Friday, September 12, 2025

লোকসংসকৃতির উন্নিদ্র প্রহরী ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুমের একজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেঙ্গাফ্রু মগ । তিনি ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সাব্রুমের মনুবাজারের দক্ষিণ কালাপানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম প্রয়াত অংগিয় মগ ও মা প্রয়াতা নিবাইফ্রু মগ । তিনি মনু এইচএস স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন এবং এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন । ১৯৭৮ সালে সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন । ১৯৮৩ সালে বিলোনিয়া কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাস করেন । ১৯৯১ সালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন একজন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে তিনি ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের শিক্ষাদপ্তরে চাকরিতে যোগদান করে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে ২০০২ সালে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন । দীর্ঘদিন সুনামের সাথে শিক্ষকতা করার পর ২০১৯ সালের ৩০ শে নভেম্বর মনু উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন । তাঁর অসাধারণ কণ্ঠসুষমার জন্য তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সংগীতের ক্ষেত্রে ও বিশেষ সুনাম অর্জন করেন । রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরে তিনি সংগীত পরিবেশন করে ভুয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । মগ জনজাতির সংগীত, নৃত্য ও লোকসংস্কৃতির একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব তিনি । তাঁর নিজের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান 'ফোক কালচারাল একাডেমি'র মাধ্যমে তিনি লোকনৃত্য, মনিপুরী নৃত্য ইত্যাদির চর্চা ও প্রসার ঘটিয়ে চলেছেন । ঐতিহ্যবাহী মগ লোকনৃত্যকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে । তাঁর গুরু নীরেন্দ্রনাথ আচার্জির মতো তাঁরও অসংখ্য গুনমুগ্ধ শিক্ষার্থী রয়েছে । জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি সংগীত ও নৃত্য চর্চার মাধ্যমেই সুকুমারচর্চা করে দিন যাপন করছেন ।

Thursday, September 4, 2025

'ত্র্যহস্পর্শ'– লুপ্ত 'অ'

'ত্র্যহস্পর্শ' শব্দের উচ্চারণ

উচ্চারণটা হবে 'ত্রঅস্পর্শ' (ত্রয়স্পর্শ ) ।  মূল শব্দটি ত্র্যহস্পর্শ । এখানে সন্ধির নিয়মের মাধ্যমে শব্দটি গঠিত হয়েছে । ত্রি+ অহ+ স্পর্শ = ত্র্যহস্পর্শ । তিনটি তিথি যেখানে স্পর্শ করেছে । স্বরসন্ধির নিয়ম অনুসারে পূর্বপদের 'ই' ও পরপদের 'অ' মিলে 'য' ফলা হয়েছে । বাংলা উচ্চারণে 'য' ফলাটি উহ্য হয়ে যায় । সংস্কৃত শব্দ বাংলা লিপিতে হ এর মতো একটি বর্ণ লেখা হয় এবং এই 'হ' বর্ণটি লুপ্ত 'অ' বর্ণ বলে পরিচিত হয়েছে । যেমন- 'সোহহম' ( সোঅহম ) । লুপ্ত 'অ' বর্ণটি অর্ধমাত্রাযুক্ত হ বর্ণ দিয়ে বোঝানো হয় । এটিকে হ এর মতো উচ্চারণ করা ঠিক হবে না । বাংলাবর্ণমালায় এই বর্ণটি নেই । তবে সংস্কৃত বর্ণমালায় রয়েছে এবং তার ব্যবহারও রয়েছে । এই লুপ্ত 'অ' এর উচ্চারণ 'হ' উচ্চারণ করতে যতটা জোর বা শ্বাসাঘাত হয় ততটা হয় না । অনেকটা 'অ' এর মতো বা তার চেয়ে কম জোর দেওয়া হয় ।

Wednesday, September 3, 2025

অশোকানন্দ রায়বর্ধনের পরিচয়পঞ্জী

আমার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী ও সাহিত্যকর্ম
১) নাম : অশোকানন্দ রায়বর্ধন
২) বাবাi ও মার নাম : প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন, ঊষারানি বর্ধন
৩) জন্মের তারিখ : ১১ জানুয়ারি, ১৯৫৬

৫) পেশা : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক
৬) শিক্ষাগত যোগ্যতা : বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও বিএড 
৭) সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
জীবনের প্রথম পাঠ শুরু ডিব্রুগড় শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ প্রতিষ্ঠিত অখণ্ডমণ্ডলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । পরবর্তী সময়ে বাবার চাকরির সুবাদে ত্রিপুরার পেচার‌থল, বক্সনগর,কুলাইসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ধলাই জেলার কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন  ( ১৯৭৩ )। বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় ( অধুনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয় ) থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছেন । ১০৭৯ সালে সহকারী শিক্ষক হিসাবে সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন । পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানশিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করেন জয়কুমার রোয়াজা পাড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয় এবং উত্তর দৌলবাড়ি উচ্চ বনিয়াদী বিদ্যালয়ে । ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং সরাসরি বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে যথেষ্ট  নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন ।


৮ ) সাহিত্যকর্ম : 

সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের মুখপত্র 'আন্তর'-এ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর লেখালেখি শুরু । নবম শ্রেণিতে পাঠকালীন বিদ্যাiukলয়ের মুখপত্রের সম্পাদনার দায়িত্ব পান । কবি হিসেবে পরিচিতি শুরু হলেও তিনি রাজ্যের একজন সাহিত্যসমালোচনা ও সমাজবিষয়ক প্রবন্ধরচনাকার । লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষণাকর্মে রত ।ইতোমধ্যে তাঁর বহু কবিতা, গল্প ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশের ও দেশের বাইরে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে ইতোমধ্যে ভারতে ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকটি  সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি । এই বয়সেও সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক 
ইতিহাস নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও লেখালেখিতে রত আছেন। নিজের গবেষণা সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও রাজ্যের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষকের গবেষণাপত্র রচনা ক্ষেত্রে ক্ষেত্রসমীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি ।সংশ্লিষ্ট গবেষকগণও তাঁদের গবেষণাপত্রে তাঁর সাহচর্য বিষয়ে বেশ যত্ন সহকারে উল্লেখ্য করেছেন । সেই সুবাদে সম্প্রতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষিকা ইশিতা ভৌমিকের গবেষণাপত্রের সহতত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব ও পালন করেছেন তিনি । 
তিনি নাটক লেখা ও অভিনয়েও দক্ষ ।জীবনে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন । নাটক লিখেছেন । নাট্যকর্মশালায় প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন । 'ভাঙন' ও 'রাঙামাটির পথে' নামে ত্রিপুরার দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন ।
রেছেন ।বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছেন । তিনি ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটির উপদেষ্টামন্ডলীরও অন্যতম সদস্য । সামাজিক কাজকর্ম, সাহিত্যসৃষ্টি ও গবেষণাকর্মের মধ্যে ডুবে থেকেই তিনি তাঁর বর্তমান অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন ।

৯) প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা :

    ক) ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), ভাষা, আগরতলা ২০০২ 
    খ) বিনীত চুম্বন ( কবিতা ),  89স্রোত, কুমারঘাট, ২০০৭ 
     গ) ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ সন্ধান ও বিষয়বিন্যাস ও বিষয় বিন্যাস (প্রবন্ধ ), স্রোত, কুমারঘাট ২০১৩ 
      ঘ) ত্রিপুরার মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ সম্পাদনা ), স্রোত, কুমারঘাট, ২০১৬
i        চ ) জোছনার হাওরে বলিরেখা ( কবিতা ), ত্রিধারা, ২০২২ 
        ছ )  অন্তরে দহন অনন্ত ( মুক্তগদ্য ), ত্রিধারা, ২০২৩ 
         জ ) কুসুমে কুসুমে রেখে যাওয়া চরণচিহ্ন :99 ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের ১২৫ বছর ( প্রবন্ধ ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঝ ) ফেনী নদীর প্রত্নকথা ও মানুষের উপখ্যান ( আঞ্চলিক ইতিহাস ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঞ ) ত্রিপুরার লোক ধর্ম ও লোকাচার ( প্রবন্ধ ) অন্যপাঠ , ২০২৩

১০)  সম্মান,পুরস্কার ও স্বীকৃতি :

           ক ) অগ্রণী পুরস্কার, বিলোনিয়া, ত্রিপুরা ১৯৭৫
           খ ) সংবাদ সাহিত্য পুরস্কার, আগরতলা, ১৯৯৫ 
            গ ) লোকসংস্কৃতি সম্মাননা, মনুবাজার,২০১৫
             ঘ ) সাহিত্য সম্মান– তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, ত্রিপুরা সরকার ২০১৭
            ঙ ) সমভূমি সাহিত্য সম্মান, বাইখোরা,  দ. ত্রিপুরা ২০১৭
             চ ) সৃজন সাহিত্য সম্মান, ইসলামপুর, উত্তর দিনাlজপুর, প. বঙ্গ, ২০১৮
             ছ ) স্রোত রজতজয়ন্তী প্রকাশনা উৎসব সম্মাননা, সুকান্ত একাডেমি আগরতলা, ২০১৯ 
             জ ) বনতট সাহিত্য সম্মান, কাঞ্চনপুর, উত্তর ত্রিপুরা ২০২০ 
             ঝ ) দেবদ্বীপ সম্মান, শান্তির বাজার, ২০২২ 
              ঞ ) গবেষক সংবর্ধনা, ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ, উদয়পুর ২০২৩
              চ ) বরিষ্ঠ সাংবাদিক সম্মাননা, ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, আগরতলা, ২০২৪
               ছ )ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মাননা, বিশ্ব বাঙালি সংসদ বাংলাদেশ, ঢাকা ২০২৪
               জ) সৃষ্টি সাহিত্য সম্মান ২০২৪, সৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকা, নলুয়া বিলোনিয়া ।
               সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ( ত্রিপুরা সরকার ) ২০২৪

এছাড়া জাতীয় শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসের 'প্রজেক্ট গাইড' হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান ২০০৩ প্রাপক ।

Wednesday, May 28, 2025

MY PENSION FROM = APRIL 2025

FOR FEB21 : BP=40500 DA=00 COMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 : DA (8% )=3240 REC=00
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=37940
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=40500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 00 COMM = 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NET = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

FROM JAN24 : BP=40500 : DA ( 25% )= 10125 REC =<00 COMM = 6300 DID=00 IR = 00 OLD = 00 FMA= 500 TDS = 00 NET = 44825

FROM NOV24 : BP = 40500 : DA ( 30% ) = 12150 : REV = 00 COMM : 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 NET = 46850

FROM APRL25 : BP = 40500 : DA ( 33% ) = 13365 : REV = 00 COMM : 6300 : DID = 00 : IR = 00 : OLD = 00 : FMA = 500 : TDS = 00 : NET = 48065/-

Sunday, May 4, 2025

রবীন্দ্রসৃষ্টিতে পূর্ববাংলার ভাষা, জীবন ও কৃষ্টিসংস্কৃতির প্রভাব

রবীন্দ্রসৃষ্টিতে পূর্ববাংলার ভাষা, জীবন ও কৃষ্টিসংস্কৃতির প্রভাব

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯–১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর ও কালিগঞ্জ অঞ্চলে কবির জীবনের ২৮ থেকে ৪০ বছর সময়কালের ১২ বছর অতিবাহিত করেন । পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে বিয়ের দুদিন আগে ২২ অগ্রাহায়ন ১২৯০ বঙ্গাব্দে একটি চিঠিতে তার পূর্ববঙ্গের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করেন । সেই চিঠিতে তিনি লেখেন–'এইক্ষণে তুমি জমিদারীর কার্য পর্যবেক্ষণ করবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিল বাকি ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তাহার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ ।' ( রবিজীবনী, তৃতীয় খন্ড, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. ২০০৯ । পৃষ্ঠা ১১৯ ) । তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ২২ বৎসর সেই থেকে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার জমিদারি সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন । রবীন্দ্রনাথের জীবনপঞ্জি অনুযায়ী দেখা যায় যে আরও প্রায় ছয় বছর পরে তার আঠাশ বছর বয়সে ১৮৮৯ সালের ২৮শে নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন । ( তদেব ) ।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে শিলাইদহপর্ব তাঁর কল্পনার জগতকে সমৃদ্ধিদানের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে । শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর ও কালীগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ লেখালেখির উৎকর্ষতার সুযোগ পান । রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের সৃষ্টিকে গবেষকগণ শিলাইদহপর্ব বলে আখ্যায়িত করেন । এখানে এসে তিনি পরিচিত হন গ্রাম বাংলার উদার শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে । এখানকার পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, নাগর, বড়াল ও ইছামতি নদী তাঁকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডেকেছে । সর্বোপরি এখানকার দরিদ্র চাষি জনগণের জীবন দেখেছেন তিনি খুব কাছে থেকে । তাদের চিরক্রন্দনময় জীবন দেখে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন । তিনি লিখেছেন–'কেবলই ভাবছি আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা । আমার যৌবনের আরম্ভ কাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট পরিচয় হয়েছে । তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ ছিল দেখাশোনা–ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে । আমি জানি ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে, ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পৌছয়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয় ।' ( রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্ররচনাবলী, পৃষ্ঠা ৬৮৩ ) ।

পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল অবিনাশী । পদ্মার তরঙ্গ-বিভঙ্গে নৌকায় ভেসে ভেসে তিনি নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন এ অঞ্চলের শান্ত শ্যামল পল্লীপ্রকৃতি ও সহজ সরল প্রজাসাধারণ ও তাদের জীবনযাত্রা । রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ পর্বে সৃষ্টি হয়েছে সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কথা, কাহিনী, কল্পনা, কণিকা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য ইত্যাদি ঐশ্বর্যময় কাব্য সম্ভার । 'সোনার তরী' কাব্যে পদ্মার তীর, বর্ষার বন্যা, নৌকা, চর ক্ষেতের ফসল, চাষির জীবন, নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি । 'সোনার তরী' কবিতায় ১) গান গেয়ে তুলিবে কে আসে পারে দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ২ ) রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা ৩ ) পরপারে দেখি আঁকা তরু-ছায়া মুসলিম মাখা, গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাতবেলায় ৪ ) ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা  ইত্যাদি পংক্তিতে পদ্মাতীরের নয়নমুগ্ধকর চিত্র ফুটে উঠে ।

'চিত্রা' কাব্যের বিষয়বস্তু সৌন্দর্যবোধ হলেও গ্রামীন চাষিজীবনের সংকট ফুটে উঠেছে 'এবার ফেরাও মোরে' কবিতায় । দরিদ্র চাষিদের সংকটমোচনের জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন–'এইসব মূঢ় ম্লান মুখ মুখে / দিতে হবে ভাষা–এইসব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা–' । 'চৈতালি' কাব্যে পদ্মাকে নিয়ে রয়েছে কবিতা, 'হে পদ্মা আমার /তোমায় আমায় দেখা শত শত বার ।' 'কথা' ও 'কাহিনী' কাব্যে বারবার এসেছে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের কথা । 'দুই বিঘা জমি'র উপেন মিথ হয়ে আছে । এর কাহিনি নাকি রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল । এই কবিতায় তিনি পূববাংলার পল্লীপ্রকৃতির একটি চিত্র তুলে ধরেন–'ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি / পল্লব ঘন আম্রকানন রাখালের খেলা গেহ / স্তব্ধ অতল দিঘি কালো জল নিশীথ শীতল স্নেহ / বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে / মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে ।' ক্ষণিকা কাব্যেও রয়েছে নিসর্গ ও মানুষ । 'আষাঢ়' ও 'নববর্ষা' কবিতায় বর্ষার গুরুগম্ভীর রূপ প্রকাশ পেয়েছে । 'নৈবেদ্য' কাব্য প্রকাশের সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন । নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ঈশ্বরোপলব্ধির ভূমিকা প্রধান থাকলেও বাংলার দিগন্তপ্রসারী উদার প্রকৃতির প্রভাবও রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টিতে ।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের ৯৪টি গল্পের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গল্প তিনি রচনা করেছেন শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে অবস্থানকালে । গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত সুখদুঃখ, আশানিরাশা, কৃষ্টিসংস্কৃতির জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাঁর ছোটোগল্পসমূহে । পূর্ববাংলায় বসে লেখা তাঁর গল্পগুলোতে বাংলাদেশের শ্যামল সুন্দর প্রকৃতি, অজ্ঞ, অসহায়, অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি জমিদারি শাসনের নেতিবাচক শৃংখলে পর্যুদস্ত জীবনচিত্র ও প্রতিফলিত হয়েছে । তাঁর রচিত 'ছুটি', 'পোস্টমাস্টার', 'সমাপ্তি', 'দেনা পাওনা' 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' ইত্যাদি গল্পে কৃষক, গৃহিণী, দরিদ্র প্রজা, জমিদারের কর্মচারী, এমনকি গ্রামীন বালকের জীবন সংগ্রাম দুঃখ-কষ্ট নিঃসঙ্গতা ও নীরব অভিমান অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে । 'পোস্টমাস্টার' গল্পে গ্রামীন জনপদের নিঃসঙ্গ পোস্টমাস্টার ও ছোটো রতনের মধ্যে আবেগময় সম্পর্কের মানবিকতা, 'ছুটি' গল্পে ফটিক চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ বালকের জীবনযুদ্ধ, 'দেনা পাওনা'য় পণপ্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর অসহায়ত্ব,  'সমাপ্তি' গল্পে গ্রামীন শিক্ষকের সহজ জীবন ও স্বাভাবিক প্রেমের বিকাশ এগুলো শুধু শিল্প সুষমায় সমৃদ্ধ নয় বরং গ্রামবাংলার ইতিহাস, জীবনপ্রবাহ ও সংস্কৃতির অনন্য দলিল ।

পূর্ববাংলার নদীমাতৃক প্রকৃতি লোকজ  জীবনধারা, নদী, নৌকা, কৃষিজীবন ও লোকসংগীত রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে । তিনি বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকগানের সহজ সরল আবেগপ্রবণ ধারাকে আধুনিক সাহিত্যে ও সঙ্গীতে ব্যবহার করে নতুন মাত্রা দিয়েছেন । নদী ও নৌকার সঙ্গে সম্পর্কিত ভাটিয়ালি গানের সুর ও ছন্দ রবীন্দ্রসংগীতে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে । 'এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী' এই জাতীয় গানের উদাহরণ । লোকগানে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দ, সহজ, সরল, ভাষাব্যবহার ও চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে । ফলে তাঁর সৃষ্টি সর্বজনগ্রাহ্য আবেদন এনে দিয়েছে । তিনি লোকসংগীতের ঢঙে নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করেছেন । আবার কখনো সরাসরি লোকসুর ব্যবহার করেও গান রচনা করেছেন । রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের শ্রাবণ ( ৭ই আগস্ট ) রচনা করেছিলেন 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি । এই গানটি গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে' গানটির সুরে রচিত । এই গানটি এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল যে ৭১এ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে ফিরত । পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রূপে গানটি গৃহীত হয় । লোকসংগীতের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক আবেদন রয়েছে তেমনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতার মধ্যে ঈশ্বরোপলব্ধি বা জীবনের গভীর সত্যের অনুসন্ধান লক্ষ্য করা যায় । 'রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করে',  'তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি',  'তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছ নিচে /তোমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর আমার প্রেম হতো যে মিছে' গানগুলো এ প্হঙ্গে উল্লেখ করা যায় ।' শিলাইদহে বাউলদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয় ঘটে । এখানে অবস্থানকালে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, গোঁসাই রামলাল, গোসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, লালনের শিষ্যসামন্তদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাসাক্ষাৎ ও আলোচনা হত । শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া থেকে তিনি লালন ফকির ও গগন হরকরার গান সংগ্রহ করে বিদগ্ধ মহলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত গানগুলো 'বাউল' নামে গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল । তিনি তাঁর কয়েকটি নাটকেও বাউল গান ব্যবহার করেছেন । 'মানুষের ধর্ম' গ্রন্থে ঔপনিষদীয় আত্মতত্ত্ব ও বাউল দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা তিনি করেছেন । তাঁর চিত্রাঙ্গদা ও চন্ডালিকা নাটকে লোকজ আঙ্গিক এবং নারীচেতনার দেশজ স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে । এই নাটক দুটিতে সমাজের নারী, জাতপাত ও মূল্যবোধের জটিলতাকে শিল্পিত ও মানবিক রূপে উপস্থাপন করেছেন ।

রবীন্দ্রনাথের গদ্য ও পদ্যে বহুবার পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক শব্দ, ধ্বনি ও বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন সাজু, লাউ, চাষা, নাও, মাঝি, ডিঙি, পাল, গাঙ, জোয়াল, তালগাছ ইত্যাদি শব্দ তাঁর রচনায় দেখা যায় । শিলাইদহে থাকাকালীন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রসমূহ 'ছিন্নপত্রে' যেমন পূর্ববঙ্গের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে তেমনি সেখানকার মানুষের মুখের ভাষা ও উচ্চারণের ছাপ স্পষ্ট । তার উদাহরণ, 'চাষার ভাষায়, মহারাজ ফসল ভালো হয় নাই, তবে আল্লার কৃপা হইলে বাঁচুম ।' এই জাতীয় সংলাপ তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের উদাহরণ ।

তাঁর বিসর্জন, ডাকঘর, মালিনী নাটকে সহজিয়া ভাষাব্যবহারের ছাপ রয়েছে । সংলাপে গানে আঞ্চলিক শব্দ ও লোকজ ভাষাভঙ্গের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । যেমন–রে !ওরে !হে দাদা ! বাপু তুমি না কেমন করো না রে ! তুই বড় গেঁয়ো জাতীয় শব্দ নাটকের চরিত্রদের সংলাপে ব্যবহৃত হয়েছে । 'চন্ডালিকা' নাটকের একটি সংলাপে দেখি–'তুমি তো জাতের লোক, আমি তো চন্ডালের মেয়ে ' জাতপাতের লোকজ দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব । 'মুকুট' নাটকে 'ওগো রে ! মুকুট যে মাথার উপর বসে সেই জানে ওটা কত ভারী ।' প্রবাদপ্রতিম বাক্যে একদিকে দার্শনিকতা আবার অন্যদিকে লোকজবোধের প্রকাশ ঘটে ।

১৯০১ সালের পর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে গিয়ে শান্তিনিকেতনে বসবাস করলেও পরবর্তী সময়ে বহুবার শিলাইদহ এসেছেন । এখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করেছেন তাঁর সারাজীবনের সৃজনের সঞ্চয় । এ প্রসঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন–'আমার ধারণা বাবার গদ্য ও পদ্য দু'রকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, একদিনের জন্য কলম বন্ধ হয়নি । শিলাইদহের যে রূপবৈচিত্র তার মধ্যেই পেয়েছিলেন তিনি লেখার অনুকূল পরিবেশ ' । এই পূর্ববাংলার জল, মাটি, হাওয়া, নদী ও মানুষের মধ্যেই রবীন্দ্রমানসের, রবীন্দ্রমননের সূচনা হয় । রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীজীবনে আঁকা চিত্রসম্ভারেও শিলাইদহ তথা পূর্ব বাংলার প্রভাব নিহিত ছিল । রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতরণি একদিন পূর্ববঙ্গেরই সোনার ধানে ভরে গিয়েছিল ।

Monday, March 17, 2025

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

গতকাল বামুটিয়া কালিবাজার সংলগ্ন পাতাবাজারে নবোন্মেষ ও সমতট সাহিত্যপত্রের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত উৎসব । অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে রঙে রঙে রাঙিয়ে বনভূমিবেষ্টিত এই নির্জন পল্লীতে রাজ্যের প্রায় ৩০০ জন গুণী ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, সংগীতশিল্পীর সম্মিলিত সমাবেশে এই মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় । প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই অনুষ্ঠান ও মধ্যাহ্নের আহার্য খিচুড়ি ও সবজি সবাইকে মনে প্রাণে তৃপ্তি দেয় । আয়োজকদের প্রত্যেকের অকুন্ঠ আতিথেয়তায় সবাই অভিভূত। আলোচনা, নৃত্য পরিবেশন কবিতাপাঠে গোটা অনুষ্ঠান ছিল প্রাণবন্ত । এ জাতীয় অনুষ্ঠানে শুধু সৃজনশীলতার চর্চাই হয় না । ভাবের আদান-প্রদানসহ আন্তরিক সম্পর্কও তৈরি করে । 

অনুষ্ঠানের একটা পর্বে ছিল রাজ্যর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কুমার কমলের আকর্ষণীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, যা সকলের মন জয় করে । কুমার কমলকে হোলির গান গাওয়ার জন্য জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাঁর অপারগতার কথা অকপটে স্বীকার করেন । কিন্তু তিনি শেষদিকে উপস্থিত গুণীজনের জন্যে একটা প্রশ্ন রেখে যান । তাঁর কাছে নাকি পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে । এবং তিনি নাকি সেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছেন । তিনি নাকি বেদ-পুরান-ভাগবতের কোথাও 'রাধা' শব্দটি পাননি । উপস্থিত গুণীজনদের কাছে তিনি তার ব্যাখ্যা চেয়েছেন । এ নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে প্রশ্ন ও কিঞ্চিৎ গুঞ্জন সৃষ্টি হয় । দু-একজন আমার কাছে বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন । আমার শাস্ত্রগ্রন্থাদির তেমন পাঠ নেই । কিন্তু বাংলাসাহিত্যের দীন ছাত্র হিসেবে যে সমস্ত গ্রন্থ সামান্য পাঠ করেছি কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য সেখানে কিন্তু 'রাধা' নাম আমি পেয়েছি । এমনিতেই অনুষ্ঠানটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল না তাই আমি আরও সময় নষ্ট করে ব্যাখ্যায় যাইনি ।

সবার অবগতির জন্য আমি আমার সামান্য জ্ঞান থেকে এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি কোথায় কোথায় 'রাধা' নামের কিরূপ অবস্থান রয়েছে । এবিষয়ে যাঁরা নিবিড় চর্চা করেন তাঁরা আরও  বিস্তৃত বিশ্লেষণ করতে পারবেন । জয়দেবের 'গীতগোবিন্দম্' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের মিলন, বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, হর্ষোল্লাস তথা পুনর্মিলনের কাহিনি মধুর লালিত্যমন্ডিত পদ দ্বারা সংবদ্ধিত হয়েছে । কাব্যের শেষে ভগবানরূপী শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার চরণযুগল মস্তকে ধারণের প্রার্থনা করেছেন 'দেহি পদপল্লবমুদারম' বলে । আমাদের পাঠ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটিও রাধাকৃষ্ণের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট । সেখানে 'রাধাবিরহ' নামে একটা ছিন্ন খন্ড রয়েছে। এছাড়া বাংলার কাব্য, সাহিত্য, গীতিকা, পদাবলী বা বৈষ্ণবকবিতা, বৈষ্ণবাচার্যদের টীকা-টিপ্পনীসমূহে তো বহুভাবে  রাধাপ্রসঙ্গের  উল্লেখ রয়েছে । পুরাণের মধ্যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও পদ্মপুরাণ এর নানা স্থানে রাধা নামের উল্লেখ রয়েছে । মৎস্যপুরাণে 'রুক্মিণী দ্বারাবত্যাং তু রাধা বৃন্দাবনে ।' বায়ুপুরাণে  'রাধা বিলাস রসিকং' । বরাহপুরাণে  'তস্য রাধা সমাশ্লিষ্য ' রয়েছে । ঋকবেদেও ১/২২/৭-৮ এবং ৮/৪৫/২৮ সূক্তে 'রাধা' 'রাধস' 'গোপি' শব্দের উল্লেখ আছে সামবেদে শ্রীরাধার সহস্র নাম আছে । তার মধ্যে ষোড়শ নাম প্রধান । অথর্ববেদ এবং অথর্ববেদের অন্তর্গত পুরুষবোধিনী শ্রুতি ( রাধা যস্যা ), গোপালতাপনী শ্রুতি, গৌতমীয় তন্ত্র ( রাধিকা পরদেবতা ) তৈত্তরীয় উপনিষদ, রাধাতন্ত্র এবং নারদপঞ্চরাত্রতেও ( জগন্মাতা চ রাধিকা ) রাধা নাম উল্লেখিত আছে । শ্রীমৎ ভাগবত গীতা হল শ্রী ভগবানের বাণী । এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের পারস্পরিক সংলাপে অন্য কোন চরিত্রের উপস্থিতি অস্বাভাবিক । বিষয়বস্তু ও আলাদা । রাধার উপস্থিতিও অপ্রাসঙ্গিক । এখানে একটি দর্শনকে উপস্থাপন করা হয়েছে ।

শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে প্রকাশ্যে রাধা নাম না থাকলেও রাধাকৃষ্ণকে নিয়েই এই গ্রন্থ । প্রাণবিহীন যেমন দেহের অর্থ নেই । প্রাণই দেহের মূল । তেমনি শ্রীরাধা ভাগবতের প্রাণ । শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের প্রাণ । শ্রীল শুকদেব গোস্বামী শ্রীরাধিকার প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণে বৈষ্ণবীয় বিনম্রতায় ভাগবতে রাধা নাম উল্লেখ করেননি । শুকদেব কেন শ্রীমতি রাধারানি নাম উচ্চারণ করেননি সেই প্রসঙ্গে সনাতন গোস্বামীর ব্যাখ্যায় রয়েছে–

 "গোপীনাং বিততিদ্ভুতস্ফুটতর নামপ্রেমানলার্চিশ্চটাদগ্ধানাং কিল নাম কীর্তনকৃতাত্তাসাং স্পর্শেন সদ্যো মহাবৈকল্যং 
স ভজন কদাপি ন মুখে নামানি কর্তুং প্রভুঃ ।" 

অনুবাদ:– 'শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতকথা, কীর্তন করার সময় গোপীদের কারো নাম উচ্চারণ করতে সমর্থ হননি । তার কারণ গোপীদের নাম উচ্চারণ করলে তিনি ভাবাবেগে আত্মবিহ্বল হয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন । যার ফলে তিনি আর ভাগবতের কথা বলতে পারতেন না । ফলে মহারাজ পরীক্ষিতের ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ ব্যাহত হয়ে পড়ে । তাই শুকদেব গোস্বামী এখানে কৌশল অবলম্বন করেন । ভাগবতের রাসলীলা বর্ণনায় একজন ভাগ্যশালিনী গোপিনী প্রিয়তমা গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তরালে বিবিধ বিলাস করার বর্ণনা রয়েছে । আসলে অন্যতমা এই গোপিনী শ্রীকৃষ্ণের বক্ষবিলাসিনী শ্রীমতী রাধাঠাকুরানি । ভাগবতের 'অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরী' এই শ্লোকের 'অনয়ারাধিত'  শব্দে রাধা নাম আছে । টীকাকার শ্রীসনাতন গোস্বামী বলেছেন, 'আরাধিত' শব্দের মাধ্যমে এখানে রাধা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এই বাক্যের মাধ্যমে  শুকদেব গোস্বামী রাধাকে দর্শন করেছেন। 'রাধেতি  নামকরঞ্চ দর্শিতং ।' ব্যাসদেব রচিত হরিবংশেও 'যুবতী গোপ কন্যাশ্চ' শব্দের মাধ্যমে রাধিকাকে বোঝানো হয়েছে । ভাগবতের ন্যায় শ্রীমতি রাধিকা এখানেও লুক্কায়িত । কিন্তু যেখানে রাস আছে সেখানেই রাসেশ্বরী শ্রীমতি রাধাঠাকুরানি আছেন । ভগবানের শক্তির তিনটি ভাব আছে । একটি সদ্ভাব ( সন্ধিনী শক্তি ), দ্বিতীয় চিৎ ভাব ( সম্বিৎশক্তি ), তৃতীয়টি আনন্দ ভাব ( হ্লাদিনী শক্তি ) । এই হ্লাদিনী শক্তি ভগবানের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত স্বরূপ-আনন্দ শক্তি । ইনি নিত্য-বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীমতি রাধারানী ।

কবিরাজ কৃষ্ণ দাস গোস্বামী তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে রাধা নামের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন । তিনি তার গ্রন্থের মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে রায় রামানন্দ  সাক্ষাৎ করলে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণের বিবিধ বিলাসতত্ত্ব ও সাধ্যসাধন তত্ত্বকে তুলে ধরেন । সেখানে কান্তাপ্রেমের ব্যাখ্যায় বলেছেন কান্তভাব প্রেম সর্বসাধ্য সার অর্থাৎ পরম পুরুষ ভগবানের সঙ্গে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক স্থাপন হল ভক্তিপূর্ণ জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় একমাত্র গোপীগণ ও শ্রীমতি রাধারানী তা সম্ভব করে তোলেন । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন–
 
রাধা কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি । 
অন্যোন্যে বিলশে রস আস্বাদন করি ।। 
সেই দুই এক এবি চৈতন্য গোঁসাঞি 
ভাব-আস্বাদিতে দোঁহে হইল এক ঠাঁই ।

অর্থাৎ রাধা ও কৃষ্ণ এক আত্মা । রাধাকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি । 

হ্লাদিনী সার 'প্রেম' প্রেম সার 'ভাব' ।
 ভাবের পরমকাষ্ঠা নাম মহাভাব ।।
মহাভাব স্বরূপা শ্রীরাধা ঠাকুরানি ।
 সর্বগুণখনি কৃষ্ণ কান্তা শিরোমণি ।।

শক্তি ও শক্তিমানের অভেদের কারণে রাধা কৃষ্ণ স্বরূপত এক ও অভিন্ন । তবু লীলারস আস্বাদন করার জন্য ভিন্ন দেহ ধারণ করে লীলা-বিলাস করেছেন কিন্তু পুনরায় এই রস আস্বাদন করার জন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ শ্রীচৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন । কবি চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের মুখ্য কারণটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কিদৃশো বানয়ৈবা 
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুত মধুরিমা কিদৃশো বা মদীয় ।
 সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কী দৃশং বেতি লোভা
 তদ্ভাবাঢ়্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ ।

অর্থাৎ, শ্রীরাধার প্রেমমাহাত্ম্য কেমন এই প্রেমের দ্বারা রাধাকৃষ্ণ যে অদ্ভুত মাধুর্যরস আস্বাদন করেন, রাধা যে সুখ পান সেই সুখই বা কেমন, এই সমস্ত বিষয়ে জানার ইচ্ছার কারণেই রাধার ভাব গ্রহণ করে কৃষ্ণ শচীগর্ভে চৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন ।

বৃন্দাবনে গোপিগণের প্রেম ছিল কামগন্ধহীন । কবিরাজ গোস্বামী কাম ও প্রেমের বিভাজন করেছেন–

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা তারে বলি কাম ।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ।।

গোপীদের মধ্যে রাধারানি শ্রেষ্ঠ । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন– 
সেই গোপিগণ মধ্যে উত্তম রাধিকা ।
 রূপেগুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্বাধিকা ।।

বাংলার সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলি ও অন্যান্য বৈষ্ণবসাহিত্যের কেন্দ্রভূমিতেই রয়েছেন শ্রীরাধিকা ।

ভারতের সমস্ত মহান ভক্তিশাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে । যাঁরা রাধানাম অস্বীকার করেন তাঁরাই এই ধরনের প্রশ্ন তোলেন এবং শ্রীরাধার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশ করেন । যথাযথ গ্রন্থের নিবিড় অধ্যয়নের মাধ্যমে এই সংশয় দূর করা যাবে । ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে এমন বহু প্রশ্নই থেকে যায় বা রাখা যায় ।
সতেরো, তিন, দুহাজার পঁচিশ ।

Monday, March 10, 2025

ত্রিপুরার অরণ্যের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় প্রাণী

ত্রিপুরার অরণ্যের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় প্রাণী 

ত্রিপুরার অরণ্য একসময় নানারকমের প্রাণীকুলে সমৃদ্ধ ছিল । কিন্তু ক্রমান্বয়ে অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে বহু প্রাণী আজ হারিয়ে গেছে । বহু প্রাণী বিলুপ্তির পথে । সেরকমই  উড়ুক্বু বেড়াল । সিভ্যাট ক্যাট । একেবারেই বিলুপ্তির পথে । এরা গভীর অরণ্যে থাকে । একসময় ত্রিপুরার জঙ্গলেও ছিল । বন ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে । এখন ক্বচিৎ কদাচিৎ দুএকটা লোকালয়ে এসে পড়ে । এরকম এ অঞ্চলের আরও কয়েকটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী কেন্দাবাঘ, ভল্লুক, চশমা বানর ও লজ্জাবতী বানর।  হারিয়ে গেছে  বনরুই, রামকুত্তা, শজারু ও মথুরা নামের ময়ূরের মতো পাখিটি । আরও কতরকমের সরীসৃপ, পাখি ও কীটপতঙ্গ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না ।কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও অরণ্যসংকুল হওয়ায় এমন বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী এখনও দেখা যাচ্ছে । বন যত হারিয়ে ততই এইসব প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।