লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরার সমাজ জীবনের প্রেক্ষিতে
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । এই লোকসংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যশালী শাখা লোকনাট্য । নাটক একটি অনন্য ও আকর্ষণীয় শিল্পমাধ্যম যা ভারতীয় লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে । ভারতীয় নাটকের প্রায় পাঁচহাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । প্রাচীনকালের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে নাটকের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল । আদিম কৃষি-নির্ভর সমাজে কৃষিদেবতার অলৌকিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হত । এই শ্রদ্ধাপ্রকাশ বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মানুষ নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত । সেই সব অনুষ্ঠানের আবশ্যিক অঙ্গ ছিল নৃত্য প্রদর্শন । এই নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গীত, মন্ত্র, স্তোত্র ও সংলাপ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় লোকনাট্যের । শুধুমাত্র ভারত উপমহাদেশীয় ভূখণ্ড নয় । পাশ্চাত্য নাট্যের উদ্ভব ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা একই ধরনের তথ্য পাই । পাশ্চাত্যে গ্রিসকে নাটকের জন্মস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় । 'ডাইনোসিস' ছিলেন উর্বরতা ও মদ্যের দেবতা । গ্রিসিয়য়রা আরাধ্য ঈশ্বর ডাইনোসিসকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ভক্তরা বৃত্তাকারে কোরাস নাচ করতেন ও গান গাইতেন । থেস্পিস কোরাসের একজন পরিচালক ছিলেন । তিনি কোরাসে একজন অভিনেতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং তার সাথে কথোপকথন করেছিলেন । এভাবেই প্রথমবারের মতো পাশ্চাত্য নাটকের সংলাপ ব্যবহার করা হয় । ভারতীয় নৃত্যগীতের মধ্যেও দেখা যায় ধীরে ধীরে তার মধ্যে নাট্যউপাদান সংযোজিত হতে থাকে । বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে লাঙ্গল চষা, খননকার্য, মাছ ধরা ইত্যাদির অনুকরণ নৃত্য ও সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে । এভাবেই নাটকের পরম্পরা শুরু হয় ।
ভারতীয় নাট্যকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয় । ধ্রুপদী নাট্য, লোকনাট্য ও আধুনিক নাট্য । প্রাচীন ভারতের ধ্রুপদী নাট্য বলতে ভারতীয় নাট্যসাহিত্য এবং অভিনয়কে বোঝানো হয় । প্রাচীন ভারতের ঋকবেদের ( ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) মধ্যে নাটকের উদ্ভবের সূত্র পাওয়া যেতে পারে । সেখানে সংলাপ ও দৃশ্যের আকারে অনেকগুলি স্তোত্র রয়েছে । এছাড়া ভারতীয় ধ্রুপদী নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে ধ্রুপদীনাট্যের সূচনা । সংস্কৃতভাষায় এই জাতীয় নাট্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব হয়েছে । বৌদ্ধ নাট্যকার অশ্বঘোষ রচনা করেন বুদ্ধচরিত । সংস্কৃত নাট্যকার ভাস ও অশ্বঘোষ ( খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী ) সমসাময়িক বলে মনে করা হয় । এই সময়ের অন্যান্য নাট্যকারগণ শূদ্রক ও বিশাখ দত্ত । খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকে কালিদাস রচনা করেন মালবিকাগ্নিমিত্র, বিক্রমোর্বশী, অভিজ্ঞান শকুন্তলম ইত্যাদি নাটক । নাট্যতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুপদী গ্রন্থ ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকের মধ্যে সৃষ্ট হয়েছিল বলে গবেষকগণ মনে করে থাকেন ।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি সমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল যা বাংলার সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশেষত সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন হয়েছিল । প্রথমে ইংরেজ পরিচালিত কিছু নাট্যশালায় কিছু কিছু নাটক মঞ্চস্থ হত । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত সাহেবি থিয়েটারের একটা ধারা প্রচলিত ছিল । পরে স্থানীয় বাংলা নাটকের উদ্ভাবনের পর থেকে সেগুলোর গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে । উনিশ শতকের প্রথমদিকে ইউরোপীয় নাট্যরীতিকে মান্যতা দেওয়া হলেও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রভাবশালী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেশ কিছু নাট্যশালা । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বেলগাছিয়া থিয়েটার ( ১৮৫১-৬১ ) পাইকপাড়ার জমিদারগণ তাদের বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কিছু সৌখিন নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয় । এসময় নাটক রচনা করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন কুলিনকুলসর্বস্ব ( ১৮৫৪ ) । এছাড়া তাঁর সৃষ্টি নবনাটক ( ১৮৬৬ ), রুক্মিণীহরণ ( ১৮৭১ ) প্রভৃতি ।
ইউরোপিয় নাট্যনির্মাণ কৌশলকে সাফল্যের সঙ্গে আয়ত্ব করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ( ১৮২৪-১৮৭৩ ) মৌলিক নাটক রচনা করতে শুরু করেন । তাঁর রচিত নাটক গুলির মধ্যে শর্মিষ্ঠা ( মঞ্চায়ন ১৮৫৯ ), পদ্মাবতী ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০, প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৫ ), ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি কৃষ্ণকুমারী ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬১ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৭ ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রহসনগুলির মধ্যে একেই কি বলে সভ্যতা ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৫ ), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৭ ) উল্লেখযোগ্য । মধুসূদনের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র ( ১৮৩০-১৮৭৩ ) নীলদর্পণ ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬১ ) নাটকে সমকালীন নীলকরদের অত্যাচারের চিত্র ফুটে ওঠে । উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কলকাতার বাঙালি সমাজে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সময় অসংখ্য নাটক রচনা করেন দক্ষ অভিনেতা ও পরিচালক গিরিশচন্দ্র ঘোষ ( ১৮৪৪-১৯১১ )। তাঁর জনা, প্রফুল্ল ও সিরাজউদ্দৌলা বিখ্যাত নাটক । বিশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কাহিনিনির্ভর দেশপ্রেমের বক্তব্য সম্বলিত নাটক রচনায় হাত দেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ( ১৮৬৩- ১৯১৩ )। এই সময় অপর দুজন নাট্যকার হলেন অমৃতলাল বসু ( ১৮৫২-১৯২৯ ) ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৪৯-১৯২৫ ) । তাঁদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ ) দেশজ ও ইউরোপিয় নাট্যরীতির মিশ্রণে কিছু নাটক রচনা করেন । পাশাপাশি রূপক সাংকেতিক নাট্যlরীতির উদ্ভাবকও তিনি । বিশ শতকের শুরু থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ি ( ১৮৮৯-১৯৫৯ ) মন্মথ রায় ( ১৮৯৯-১৯৮৮ ) শচীন্দ্র সেনগুপ্ত ( ১৮৯২-১৯৬১ ) বিধায়ক ভট্টাচার্য ( ১৯০৭-১৯৮৬ ) এবং আরও কয়েকজন বাংলা নাটকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন । এই সময়ের নেতৃস্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ লেখক শিল্পীবৃন্দ প্রগতিশীল লেখক সংঘ ( ১৯৩৬ ) ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ ( ১৯৪২ ) ও পরবর্তীতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ( ১৯৪৩২ ) প্রতিষ্ঠা করে সমকালীন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ও মানবিক দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন তাঁদের নাটকে । স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও বাংলা নাটকশচর্চার ধারা অব্যাহত রয়েছে । শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র প্রমুখগণ ইতিহাসচেতনা, রাজনীতি, উদ্বাস্তুসমস্যা ও জীবনবাস্তবতা নিয়ে নিরন্তর নাটক রচনা করে গেছেন ।
ভারতীয় নাটকের আরেকটি পর্যায় হল লোকনাট্য । ভরতমুণি তার নাট্যশাস্ত্রে লোকনাট্য বিষয়ে আলাদা করে কিছু না বললেও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, লোকজীবনচিত্রই হল নাটকের মূল প্রেরণার উৎস । তিনি বলেছেন যে, নাটকের সৃষ্টি বেদ থেকে হলেও তা তখনই উৎকৃষ্ট হবে যখন তার মুখ্য উপাদান 'লোক' হবে । ভরত মুনি বলেছেন, 'লোকধর্ম ভবেত্ত্বন্যা নাট্যধর্মী তথা পরা । স্বভাবো লোকধর্মী তু বিভাবো নাট্যমেব হি ।' অর্থাৎ স্বাভাবিক অভিনয় হল লোকধর্মী অভিনয় আর সভা বাতির রিক্ত অভিনয় হলো নাট্যধর্মী অভিনয় । প্রসঙ্গত ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মার দ্বারা নাটকের জ্ঞান তৈরি হয়েছিল । ব্রহ্মা তার চার হাতে চার বেদ নিয়ে ঋগ্বেদ থেকে নিয়েছিলেন সংলাপ, সামবেদ থেকে সংগীত, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ থেকে রস নিয়ে সৃষ্টি করেছেন নাট্যবেদ । একে পঞ্চমবেদও বলা হয় ।
লোকনাট্যের সঙ্গে 'লোক' ও 'নাট্য' শব্দ দুইটি জড়িত । লোকসংস্কৃতির নানা শাখার মত লোকনাট্যেরও কেন্দ্রভূমি হল লোকসমাজ। লোকসমাজের লোক শব্দটি লোকসংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বহন করে । লোকসমাজ বলতে গ্রামীণ সমাজকেই বোঝানো হয় । ইংরেজি Folk শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'লোক' ব্যবহার করা হয় । 'লোক' শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ড. অজিতকুমার ঘোষ বলেন, "'লোক' শব্দটির আভিধানিক অর্থ 'মানুষ' বা 'ব্যক্তি' হলেও বর্তমানে বিশেষ অর্থে নাগরিক মানব সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ঐতিহ্যধারাবাহী গ্রামীণ মানব সম্প্রদায়কে বোঝায় ।" আবার ডক্টর দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় 'লোক' শব্দটির অর্থপ্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন সেটি হল–'.লোকনাট্যের অন্তর্গত লোক শব্দটির বিশেষ অর্থ আছে । এর অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে লোকনাট্যকেও ঠিক বোঝা যাবেনা । একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামীণ যে মানবগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে জাতিগত একটি প্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে সেই মানবগোষ্ঠী হল 'লোক'গোষ্ঠী । লোকসংস্কৃতির এই জনপ্রিয় শাখাটি লোকজ জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত । এক কথায় 'লোক' অর্থাৎ সাধারণ মানুষজন ও অন্যদিকে 'নাট্য' অর্থাৎ অভিনয় করা । এই দুইয়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট লোকনাট্য ।
স্বরূপ :
ভারতীয় নৃত্য ও সংস্কৃতিকলারই অংশ হল লোকনাট্য ঐতিহ্যবাহিত গ্রামীণ প্রয়োগশিল্পকে নির্দেশ করে স্থানিকতার চিহ্ন ও পরিচয়বাহী দেশীয় সংস্কৃতি প্রথাসমূহ, সামাজিক অনুশাসন, জীবনশৈলী ও বিশিষ্টতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রদেশে আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ পায় । লোকনাট্য নৃত্য, সংগীত, সংলাপ, অভিনয়, সাজ ও পোশাকের সমন্বিত মিশ্রশিল্প যা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর দর্শানো হয় । লিখিত স্ক্রিপ্ট এর পরিবর্তে লোকনাট্য অভিনেতার স্মৃতিশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার উপর নির্ভর করে । তার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না । সংলাপের চেয়ে সংগীত প্রাধান্য পায় । সাধারণ মানুষের কথাবার্তা রীতিনীতি প্রতিফলিত হয় ।
ভারতীয় লোকনাট্য লোকসাধারণের মধ্যে মনোরঞ্জনের বা বিনোদনের পাশাপাশি লোকশিক্ষা ও গণসংযোগ এর ভূমিকাও পালন করে । সমাজে ধার্মিকতা, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক মান্যতা প্রদানের জন্য লোকনাট্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করে । যে কাজটি বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে করা হয় । তা সেকালে করা হত লোকনাট্যের মাধ্যমে । লোকনাট্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় । প্রাচীন মাধ্যম হলেও এর দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করতে সরাসরি আবেদন জানানো হয় ।
বিশেষত্ব :
১. লোকনাটকে সাধারণ লোকমানসের প্রতিভার সামগ্রিক বিকাশ ঘটে । এতে সম্পূর্ণ লোকমানসের প্রতিনিধিত্ব ঘটে ।
২.লোকরুচি লোকবিশ্বাস ও লোকপরম্পরা লোকনাটকের মূল আধার । লোকজীবনের প্রেম, বিরহ, বিরোধ, সহযোগ ও ধর্মীয় সংস্কৃতিক উপলব্ধির পাশাপাশি মনোরঞ্জনের ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয় ।
৩.সামাজিক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও পৌরাণিক ধর্মীয় কাহিনির বিষয়বস্তু নিহিত বার্তা অভিনয়ের মাধ্যমে লোকসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয় ।
৪. খোলা রঙ্গ মঞ্চ
৫. কোন অংক থাকে না
৬. পুরুষ প্রধান ( চরিত্রের রূপায়নে পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে । )
৭. বিদুষক বা কৌতুক অভিনেতা
৮. বিবেক ও নিয়তি চরিত্র
৯. স্থানীয় ভাষা
লোক নাটকের আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিশেষত্ব হল সময়ের সাথে এর বিকাশ ঘটে । যা আজও ঘটে চলেছে । আধুনিক লোকনাট্যকারগণ নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রূপের প্রয়োগ করছেন যাতে এই শিল্পে কোনরকম স্থবিরতা না আসে এবং আগামী প্রজন্ম এর দ্বারা উপকৃত হয় ।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে লোকনাট্যের সূত্রপাত হয় । নাটকে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার ব্যবহারের সূত্রপাতও এই সময় থেকেই শুরু হয় । প্রথমদিকের লোকনাট্যসমূহে কঠোরভাবে ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দেওয়া হত । নাটকের উপাদান সংগ্রহ করা হত ধর্মীয় কাহিনি, মিথ এবং স্থানীয় উপকথা থেকে । পরবর্তী সময়ে প্রাদেশিক লোকনাট্যগুলোর মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয় এবং ধর্মীয় বিষয়ের বাইরে স্থানীয় বীরদের বীরত্বমূলক কাহিনি এবং শৌর্য ও প্রণয়মূলক কাহিনি ও স্থান করে নিতে থাকে । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কিছু লোকনাট্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের নৌটঙ্কি, সাং, রামলীলা, কাশ্মীরের ভন্ড পথের, গুজরাট ও রাজস্থানের ভাওয়াই, মধ্যপ্রদেশের মাচ, মহারাষ্ট্রের তামাশা পোয়াদা, গোয়ার দশাবতার, আসামের ভাবনা, অঙ্কিয়ানাট, ওজাপালি, কেরালার পুডিয়াট্টম, কৃষ্ণাট্টম, মুডিয়েট্টু, কর্ণাটকের যক্ষগানা তামিলনাডুর থেরুকুথু এবং বাংলার গম্ভীরা, আলকাপ, খন বিখ্যাত । লোকনাট্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সত্বেও মূল অখন্ডতা কিন্তু স্পষ্টই ছিল । এই অখণ্ডতার মূল কারণ, লোকনাট্যের উপাদান এসেছে ইতিহাস, কাব্য, পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় দেবদেবীর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার ঐতিহ্যধারা থেকে । বিভিন্ন অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবী থাকলেও পরবর্তী সময়ে তার আর্যীকরণ ঘটে গেছে । ফলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একটা সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে ।
আধুনিক নাট্যশিল্পের আদিরূপ হল লোকনাট্য । গ্রামীণ লোকসমাজের মধ্যেই এই লোকনাট্যের উদ্ভব । যে যুগে সংস্কৃত নাটক প্রচলিত ছিল সে সময়ে সংস্কৃত নাটকের পাশাপাশি প্রাকৃত, অপভ্রংশের মাধ্যমে যে অভিনয়ধারা প্রবহমান ছিল তাই লোকনাট্যের উৎস । সে সময়ের সাধারণ মানুষের ভাষাও সংস্কৃত নাটকের অপ্রধান চরিত্রসমূহে ব্যবহার করা হত । খোলা আকাশের নীচে নৃত্য, গীত, বাদ্যের সঙ্গে এই নাটক গুলির অভিনয় চলত । সেকারণে এই নাটকগুলিতে লোকনাট্যের লক্ষণ যুক্ত ছিল । খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগে গৌড়ের রাজা ছিলেন লক্ষণ সেন ( ১১৭৮-১২০৬ ) । তাঁর রাজসভায় পঞ্চরত্নের মধ্যে জয়দেব একজন ছিলেন । তাঁর রচিত কাব্য গীতগোবিন্দম রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলাকে নিয়ে রচিত । এই কাব্যে ১২টি সর্গ ৮০টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমাবেশ রয়েছে । বৈষ্ণব সাধকদের কাছে কাব্যটি দার্শনিক মহাকাব্যরূপে সমাদৃত । শ্রীরাধার কৃষ্ণবিরহ ব্যাকুলতা ও রাধাকৃষ্ণের মিলন বিলাস বর্ণনা এই দ্বাদশ সর্গবিশিষ্ট কাব্যের কাহিনিসার । গীতগোবিন্দম মিলনান্তক ভক্তিমূলক গীতিকাব্য । জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাট্যগীতের আকারে লেখা । এই কাব্যের পাত্র-পাত্রী তিনজন । কৃষ্ণ রাধা ও সখি । এই কাব্যটি সংস্কৃতে রচিত হলেও তার ভাবধর্মে লৌকিক নাট্যধর্মিতার প্রকাশ পায়। সুকুমার সেন এই কাব্যগ্রন্থটিকে পালাগান বলেছেন এবং একে বাংলা লোকনাটকের এক বিশিষ্ট আঙ্গিক যাত্রা আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।
গোবর্ধন আচার্যের আর্য সপ্তশতীতে নৃত্য, গীত, অভিনয়ের উল্লেখ আছে । এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত । এখানে নিতম্বিনীর 'মনোহরণ' নৃত্যের কথাও রয়েছে । আরেক জায়গায় তুলনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যবনিকা অপসারিত হলে নটী এখানে প্রবেশ করে ।
প্রাচীন বাংলাসাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদে আমরা বুদ্ধনাটকের উল্লেখ পাই । প্রাচীন বুদ্ধনাটকে গান-বাজনার সাথে নাট্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল ।
জবে করহা করহকলে চাপিউ ।
বতিশ তান্তি ধনি সএল বিআপিউ ।।—এই চর্যার শেষ চরণদুটিতে দেখি–
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী
বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই । ( চর্যা ১৭ বীণাপাদ )
যখন হাতে চেপে সুর তোলা হয় তখন বত্রিশতন্ত্রী ধ্বনিতে সমস্ত ব্যক্ত হয় । নাচেন বজ্রধর । দেবী গান করেন । বুদ্ধ নাটক এইরকম বিষম হয়। এখানে বুদ্ধনাটক কথাটি লক্ষণীয় । হয়তো সেকালে নাচ গানের মধ্য দিয়ে কোনো ঘটনা বা বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনি তুলে ধরা হত । তার প্রমাণ আমরা আরেকটি পদে পাই—
এক সো পদুমা চৌখুটি পাখুড়ি
তঁহি হচড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ি
**************************
তোহোরো অন্তরে ছাড়ি নড়াএড়া ( নটসজ্জা )
চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে অথবা পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চন্ডীদাসের লেখা মধ্যযুগের একটি বাংলাকাব্য । এই কাব্যটিকে প্রাক চৈতন্য যুগের একমাত্র বাংলা আখ্যানকাব্য হিসেবে ধরা হয় । এই কাব্যেরও উপজীব্য রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি । সমগ্র কাব্যটির ১৩ খন্ডে বিভক্ত । যথা জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখণ্ড, ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত কালীয় দমনখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত বস্ত্রহরণখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত হারখণ্ড, বানখন্ড, বংশীখন্ড ও রাধাবিরহ । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তিন চরিত্র । রাধা কৃষ্ণ ও বড়ায়ি । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও অনেক অভিনয় উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেও রাধা কৃষ্ণ ও বড়ায়ি চরিত্রের সংলাপ রয়েছে । তাদের উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে নিহিত রয়েছে পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যসাহিত্যের বীজ । ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একে লোকনাট্যের আদি অবস্থা বলে মন্তব্য করেছেন । বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চতুর্থ খন্ডে তিনি বলেছেন, 'বেশধারী যাত্রা চরিত্রের ঈষৎ পূর্বাভাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মিলবে । এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে নৃত্যগীতাত্মক লোকনাট্যের পূর্ব রূপ ফুটে উঠেছিল এরকম অনুমান নিতান্ত অসম্ভব নয়। পরে যে সমস্ত কৃষ্ণযাত্রা অনুষ্ঠিত হত তাতে এ ধরনের লোকনাট্য পালাই অনুসৃত হয়েছিল ।' তাছাড়া বাংলা মঙ্গলকাব্যের গানের মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে, রামায়ণে এমন কি বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্বকথার মধ্যে, শাক্ত পদাবলীর মধ্যে নাট্যগুণের উপস্থিতি রয়েছে । মা মেনকার যে আর্তি তার মধ্যে আমরা লোকনাট্যের স্বরূপ সন্ধান করতে পারি।
পঞ্চদশ শতকের শেষ অংশ থেকে ষোড়শ শতকের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ( ১৪৮৬-১৫৩৩ ) ব্যাপক অবদান রয়েছে । তিনি নিজে যাত্রা অভিনয় করতেন বলে তার জীবনী পাঠে জানা যায় । মহাপ্রভু চৈতন্যদেব কৃষ্ণভক্তি প্রসারের কালে তাঁর যাত্রাপথে অনেক স্থানে ভজন কীর্তন এর আয়োজন করেন । এর মধ্যে লোকনাট্যের ব্যবহার করেন তিনি । তাঁর যাত্রাপথের উৎসব বা শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান বলে এর নাম যাত্রা হয়েছে বলে অনেকে অনুমান করেন । অনেকে আবার একে যাত্রা না বলে নাটকগীত বা লীলানাট্য বলে থাকেন । চন্দ্রশেখরের গৃহে চৈতন্যদেবের অভিনয়ের বিবরণ পাওয়া যায় কবি কর্ণপুর পরমানন্দ সেনের 'চৈতন্য চন্দ্রোদয়' নাটকে । ষোড়শ শতাব্দীতে প্রথম অভিনয় অর্থে 'যাত্রা' শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অসমের শংকরদেওর অঙ্কিয়ানাটে । চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে যে যাত্রার শুরু হয় তা পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সময়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শত পুষ্পে বিকশিত হয়ে ওঠে । বাংলার রঙ্গালয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আলো ঝলমল হয়ে উঠত । সে ধারাকে অনুসরণ করেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা লোকনাট্য ।
ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা । পুরাণ কাহিনিতে একে কিরাতভূমি বা পান্ডবর্জিত বলে আখ্যা দেওয়া হলেও এর প্রাচীনতার স্বীকৃতি অবশ্যই আছে । অতি প্রাচীনকালের কোন তথ্য না থাকলেও ১৮৪ জনের মত রাজাদের এই রাজ্যটিকে শাসন করেছেন তার ইতিহাস রয়ে গেছে । স্বাধীনতাপূর্বকালে ত্রিপুরা মুখ্যত রাজন্যশাসনাধীন ছিল । রাজন্য আমলের ত্রিপুরা রাজ্য সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল । মহারাজা ধন্যমানিক্য ( ১৪৯০-১৫২৯ ) সংগীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ত্রিহুত ( মিথিলা ) ও বঙ্গদেশ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে এনে তৎকালীন রাজপ্রাসাদ সংগীতমুখর করে তুলেছিলেন । তাদের স্থায়ীভাবে ত্রিপুরায় বসবাসের ব্যবস্থাও করেছিলেন । ত্রিপুরার প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালায় তার প্রামাণ্য তথ্য পাই—
ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্য গীত আনি
রাজাতে শেখায় গীত নৃত্য নৃপমনি
ত্রিপুর সকলে ক্রমে সেই গীত গায়
ছাগ অন্ত্রে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।
এ থেকে বোঝা যায় যে, রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতায় নৃত্যগীতের চর্চা থেকে থাকলে এই রাজ্যে নাট্যচর্চা অবশ্যই ছিল । বীরচন্দ্র মানিক্য ও তাঁর পরবর্তী সময়ে রাজপরিবারকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় ।
অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির কাল পর্যন্ত নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও উত্থান পতনের ফলে এর সীমানা কখনো বিস্তৃত হয়েছে আবার কখনো সংকীর্ণ হয়েছে । ফলে নানা জাতি, উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের বৈচিত্র্যময় নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করে এসেছে এখানে যুগের পর যুগ ধরে । এখানকার সংস্কৃতি প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত । ১) সমভূমির জনগণের সংস্কৃতি ও ২) পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের সংস্কৃতি । রাজন্য আমলে পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত তা সে সময়ে সমতল ত্রিপুরা, জেলা ত্রিপুরা বা চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিত ছিল । এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পরে বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যে এসে বসতি স্থাপন করে । ফলে ত্রিপুরা রাজ্যের উনিশটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবত পাশাপাশি বসবাস করে আসছে । ফলে সারা ত্রিপুরা রাজ্যেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন যাবত নিজস্ব সংস্কৃতি লালন করে এলেও দীর্ঘকালের পারস্পরিক সংমিশ্রণ বিমিশ্রণের ফলে মিশ্রসংস্কৃতির একটা ধরন এখানে লক্ষ্য করা যায় । বাঙালিরা তাদের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতি সমূহ নিয়ে বেঁচে যেমন রয়েছে তেমনি ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সৃষ্টি নিয়ে বেঁচে আছে । ফলে সারা রাজ্যে প্রায় একই ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন পরিলক্ষিত হয় শুধুমাত্র জনবিন্যাসগত কারণে তার কিছু কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা যায় । ত্রিপুরার তিনদিকেই বাংলাদেশের সীমানা থাকায় সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশীয় জনগণের কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । যেমন উত্তরে শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতি, আগরতলা বিশালগড় সিপাহীজলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের সংস্কৃতি, সোনামুড়া অমরপুর উদয়পুরে কুমিল্লার সংস্কৃতি, বিলোনিয়া শান্তিরবাজার সাবরুমে নোয়াখালী চট্টগ্রামের সাংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক বিলোনিয়া শান্তিরবাজার এবং সাব্রুম মহকুমাকে নিয়ে গঠিত হয়েছে রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা । ২০১১ সালে পূর্বতন দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করে গোমতী ও দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার নাম দেওয়া হয়েছে । উদয়পুর অমরপুর ও করবুক মহকুমাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে গোমতী জেলা । বলাবাহুল্য এই দুই জেলাতেই জনবিন্যাস ও তাদের সংস্কৃতি প্রায় একই রকম । দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা কৃষিপ্রধান অঞ্চল । এখানকার অধিকাংশ মানুষজনের জীবিকাই কৃষিকাজ । বর্তমানে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাবারের চাষ হয় । এই জেলায় বাঙালি ত্রিপুরি মগ ও চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন । তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি সুদীর্ঘকালের লোকনাট্য চর্চার ধারাও প্রবাহমান রয়েছে । দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসমাজের প্রচলিত লোকনাট্যসমূহকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় । সেগুলো হল ধর্মীয় লোকনাট্য, বিনোদনমূলক লোকনাট্য ও কৃষিকেন্দ্রিক লোকনাট্য । প্রাচীন লোকনাট্যের আঙ্গিকই এই সমস্ত লোকনাট্যে পরিলক্ষিত । আদিতে লক্ষ্য করা নৃত্য, গীত, বাদ্য, সংলাপ, অভিনয়, মূকাভিনয়, মেকআপ ও পোশাক ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায় । এখানে আবার কোনরকম উপকরণবিহীন লোকনাট্য ও দেখা যায়। লোকনাট্যের প্রধান বিষয় সংলাপ ও অভিনয়। সেক্ষেত্রে আমরা দেখি একক, দ্বৈত বা যৌথ অংশগ্রহণ । কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগীতের ভাগ বেশি থাকে । সে অনুযায়ী দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিককে আমরা লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি ।
ধর্মীয় লোকনাট্য : লীলা কীর্তন, ঢপযাত্রা, হটিকীর্তন, বুদ্ধকীর্তন, মনসা পুঁথি পাঠ, মঙ্গলচন্ডী ব্রত, সত্যনারায়ণব্রত, শিবের গাজন ইত্যাদি ।
বিনোদনমূলক লোকনাট্য : কবিগান, যাত্রা, পাল্টাকীর্তন, রাধামন ধনপুদি পালা, কুচুক হা সিকাম কামানি, লেবাং বুমানি ইত্যাদি ।
কৃষি কেন্দ্রিক লোকনাট্য : আশ্বিনের ব্রত, ধান্যপূর্ণিমার ব্রত,কার্তিকের ব্রত, মাঘস্নান ইত্যাদি ।
ধর্মীয় লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরায় লীলাকীর্তন নামে যে লোকনাট্য পরিবেশিত হয় তা ত্রিপুরার অন্যান্য অঞ্চলে পালাগান বা পালা কীর্তন নামেও প্রচলিত । লীলাকীর্তন মুখ্যত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা, গৌরাঙ্গলীলা, রামায়ণকাহিনি থেকে নিয়ে দর্শকের আসরে পরিবেশন করা হয় । এখানে একজন থাকে মুখ্য চরিত্র । তিনিই অভিনেতা, তিনিই কথক এবং তিনি গায়ক । তাঁকে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের সহায়তা করার জন্য একদল বাইন ও দোহার থাকেন । হিন্দু বাঙালিদের শ্রাদ্ধবাসরে হটিকীর্তন নামে একই ধারায় লোকনাট্যের পরিবেশনা হয় । তবে সেখানে বিয়োগান্ত ও আবেগধর্মী ধর্মীয় ও পুরাণকাহিনি পরিবেশন করা হয় । বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নিমাই সন্ন্যাস বা হরিশচন্দ্র পালা । কীর্তনের শেষভাগে কথক-অভিনেতা এমন আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যে মৃতের সন্তানাদি ও পরিজন কান্নাকাটি করে ধুলায় গড়াগড়ি যান । এভাবে শোক সংবরণ করে আবার সংসার জীবনে যোগ দেওয়ার জন্য তারা স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠেন । স্ফটিক শব্দ থেকে 'হটি' শব্দটির উদ্ভব । এছাড়া সংগীত, সংলাপ, কথকতার সাথে গীতাকীর্তন নামে একই ধরনের লোকনাট্যও এ জেলায় দেখা যায় ।
ঢপযাত্রার বিষয়বস্তু ও হিন্দুধর্মীয় কাহিনি থেকে নেওয়া হয় । তবে মুখ্যত সঙ্গীতধর্মী এই ধরনের লোকনাট্যে পাত্র-পাত্রী থাকে । তারা সংগীতের মাধ্যমেই একে অন্যের উত্তর প্রত্যুত্তর দিয়ে থাকে । সংগীতের একটা অংশ পাত্র বা পাত্রী গাওওয়ার পর আসরে উপস্থিত দোহাররা সেখানে কণ্ঠদান করে থাকে । এখানে মাঝে মাঝে সংলাপ থাকে । নৌকাবিলাস, রাধার মানভঞ্জন, সীতাহরণ, রাবণবধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঢপযাত্রা পরিচালিত পরিচালনা করা হয় ।
বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সারা শ্রাবণ মাসব্যাপী পদ্মাপুরাণ পাঠের রেওয়াজ রয়েছে । দক্ষিণ ত্রিপুরার বাঙালিদের ঘরেও সারা মাসব্যাপী পদ্মাপুরান বা মনসাপুথি পাঠ হয়ে থাকে । বিশেষত বাইশকবি মনসামঙ্গলের বিভিন্ন অধ্যায়ের পয়ার লাচাড়ি এবং ত্রিপদী অংশ সুর করে পাঠ করা হয় । মূল পাঠক এখানে একজনই থাকেন তিনি বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে বিভিন্ন প্রচলিত লোকসঙ্গীতের সুরে পদ্মপুরাণ থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করেন । তার সহযোগীরা মূল সুরটি ধরে রেখে ধুয়া তোলেন । এভাবে ক্রমান্বয়ে পাঠকের বদল করে মূল শিল্পীরা বিশ্রামের অবকাশ পান । মাঝে মাঝে এই পুথিপাঠের আসরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কোন শাস্ত্রীয় বিষয় নিয়ে সংগীতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তর্কেও অবতীর্ণ হন । চাকমাদের মধ্যে লীলা কীর্তন এর ধারায় বুদ্ধ কীর্তন করতে দেখা যায় । এছাড়া বাঙালি মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত কিছু ব্রতাচারমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লোকনাট্যের লক্ষণ পাওয়া যায় । এগুলোর মধ্যে মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, ও সত্যনারায়ণব্রত লৌকিক দেবদেবীর পূজামূলক অনুষ্ঠান । ব্রতে অংশগ্রহণ করেন অনেক মহিলা । কিন্তু ব্রতকথা পরিবেশন করেন একজন কথক । মহিলা তার বাচিকশিল্পের মাধ্যমে সম্মিলিত মহিলাদের মধ্যে তা পরিবেশন করেন । ব্রত শেষে শ্রোতারা উলুধ্বনি দেন ।
দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকনাট্যের একটি বৈচিত্রপূর্ণ আঙ্গিক হল শিবের গাজন । মনসা পূজার মতো বর্ষশেষের লোকপার্বণ শিবের গাজনও ত্রিপুরার সর্বত্রই পালিত হয় । এই অঞ্চলে চড়ক পূজাকে বলা হয় 'গাছ ঘুরানি' । আর গাজনের দলকে বলা হয় 'ঢাকির দল' । তাদের গ্রামপরিক্রমাকে বলা হয় 'ঢাকি ফিরা' । সারা চৈত্রমাসব্যাপী একজন সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে ভক্তের দল ঢাকি ফিরা করে বেড়ায় । গৃহস্থ বাড়িতে নৃত্য, গীত,লোকনাট্য পরিবেশন করে ধান, চাল, অর্থ সংগ্রহ করে । বছরের শেষ দিন চড়ক গাছ ঘুরানির মাধ্যমে তাদের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে । এই দলের প্রধান চরিত্র শিব দুর্গা ও গঙ্গা । দুর্গা ও গঙ্গাকে একসঙ্গে এখানে 'গৈরা গঙ্গা' বলা হয় । শিব দুর্গা ও গঙ্গা গৃহস্থের উঠোনে ঢাকের তালে প্রথমে নাচ করে । তারপর আরো কিছু কিছু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে লোকনাট্য পরিবেশন করা হয় । তার মধ্যে মহিষাসুর বধ, সীতাহরণ, সিন্ধুমুনির পুত্রহত্যা ইত্যাদি থাকে । পাত্র-পাত্রীগণ চরিত্র অনুযায়ী পোশাক পরেন । এই লোকনাট্যে প্রয়োজন অনুযায়ী মুখোশের ব্যবহারও থাকে । দক্ষিণ ত্রিপুরার গাজনের দলের এক বিশেষ চরিত্র পাগলী । এই চরিত্র আর কোথাও গাজনের দলে দেখা যায় না । পাগলীর পোশাক স্বতচ্ছিন্ন । ছেঁড়া জাল তার বস্ত্র । মুখে ঝূলকালি মাখা । একহাতে ঝাঁটা, অন্য হাতে পয়সার কৌটো । নাকি সুরে কথা বলে । গাজনের দলের সঙ্গে গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে নানা রকম পাগলামো করে, ঝাঁটা দিয়ে মৃদু আঘাত করে, টাকা পয়সার আবদার করে । বিদুষক ধরনের এই চরিত্রের কান্ডকারখানা গৃহস্থ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে । গাজনের দলে নারী চরিত্রগুলিতে পুরুষরাই অভিনয় করে । এককথায় পুরো গাজনের দলের নাট্যায়নে লোকনাট্যের সমস্ত লক্ষণই বিদ্যমান ।
বিনোদনমূলক লোকনাট্য : বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির ধারা কবিগান দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতিক চর্চার এক বিশেষ অঙ্গ । ধর্মীয় ও পৌরাণিক পালার বিশিষ্ট চরিত্রের ভূমিকায় উঅবতীর্ণ হয়ে দুজন শিল্পী আসরে তাৎক্ষণিক কবিতা ও সংগীত রচনার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন । প্রথমে একজন আসরে কিছু প্রশ্ন রেখে যান । পরে দ্বিতীয়জন আসরে এসে প্রশ্নের উত্তর দেন ও নতুন প্রশ্ন রাখেন । প্রশ্ন-উত্তর কালে তাঁরা চরিত্র অনুযায়ী নাটকীয়তাও প্রদর্শন করেন । দক্ষিণ ত্রিপুরার বিভিন্ন পূজাপ্যান্ডেলে প্রায়ই কবিগানের আসরের ব্যবস্থা করা হয় । কবি গান দীর্ঘ সময় ধরে চলে । এর মধ্যে কবির সরকারগণ সঙ্গীত, কথা, শাস্ত্রালোচনা, প্রশ্ন উত্তর পর্ব চালিয়ে যান । আর এক ধরনের লোকনাট্যমাধ্যম রয়েছে তার নাম পাল্টাকীর্তন । এটা কবিগানেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ । অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পীরা সংগীত ও কথার মাধ্যমে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় প্রশ্নোত্তর পর্ব চালিয়ে যান । অল্প সময়ে এটা খুব ভালো জমে । চাকমাদের এজাতীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান রাধামন ধনপুদি পালা ত্রিপুরীদের কুচক হা সিকাম কামানি, পুনদা তাইন্নাই, লেবাং বুমানি ইত্যাদি । লেবাং বুমানির নৃত্যে শস্যক্ষেত্রে লেবাং পোকা তাড়ানোর অভিনয় করা হয় বিনোদনমূলক লোকনাট্যের আরেকটি উদাহরণ হল যাত্রা । এবিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি ।
দক্ষিণ ত্রিপুরায় লোকনাট্য যাত্রার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এক সময় শীতকালে বা পূজা পার্বনের সময় প্রায় প্রতিটি গ্রামে যাত্রা অনুষ্ঠান হত । বর্তমানে বিশ্বায়নের কারণে এই মাধ্যমটিতে কিছুটা ভাঁটা পড়েছে । তারপরও এই জেলার জোলাইবাড়ি, বাইখোরা অঞ্চলে এখনো নিয়মিত যাত্রার চর্চা হয় । নটী বিনোদিনী, কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ, অর্জুন গান্ডীব ধরো ইত্যাদি পৌরাণিক পালা এখনো খুবই জনপ্রিয় ।
কৃষিকেন্দ্রিক লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকজীবনে বিশেষ কিছু লোকিক ব্রত কৃষিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় । তার মধ্যে আশ্বিনের ব্রত, ধান্যপূর্ণিমার ব্রত, কার্তিকের ব্রত, ইত্যাদিতে কৃষিজ পণ্যের ব্যবহার করা হয় । এখানেও ব্রতের কথক থাকেন । কার্তিক ব্রতে উঠোনে একটা জায়গায় ধানচারা রোপণ করা হয় । তা ব্রতের কাজে লাগে । ধান্যপূর্ণিমা ব্রতে ধানের ছড়া প্রধান উপকরণ । সেরকম মাঘস্নান ব্রতে পুকুরপাড়ে ছোট্ট একটা পুকুরের অনুকৃতি করে তার পাড়ে বসে গীত গাওয়া হয় ।
অভিনয়ের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুকরণ । লোকজীবনের এই ব্রতগুলোতে তাদের যাপনেরই বিভিন্ন বিষয়ের অনুকরণ করা হয় । আদিম শিকারজীবী মানুষ তাদের দৈনন্দিন শিকারের বর্ণনা অনুকরণের মাধ্যমে একে অন্যের কাছে ব্যক্ত করত । ত্রিপুরি উপজাতীয়দের গড়িয়া নৃত্যে তাদের জমি চাষের সমস্ত পর্যায়ে গুলি অনুকরণ করে এক একটি মুদ্রায় পরিবেশন করা হয় । সেরকম মগদের ওয়া নৃত্যে তাঁরা বৌদ্ধমন্দিরে প্রদীপ হাতে যেভাবে প্রদক্ষিণ করেন বা আরতি করেন তারই অনুকৃতি পরিবেশন করা হয় ।
কিছু কিছু লোকসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে যার মধ্যেও লোকনাটকের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । গ্রীষ্মকালে প্রবল খরায় চারদিক শুকিয়ে গেলে, বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে । সেখানেও দুটি ব্যাঙকে পাত্র-পাত্রী হিসেবে হাজির করা হয় । তাদের সাজিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় । তাও লোকনাট্য লক্ষণ যুক্ত । এই জাতীয় লোকনাটকের উৎসে জাদু বিশ্বাসমূলক অনুষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে । ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর 'লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ' গ্রন্থে লিখেছেন —'নাচ গান চিত্রকলা প্রকৃতির আড়ালে শুরুতে যেমন জাদুর সংস্কার এবং তারপর ধর্মীয় প্রতিটির অস্তিত্ব অবিসংবাদিতভাবে দেখা গেছে ঠিক তেমনি ভাবেই নাটকের উদ্ভবের প্রেক্ষিতেও ওই ব্যাপার দুটি লুকিয়ে ছিল ক্রমান্বয়ে । ( পৃষ্ঠা ২২২ ) এরকম কোনো কীর্তনের আসরে, ভোজের অনুষ্ঠানে বা মৃতদেহ দাহকার্যের সময় ধ্বনি দিয়ে নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টি করা হয় । তাও জাদুবিশ্বাসের ফল ।
লোকনাট্যের দ্বারা সমাজজীবনে আসে আনন্দের স্পন্দন । জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময় । তখনই বলা হয়, আনন্দেন ও জাতানি জীবস্তি । আজ অবশ্য লোকনাট্যের ঐতিহ্য ও চর্চা হারিয়ে যেতে বসেছে । আধুনিক বিনোদন ও নগরায়নের ফলে এই লোকশিল্প ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে । জীবন ও গতিশীল হয়ে যাওয়ার ফলে জীবিকার সন্ধানে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে । যার ফলে শিল্পচর্চার মধ্যে সময় দেওয়ার ফুরসত আজকের লোকসমাজের নেই । তরুণ প্রজন্মও স্থিতিশীল পেশার তাগিদে গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহরে ছুটছে । এই জাতীয় লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা ও সামাজিক সমর্থন অনেক কমে যাওয়ায় গ্রাম জীবনের এই সমৃদ্ধ কারুশিল্প আজ বিলুপ্তি ও ঝুঁকির সম্মুখীন ।
এত কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আজও এই ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি তার সৃজনশীলতার গুণে এখনো বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ক্ষীণ ধারায় হলেও টিকে আছে ।
**********************************
সহায়ক তথ্য :–
১. বাংলা লোকসাহিত্য ( প্রথম খন্ড ) –আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. লোকসংস্কৃতির পাঠের ভূমিকা– তুষার চট্টোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ– ডঃ পল্লব ভট্টাচার্য
৪. বাংলার লোকসাহিত্যচর্চার ইতিহাস– বরুণ কুমার চক্রবর্তী
৫. লোকঐতিহ্যের দর্পণে– মানস মজুমদার
৬. ভারতের লোকনাট্য– ডঃ ধ্রুব দাস
৭. ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি– অশোকানন্দ রায়বর্ধন
৮. ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির উৎসসন্ধান ও বিষয়বিন্যাস– অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।
৯. চর্যাপদ–অতীন্দ্র মজুমদার
১০. বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন– অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
১১. যাত্রাগানের যাত্রাকথা ( প্রবন্ধ )–তপন বাগচী
১২. গ্রামীণ লোকনাটক– পুষ্পজিত রায়
১৩. বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ– বরুণকুমার চক্রবর্তী