Saturday, January 25, 2025
আমার কুম্ভস্নান ও অগণিত রত্নঢেউ
আমার কুম্ভস্নান ও অগণিত রত্নঢেউ ।
আজ কুম্ভস্নানতিথি । মহাকুম্ভস্নানের ক্ষণ । আমার কুম্ভস্নান । বইমেলা আমার কুম্ভমেলা । এই মেলার শুরুর দিন থেকে প্রতিবছর অগণিত জনসমুদ্রে অবগাহন করে এসেছি । আজ এল আমার সেই মহালগ্ন । পূর্ণ আমার অমৃতকুম্ভের সন্ধান । আমার জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার পিতৃদেবকে । যিনি আমার শৈশবের কোন একদিন আমাদের পারিবারিক আরাধ্য দেবতাবর্গের পটের সামনে বসিয়ে হালকা আবির রঙের এক পাখির পালক দোয়াতে ডুবিয়ে কলাপাতায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন । তারপর ক্রমান্বয়ে আমি খাগের কলম, বাঁশের কঞ্চির কলম,স্লেটপেন্সিল, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেন পেন বলপেন ও আজকের দিনের মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপে অক্ষর সাজিয়ে চলেছি । আমার অক্ষর বিন্যাসের মহড়ায় শৈশব থেকে আমাকে নিয়ত লালন করে গেছেন বহু শ্রদ্ধেয়জন । আজ কুম্ভজলের প্রতিটি ঢেউয়ের আলোড়নে অমার অন্তরাত্মা বারবার উচ্চারণ করছে তাঁদের নাম যাঁরা আমার জীবনের নানাক্ষেত্রে আমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন । শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানশিক্ষক প্রমোদরঞ্জন দে, পূর্ণেন্দুবিকিশ দত্ত, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ও লালকৃষ্ণ দাশসহ সুনীল বর্মন, নিখিল চৌধুরী, গোপাল চক্রবর্তী, দীপংকর নাথ, সত্যজিৎ ভট্টাচার্য, প্রদ্যোৎ পাল, বিক্রমজিৎ দেব, নিকুঞ্জবিহারী নাথ, দেবলমোহন ভট্টাচার্য, সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী, নিখিল চৌধুরী, অমিয়প্রভা চৌধুরী, স্বপ্না ভট্টাচার্য, সুরেশ দত্ত, প্রাণতোষ কর্মকার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক দেবতোষ চৌধুরী ও মানিক চক্রবর্তী ( গল্পকার ), কাশীনাথ দাস প্রমুখ সেকালের দিকপাল শিক্ষকরা । শৈশব কৈশোরে বাবার চাকুরিসূত্রে কাটিয়েছি কুলাইতে । সে স্কুলের গ্রন্থাগারটিও ছিল সেযুগে সমৃদ্ধ । পড়ার বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি সেখানে । কুলাই হাসপাতালে চিকিৎসক দম্পতি ছিলেন ড. এম এল বোস এবং ড. লীলা বোস । তাঁদের একমাত্র সন্তান কুশল আমার বাল্যবন্ধু । তাদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল । সেখানে আমি গোগ্রাসে পড়েছি আগকার দিনের সেই পূজাবার্ষিকীগুলো, দেশ, অমৃত, শুকতারা, নবকল্লোল, প্রসাদ, উল্টোরথ, সিনেমা জগৎসহ, টারজান, নন্টে-ফন্টে, ইন্দ্রজাল কমিকস, স্বপনকুমার সিরিজসহ বিশ্বসাহিত্যের বহু অনুবাদগ্রন্থ । কুশল অর্থাৎ শিবাজী বসুর দিদি ভাস্বতী বসু রত্নাদির সঙ্গে আমার বইপড়ার প্রতিযোগিতা চলত । পিসিমা ড. লীলা বসু বেশ উৎসাহ দিতেন আমাদের । ওরা সবাই এখন কলকাতাবাসী । সাব্রুম মহকুমায় আমি সাহচর্য পেয়েছি ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, ড. রঞ্জিত দে, কৃষ্ণধন নাথ, তিমিরবরণ চাকমা, গোপীরঞ্জন বসাক, কানাইলাল নাথ, জয়দেব বসাক, প্রদীপ চৌধুরী, দীপক দাস রতন চক্রবর্তী, থেঙ্গাফ্রু মগ, সঞ্জিৎ মালাকার প্রমুখগণের । সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূত্রে আমি সেই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলাম দীর্ঘদিন । এখানে আমি পড়েছি প্রচুর । সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি শ্রদ্ধাস্পদ প্রধান শিক্ষক লালকৃষ্ণ দাস, স্বপন মুখার্জী ও ব্যোমকেশসখা দেবনাথ, পন্ডিতমশাই যশোদাজীবন গোস্বামী, মানিকলাল ব্যানার্জী, সুভাষ দাস, রমণীমোহন নাথ, রণজিৎ দেবনাথ, গোপাল দেবনাথ, ড. রঞ্জিত দে, ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, শংকর বনিক, শম্ভু চৌধুরী, শিখা ভট্টাচার্য, শম্ভুনাথ সাহা আলপনা চক্রবর্তী, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, সুব্রতা দে, অর্জুন শর্মা, সাধন মজুমদার, টুটুল মজূমদার, গণেশ কর, রাখাল সোম, সাধন পাল, সাধন মজুমদার, পার্থ দেব, পার্থ সাহা, গীতা চক্রবর্তী, রণজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ দিকপাল শিক্ষক শিক্ষিকাদের । বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় পড়ার সময় নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি অধ্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়, কালিপদ হুই, প্রাণকৃষ্ণ মন্ডল, পরিতোষ সরকার ( ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর পবিত্র সরকার এর অনুজ ), রণজিৎ দত্তকে এবং হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, হরিভূষণ পাল, অশোক দাশগুপ্ত, কুসুমকুমার পাল, ভূপাল সিনহা প্রমুখ সেকালের বিলোনিয়ার অগ্রজ সাহিত্যসেবীগণের । গত শতকের সাতের দশকের শেষ দিকে আমার দুর্দিনে আমাকে মরুদ্যানপ্রতিম সাহচর্য দিয়েছেন প্রয়াত কবি অরুণ বনিক । তিনি আমাকে বিশ্বসাহিত্যের বিশিষ্ট লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করান সেদিন । ছোটোখিলের মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আমার কবিতা নিয়ে গ্রুপ সেঞ্চুরির উদ্যোগে আয়োজিত আগরতলা পোস্ট অফিসের সামনে অনুষ্ঠানে পাঠ করে শোনান । এই দশকেই জাগরণ সাহিত্য বাসরের সৌজন্যে আমার পরিচয় হয় রাজ্যের বরিষ্ঠ কবি নকুল রায় ও মানস পালের সঙ্গে । এই দুজন আমাকে ফুটে ওঠার জন্য তুমুল ভাবে উত্তাপ দিয়ে যাচ্ছেন । তাঁদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছি সে যুগের দিকপাল সব সাহিত্যিকদের সঙ্গে । আগরতলায় বন্ধুবর কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তীর বাড়িতে আসত নানাধরনের বই ম্যাগাজিন । আসতেন রাজ্যের দিকপাল সাহিত্যসেবীরা । সেখানে নিবিড় অধ্যয়নের পাশাপাশি আমি পরিচিত হয়েছি তাঁদের সাথে । আশির দশকের শুরুতে বইমেলা যেন আমাকে সাগর সঙ্গমে নিয়ে এল । সেদিন যাদের অভিভাবকত্বে আমি বেড়ে উঠেছিলাম তাঁরা হলেন ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, বিমল চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী, অসীম দত্তরায়, ননী কর, দিব্যেন্দু নাগ, পূর্ণেন্দু গুপ্ত, সমরজিৎ সিংহ, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিলীপ দাস, সুজিতরঞ্জন দাস করুণাময় শর্মা । আরো অনেকেই আমাকে লালন করেছিলেন সেদিন যাদের নাম আমি আজ আর মনে করতে পারছি না । আমার সময়ে কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, সন্তোষ রায় লক্ষ্মণ বণিক, সমর চক্রবর্তী, প্রত্যুষরঞ্জন দেব, মাধব বনিক প্রমুখগণ আমাকে ক্রমাগত উৎসাহিত করেছেন । আমার পরবর্তী প্রজন্মের দেবাশিস চক্রবর্তী, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, আকবর আহমেদ, অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, মিলনকান্তি দত্ত, গোবিন্দ ধর অপাংশু দেবনাথ, গোপেশ চক্রবর্তী, তারাপ্রসাদ বনিক, অভীককুমার দে, বিজন বোস থেকে শুরু করে আজকের দিনের সপ্তশ্রী কর্মকার, মিঠু মল্লিক বৈদ্য, অনামিকা লস্কর, শংকর সাহা, গোপা সাহা, টিঙ্কুরঞ্জন দাস, অর্ধেন্দু ভৌমিক সাচীরাম মানিক, রুপন মজুমদার, রাহুল শীল, ভবানী বিশ্বাস তাদের সৌহার্দ্যবলয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছেন । জীবনের সাঁঝবেলা হলেও নবীন প্রজন্মের সাথে আমি পা মিলিয়ে চলেছি আলোপথে । কালের কাছে আমার প্রার্থনা, আরো আরো সময় দাও আমাকে হে! আরো বেশি করে যেন খুঁজতে পারি সাহিত্যের মণি-মানিক । আমার এই সাহিত্যসম্মান ত্রিপুরার সমস্ত সাহিত্যপ্রাণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করছি ।
১৪ জানুয়ারি, ২০২৫
আগরতলা বইমেলা প্রাঙ্গন ।
No comments:
Post a Comment