সে আমার ছোটো বোন
কলম চলছেনা কিছুতেই । শব্দ খুঁজে পাচ্ছিনা কিছুতেই । গত সন্ধ্যায় সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে যেন স্থবির হয়ে গেছি । আমার শিক্ষকতা জীবনের একেবারে শুরুর দিকের ছাত্রী রীতা । রীতা কর । সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাতের দশকের শেষ বছর অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে শিক্ষকতায় যোগ দিই অগ্রজপ্রতিম দীপক দাস (স্বপন স্যর ) ও আমি । তখন রীতা গার্লস স্কুলে পড়ত । সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর আমাদের স্কুলে এসে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় । আমি আর স্বপনদা সেসময়ে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ দেখে তদ্বির করে স্কুলে বাণিজ্য বিভাগ চালু করালাম । শ্রীনগর থেকে এসে সদ্য জয়েন করলেন নেপাল সরকার । তিনজন মিলে শুরু করলাম একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাণিজ্য বিভাগের ক্লাশ । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারির তখন সোনালি দিন । ডাকসাইটে শিক্ষকরা সব আছেন এখানে । সবাই এ স্কুলে পড়তে চায় । তখন কেবল একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে মেয়েরা পড়তে পারত । গার্লস স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় ।
কমার্স খোলায় দুটি মেয়ে এসে ভর্তি হল । একজন রীতা কর । অন্যজন পন্ডিতমশাই যশোদাজীবন গোস্বামী স্যরের মেয়ে । দুবছর পড়েছিল সে আমাদের স্কুলে । পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলায়ও ভালো ছিল রীতা । থ্রোয়িং ইভেন্টে সে ছিল দক্ষ খেলোয়াড় । মাত্র দুবছরের হলেও গোটা জীবন ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কে জড়িয়ে রেখেছিল রীতা । কলেজে যাওয়ার পর ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দেয় । সেসময় আগরতলা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ছিল তার দাপট । সুস্বাস্থ্যের অধিকারীণী রীতার ভয়ে মহিলা কলেজের সামনে রোমিওদের ঘুরঘুর করা একদম থেমে গিয়েছিল সেসময়ে । কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেয় রীতা । সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে দলের একেবারে প্রথম সারিতে চলে আসে । আমার বহু ছাত্রছাত্রী আজ দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠিত । তাদের অনেকের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয় । যোগাযোগ হয় । একদম কাছ থেকে উঠে আসতে দেখেছি রীতাকে ।
এই মহকুমায় আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী রয়েছে যারা রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার জন্যে । রীতা কর, অরুণ ত্রিপুরা, শান্তিপ্রিয় ভৌমিক, তাপস লোধ,দীপক দে, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী সহ আরো অনেকে বিভিন্ন ফ্রন্টে । সবার সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক । যেকারণে আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়াইনা । রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দিতা থাকে । থাকে কালি ছেটানোর প্রতিযোগিতা । কিন্তু আমি লক্ষ করেছি রাজনীতিবিদদের একটা বড়ো অংশই কিন্তু ব্যক্তিগত লাভালাভ বা প্রতিষ্ঠার চাইতে সমাজের কল্যাণের জন্যে রাজনীতিতে আসে । তাই রাজনীতির মানুষদের আমি শ্রদ্ধা করি । সে যে দলেরই হোক । রীতার ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার আমি প্রায় প্রত্যক্ষদর্শী । একসময় সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের চেয়ারপার্সন হল । তারপর দুইবার বিধানসভার সদস্যা । চাকুরিসূত্রে ভোটগণনার দায়িত্ব পেতাম । দুবারই জেতার পর কাউন্টিং হলের ভেতর সে আমাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছে ।
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছিল ওর ছিল দারুণ আগ্রহ । একবার ত্রিপুরা রবীন্দ্রপরিষদের শাখা খোলার চেষ্টা করা হল । বিলোনিয়া রবীন্দ্রপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল দাশ এলেন । কথাবার্তা হল, সভা হল । কিন্তু একটা অদৃশ্য শক্তির সন্দেহের কারণে তা ভেস্তে গেল। কদিন আগেও এক আলাপচারিতায় সে কথাটা তুলেছিল । এ দুঃখটা তার আজীবন রয়ে গিয়েছিল ।
তার নিজের বাড়িতে সে একটা নার্সারি স্কুল খোলে । তার একটা শাখা আনন্দপাড়াতে খোলা হয় । সেখানে এখন প্রাইমারির ক্লাশ হয় ।
মেলা,উৎসব , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীদের ডাকা, বাইরের শিল্পীদের আনা, রাত জেগে তাদের তদ্বির করা, বৈশাখিমেলায় সারা রাজ্য থেকে কবিদের আমন্ত্রণ করে এনে কবিসম্মেলন করা রীতার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিরল নজির । একবার বাংলাদেশের মহাকাল নাট্যদল এসেছিল সাব্রুমে । রীতার আন্তরিক ও মিশুকে স্বভাব এবং প্রটোকলের ধারে কাছেও না থাকায় ওরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি যে সে রাজ্য বিধানসভার সদস্য । দুই পিজির বাইকে চড়ে সারা নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়ে জনসংযোগ রক্ষা করা, দুর্যোগে ছুটে যাওয়া রীতাই পারত । একারণেই রীতা রীতাদি, রীতাপিসি, রীতামাসি হয়ে উঠেছিল । সাব্রুমে নির্মীয়মান মৈত্রীসেতুর পরিকল্পনার প্রথমদিকে তা বানচাল করার চক্রান্তকে কীভাবে নস্যাৎ করা হয়েছিল সেদিন তা সাব্রুমের কয়েকজন সাংবাদিক আর রীতা ছাড়া বিশেষ কেউ জানেননা ।
রীতা শুধু আমার ছাত্রী নয় । বোন । নিজে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও আমার শরীরের খোঁজ খবর নিত । পরামর্শ দিত । একবার সীমান্ত হাটে যাওয়ার পথে আমিও সঙ্গী হয়েছিলাম । এই হাটটি চালু করার ক্ষেত্রে তার বিরাট ভূমিকা ছিল সেদিন ।পথে শ্রীনগরের এক কৃষকের সঙ্গে দেখা হয় । তিনি রীতাকে একটা বড়ো তরমুজ দিয়ে আপ্যায়ণ করেন। সুগারের রোগি রীতা টপাটপ দুতিন টুকরো তরমুজ খেয়ে আমাকে সাবধান করে, স্যর বেশি খাইয়েননা । আন্নের সুগার ।
গতমাসের শুরুতে আমরা সপরিবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম । কে কার যত্ন করবে । কে কাকে রেঁধে খাওয়াবে । সবাইকে আইসোলেশনে থাকতে হয়েছে । রীতা জানতে পেরে টানা দশদিন দুবেলা খাবার পাঠিয়ে গেছে আমার বাড়িতে ।
ফুল খুব ভালো বাসত রীতা । বাড়িতে আছে বাহারি ফুলের গাছ । উঠোনের একটা হাস্নুহানার কথা খুব বলত । আমন্ত্রণ করেছিল বৌদিকে নিয়ে জোছনারাতে তার বারান্দায় বসে হাস্নুহানার গন্ধ নেওয়ার জন্যে । আমাকে এবছর অনেকগুলো ফুলের চারা দেয় ও । প্ল্যান হত তিমিরদাদের বাড়ি গিয়ে ফুলের চারা আনার । আমার উঠোন থেকে কয়েকরকম ছোটো ফুলগাছের চারা দেওয়ার কথা ছিল । সে আর হয়ে ওঠেনি ।
এই প্রকৃতির মানুষ, পাখি, ফুল আর প্রিয়জনকে ছেড়ে অসময়ে পাড়ি দিল রীতা অনন্তকাননের পথে । চিরশান্তিতে থাকো আমার স্নেহের ছাত্রী, রীতা বোন আমার ।
No comments:
Post a Comment