Thursday, October 10, 2024

প্রগাঢ় বিশ্বাস

প্রগাঢ় বিশ্বাস


আসলে সাপলুডো নয়, চরাচরে ঝরছে কালো হলাহল 
ঘরেও বাইরে ঝরা পাতার মত উড়ে আসছে বিষ ।

যেখানেই বসতঘড়ি উপরের ছানি উড়ে যায় বারবার 
তীব্র রোদ, বৃষ্টির জল, ঝড়ের হাওয়ায় নড়ে বিশ্বাসবোধ ।
বুকে জড়ানো বর্মে জং ধরে । নিমেষে ভেঙে পড়ে যায় 
রাতের আঁধারের মতো সময় । ঋতুহীন কাটে বিষন্ন কাল ।

অনাথ বাতাস করুণ দোলায় কাঁপিয়ে দেয়
কোথা যায় নদী একাকী ? শ্মশান বন্ধু  নেই তার ।অক
 ক্রমশ শরীরে প্রস্থ কমে কমে অদৃশ্য হতে বাকি নেই ।
অচিন মাঝি সন্ধ্যার আঁধারে নৌকা নিয়ে পথ ভুলে যায়
 পলকা জলের ভেতর চাঁদ ঢুকে গেলে ঢেউ দুলে ওঠে ।

নোনাজল, পলি আর নুড়িবালি সব ইতিহাস জানে ।
তাদের ছোটো ছোটো বুকে লেখা আছে সব দিনলিপি 
এই গ্রামদেশেও বেদনায় আহত কবি লেখেন রক্তকবিতা 
সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কখন আদিগন্ত 
সোনালি গালিচাতে একাকার হবে সারাদেশ

 দুচোখে এক প্রগাঢ় শ্বাস নিয়ে জাগে মায়ার পলক ।

Tuesday, September 24, 2024

কোভিড পরবর্তী শরীরের যত্ন

কোভিড পরবর্তী শরীরের যত্ন

 নিয়মিত শরীরচর্চা, ধ্যান, নির্মেদ শরীর, নেশামুক্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন, সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকা, ক্রোধ সংবরণ, শরীর সম্পর্কে উদাসীন না থেকে নিয়মিত চেক আপ করিয়ে বিধিবদ্ধভাবে জীবনযাপন ও মনের প্রশান্তি শরীরকে অনেক সুস্থ রাখবে । অতিরিক্ত মাংসভক্ষণের ও পানীয়সেবনের অভ্যাস দূর করতে হবে । পাশাপাশি মোবাইল ফোনের ব্যবহার কম করতে হবে । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড ভ্যাকসিন গ্রহণকারী তরুণদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় দুর্ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে । দায় এড়াবার উদ্যেশ্যে তাৎক্ষণিক আবিস্কৃত কৌভিড ভ্যাকসিনের কুফল প্রকাশ্যে আসছে না । একটু ভারিক্কি শরীরের তরুণদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে ।

Monday, August 26, 2024

ধরগো তোরা, হাতে হাতে ধরো...

ধরগো তোরা, হাতে হাতে ধরগো...

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

হড়পা বানের নাম শুনেছিলাম। এবার চাক্ষুষ করলাম আমরা । দেখলাম গোটা রাজ্য কিভাবে তছনচ হয়ে যায় তার ভয়াল তান্ডবে । প্রকৃতির এই উদ্দাম মত্ততায় আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশও উপদ্রুত । কাঁটাতারের ওপার থেকেও ভেসে এসেছে হাহাকার । আমরা জল আর পানিতে ভাগ করি । কিন্তু তার তো কোনো সীমানা নেই । খেপে গেলে সে সসাগরার দখল নিতে চায় । আমরা প্রকৃতিকে চিনি না । প্রকৃতির রুদ্ররোষের খবর জানি না । যে প্রকৃতি আমাদের সবকিছু দেন তাঁকে আমরা ধ্বংস করি । তাঁর বুক টেনে চিরে ফেলি । প্রকৃতি সহ্য করতে করতে একদিন ফুঁসে ওঠেন ক্রোধে । প্রতিশোধের হাতিয়ার নামিয়ে দেন জনপদে । 

পৃথিবীতে যখন মানবতার সংকট দেখা দেয়, যখন মানুষের লোভ গগনচুম্বী হয়ে ওঠে, মনুষ্যত্ব বিপন্ন হয় তখনই প্রকৃতি জেগে ওঠে মানুষকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন । মানষের ঘুমিয়ে পড়া বিবেককে জাগানোর জন্য প্রকৃতি মাঝে মাঝে তার আয়ুধ প্রয়োগ করেন । আর তাতে মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । প্রতিবেশিকে আপন মনে হয় । দুঃখে, দুর্দৈবে, দুর্দিনে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ লাগাতে ইচ্ছে হয় । একে অন্যকে সাহস জাগাতে ইচ্ছা হয় । প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াতে সাধ জাগে । আবার এসময়ে আসল বান্ধবকেও চেনায় । পরিচয় হয় সৎ প্রিয়জনের সঙ্গে । এবারের বন্যায় প্রকৃতি আমাদের সে পাঠ দিয়ে গেছেন । কিভাবে আর্ত মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়িয়ে পড়ে তা আমরা দেখেছি । আর্ত মানুষ এবারে দেখেছেন সাংসদ না থাকুক সজ্জন, সৎ জন, প্রিয়জন তাঁদের পাশে আছেন । একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় থেকে আমরা অন্যপ্রদেশের দুর্যোগে আমাদের সাধ্যমতো সম্বল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি । আর আমাদের দুর্দিনে সেই প্রিয় প্রতিবেশিদের দেখলাম হিমশীতল প্রতিক্রিয়ায়, মধ্যরাতের নীরবতায় । আবার এমন প্রতিবেশীও দেখলাম যারা অকারণ অন্ধ অজ্ঞ দোষারোপ করে শুধু চিলচিৎকার করে গেছে এই দুঃসময়ে । এরা নিজেদের দুর্দিনেও ত্রাতা হবার যোগ্যতা অর্জন করেনি । একদিন বোধ হবে এদের । এরা নিজের দেশের বিপন্নদের সেবায়ও লাগেনি । শুধু কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে ফাঁকা আওয়াজ করে গেছে । কারো প্রতি ক্ষোভ নেই আমাদের ।  বরং এইসময়ে আমরা নিজেরা পরস্পর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি । নিজেরা নিজেদের চিনতে পেরেছি । শুধু একরাশ নীরব অভিমান আর ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে আমরা আবার আমাদের সংসার গড়ব ।

জল কমে গেছে অনেকটা। পলিবিছানো প্রলয়ভূমির উপর নিথর হয়ে থাকা বাস্তুভূমিতে কপর্দকহীন অশ্রুসম্বল বন্যার্তরা ফিরছেন । যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত বিষাদভূখন্ডে ফিরছে সর্বহারা ভূমিপুত্রকন্যারা । এবারে সংকট দেখা দেবে খাদ্য ও পানীয় জলের । ঘরে রাখা খাদ্যশস্যসহ সব ফসল মাঠে মারা গেছে । কৃষকের ঘরের আয়ের উৎস শেষ । অপেক্ষা করতে হবে নতুন ফসল আসা পর্যন্ত । 

এই আর্তসময়ে সরকারের নিকট আমার বিনীত আবেদন, আগামী ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি আর্ত পরিবারে বিনামূল্যে রেশনসামগ্রী বিলির ব্যবস্থা করা হোক । ধান ও অন্যান্য শস্যবীজ ও সার-ঔষধের ব্যবস্থা করা হোক বিনামূল্যে। ততদিন পর্যন্ত হাতখরচা হিসেবে নিয়মিত কিছু আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক । শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় ও অসুস্থদের তালিকাভুক্ত করে তাদের যথাযথ পরিষেবার আওতায় আনা হোক । একা সরকারের পক্ষে সবদিক রক্ষা করা সম্ভব নয় । হৃদয়বানগণ ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরাও আর কটাদিন পাশে থাকুন । বিশ্বাস আমরা আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবই ।

শিল্পী তাঁর কল্পনা, মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে তাঁর শিল্পকে নান্দনিক করে তোলেন । তাঁর সৃজন বিপর্যস্ত হলে ক্ষুব্ধ হন তিনি । পরিত্যক্ত শিল্পের উপর আবার বোলান তাঁর চারুতুলি । প্রকৃতিও তেমনি । তাঁর এই বিধ্বংসী তান্ডবের অন্তরালেই রয়েছে সৃজনের বীজ । যা তিনি নিয়েছেন দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবেন আমাদের । কারণ আমরা প্রকৃতির সন্তান । তিনি শুধু শাসন নয় । সোহাগও আমাদের করবেন ।

Saturday, August 10, 2024

আমাদের অমৃতকাল অতিক্রম ও কবিতায় স্বদেশভাবনা

আমাদের অমৃতকাল অতিক্রম ও কবিতায় স্বদেশভাবনা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

স্বদেশপ্রেম মনুষ্যচরিত্রের একটি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য । মানুষ পৃথিবীর অধিবাসী হলেও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং সেখানে বেড়ে ওঠে । তার পরিচয় হয় একটা বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে । সেটাই তার জন্মভূমি তার মাতৃভূমি এবং তার স্বদেশ । সে দেশের মাটি আলো বাতাস জলে তার জীবন বিকশিত হয় । তার ফলে সেই ভূখণ্ডের প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ তৈরি হয় । এই আজন্ম আকর্ষণ থেকে সেই ভূমির প্রতি মানুষের অনুরাগের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় বা তার প্রতি একটা প্রেম ভালোবাসা তৈরি হয় তাকেই স্বদেশপ্রেম বলা হয় । নিজের দেশ জাতি এবং মাতৃভাষার প্রতি তীব্র মমত্ববোধ ও আনুগত্যই দেশপ্রেম । যার দেশের প্রতি গভীর উপলব্ধি এবং ভালোবাসা থাকে তিনিই দেশপ্রেমিক । দেশপ্রেমিক দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । একজন দেশপ্রেমিক মানুষ নিজের কথা না ভেবে পরের মঙ্গলের জন্য বা দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য আত্মোৎসর্গ করে থাকেন । মহৎ মানুষের চিন্তা কর্ম সবসময় সমাজকেন্দ্রিক ও দেশকেন্দ্রিক । তাঁরা সবসময় দেশ ও জাতি ও সমাজকে নিয়ে দেশের কল্যাণ সাধনা সম্পর্কে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন । সমাজের মানুষের মধ্যে সব ধরনের মানবিক গুণাবলি জাগিয়ে তোলার স্পৃহা থাকে দেশপ্রেমিকের মনে । একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক যেমন দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তেমনি সাহিত্য শিল্পকলা ও অন্যান্য নন্দনচর্চার মাধ্যমেও দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব । সাহিত্যসৃজনের ক্ষেত্রে স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করে সাহস শক্তি সৌন্দর্য ও মহিমা । সাহিত্যস্রষ্টা ও শিল্পী তার সৃজনের মাধ্যমে নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিপন্ন করেন এবং দেশের মানুষের মধ্যে উদার মানবপ্রেমিক মানবিক গুণাবলিসহ দেশপ্রেমের ভাবধারা সঞ্চারিত করেন । স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরও একটি অংশ । স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমের এক মহৎ উপলব্ধি ও মানবিক জাগরণ ঘটে থাকে । পৃথিবীতে বহু বীর বিপ্লবী ত্যাগী এবং মহৎ দেশপ্রেমিক এসেছেন । সেই সঙ্গে এসেছেন বহু দেশপ্রেমিক কবি ও সাহিত্যিক । প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার দেশ সকল দেশের সেরা এবং সব দেশের রানি ।

দেশপ্রেম একটি আবেগ । আবেগ সাহিত্যের বিভিন্ন ধারাকেও পুষ্ট করে । কবিতায় দেশপ্রেমের আবেগ থেকে সৃষ্টি হয় দেশপ্রেমের কবিতা । সেই সব কবিতায় দেশপ্রেমের প্রতি গভীর মর্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায় । দেশপ্রেম জাগানিয়া কবিতা বাংলাকবিতাকেও সমৃদ্ধ করেছে । ভারতবর্ষের অন্তরে মাতৃভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ বৃদ্ধি করে স্বদেশপ্রেম সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারত মহাকাব্য ছাড়াও গীতা, উপনিষদ, পুরাণ-উপপুরাণ ইত্যাদির বাণী আর দর্শনের প্রভাব অতি প্রাচীন । 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী' ( রামায়ণ, লঙ্কাকাণ্ড ) অর্থাৎ জননী জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও শ্রেষ্ঠ । রামায়ণের এই মহতবাণীর আবেদন প্রতিটি ভারতবাসীর প্রাণে প্রাণে প্রাচীন শাস্ত্রে ভারত ভূমি প্রশস্তি করা হয়েছে পূণ্যভূমি ও কর্মভূমি রূপে গীতার কর্মযোগে উল্লিখিত 'মরিলে স্বর্গ তরিলে দেশ' বাণী স্বদেশপ্রেমেরই অমল উৎস । তদুপরি বিভিন্ন পুরাণ উপ-পুরাণে বর্ণিত কাহিনি ও প্রতিষ্ঠিত দর্শনে ভারতীয়দের প্রাণে জুগিয়ে আসছে জন্মভূমির যশ, মান বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য আত্মোৎসর্গের প্রেরণা । 

বাংলা কবিতায়ও বিভিন্ন সময়ে কবিরা দেশপ্রেমের আবেগসংবেদী কবিতা রচনা করে গেছেন ।  দেশপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ তাঁদের কবিতা আমাদের বাংলাকাব্যের সম্পদ হয়ে রয়েছে । প্রাচীন বাংলাকাব্যের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে আমরা সেখানেও স্বদেশভাবনার কিছু কিছু প্রমাণ পাই । বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ বা চর্যাগীতিকায় বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যরা সেসময়ে যে পদগুলি রচনা করেন তার মধ্যে স্বদেশভাবনা এখনকার মত এতটা স্পষ্ট ছিল না । তাই আজকের দিনের মত দেশভাবনার উজ্জ্বল প্রকাশ তখনকার কবিতায় এতটা প্রতিফলিত হয়ে ওঠেনি । তাঁদের কবিতায় তাঁরা তাঁদের বসতভূমি ও ভূখণ্ডের প্রকৃতির কথা কিছু কিছু তুলে ধরেছেন । সেটা দেশপ্রেম না হলেও দেশ পরিচিতি হিসেবে  কিছুটা  আভাস পাওয়া যায়– উঁচা উঁচা পাব তহি বসই শবরী বালী । / মৌরঙ্গী পিচ্ছ পিরিহিন শবরী গীবত গুঞ্জরী মালী । এখানে তাদের বাসভূমির অর্থাৎ স্বভূমির পরিচয় পাওয়া যায় । 'নৌবাহী নৌকা টান অ গুণে'– সরহপাদের এই পদটিসহ বিভিন্ন পদে তৎকালীন নদীমাতৃক বাংলার ভূপ্রকৃতি, জলপথে যাতায়াত বা যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠেছে ।

চর্যার কবিদের মতো মধ্যযুগের কবিদের কাব্যেও স্বদেশের ধারণা আধুনিক কালের কবিদের মতো ততটা স্বচ্ছতা নিয়ে আসেনি । তা কখনো নিসর্গের মধ্যে ব্যস্ত আবার কখনো প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে স্বদেশকে । কখনো বা মাতৃভাষাকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে স্বদেশ প্রীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগের অন্যতম কবি আব্দুল হাকিমের নূরনামা কাব্যের ' বঙ্গবাণী' কাব্যাংশে দেখা যায়– 'যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী । / সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি ।। / দেশী ভাষা বিদ্যা যায় মন ন জুয়ায় । /  নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় ।। /  মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি । / দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি । আব্দুল হাকিম ছাড়াও মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় সরাসরি না হল প্রচ্ছন্নভাবে স্বদেশপ্রেম স্থান লাভ করেছে । মধ্যযুগের সর্বশেষ বড় কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বাংলাদেশের বর্ণনা ও গুণগান করেছেন । তাঁর আগে আলাওল এবং পরে রামনিধি গুপ্তের কবিতায় স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় । মধ্যযুগের শেষে ও আধুনিক যুগের প্রথমদিকে অর্থাৎ যুগ ও সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর গুপ্ত জন্মভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন তার স্বদেশ প্রীতি ও জন্মভূমি কবিতায়ই সর্বপ্রথম স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে । ' জানো না কিন্নর তুমি / জননী জন্মভূমি / যে তোমার হৃদয়ে রেখেছে ।।/  থাকিয়া মায়ের কোলে / সন্তানের জননী ভুলে / কে কোথায় এমন দেখেছে?

উনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র ভারতে জাতীয়তাবাদের ভাবনার বিস্তার ঘটেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী কালে উপনিবেশিকবাদের অবসান সমগ্র পৃথিবীতে এক অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণ করে । ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছর ধরে ইংরেজ উপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল । এদেশে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লব ইংরেজ শাসককে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছিল । সে সময়ে সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নাটকে, কবিতায় ইংরেজ শাসকের স্বৈরাচারী দিকটি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । সেই সাথে সাধারণ জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা জাগ্রত হয়েছিল । ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় রচিত একটি বন্দনাগীতি একদিকে জাতীয়তাবাদকে উদ্বুদ্ধ করতে যেমন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল পাশাপাশি ইংরেজ উপনিবেশিকতাবাদের ভিতকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল । পৃথিবীর সব দেশে সর্বযুগে প্রকৃত লেখকরা তাঁদের সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকেন । মধুসূদনও ( ১৮২৪– ১৮৭৩ ) দক্ষতার সাথে এটিকে ধারণ করে নিপুণ হাতে অনবদ্য সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করেছিলেন । তাঁর রচনায় স্বদেশভাবনা ঐকান্তিক রূপে বিকশিত হয়েছিল । স্বদেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ সুদূর ভার্সাই নগরীতে বসে লেখা 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি উজ্জ্বল নিদর্শন । তাঁর সৃষ্টিতে পৌরাণিক ভাবনার মধ্যে যুগচেতনার সুচিত্রিত প্রকাশে স্বদেশভাবনা পূর্ণতা লাভ করেছে । এই সময়ের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৩৮–১৯০৩ ) রচনা করেন বৃত্রসংহার ( ১৮৭৫–৭৭ ) । তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না একজন একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিকও ছিলেন ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তার রচনা 'বীরবাহু' কাব্যে তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন । ১৮৭৫ সালে 'পলাশীর যুদ্ধ' মহাকাব্য প্রকাশিত হলে কবি নবীনচন্দ্র সেন ( ১৮৪৭–১৯০৯ ) ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন স্বজাতিবোধ ও স্বদেশানুরাগ ছিল তাঁর কাব্যের মূল সুর যা তাঁর কবিত্ব শক্তিকে উদ্দীপিত করেছিল । নবীনচন্দ্রের চিন্তাভাবনা অনেক পরিমানে বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিল ।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটি রচনা করেন । তাঁর অকৃত্রিম মানবতাবোধ থেকে উঠে এসেছে দেশপ্রেম । জগতের আনন্দযজ্ঞে ভারতীয়ত্বের শুভ সূচনার বিশ্বায়ন ঘটেছে রবীন্দ্রনাথেরই হাত ধরে । আধুনিক দুনিয়ার বিশ্বায়নের স্থায়ী ছাপ রেখেছে তার স্বদেশভাবনা। তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় দেশের মানুষ জাতীয় সংগীত গেয়ে ওঠে–'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে / ভারত ভাগ্য বিধাতা । তিনি উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন– হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে / এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে' ।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম ( ১৮৯৯–১৯৭৩ ) এক বিস্ময়কর প্রতিভা । তাঁর কাব্যভুবন নানা রঙে, নানা বর্ণে রঞ্জিত । বহু ভাবনা তাঁর কাব্যের অঙ্গনের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে । তাঁর শক্তিশালী কাব্যভাবনার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্বদেশপ্রেম । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ কবিতাসমূহ দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেম উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিল । তাঁর অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফনিমনসা ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তার উজ্জ্বল উদাহরণ । তাঁর বিদ্রোহী, কান্ডারী হুঁশিয়ার, আমার কৈফিয়ত, আগমনী ইত্যাদি কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ পেয়েছে । কবি নজরুলের কবিতায় দেশাত্মবোধের পাশাপাশি মানবপ্রেম ও প্রকাশ পেয়েছে । পরাধীন ভারতবর্ষে সংগঠিত স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুল দেশবাসীকে সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্র দীক্ষিত করেন । আসন্ন স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন গভীর আশাবাদী । দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি উচ্চারণ করেন–'ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর / উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার'  ( কান্ডারী হুশিয়ার ) ।

দেশভাগের যন্ত্রণা এবং উদ্বাস্তুজীবন বাংলাকবিতায় এক নতুন ধারার জন্ম দেয় । ইতিহাসের চেতনার সঙ্গে দেশবিভাজনের ট্রমাতাড়িত মানুষের জীবনের তীব্র ট্রাজেডিকে ঘিরে গভীর অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে সেইসময়ের কবিতায় । দ্বিজাতিতত্ত্বের খাঁড়ার ঘায়ে ভাগ হওয়া রাষ্ট্রের যে যন্ত্রণা আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে শুরু হয়েছিল তা যেন আজও এই ভূখণ্ডের মানুষের পিছু ছাড়ছে না । সেই যে স্বাধীনতার তাৎক্ষণিক ঘোষণায় 'বাংলার লক্ষ্য গ্রাম নিরাশার আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল ( ১৯৪৬–৪৭ / জীবনানন্দ দাশ ) তা অতি সম্প্রতিক মুহূর্তেও কুটিল দংশন করতে ছাড়ছে না । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত 'পূর্ব-পশ্চিম', 'উদ্বাস্তু' কবিতায় দেশভাগের যে যন্ত্রনা ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপমহাদেশের ভূখণ্ডে তা কিছুদিন পরপরই যেন ঘুরে ফিরে আসে ।স্বাধীনতার কালের সময় থেকে বাংলাকবিতা দেশভাগ ও দেশত্যাগ স্মৃতিকাতর হয়ে উচ্চারিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় । ঘুরে ফিরে এসেছে দেশভাগ তার 'যদি নির্বাসন দাও', ,জনমদুখিনী, 'দুঃখের গল্প' 'সাঁকোটা দুলছে' কবিতাগুলোতে । স্মৃতিকাতরতায় কবিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে । শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ও দেশভাগ,জন্মভূমি, উদ্বাস্ত জীবন এক বিশেষ অনুষঙ্গ । দ্বিখন্ডিত দেশের বেদনায় রয়েছে দেশপ্রেমের নিহিত পাতাল ছায়া । খন্ডিত ভূখণ্ডকে নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচার ভাবনা এসেছে সেই সব কবির চেতনায় যাঁরা দেশবিভাগ দেখেছেন কাছে থেকে । যাঁরা তার শিকার হয়েছেন । তাঁদের কবিতায় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাত প্রভাব পড়েছে । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায়, মিহির দেব, স্বপন সেনগুপ্ত, দিলীপ দাস প্রমুখের কবিতায় দেশভাগ এবং নতুন দেশের অনুভূতি নতুন দেশকে ঘিরে স্বপ্ন,  প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বেদনা ইত্যাদি ফুটে উঠেছে নতুন ধারার কবিতায় ।

নতুন জন্ম নেওয়া দেশ, নতুন ভূখণ্ড, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো প্রাদেশিক চেতনাকে নিয়ে সম্মিলিত দেশাত্মবোধ, স্বদেশপ্রেম নতুন মাত্রায় দেখা দিয়েছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে । তাঁদের পূর্বসূরী দেখিয়ে দেন সেই পথ । নতুন দেশভাবনার পাঠ দেন উত্তর-পূর্বের শ্রেষ্ঠ কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী– 'যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সেই করেছে ভয় / আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয় / হিংসাজয়ী যুদ্ধে যাব আর হবেনা ভুল / মেখলা পরা বোন দিয়েছে একখানা তাম্বুল ! / এবার আমি পাঠ নিয়েছি আর কিছুতে নয় /  ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় / বাংলা আমার আই ভাষা গো বিশ্ব আমার ঠাঁই, / প্রফুল্ল ও ভৃগু আমার খুল্লতাত ভাই ।' এখানেই রয়েছে নতুন স্বদেশচেতনার বোধ । বহভাষাভাষী মানুষের বহুত্ববোধের ভাবনা । বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সহানুভূতি ভ্রাতৃত্ববোধ ও বোঝাপড়া গড়ে তোলার এবং তাদের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা থাকে স্বাধীন ভারতবর্ষে । 

স্বদেশ প্রেমের স্বরূপ হল নিজের দেশের জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রেম সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেম ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার মাধ্যমে মাতৃভূমির বিভিন্ন বিষয়ে সুরক্ষার প্রচেষ্টা । সেই চেতনায় আজকের কবি লেখেন– 'একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে জেগে উঠছে অন্য পৃথিবী । / মাঠের ভেতর সাধারণ একটা কুয়ো, কিভাবে আজও আমাদের হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে । ( জালিয়ান ওয়ালাবাগ/ সৌমিত বসু ) । আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের এক নৃশংস ঘটনাকে প্রতিটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে কবি দেশের স্বাধীনতাকে জেগে ওঠার কথা ব্যক্ত করছেন, 'একটা কুয়োর ভেতর যদি ঢুকে পড়ে গোটা পাঞ্জাব কিংবা গ্যালন / গ্যালন রক্ত,/  ঠিক তখনই জেগে উঠে ফিনিক্স পাখিরা, / আশ্চর্যভাবে ডানা মেলে জন্ম নেয় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী / হাজার হাজার মানুষের বুকে এঁটে থাকা ঘৃণ্য বুলেট, সমস্ত গা বেয়ে / গড়িয়ে পড়া গরম কুমকুম । / আজও আমি অবাক হয়ে দেখি একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসছে উন্মুক্ত কৃপাণ / একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে জেগে উঠছে ভারতের স্বাধীনতা । । ( জালিয়ানওয়ালাবাগ সৌমিত বসু ত্রিধারা আগস্ট ২০২২ ) । দেশ ভাবনায় স্নাত হওয়া আরেক কবি লেখেন– 'শোনো লোলিতা, যার মা নেই সে পরাধীন–তার আগুনে / আলো নেই / তার চোখের জলে আগুন নেই / কেবল আলো ডাক পাওয়ার জন্য অনেক অযুত নিযুত / অন্ধকার তাকিয়ে আছে । / আগামী বলে দেবে কবিতার ভিতরে কতটা নক্ষত্র ছুঁয়ে / মাকে জড়িয়ে আছে মূলে / হে ভারত হে ভার্গব গীতবিতান আমার ! ( আলোগান / সুনীল মাজি, জলপাই দ্বীপের আলো, ব্লগজিন, আশ্বিন, ১৪২৮ ) । এই সময়ের কবির কাছে 'দেশ আসলে তোরণের মতো যেখানে লেখা থাকে / ওয়েলকাম / পতাকার ছায়ায় খুব নিবিড় হয়ে দেশ ঘুমোয় । / নির্জন সাঁকোতে বাঁশি বাজতে থাকে । / জাতীয় পশু ও জাতীয় পাখি থাকা মানে একটা / দেশ থাকা / দেশজুড়ে হাওয়া গানের সুরে ডুবে যেতে যেতে / আমি কেবল দেশ আঁকি, মানচিত্র আঁকি । (দেশ / সুবীর সরকার,ত্রিধারা, আগস্ট ২০২২ ) ।

ধীরে ধীরে স্বাধীন ভারতবর্ষ ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেছে । ১২ মার্চ ২০২৩ থেকে দেশ জুড়ে পালিত হয়েছে আজাদী কা অমৃত মহোৎসব । স্বাধীনতাযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করা, উপলব্ধি করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ভার তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের পাঠ নেওয়া এই উৎসবের নিহিত বার্তা । নতুন প্রজন্ম আজ দেশের প্রধান মুখ । সাহিত্যে তাদের দেশভাবনা কিভাবে কতটা প্রকাশিত হচ্ছে তাও আজ আলোচনার বিষয় । অনেকে বলছেন, আজকের প্রজন্ম শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছে । নিজস্ব উন্নতি, প্রতিষ্ঠার পেছনে তারা নিজেকে নিয়োজিত রাখছে । দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যে তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে । আসলে কিন্তু তা নয় । নতুন প্রজন্মের সৃজনে, কবিতায় প্রতিফলন ঘটছে স্বদেশপ্রেমের । পূর্বজদের ভাবনা, তাদের দেশভাগের যন্ত্রণা, ইতিহাস চেতনাকে আধার করে এই প্রজন্মের কবিরা তাদের সৃষ্টিকে তুলে ধরেছেন । তারা স্পষ্টই জানেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা কিভাবে এসেছে । তাঁদের বোধে রয়েছে 'শীততাপ বিছানা ছেড়ে বনবাদাড়কে করেছিলে বালিশ /কাবুলি, কাগজ-ওয়ালার কষ্টরূপ নিয়ে খুঁজেছ মুক্তির পথ–/  সয়েছ বুটের ঘা, গারদের কামড়, সহযোগীর কষ্ট করুণ চোখের ভাষা / জানি / পঁচাত্তর বছর মানে সাড়ে সাতষট্টি হাজার দিন আমাদের বোধোদয়ে / নেহাত কম নয়; ( অধিনায়ক, দুই / চন্দন পাল, ত্রিধারা ২০২১ ) । আর এক কবি উচ্চারণ করেন, 'আশ্বিনের প্রতীক্ষার শেষে সোনাঝরা সকাল / বেড়িয়ে আসি পাখিদের সাথে ধান শির শিস দেখে /  বুনো পাখি জানে এ ধান তার, আমি জানি আমার / এক মুঠো ধান হতে শত মুঠো ধানে খুঁজি আমি-/  অমিয় মাতৃদুগ্ধ, পাখি খোঁজে জীবন বেনামী । / আর গেয়ে উঠি পাখিদের সাথে মনের কথা / ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা ( অমিয় মাতৃদুগ্ধ / রাজীব পাল, ত্রিধারা, আগস্ট ২০২১ ) । এই সময়ের শক্তিমান মেধাবী ও অগ্রজ কবি লেখেন, ১. ঋত্বিক ঘটকের / বঙ্গবালার মুখের মতো চাঁদ /  লিখেছি প্রেমের পত্রে, / স্বাধীনতা, তুমি / বলেছিলে, যেন / গান্ধীর হাতে ভাঙা বাংলা অক্ষরের / ছাঁচ ! ২.  ভালবাসা পেলে সব /লন্ডভন্ড করে যাব না, বরং লণ্ডভণ্ডকে দেব / বিদগ্ধ সৃজন । / যেদিকে চোখ যায়, যাব না / যাব না বরং সৃষ্টিকে পায়সান্ন করে খাব / সম্পন্নের মতো ( দুটো মন্ত্র / মিলন কান্তি দত্ত, জলপাই দ্বীপের আলো, ব্লগজিন, আশ্বিন ১৪২৮ ) । কবির বার্তা এখানে ধ্বংসাত্মক নয় । বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদের মতো তিনি মানচিত্র ছিঁড়ে খাবার আগ্রাসী ক্ষুধা প্রদর্শন করেন না । তিনি বরং বিদগ্ধ সৃজনের কথা বলেন । কবি সত্যজিৎ দত্তের উচ্চারণেও এরকম স্বাধীন ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে । 'পতাকা উড়ছে দিব্যি এখন / দিনে এবং রাতে / ঘর চাইলাম, কাপড় দেহে /ভাত চাইলাম পাতে / হাত রয়েছে জোড়া জোড়া / কাজ চাইলাম হাতে / পতাকা উড়ছে দিব্যি এখন / দিনে এবং রাতে ( পতাকা / সত্যজিৎ দত্ত, ত্রিধারা, আগস্ট, ২০২২ ) । চলমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভেই শুরু হয়েছে স্বিধীনতার অমৃতকাল । এই সময়ের নবীন কবিদের কবিতায় কালের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সময়ের গমনকে তাঁরা অনুসরণ করেন তাঁদের কবিতায় । এই প্রজন্মের কবিদের কাছে 'দেশ বলতে কেবল মানচিত্র নয় / শুধুই দেশের মাটি নয় / ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটিয়ে যাদের রোজগার / বরফের চাদরে যারা সীমান্ত রক্ষা করে / বর্শা নিক্ষেপ করে শত কোটি মানুষের / লজ্জাকে সম্মানে বদলে দেয় / এরাই তো গর্বের দেশ, দেশের প্রকৃত কান্ডারী ।' ( দেশপ্রেম / রঞ্জিত রায়, ত্রিধারা, আগস্ট ২০২১ ) । এই সময়ের কবি স্পষ্টভাবেই বলেন– 'পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত রক্তে এখনো কিছু বিন্দু বেঁচে / আছে দেশপ্রেম, /  টগবগে করা স্নায়ু, চোখে জল গড়াতেই চোখ খুলে দেখি / পতাকার মাঝে ভারত মা বিশ্বাসের চোখে আহবান করছে/ যাকে আমি সেদিন ছত্রিশগড়ের দন্তে বাড়ায় দেখেছি মোমবাতি হাতে / বলছে– / এসো আমার অমৃতপুত্র, সূর্যসন্তান, আমি জানি আমার অস্তিত্ব বাঁচাতে / প্রাণ দিতে এবং নিতে তোমরা পিছপা হবে না কখনো । ( সেই দিন পুলবামাতে / অমিত সরকার / । অতি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন প্রতিনিধিস্থানীয় কবীদের কবিতায় দেখছি দেশপ্রেম বা দেশ ভাবনা নানা আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে—

১. বিপ্লবীদের স্বপ্ন সত্যি হোক, /  আমাদের হাত ধরে । / স্বাধীন গান গাইব তখন / স্বাধীনতার তরে । ( স্বাধীনতা কাগজের বুকে / সম্রাট শীল ) ।
  ২. শতাব্দীর জনরোলে নন্দিত হয় বীর শহীদদের আত্মা, / বেজে ওঠে নম্র শপথ, তোমাদের রক্তঋণ ভোলার নয় । / আমাদের প্রতিটি রোম কুপিয়ে ভালোবাসার পরশ / সূর্যস্নাত ভোরের পুণ্য আলোয় বেঁচে থাকুক শহীদেরা ( বীর শহীদ / গোপাল বণিক ) ।

৩. দেশ মানে শহীদের রক্তরাঙা /  স্বাধীনতার সূর্য / দেশ মানে একতার মন্ত্র গাথা / আমার ভারতবর্ষ ( দেশ মানে / পিংকু চন্দ ) ।

৪. বয়স্ক কাঁটাতারে তর্জনী ছোঁয়ালেই /  কোথা থেকে যেন ভেসে আসে বিপ্লবের গর্জন, / আমার বন্য সুখের নির্জনতায় /  কফিন ভর্তি স্বদেশীদের যুদ্ধের সূত্র লুকিয়ে... / আর আমার মানচিত্রে ইতিহাস গড়তে / ঘর দখল করেছে আগামীর সুভাষ ( ঘর দখল পলাশ পাল ) ।
    ৫. তেরঙার মাথায় আগুন বরণ বাঁধা / সে আগুন বুকে নিয়ে জাগো / যজ্ঞের ভারতের উজ্জ্বলতা পুনর্জাগরণে  । /  যতই হোক জমাট বাধা দুর্গন্ধবেদীমূলে / উত্তরে তেরঙ্গা উজ্জ্বলতায় সাহস ও স্বপ্ন পাই ( তেরঙার বেদীমূলে / পঙ্কজ কান্তি মালাকার / ।

৭. স্বর্গের দেশ ঘুমিয়ে আছে বুকের উপর / নিশ্চিন্তে শ্বাস নিচ্ছি শান্তিপুরে / ভেতরে আমি অহংকারী ভাবি / ভারতের রক্ত গোটা শরীরজুড়ে ( জীবননদী / রাহুল শীল ) ।
৮. দেশপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে; / আজীবন থাকতে চাই দেশে । /  ভালবাসতে চাই এই দেশকে । / মৃত্যুর পরেও যেন ফিরতে চাই নানারূপে ( ফিরতে চাই দেশে / সুরমা আকতার ) ।

দেশাত্মবোধক কবিতার মধ্য দিয়ে যে আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের দৃঢ় অনুভূতি প্রকাশ পায় তা বর্তমান প্রজন্মের কবিদের মধ্যেও সমানভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে । কবিতায় দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশভাবনা ও দেশপ্রেম প্রদর্শনের মাধ্যমে কবি মিশে যেতে পারেন দেশের প্রকৃতি ও মাটির অফুরন্ত গুণ ও সৌন্দর্য আহরণে । প্রকৃত দেশপ্রেমের কবিতা শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের থাকে না । তা হয়ে ওঠে সত্যিকারের বিশ্বমাত্রার কবিতা । কবি ও পান বিশ্বমাতৃক পরিচিতি । এই প্রজন্মের কবিদের কবিতায় আমাদের দেশের স্বাধীনতাযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, দেশরক্ষায় অতন্দ্র সৈনিকের লড়াইকে ঘিরে দেশাত্মবোধক কাব্যসৃজন এদেশের মাটি ও নিসর্গ সৌন্দর্যকে আবর্তন করে মুখর হয়ে ওঠে । অতি সাম্প্রতিক কবিদের সৃজনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার স্বপ্ন যা তাদের আজন্ম অর্জন । সময়ের প্রতিঘাতে বাংলাকবিতায় বহু বাঁকবদল ঘটেছে । আমাদের কয়েক দশকের হতাশাদীর্ণ কবিতা অতিক্রম করে সমকালের কবিরা আবার তাঁদের শব্দ কুশলতা ও ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায় দেশপ্রেম প্রকাশের বৈচিত্র অনুভব করছেন । এও এক আশার সৃজন ।

Thursday, July 11, 2024

অশোকানন্দ রায়বর্ধনের পরিচয়পঞ্জী

আমার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী ও সাহিত্যকর্ম
১) নাম : অশোকানন্দ রায়বর্ধন
২) বাবাi ও মার নাম : প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন, ঊষারানি বর্ধন
৩) জন্মের তারিখ : ১১ জানুয়ারি, ১৯৫৬

৫) পেশা : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক
৬) শিক্ষাগত যোগ্যতা : বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও বিএড 
৭) সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
জীবনের প্রথম পাঠ শুরু ডিব্রুগড় শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ প্রতিষ্ঠিত অখণ্ডমণ্ডলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । পরবর্তী সময়ে বাবার চাকরির সুবাদে ত্রিপুরার পেচার‌থল, বক্সনগর,কুলাইসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ধলাই জেলার কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন  ( ১৯৭৩ )। বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় ( অধুনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয় ) থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছেন । ১০৭৯ সালে সহকারী শিক্ষক হিসাবে সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন । পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানশিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করেন জয়কুমার রোয়াজা পাড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয় এবং উত্তর দৌলবাড়ি উচ্চ বনিয়াদী বিদ্যালয়ে । ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং সরাসরি বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে যথেষ্ট  নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন ।


৮ ) সাহিত্যকর্ম : 

সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের মুখপত্র 'আন্তর'-এ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর লেখালেখি শুরু । নবম শ্রেণিতে পাঠকালীন বিদ্যাiukলয়ের মুখপত্রের সম্পাদনার দায়িত্ব পান । কবি হিসেবে পরিচিতি শুরু হলেও তিনি রাজ্যের একজন সাহিত্যসমালোচনা ও সমাজবিষয়ক প্রবন্ধরচনাকার । লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষণাকর্মে রত ।ইতোমধ্যে তাঁর বহু কবিতা, গল্প ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশের ও দেশের বাইরে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে ইতোমধ্যে ভারতে ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকটি  সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি । এই বয়সেও সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক 
ইতিহাস নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও লেখালেখিতে রত আছেন। নিজের গবেষণা সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও রাজ্যের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষকের গবেষণাপত্র রচনা ক্ষেত্রে ক্ষেত্রসমীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি ।সংশ্লিষ্ট গবেষকগণও তাঁদের গবেষণাপত্রে তাঁর সাহচর্য বিষয়ে বেশ যত্ন সহকারে উল্লেখ্য করেছেন । সেই সুবাদে সম্প্রতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষিকা ইশিতা ভৌমিকের গবেষণাপত্রের সহতত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব ও পালন করেছেন তিনি । 
তিনি নাটক লেখা ও অভিনয়েও দক্ষ ।জীবনে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন । নাটক লিখেছেন । নাট্যকর্মশালায় প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন । 'ভাঙন' ও 'রাঙামাটির পথে' নামে ত্রিপুরার দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন ।
রেছেন ।বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছেন । তিনি ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটির উপদেষ্টামন্ডলীরও অন্যতম সদস্য । সামাজিক কাজকর্ম, সাহিত্যসৃষ্টি ও গবেষণাকর্মের মধ্যে ডুবে থেকেই তিনি তাঁর বর্তমান অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন ।

৯) প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা :

    ক) ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), ভাষা, আগরতলা ২০০২ 
    খ) বিনীত চুম্বন ( কবিতা ),  89স্রোত, কুমারঘাট, ২০০৭ 
     গ) ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ সন্ধান ও বিষয়বিন্যাস ও বিষয় বিন্যাস (প্রবন্ধ ), স্রোত, কুমারঘাট ২০১৩ 
      ঘ) ত্রিপুরার মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ সম্পাদনা ), স্রোত, কুমারঘাট, ২০১৬
i        চ ) জোছনার হাওরে বলিরেখা ( কবিতা ), ত্রিধারা, ২০২২ 
        ছ )  অন্তরে দহন অনন্ত ( মুক্তগদ্য ), ত্রিধারা, ২০২৩ 
         জ ) কুসুমে কুসুমে রেখে যাওয়া চরণচিহ্ন :99 ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের ১২৫ বছর ( প্রবন্ধ ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঝ ) ফেনী নদীর প্রত্নকথা ও মানুষের উপখ্যান ( আঞ্চলিক ইতিহাস ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঞ ) ত্রিপুরার লোক ধর্ম ও লোকাচার ( প্রবন্ধ ) অন্যপাঠ , ২০২৩

১০)  সম্মান,পুরস্কার ও স্বীকৃতি :

           ক ) অগ্রণী পুরস্কার, বিলোনিয়া, ত্রিপুরা ১৯৭৫
           খ ) সংবাদ সাহিত্য পুরস্কার, আগরতলা, ১৯৯৫ 
            গ ) লোকসংস্কৃতি সম্মাননা, মনুবাজার,২০১৫
             ঘ ) সাহিত্য সম্মান– তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, ত্রিপুরা সরকার ২০১৭
            ঙ ) সমভূমি সাহিত্য সম্মান, বাইখোরা,  দ. ত্রিপুরা ২০১৭
             চ ) সৃজন সাহিত্য সম্মান, ইসলামপুর, উত্তর দিনাlজপুর, প. বঙ্গ, ২০১৮
             ছ ) স্রোত রজতজয়ন্তী প্রকাশনা উৎসব সম্মাননা, সুকান্ত একাডেমি আগরতলা, ২০১৯ 
             জ ) বনতট সাহিত্য সম্মান, কাঞ্চনপুর, উত্তর ত্রিপুরা ২০২০ 
             ঝ ) দেবদ্বীপ সম্মান, শান্তির বাজার, ২০২২ 
              ঞ ) গবেষক সংবর্ধনা, ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ, উদয়পুর ২০২৩
              চ ) বরিষ্ঠ সাংবাদিক সম্মাননা, ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, আগরতলা, ২০২৪
               ছ )ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মাননা, বিশ্ব বাঙালি সংসদ বাংলাদেশ, ঢাকা ২০২৪
               জ) সৃষ্টি সাহিত্য সম্মান ২০২৪, সৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকা, নলুয়া বিলোনিয়া ।

এছাড়া জাতীয় শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসের 'প্রজেক্ট গাইড' হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান ২০০৩ প্রাপক ।

Thursday, June 13, 2024

'মধ্যাহ্নে' কবিতার পাঠগ্রহণ

আমি তিয়াত্তর সালের ওল্ড হায়ার সেকেন্ডারি ( নবম,দশম,একাদশ ) । অক্ষয়কুমার বড়ালের 'মধ্যাহ্নে'  কবিতাটি আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল । গল্পকার মানিক চক্রবর্তী ও দেবতোষ চৌধুরী ( জুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ) ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষক । ক্লাশ টেনে মানিক স্যর অসাধারণ বর্ণনায় পড়াতেন কবিতাটি । ইলাভেনে রিভিশনের সময় দেবতোষ স্যর আবার পড়িয়েছিলেন। আজো মনে আছে ।

Friday, May 3, 2024

সরস্বতী ও কুন্তী : কিছু কথা 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সরস্বতী ও কুন্তী দুটোই নদী । পশ্চিমবঙ্গের হুগলির সপ্তগ্রামের কাছে ত্রিবেণীর শ্মশান‌ঘাটের পাশে সরস্বতী নদী গঙ্গায় মিশেছে । একসময় সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল । তেমনি পূর্বভারতে সপ্তগ্রাম বড়ো বাণিজ্যবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল । এই তিন নদীকে কেন্দ্র করে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য । কলকাতার আগেই সপ্তগ্রাম ছিল বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্র । বাংলার প্রাচীন জনপদ ও পবিত্র স্থান হল এই ত্রিবেণী । ব্যান্ডেল জংশন থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত এখানে গঙ্গা-কুন্তী ও সরস্বতীর মিলন ঘটেছে । প্রয়াগের সরস্বতী নদী অন্তঃলিলা । আর হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গা-সরস্বতী মুক্ত । এই স্থানকে বলা হয় মুক্তবেণী ।  সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাই– 'মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে / আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে ।' ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান হিন্দুদের পবিত্র কৃষ্টি । দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত ধোয়ীর  'পবনদূতম' কাব্যে এর উল্লেখ রয়েছে । মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই স্থানকে 'তিরপানি' ও 'ফিরোজাবাদ' নাম দিয়েছেন । ফিরোজ শাহ কিছুকাল এখানে রাজত্ব করেছিলেন । ত্রিবেণীতে মুসলমান আমলের কীর্তি 'জাফরখান মসজিদ' রয়েছে । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখেছেন– 'বামদিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী / যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি ।' হুগলির ত্রিবেণীও প্রয়াগরাজেরই সংস্করণ । তথ্য বলে, ১৩০৯ সালে শেষবার মাঘী পূর্ণিমায় কুম্ভস্নান হয়েছিল এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে মুসলিম আক্রমণের পর বা ইংরেজ আমলে এই ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে কানাডার নৃতত্ত্ববিদ তথা ইতিহাসবিদ অ্যালান মরিনিস ( জন্ম- ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ) অক্সফোর্ডে জমা দেওয়া গবেষণাধর্মী কাজের  সূত্রে এই তথ্য প্রকাশ করেন যে, কয়েকশো বছর আগে ত্রিবেণীতে হত কুম্ভমেলা বা কুম্ভস্নান ( Kumbh Mela in Tribeni ) । হুগলি জেলার কুন্তীঘাট বা চন্দ্রহাটি বিড়লা মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুন্তী নদী । এ নদীও ত্রিবেণীতে মিলিত হয়েছে । কুন্তী দামোদরের একটি শাখা নদী । প্রাচীন ভৌগোলিক তথ্য ব্লেভের মানচিত্র ( ১৬৫০ ) অনুসারে দামোদরের একটি ফ্লোজ মাধ্যম প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ নদী নয়াসরাতে অগ্নি নদীর পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ত্রিবেণীতে যোগদান করেছে । গেস্টাল্ট এর মানচিত্র ( ১৫৬১ ) অনুযায়ী দামোদরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদী কুন্তীনদী, যা মিলিত হয় সাতগাঁওয়ের কাছে । তিনটি নদীর মিলনস্থল বলেই জায়গাটার নাম ত্রিবেণী । একসময়ের বাণিজ্যকেন্দ্র সরস্বতীনদীর সঙ্গমস্থল আজ পরিত্যক্ত । কারণ নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে । শুধু জোয়ারের সময় একটা ক্ষীণধারার সৃষ্টি হয় ।  কুন্তীনদীর স্রোতধারা এখনও বহমান । জোয়ারের সময় তার দুকূল ভরাট হয়ে যায় । তখন নদীকে অনেক বিস্তৃত দেখা যায় ।
এছাড়া দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশেও কুন্তী নামে একটি নদীর অবস্থান জানা যায় । কুন্তীনদী  কেরালার সাইলেন্ট ভ্যালির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।