গভীর মর্মাহত হলাম কবিয়াল বিষ্ণুরমণ দত্তের প্রয়াণে ৷ লোকসংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যম কবিগান আজ প্রায় অস্তমিত ৷ এক সময় বাঙালি অধ্যুষিত গ্রাম ও মফস্বল শহরে বিনোদনের এক বিশেষ উপাদান ছিল কবিগান ৷ বাংলার জমিদার বাড়িতে দোল দুর্গোৎসবে কবিগানের আয়োজন করা হত ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিওয়ালাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ভোলা ময়রা, নিধুবাবু, হরু ঠাকুর, এন্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখ ৷ তার পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলায় ছিলেন হরিচরণ আচার্য, রমেশ শীল প্রমুখ ৷ চট্গ্রামের কবিয়াল রমেশ শীলের শিষ্য ছিলেন তিনি ৷ ত্রিপুরার অল্প কয়েকজন হাতে গোনা কবিয়ালের তিনি ছিলেন অন্যতম ৷আমাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁর ৷ আমাকে শ্বশুর এবং আমার গিন্নিকে শাশুড়ি ডাকতেন ৷ তাঁদের আদি নিবাস আমার মামাবাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালির বিষ্ণুপুর গ্রাম ৷ সেই সুবাদে তিনি আমার মাকে দিদি ডাকতেন ৷ ভাগনে হিসেবে এই অভাজনকে শ্বশুর সম্বোধন করতেন ৷ সাব্রুমের পশ্চিমাংশের কোন গ্রামে কবিগান গাইতে গেলে তাঁর অস্থায়ী আবাস ছিল আমাদের ছোটোখিলের বাড়ি ৷ আমার ঘরে থেকে খেয়ে কবির আসরে ছদ্ম অশ্লীল কাব্যভাষায় শ্বশুরের আদ্যশ্রাদ্ধ করতেন ৷ শ্রোতৃমন্ডলী খুব মজা পেতেন ৷ আমি আসরে মাথা নুয়ে থাকতাম বা আসর ছেড়ে পালাতাম ৷ আসর থেকে ফিরেই রাস্তা থেকে হাঁক দিতেন, শ্বশুর আমি আইয়ের ৷তোঁয়ার বইপত্র বাইর করি রাখো ৷ আঁই আইয়ের ৷ স্কুলে যাওয়ার সময় আমি বইয়ের আলমারির চাবি রেখে যেতাম ৷ তিনি স্নান করে খাওয়া দাওয়া সেরে দরজা বন্ধ করে বই পড়তেন আর প্রয়োজনীয় নোট নিতেন ৷ তাঁর কাছ থেকে বেদ পুরাণের অনেক তথ্য পেয়ে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি ৷ একবার আমাদের বাড়িতে অবস্থানকালে গভীর রাত্রিতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন ৷আমরা তিনভাই হাঁকডাক করে পাড়ার লোকজনকে ডেকে আনি ৷ ডেকে আনা হল আমার পিতৃদেবের সহকর্মী চিকিৎসক রমেশ সাহাকে ৷ তাঁর চিকিৎসায় ভোরের দিকে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর সবার সামনে রসিকতা করে বলে ওঠেন, কাইল্লা রাইত্তা যদি মরি যাইতাম, আঁর শ্বশুর কইন্না দায় তুন মুক্ত অইতো না ৷ দুঃখে একঘর লোক হাসবে না কাঁদবে! এমনই রসবোধ ছিল তাঁর ৷ বড়ো খারাপ লাগছে ৷ তাঁর প্রয়াণে ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতিচর্চার এক নান্দনিক মাধ্যমের যুগাবসান ঘটল ৷ যেখানেই থাকুন ৷ চিরশান্তিতে থাকুন ৷
No comments:
Post a Comment