা করে সভা পন্ড করে দিয়েছে ৷ ওরা বলেছে মিস্টি কথায় চিরা ভিজনের দিন গেছেগা ৷ ওরা বলছে মারের বদলে মার দিতে হবে ৷
বুড়োরা যেন ঘরে গিয়ে বসে থাকে ৷ এখন জোয়ানদের দিন ৷ ওপর থেকে খবর এসেছে ওগুলোকে ঝাড়ে বংশে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই ৷ ছেলেগুলোর মিলিত চিৎকারে সন্ধ্যার পাখিগুলো কিচিরমিচির করে উঠল বাসা ছেড়ে দিয়ে ৷ পাড়ার ঘরে ঘরে একটা গুমোট আতঙ্ক ৷

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বউয়ের শরীর আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷ ব্যথায় ককিয়ে উঠছে বউটা ৷ আর অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে তার দিকে ৷ উঠে দাঁড়ায় সে ৷ একটা কিছু করতে হবে ৷

অনেক রাতে হন্যে হয়ে ঘুরে কোনো যানবাহনে দেখা পেলনা ৷ হতাশ যখন ফিরে আসছে তখন একটা একটা ঝুপড়ির পাশে একটা রিক্সা পড়ে রয়েছে দেখতে পেল ৷ কাছে গিয়ে চালক বা সওয়ারি কাউকে দেখতে পেলনা ৷ একটু ভেবে সে নিজেই রিক্সাটা টেনে নিয়ে চলল বাসার দিকে ৷ কাজ সেরে আবার রেখে দেবে সেখানেই ৷ সকালে মালিককে বুঝিয়ে কিছু টাকা দিয়ে দেবে ৷

পাড়ার কাছাকাছি পৌঁছুতেই দেখল পাড়ায় আগুন চারদিকে ৷ লোকজনের চিৎকার ৷ মার ৷ মার ৷ ধর ৷ ধর ৷ কাইট্টা ফালা ৷  আগুনের আলোয় দেখা যাচ্ছে একদল লাঠিসোটা দা কিরিচ নিয়ে ধাওয়া করছে ৷ বাঁচাও ৷ বাঁচাও ৷ আর্তনাদ চিৎকারে একটা থমথমে পরিবেশ ৷ ওর বুকের ভেতর মোচড় দেয় ৷ বউয়ের জন্যে ৷ আর একটা স্বপ্নের জন্যে ৷ দ্রুত পৌঁছে যায় তাদের বাড়ির কাছাকাছি ৷ আর দুএকটা বাসার পরে ওদের ঘরে লাগবে আগুন ৷ দ্রুত ছড়াচ্ছে ৷

—এই....এই....খাড়অ ৷ শালার শালা ৷ কই যাইতাছচ ৷ 
—ধর তারে ৷ ভাগতাছে ৷ 
সে দাঁড়িয়ে পরে ৷ না না ভাই ৷ আমি ভাগতাছিনা ৷
 ভাগতাছৎনা ৷ বাল ফালাইতাছৎ ৷ রিসকা লইয়া কিতা করতাছৎ?
—না দাদা ৷ আমার বউ ৷ ব...অ...উ... ৷
—পুন্দেদা দিমু তর বউ ৷ বান তারে ৷ কাইট্টাঅই লামু আজগা তরে ৷
দাদা ৷ আমারে মাইরেননা ৷ আমি প্রাণভিক্কা চাই আপনেরার কাছে ৷ আমার কথাডা হুনেন ৷
চিৎকার চেঁচামেচিতে শোনা যায়না তার কথা ৷ পিছমোড়া বেঁধে ফেলে তাকে ৷ তার বাসার সামনে ৷ সে অসহায় চেয়ে থাকে বাড়ির দিকে  ৷
দড়িতে টান পড়ে ৷ চল আজগা তোর শেষদিন ৷

ঠিক এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে কান্না ভেসে আসে দুটি মানুষের— মা মা ৷ ওঙা ওঙ্গা ৷ মা..ওঙ্গা...মা...ওঙ্গা ৷ আর আর্ত চিৎকারভরা বীভৎস রাতের আকাশ থেকে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— দাঙ্গা...দাঙ্গা...দাঙ্গা...৷

জীবনদাত্রী







জাতীয় সড়কে গাড়িঘোড়া এখন আর নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারেনা ৷ নির্দিষ্ট সময় ধরে সিআরপিএফ এর এসকর্ট বেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতে হয় ৷ যখন গাড়িগুলো চলে তখন মনে হয় বিশাল কনভয় চলছে ৷ এভাবেই প্রধান দুটো পাহাড়ই আধা সামরিক বাহিনীর কঠোর অনুশাসনের মধ্যে চলাচল করতে হয় ৷ দিনে দুবার মাত্র এই সুযোগ থাকে গাড়গুলোর এবং  যাত্রীদের ৷

কিন্তু আজ কিছুতেই প্রথম এসকর্টটা ধরতে পারলনা প্রবাল ৷ গতরাতে বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল ৷ ঘুমোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে ৷ উঠতে পারেনি সময়মতো ৷ কাজেই জাতীয় সড়কপথে যাওয়ার আশা ছেড়েই দিল ৷ রাধানগর বাসস্ট্যান্ট থেকে গাড়ি ধরল ৷ এপথে এসকর্ট নেই ৷ নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপ নেই ৷ সময়ও কম লাগে ৷ তবে রিস্কি ৷ কিছু করার নেই প্রবালকে আজ অফিস ধরতেই হবে ৷ নতুন একটা প্রজেক্টে ভিজিটার্স আসবে ৷ ইম্প্লিমেন্টিং অফিসার সে ৷ যেতে বাধ্য সে ৷

গাড়িতে যাত্রীদের যথেষ্ট ভিড় ছিল ৷ সিটের প্যাসেঞ্জার ছাড়াও দাঁড়ানো যাত্রী ছিল অনেক ৷ সারাদিনে এরাস্তায় এখন দুটি গাড়ি চলে ৷ মোহনপুরে পৌঁছানোর পর অধিকাংশ যাত্রীরা নেমে যায় ৷ গাড়িটা ফাঁকা ৷ সাকুল্যে আটজন যাত্রী ৷ প্রবালই একমাত্র বাঙালি ৷ আর সবাই উপজাতি অংশের ৷ ড্রাইভার এসিস্টেন্টও ৷ প্রবালের পাশের সিটে জানলার ধার ঘেঁষে বসেছে এক উপজাতীয় তরুণী ৷ কিছুদূর চলার পরই সহযাত্রী দুজনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হয় ৷ মেয়েটি বিবাহিত ৷ খোয়াই সুভাষপার্ক বাড়ি ৷ ওখানেই ওর বরের বইয়ের দোকান ৷ ও  নিজে স্কুল টিচার ৷ চম্পাবতী নাম ৷ চম্পাবতী দেববর্মা ৷ বেশ মিশুকে ৷ নিজেই কথাবার্তা বলে গেছে অনর্গল ৷ জেনে নিয়েছে প্রবাল কেন কোথায়  যাচ্ছে ইত্যাদি ৷

গাড়িতে কয়েকজন বলাবলি করছিল গতকাল নাকি সুবলসিংএ গাড়ি থামিয়ে  কয়েকজনকে নামিয়ে নিয়ে গেছে ৷ পরিস্থিতি থমথমে ৷ প্রবালের ধূমপানের অভ্যেস আছে ৷ গাড়িটা চড়াই উঠতে শুরু করার পরই প্রবাল বলে উঠল, স্যরি, আমি একটু পেছনে যাচ্ছি ৷ কিছু মনে করবেননা ৷ আমার একটু বদঅভ্যাস আছে ৷

প্রবা গিয়ে পেছনের লম্বা ফাঁকা সিটটায় জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরাল ৷ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বাইরে তাকিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তাটা দেখছে ৷ দূরের উঁচু পাহাড় দেখছে ৷

ঢালু পথে নামতে নামতে হঠাৎ গাড়িটা জোরে ব্রেক কষল ৷ বেশ কিছু লোক মুহূর্তে গাড়িটা ঘিরে ধরল ৷ ওদের সবার হাতে ধারাল দা, টাক্কাল ৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চম্পাবতী নিজের সিট ছেড়ে ছুটে ওর কাছে চলে এল একমুহূর্তে ৷
— এই মশাই আপনার সবকিছু জানা হয়ে গেছে ৷ বাঁচতে হলে তাড়াতাড়ি নামটা বলুন ৷
—প্রবাল, প্রবাল মিত্র ৷
—কোথায় থাকেন?
—আগরতলা ৷ জয়নগর ৷ নন্দা অপটিকসের পেছনের বাড়ি ৷
— ঠিক আছে ৷ আপনি কোনো কথা বলবেননা ৷ একদম চুপ থাকবেন ৷
 বলে একদম প্রবালের গা ঘেঁষে বসল ৷
ততক্ষণে বেশ কটা গাট্টাগোট্টা গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ৷ যাত্রীদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করে সোজা পেছনের সিটে গিয়ে প্রবালের সামনে দাঁড়াল ৷
— এ্যাই ৷ কি নাম তর?
—প্রবাল মিত্র ৷ জবাব দেয় চম্পাবতী ৷
— তুমি উত্তর দিছস ক্যারে?
— হ্যা ত আমার স্বামী লাগে ৷
একটা তরল স্রোত বয়ে যায় প্রবালের শরীর বেয়ে ৷
—বারি কই তার ? নক্ বিয়াং?
—আগরতলাঅ ৷
—বিয়াং থানাই? 
—খোয়াইঅ ৷
ওরা আর প্রশ্ন করেনা ৷ নেমে গিয়ে গাড়িটা ছেড়ে দেয় ৷ 

গাড়ি চলতে থাকে ৷ কৃতজ্ঞতায় প্রবাল চম্পাবতীর দুটো হাত মুঠো করে ধরে ৷

Wednesday, February 26, 2020

বসন্তলাপ



অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছয়টা ঋতু ৷ ছয় রূপে সালংকারা প্রকৃতি ৷ মনমেজাজও তার ছয় রকমের সময়ে সময়ে ৷ আর মর্জির রকমারি প্রমান রাখে বছর জুড়ে ৷ প্রান্তর জুড়ে ৷ অরণ্য-কন্দরে ৷ লোকালয়ে ৷ ভিটেমাটিতে ৷

মাটি ঘিরে মানুষ ৷ মাটিকে সাজায় মানুষ ৷ মাটির দখলদারি মানুষই করে ৷ মাটি নিয়ে মারামারি করে ৷ মাটিকে ঘিরে সম্পদ গড়ে ৷ বিত্তবৈভব ৷ সেও একান্ত নারীজনের মতো ৷ লালনে ও রমণে ৷ জমির রমণ কর্ষণ ৷ তার লালনফল ফসলের ভার ৷ বাগবাগিচা ৷

যথাকালে বাগিচার বুলবুলি ফুলশাখায় দোল দিয়ে কবিকে জাগায় ৷ কবি বিভোর হয় ফুলের চর্চায় ৷ যেমন বিমুগ্ধ থাকে শব্দচর্চায় ৷ ঋতুকালে বাগানের গাছগাছালি কবিকে ভালোবেসে ফেলে ৷ সবুজ পত্রগুচ্ছ কবির গায়ে শরীর বুলিয়ে দেয় ৷ শিহরণ তোলে ৷ বাহারি ফুলেরা অনিমেষ চেয়ে থাকে কবির দিকে ৷ আলতো করে চুমু খায় কবির গালে ৷ কোমল অঙ্গে ৷

বর্ষার ধারাপতনের মরসুম শেষ হলে গাছেরা অধীর হয়ে ওঠে ৷ শুষ্কদিনে চায় মানুষের আশ্লেষ ৷ নিবিড় কবিতা ৷ লালন ৷ যতন ৷ প্রথম বর্ষণজলের বার্তা আবার যতদিন না আসে ততদিন গাছে-মানুষে চলে গোপন অভিসার ৷ অসম দাম্পত্য ৷

কতদিন হল বর্ষা ফিরে গেছে ৷ বসন্তের নবীন সমাগমে প্রকৃতি চঞ্চলা ৷ চটুলা ৷ দীর্ঘ শুষ্ককালে বনানী কবিকে পেয়েছে কাছে ৷ তার বৃক্ষেরা তার পত্রপল্লব তার পুষ্পসমাহার কবির ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে মোহাবিষ্ট ৷ বসন্তের বনানী হয়ে উঠতে চায় সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী ৷ কবির সঙ্গে ঝাঁপ দিতে চায় ঋতুরমণে ৷

এমন আদিম ঋতুও যেন শত্রু হয় বনানীর ৷ আকাশ ছেয়ে আসে কালোমেঘ ৷ মাটিতে প্রথম জলবিন্দু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে আসবে কবির লালনঋতু ৷ দীর্ঘকালের জন্যে আবার বিরতি ৷ অমৃতজল এবার মাটির শুশ্রূষা করবে ৷ প্রয়োজন হবেনা কবির সিঞ্চনহাতের ৷ বেশ কিছুকালের জন্যে ৷

শিউরে ওঠে বনানী ৷ তার বুকের মধ্যে বিচ্ছেদগান বাজে ৷ হৃদয়ের তারে সুর ওঠে বিরহের ৷ বসন্তে পতিসান্নিধ্য বঞ্চিতা নায়িকার অন্তর্দহনে দগ্ধদিনের আর্তসংলাপ সঙ্গীত হয় ৷ চিরকালীন বিলাপের ৷

 বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে ৷

Monday, July 1, 2019

গ র্জ ন

রাজ্য জুড়ে হাহাকার চলছে ৷ খরায় পুড়ছে সারাটা রাজ্য ৷ গত একবছরে মাঠ ঘাট শুকিয়ে ফুটিফাটা ৷ বৃষ্টি হয়নি বহুদিন ৷ খাল-বিল শুকিয়ে গেছে ৷ পুকুর জলাশয়ে জল নেই ৷ নদীর বুকে পড়ে গেছে ধু ধু বালির চর ৷ খেতে ফসলও হয়নি একবছর ৷ রাজার খাজনা দিয়ে যা কিছু ছিটে ফোঁটা সঞ্চয় ছিল তা নিয়ে আধপেটা খেয়ে কেউ কেউ শীর্ণ শরীর নিয়ে রোগে শোকে কাবু রাজ্যের মানুষ ৷ রাজার বাড়িতে খাবার চাইতে গিয়ে তোপের মুখে উড়ে গেছে বহু লোক ৷ ভয়ে মুখ না খুললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে মানুষ ৷

রাজা মারা গেছে অল্প কদিন হল ৷ শ্রাদ্ধশান্তির পর যুবরাজ আবার আপন মূর্তিতে ফিরে এসেছে ৷ ইয়ার বন্ধু নিয়ে বসছে সুরা আর সাকির মৌতাত ৷ লখনৌর দশহাজারি তিজন বাঈ এসেছে ৷ কদিন ধরে বসেছে মেহফিল ৷ ঘুঙুরের শব্দে নাচমহল গমগম করছে ৷ বাইরে খরার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে গভীর রাতে ৷ উড়ছে টাকা ৷ সুরার ফোয়ারা ছুটছে ৷ মেহফিল শেষে নাচমহলেই ঘুমিয়ে পড়েছে তিজন বাঈয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে  কুসুমকুমার ৷
    
রাজকুমারের মর্জি ৷ ভোরবেলাই আচমকা ডেকে তুলল তিজনবাঈকে ৷ তিজন ৷ তিজন ৷ ওঠো ৷ উঠে পড়ো প্রিয়ে ৷ তোমাকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরুব ৷ ঘোড়াশাল থেকে আমার প্রিয় সাদা ঘোড়া দমদমকে বের করে সাজাতে বলেছি ৷ তুমিও তৈরি হয়ে নাও ৷ সাদা চোলি ঘাগরা পরবে কিন্তু ৷ তিজনবাঈ চোখ কচলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ৷ তুমি তৈরি হয়ে নাও ৷ আমি পাশের কোঠায় আছি ৷

সাদা ঘোড়া দমদম ছুটছে সামনের দিকে ৷ পিঠে তার রাজকুমার আর অচিন রাজকুমারী ৷ রাজবাড়ির সীমানা পেরিয়েই একটা খোলা প্রান্তর ৷ সামনে বন ৷ বনের ওপারের মাথা থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে তার রাঙা মুখ নিয়ে ৷
কুসুমকুমার  বনের ভেতর ঘোড়া চালিয়ে দিল ৷ পেছনে তিজনবাঈ ৷ লেপ্টে রয়েছে কুমারের গায় ৷ ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে তিজনের নরম শরীর চাপ দিচ্ছে কুসুমকুমারের পিঠে ৷ বনের একটা বাঁকে এসে ঝরনার ধারে ঘোড়া থামাল কুসুমকুমার ৷ ঘোড় থেকে নেমে দুহাত বাড়িয়ে তিজনকে প্রায় কোলে করে নামাল ৷
এখানে কেন আনলেন আমাকে? কিজন্যে ?
রাজকুমার হাসল ৷ —তোমাকে নিয়ে এই বনের ভেতর প্রাতঃভ্রমণ করব ৷ ঝরনার ধারে বসে তোমার গান শুনব ৷ এসো প্রিয়ে ৷

রাজকুমার তন্ময় হয়ে শুনছে তিজনের গান ৷ প্রকৃতির বুকে তার গান একটা আলাদা আমেজ তৈরি করেছে ৷

হঠাৎ দেখা গেল তাদের ঘিরে ধরেছে কঙ্কালসার একদল মানুষ ৷ ওদের হাতে বুনো গাছের শক্ত ডাল ৷ কারো হাতে ঝরনার পাড়ের বড়ো বড়ো নুড়ি ৷ ওরা চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে ৷ —কে ? কে তোমরা?  রাজকুমার হাঁক পাড়ে ৷
আমরা আপনার  ক্ষুধার্ত প্রজা ৷
কি চাও তোমরা?
—আমরা প্রতিশোধ চাই ৷ প্রজাহত্যার প্রতিশোধ ৷ সারা রাজ্যে খাদ্য পানীয়ের হাহাকার ৷ আর আপনি আনন্দ, উৎসবে মেতে আছেন ৷ রাজকোষ শূন্য করছেন ৷ এই ঝরনাতেই সামান্য জল আছে ৷ এ নিয়ে আমরা কোনোরকমে বেঁচে আপনি এখানেও এসেছেন ফুর্তি করতে?  আপনাকে আমরা কিছুতেউ ছাড়ছিনা ৷
  সংঘবদ্ধ মানুষগুলো খুব কাছে চলে এসেছে ৷ তিজনবাঈ ভয়ে রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে ৷ থরথর করে কাঁপছে সে ৷

   দূরে রাজবাড়ির দিক থেকে তুমুল কোলাহল ভেসে আসতে লাগল ৷ আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে আকাশে ৷ এখানেও যেন কালো ধোঁয়ায় ঘিরে ধরেছে দুজনকে ৷ একটা বিশাল সমুদ্রের গর্জন আছড়ে পড়ছে ওদের শরীরে ৷

গ র্জ ন

রাজ্য জুড়ে হাহাকার চলছে ৷ খরায় পুড়ছে সারাটা রাজ্য ৷ গত একবছরে মাঠ ঘাট শুকিয়ে ফুটিফাটা ৷ বৃষ্টি হয়নি বহুদিন ৷ খাল-বিল শুকিয়ে গেছে ৷ পুকুর জলাশয়ে জল নেই ৷ নদীর বুকে পড়ে গেছে ধু ধু বালির চর ৷ খেতে ফসলও হয়নি একবছর ৷ রাজার খাজনা দিয়ে যা কিছু ছিটে ফোঁটা সঞ্চয় ছিল তা নিয়ে আধপেটা খেয়ে কেউ কেউ শীর্ণ শরীর নিয়ে রোগে শোকে কাবু রাজ্যের মানুষ ৷ রাজার বাড়িতে খাবার চাইতে গিয়ে তোপের মুখে উড়ে গেছে বহু লোক ৷ ভয়ে মুখ না খুললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে মানুষ ৷

রাজা মারা গেছে অল্প কদিন হল ৷ শ্রাদ্ধশান্তির পর যুবরাজ আবার আপন মূর্তিতে ফিরে এসেছে ৷ ইয়ার বন্ধু নিয়ে বসছে সুরা আর সাকির মৌতাত ৷ লখনৌর দশহাজারি তিজন বাঈ এসেছে ৷ কদিন ধরে বসেছে মেহফিল ৷ ঘুঙুরের শব্দে নাচমহল গমগম করছে ৷ বাইরে খরার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে গভীর রাতে ৷ উড়ছে টাকা ৷ সুরার ফোয়ারা ছুটছে ৷ মেহফিল শেষে নাচমহলেই ঘুমিয়ে পড়েছে তিজন বাঈয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে  কুসুমকুমার ৷
    
রাজকুমারের মর্জি ৷ ভোরবেলাই আচমকা ডেকে তুলল তিজনবাঈকে ৷ তিজন ৷ তিজন ৷ ওঠো ৷ উঠে পড়ো প্রিয়ে ৷ তোমাকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরুব ৷ ঘোড়াশাল থেকে আমার প্রিয় সাদা ঘোড়া দমদমকে বের করে সাজাতে বলেছি ৷ তুমিও তৈরি হয়ে নাও ৷ সাদা চোলি ঘাগরা পরবে কিন্তু ৷ তিজনবাঈ চোখ কচলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ৷ তুমি তৈরি হয়ে নাও ৷ আমি পাশের কোঠায় আছি ৷

সাদা ঘোড়া দমদম ছুটছে সামনের দিকে ৷ পিঠে তার রাজকুমার আর অচিন রাজকুমারী ৷ রাজবাড়ির সীমানা পেরিয়েই একটা খোলা প্রান্তর ৷ সামনে বন ৷ বনের ওপারের মাথা থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে তার রাঙা মুখ নিয়ে ৷
কুসুমকুমার  বনের ভেতর ঘোড়া চালিয়ে দিল ৷ পেছনে তিজনবাঈ ৷ লেপ্টে রয়েছে কুমারের গায় ৷ ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে তিজনের নরম শরীর চাপ দিচ্ছে কুসুমকুমারের পিঠে ৷ বনের একটা বাঁকে এসে ঝরনার ধারে ঘোড়া থামাল কুসুমকুমার ৷ ঘোড় থেকে নেমে দুহাত বাড়িয়ে তিজনকে প্রায় কোলে করে নামাল ৷
এখানে কেন আনলেন আমাকে? কিজন্যে ?
রাজকুমার হাসল ৷ —তোমাকে নিয়ে এই বনের ভেতর প্রাতঃভ্রমণ করব ৷ ঝরনার ধারে বসে তোমার গান শুনব ৷ এসো প্রিয়ে ৷

রাজকুমার তন্ময় হয়ে শুনছে তিজনের গান ৷ প্রকৃতির বুকে তার গান একটা আলাদা আমেজ তৈরি করেছে ৷

হঠাৎ দেখা গেল তাদের ঘিরে ধরেছে কঙ্কালসার একদল মানুষ ৷ ওদের হাতে বুনো গাছের শক্ত ডাল ৷ কারো হাতে ঝরনার পাড়ের বড়ো বড়ো নুড়ি ৷ ওরা চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে ৷ —কে ? কে তোমরা?  রাজকুমার হাঁক পাড়ে ৷
আমরা আপনার  ক্ষুধার্ত প্রজা ৷
কি চাও তোমরা?
—আমরা প্রতিশোধ চাই ৷ প্রজাহত্যার প্রতিশোধ ৷ সারা রাজ্যে খাদ্য পানীয়ের হাহাকার ৷ আর আপনি আনন্দ, উৎসবে মেতে আছেন ৷ রাজকোষ শূন্য করছেন ৷ এই ঝরনাতেই সামান্য জল আছে ৷ এ নিয়ে আমরা কোনোরকমে বেঁচে আপনি এখানেও এসেছেন ফুর্তি করতে?  আপনাকে আমরা কিছুতেউ ছাড়ছিনা ৷
  সংঘবদ্ধ মানুষগুলো খুব কাছে চলে এসেছে ৷ তিজনবাঈ ভয়ে রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে ৷ থরথর করে কাঁপছে সে ৷

   দূরে রাজবাড়ির দিক থেকে তুমুল কোলাহল ভেসে আসতে লাগল ৷ আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে আকাশে ৷ এখানেও যেন কালো ধোঁয়ায় ঘিরে ধরেছে দুজনকে ৷ একটা বিশাল সমুদ্রের গর্জন আছড়ে পড়ছে ওদের শরীরে ৷

ঝ ড়

ঝড়

মার কাছে জবাবদিহি করতে করতে জেরবার ৷ একটা ভয়ংকর অপরাধ বোধহয় সে করে ফেলেছে ৷ সংসারটা শুরু না করতেই যেন বজ্রাঘাত ৷ আত্মজনও এতো পাষন্ড হয়?  তার আশ্রয়ের জায়গাটা কোথায়?  নিরাপত্তা কী আছে?
বল বল কে করেছে তোর এ দশা?  আজ তার উপর মারধরও করা হয়েছে ৷ মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনে মনোবল ভেঙে গেছে ৷ বলা যায় কী এ পাপের কথা!
কদিন ধরেই ক্রমশ বিষন্নতা গ্রাস করছিল তাকে ৷ ঘরের থেকে বের হতনা বিশেষ একটা ৷ হলেই সবার চোখ পড়ত তার দিকে ৷ আর কটু কথার বান ডাকত ৷ আর মা সময় করে অনবরত জেরা করত ৷ সে নিরুত্তর থাকত ৷
আর সহ্য হয়না ৷ নিজের চারদিকে একটা ঘোর অন্ধকারের বলয় তৈরি ৷ হাত-পা ছুঁড়ে সে চায় বলয়টা ভাঙতে ৷ পারেনা ৷ পেট মোচড় দিয়ে বমির দলা উঠে আসে ৷ বমির শব্দ হলে মার খিস্তি বেড়ে যায় ৷
ঘরের এমাথা থেকে সেমাথা একগাছা নাইলন দড়ি টানা বাঁধা ৷ টুকটাক কাপড়চোপড় ঝুলিয়ে রাখার জন্য ৷ ধীরে ধীরে উঠে দড়িটা খুলে একমাথা আবার সিলিং ফ্যানের ফাঁস দিয়ে লাগাল ৷ পড়ার টুলটাকে এনে ঝোলানো দড়ির নিচে  রাখল ৷ তারপর উঠে দাঁডাল টুলটার উপর ৷ দড়িটাকে টেনে গলা সমান মেপে একটা মালার মতো করে একটা গিঁট দিয়ে গলায় পরে নিল ৷ বাড়িতে ঠাকুরের ফটোটাতে প্রায়ই মালা পরাত ৷ নিজে কখনো গলায় মালা পরেনি ৷ মালার মতো দড়ির বৃত্তে একটা নিষ্পাপ শিশুর মুখ ভেসে ওঠে ৷ অনেকটা ফটোর নাড়ুগোপালের মতো ৷ কিন্তু ভীষণ সন্ত্রস্ত সে মুখ ৷ তার পেছনে জল্লাদের মতো খাঁড়া নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এক ভয়ংকর মূর্তি ৷  যেন এক্ষণই শিশুটার গায়ে কোপ বসাবে ৷ মুখটা হুবহু তার বাবার মতো ৷
শিশুটিকে রক্ষা করার জন্যে সে হুঙ্কার দিয়ে সামনে ঝাঁপ দিল ৷ পায়ের ধাক্কা লেগে টুলটা কাত হয়ে পড়ে গেল ৷ তার সামনে একটা প্রচন্ড ঝড়ের রাতের দৃশ্য জেগে উঠছে ৷ ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও ৷

Friday, June 21, 2019

কেন চেয়ে আছো গো মা

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তর ৷ সে কী স্বপ্ন দেখ ছিল ! স্বপ্ন কী এতো স্পষ্ট হয় ৷ বয়স্কা এক আদিবাসী মহিলা যেন  ৷ যাকে বলে লোলচর্ম ৷ ঠিক ততোটা না হলেও সারামুখে স্পষ্ট বলিরেখায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ৷ হলে কী হবে কালো চাদরে প্রায় আধেকঢাকা শরীর দেখে বোঝা যায় এখনও ভেঙে পড়েনি একসময়ের কর্মজীবী দেহ ৷ একদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মুখে এক ঐশ্বরিক হাসি ৷ কোনোদিন একে দেখেছে বলেও মনে হয়না ৷ এমনিতে এটা পার্বত্য এলাকা ৷ ছোটো ছোটো টিলার উপরে ছড়ানো ছিটানো সব টংঘর ৷ কাল বিকেলে এখানে এসেই কাছাকাছি একটু ঘুরে দেখেছে ৷ রাত্তিরের আশ্রয়টা নিয়েছে এই ফরেস্ট বাংলোতে ৷ কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কিছু কিছু তথ্য ৷ ত্রিপুরি এবং মগ জনগোষ্ঠীর মানুষজন এখানে পাশাপাশি বাস করে ৷ ত্রিপুরিরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ৷ মগরা বৌদ্ধ ৷ তবে এই জায়গাটা সম্বন্ধে তার একটা পূর্ব ধারণা ছিল ৷  তার বাবাও সাতের দশকের শেষ দিকে  এখানকার রামরতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছেন ৷ আশি সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তাঁকে রাতারাতি এলাকা ছেড়ে আসতে হয় ৷ যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সে বাড়ির লোকেরাই রাতের অন্ধকারে বনের পথ ধরে আসাম-আগরতলা সড়কে উঠিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তিনি আর এগ্রামে আসেননি কোনোদিন ৷ মাঝেমাঝে তিনি গল্প করতেন ৷ এই জায়গার কথা ৷ এখানকার লোকজনের কথা ৷ পাহাড়ের উপরের প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরের কথা ৷ ভাবতে ভাবতে আর ঘুম এলোনা ৷ বাংলোর পাশের গাছগাছালিতে পাখিদের বৃন্দগান শুরু হয়েছে ৷ স্বপ্নটা দেখার পর আর ঘুম আসেনি ৷ উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে দূরে কুয়াশাঢাকা পাহাড়ের মাথায় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে লালচে আভা ছড়াচ্ছে ৷

মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বেরোনোর পরপরই চাকরিটা পেয়ে যায় ৷ পোস্টিংও এই তাকমপাড়াতেই ৷ কদিন আগেই বাবা চলে গেছেন ৷ ক্যান্সারটা থার্ড স্টেজে ধরা পড়ে ৷ দীপ্তদের আর কিছু করার তেমন সুযোগ ছিলনা ৷ মা কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন ৷ ছেলেকে কাছে কোথাও পোস্টিং হয় কিনা চেষ্টা করতে বললেন ৷ কিন্তু দীপ্ত জানে সরকারি সুযোগ নিয়ে এমডি করতে গেলে অন্তত তিনবছর গ্রামীন এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৷ তাই সে মাকে রাজি করিয়ে এখানে পোস্টিং নেয় ৷ ধীরে ধীরে এলাকায় একটা পরিচিতিও হয়ে যায় তার ৷ হৃদয়বান চিকিৎসক হিসেবেও ৷ গরীব ও বয়স্ক রোগীদের সঙ্গে মা-মাসি, কাকা-জেঠু বলে ডেকে অসুবিধার কথা জেনে নিত ৷ চিকিৎসা করত ৷

একদিন বিকেলের শিফটে আউটডোরে বসেছে অর্ক ৷ সারিতে রোগী তেমন নেই ৷ মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে বারো থেকে চোদ্দোজন হবে ৷ রোগি দেখতে দেখতে সে সারিবদ্ধ রোগিদের দিকে তাকাচ্ছিল ৷ পরিচিতির সুবাদে দুএকজনের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করাসহ কুশলও জেনে নিচ্ছিল ৷ সে লক্ষ করছিল একেবারে শেষের দিকের একজন বয়স্ক মহিলা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই রয়েছে ৷ আর হাসছে মিটিমিটি ৷ শেষসময় যখন সে এগিয়ে এল দীপ্তর মনে হল একে যেন সে কোথাও দেখেছে আগে ৷ কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা ৷ বুড়িকে জিজ্ঞেস করল , তামঅ অংখা নিনি আমা ৷ মা তোমার কী অইছে? ইতোমধ্যে স্থানীয় ভাষাও শিখে নিয়েছে সে ৷
—কী আর আর অইবো ৷ লুমজাক ৷ জ্বর হইছে ৷
দীপ্র গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুড়ির প্রচন্ড জ্বর ৷ এটা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা ৷ কনফার্ম না হয়ে চিকিৎসা করা ঠিক হবেনা ৷ দুটো পাঁচশো এমজি প্যারাসিটামোল দিয়ে বলল, রাত্রে একটা খাইয়া লাইও খাইবার পরে ৷ জ্বর থাকলে সকালে আর একটা খাইবা  ৷ সকালে এখানে আইয়া রক্ত পরীক্ষা কইরা যাবে ৷ তারপর দরকার অইলে অষুধ দিব ৷
বুড়ি যেন দীপ্রর কথা শুনছেইনা ৷ অপলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ৷ হাসিটি লেগে রয়েছে মুখে ৷
—কি অইছে বুঝছেনি?
—ইঁ ৷ সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় বুড়ি ৷ দাক্তর, তুই কী অসিত মাসতর পোলা নি?  আচমকা প্রশ্ন করে বসে বুড়ি ৷ দীপ্রও হতচকিত হয়ে যায় ৷ তার বাবার নাম কী করে জানল বুড়ি? 
দীপ্রও জবাব দেয়, হ ৷ তুমি আমার বাবার নাম কী কইরা জানলা?
—জানে জানে ৷ নিজের মানুর নাম জানতো লাগে ৷ আমার তো ভুল অইছেনা তাইলে ৷ তুমার বাবা ভালা আছেনি?
—না ৷ তাইনে তো মারা গেছে কয়েকমাস আগে ৷
অ..অ.. ৷ লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর দেখা হইলনা ৷ খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল বুড়ি ৷ দীপ্র লক্ষ্য করল যে হাসিমুখ নিয়ে সে এতোক্ষণ দীপ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল সেই মুখশ্রী যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ৷ চোখজোড়া ছলছল ৷ দুটো অশ্রুবিন্দু দুগাল বেয়ে নেমে আসছে ৷ বাইরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে ৷ সে আঁধার যেন জীবনের শেষবেলায় উত্তীর্ণ এই বয়স্ক মহিলার মুখটাকেও ঢেকে ফেলছে ৷
—হক্কলে আমারে থকাইলো ৷ হক্কলে ৷ বলতে বলতে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধা ৷ দীপ্র হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সেদিকে ৷
ডাকবাংলোর বারান্দায় একাকী বসে রয়েছে দীপ্র ৷ সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ৷ দূরে টিলার উপরে কিছু দূরে দূরে ক্ষীণ আলোর সারি ৷ ওগুলো পার্বত্যপল্লীর টংঘরগুলোর আলো ৷ কতো দূরে অথচ কত উজ্জ্বল ৷  আজ বিকেলের ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা বারবার তার মনে উঁকি দিচ্ছে ৷ ভাবছে কাল বুড়ি রক্তপরীক্ষা করতে এলে ভালো করে জেনে নেবে সব ৷ এরমধ্যেই কেয়ারটেকার কুসুমকুমার কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ৷
—স্যার আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?  বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
—না ৷ ওসব কিছুনা ৷ বসো ৷ বলছি ৷ বৃদ্ধার চেহারা বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি চেন এই মহিলাকে?  হ্যাঁ বাবু ৷ ওতো আমাদের তিরুপতি আমা ৷ ওই যে  আলো জ্বলছে দূরে ৷ রামরতন পাড়া ৷ ওখানেই থাকে ৷ তিনকুলে কেউ নেই তার ৷ বিয়েও করেনি ৷ গ্রামের মানুষই সাহায্য সহায়তা ৷ সামান্য লেখাপড়া জানে ৷ গ্রামে ট্যুইশানি করে যা পায় তা দিয়ে চালিয়ে নেয় ৷ শুনেছি দাঙ্গার সময় তাদের বাড়িতে এক মাস্টার থাকত ৷ সে তাকে পড়াত ৷ তাদের মধ্যে একটা ভাবও হয়েছিল ৷ কিন্তু সমাজ মেনে নিতে চাইছিলনা ৷ দাঙ্গার সময় একরাতে উগ্রপন্থীরা মাস্টারকে তুলে  নিয়ে যায় ৷ তারপর আর মাস্টারের খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷ তিরুপতি আমা আর বিয়ে থা করেনি ৷ চলুন আপনার খাবার দিই ৷
— হ্যাঁ, চলো ৷

মাঝরাতে আবার স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল ৷ সেই প্রথম রাতে দেখা সেই মুখ সেই পোষাক ৷ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ আজ মনে করতে পারল তিরুপতি আমাকে কেন চেনা চেনা লাগছিল ৷ সেই তো স্বপ্নে দেখা দ্য়েছিল সেদিন ৷ আজও আবার ৷ চমকে উঠল সে একই স্বপ্ন আবার দেখে ৷
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল ৷ রাত গভীর ৷ চারদিক সুনসান ৷ গাঢ় রাতের দরজা ভেঙে একটা করুণ পাহাড়ি বিলাপ রামরতনপাড়ার অন্ধকার আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে ৷

Wednesday, June 19, 2019

চরণ ধরিতে দিয়ো গো

   দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন  বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷

সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷

একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আননোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা  অনুকূলবাবু ৷

খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
   অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷

অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন?  মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷

অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়াল ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷