Friday, March 31, 2017

এপ্রিলফুল


মেইলবক্স খুলে দেখতে চাইছি কে আজ বোকা বানাল এদিনে
তেমন কোনো হাস্যকর প্রয়াসের কোনো ছাপ নেই
কেবল পাতার পর পাতা জুড়ে কানার মাতম
অশ্রুসিক্ত ইমোজি সব উঠে আসছে ওস্তাদজির সানাই হয়ে
আর টাইমলাইনের পাতা জুড়ে ঘন ঘন ট্যাগ
ভয়ংকর উল্লাসে ফেটে পড়া সব হিংসাময় সব বসন্তকথা

আমার চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে আছে
পঞ্চাশ হাজার মুখের করুণ বৃত্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দুলছে
এ ভূখন্ড সীমিত হওয়ায় কেউই অপরিচিত নয়,
সবারই হাল হকিকৎ জানা ৷ উনিশ বিশ সবাই সমান বিত্তবান ৷
আমার জনপদে এখন মন্বন্তরের নীরবতা নেমেছে
আশাহত কুপিবাতি হাওয়ায় কাঁপছে, কখন বুঝি নিভে যায় ৷

এই অন্ধকারেই দেখি একদল মর্ষমান শরীর ডঙ্কা বাজিয়ে মশালনাচে নেমেছে ৷ কী তীব্র তাদের হল্লাবোল! 

ক্রমশ পাথর হয়ে খসে  পড়ে যাচ্ছে অজস্র কান্নামুখ
আর উল্লসিত হিংস্র অবয়বগুলো শ্বাপদ হয়ে বেরিয়ে পড়ছে ৷

প্রতিবেশী বলে আর কেউ নেই মানুষের শরীর নিয়ে
লক্ষ্মণরেখার দুইপাশে অসহিষ্ণু খাদক এবং অসহায় খাদ্য

আজ বসন্তপুষ্পের দিনে এভাবেই সাজানো আমার প্রোফাইল ৷

Friday, March 24, 2017

মুর্শিদ হে

কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে,
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

রত্নাকর তার দস্যু নামটি ঘুচিয়েছে যে কলমে,
কালিদাস হন মহাকবি কলমেরই খোশনামে,
জয়দেব আর পদ্মাবতীর অমরগাথা গীতগোবিন্দ ,
কৃত্তিবাস আর কাশিরাম কলমে ধরেন ছন্দ,
ভারতচন্দ্র দৌলতকাজির আরবি ফার্সির দ্বন্দ্ব যে-
কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে ,
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

হাসন রাজা লালনগানে ধর্মাধর্মের নেইকো বাধা,
মন্দির আর মসজিদেতে খোদার সঙ্গে কৃষ্ণরাধা ,
ভেদাভেদ যে সরে গেল তা কী আমি ভুলব হে -
কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে,
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মানবতার জয়গান,
নজরুলের সাম্যবাদের উদারসুরে আহ্বান,
জগৎ জুড়ে যে ডাক পাঠায় বাংলামায়ের সন্তান,
নতুন হাওয়ায় মেতে গিয়ে সে সব কিছু ছাড়ব হে-
কলমটা কী বেচে দেব বল না গো মুর্শিদ হে,
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

পল্লীকবি জসীমউদ্দিন আর শামসুর রাহমান,
ওই কলমেই রেখে গেছেন বাংলাভাষার মানসম্মান,
বাহান্নর ভাষাশহিদ উনিশের শিলচরে,
জাতিধর্মের ধুয়া তুলে তাদেরও কী ছাড়ব হে-
কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে -
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

অন্ধকারে ছাইল আকাশ ভাঙন ধরে নদীর বুকে,
বাতাস যদি ভাগ করতে চাই থাকব কী আর পরমসুখে,
আকাশ বাতাস এই দুনিয়ায় সবই তো তাঁরই দান,
কেউ বা আল্লা কেউ বা গড কেউ বা বলেন ভগবান,
এসব কথা ভুলে গেলে আমরা কী আর বাঁচব হে-
কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে-
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

বাউল পূর্ণানন্দে বলে, সহজকথা ভুলে গেলে ,সহজ মানুষ কীআর মেলে ৷
হানাহানি হিংসা ভুলে, দেলের ভেতর বাতি জ্বেলে, ভালোবাসো মানুষে হে-
কলমটা কী বেচে দেব বলো না গো মুর্শিদ হে-
কলমেরই তরঙ্গেতে ত্রিবেণীর ওই ধারা বহে ৷

Monday, March 20, 2017

সেই প্রেমই


_________________________
ইন্টার সিটিতে চড়ে সবুজ খোঁজাখুঁজি
তিনসুকিয়ার তরুণীরা প্রেমের উল্লাসে বিহু নাচেন ৷
আত্মার সম্মেলনে মধ্যাহ্নভোজের পর স্নিগ্ধ
অলসতার ফাঁকে আপনি এলেন অরুণিমা কোঁয়র
আপনার কবিতার বই জুড়ে প্রেমের উড়াল
অবসন্ন অবসরে অপরিচিত সংলাপে যে বাঁধনের
গান আপনার মৃদুকন্ঠে
' প্রেম মিছা তো সবকিছু মিছা'
আপনার অসাম্প্রদায়িক সঙ্গীত
ব্রহ্মপুত্র-বরাক-গোমতীর স্রোতে ছড়াতেই কী
একান্তে আপনি আমার চলভাষ সংকেত নিলেন
আমাদের এ পর্যটন নিবিড় প্রেমের জন্যই
ছিল হে মেখলাময়ী, অহোমললনা ৷

Tuesday, March 14, 2017

হোলিগান

বেনামী কুটিরের গায়ে আলপনা এঁকে রেখে
বর্ষবিদায়ের পথে আবিরের চালচিত্র--

কতোটা ভালোবাসা রেখে গেলে শান্তি নামে ৷
সকাল সন্ধ্যার আঁটিবাঁধা খুচরো সংসারের তালিকায়,
তালুতে দাদনের স্বরলিপি সুরের জন্যে উসখুস ৷
নেতিয়ে পড়ে মেজাজি মালিকের জবাকুসুম চোখের সামনে,
যার গায়ের জামায় বিগত হোলির আদিম গন্ধ ৷

হোলি তবু আসে ৷ আসে প্রতি সন ৷
তার ঝোলায় থাকে প্রাচীন মেইজাইয়ের উপহার,
বিলোবার পরিবেশ পায় না ৷
অথবা খুঁজে পায় না কোনো পবিত্র সূতিকাঘর ৷

Friday, March 10, 2017

হোলি, দোল,বসন্তোৎসব : উৎস ও ক্রমবিকাশ

আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি সর্বাধিক  প্রচলিত ৷ এটি মূলত রঙের উৎসব ৷ ঋতুর উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও এই হোলি ৷ কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷ প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা ৷

স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷  হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ৷ দাদার আদেশে ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয় ৷

এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জ্বা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধি করে সখীদের সঙ্গে অাবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷এই কাহিনিরই একটু রকমফের রয়েছে অন্য আর একটি পুরাণে ৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ব্রহ্মার আদেশে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে রাধা ৷শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে রতিলীলায় মত্ত হলেন ৷ সারারাত কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় মথিত করলেন শ্রীমতী রাধিকাকে ৷ আবেগঘনাবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের দশন ও নখরাঘাতে এবং কৌমার্যখন্ডনে শ্রীমতী এমন রক্তাক্ত হলেন যে সকালে লজ্জায় কুঞ্জ থেকে বেরুতে পারছিলেন না ৷ উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে র জন্যে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁর অনুগতদের রং নিয়ে খেলার আদেশ দিলেন ৷ সকলে যখন রঙের খেলায় মত্ত সেইসময়ে রাধিকা বেরিয়ে এসে বাড়ি ফিরলেন ৷ রঙের উৎসবের উৎসকেন্দ্রিক আরও একটি মিথ পাওয়া যায় ৷ সেটিও কৃষ্ণকে নিয়েই ৷ ছোটোবেলায় রাক্ষসী পুতনার দুধ পান করে শ্রীকৃষ্ণের গাত্রবর্ণ নীল হয়ে যায় ৷ যৌবনবয়সে শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন তাঁ গায়ের রঙ নীল আর রাধিকার গায়ের রঙ গৌরবর্ণ ৷ তখন শ্রীকৃষ্ণ হীনন্মন্যতায় ভুগছিলেন ৷ ( স্মর্তব্য:   যশোমতী মাইয়া সে বোলে নন্দলালা /রাধা কিঁউ গোরী, ম্যয় কিঁউ কালা) ৷  তাঁর এই অবস্থা কাটানোর জন্যে মাতা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশ দিলেন তাঁর ইচ্ছেমতো রঙে রাধাকে রাঙিয়ে দিতে ৷ রাধার গায়ে মুখে শ্রীকৃষ্ণের রঙ লাগানো থেকেই হোলির সৃষ্টি ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলে ৷
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রম্ এ ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়কজন কবিও কাব্যে বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷বাৎস্যায়নের কামসূত্র রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে ৷ তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে ৷এখানে দোলায় বসে আমোদ প্রমোদের উল্লেখ পাই ৷ চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি উৎসবকে শবরস্বামী তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন 'হোলক উৎসব' নামে ৷ সপ্তম শতকে রচিত রত্নাবলী এবং অষ্টম শতকের মালতীমাধব নাটকেও বসন্তোৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ জীমূতবাহনের কালবিবেক ছাড়া ষোড়শ শতকের রচিত রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷