মায়াতাঁতের অসমাপ্ত বয়নশিল্পী
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
'আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোকসভা না হয় প্রদীপ,
অবনমিত মেধার শহর ছেড়ে অভিমানে কেউ কেউ
রাতারাতি চলে গেছে কুয়াশাবৃত শীতের পাহাড়ি স্টেশনে। ( ইচ্ছাপত্র–প্রবুদ্ধসুন্দর কর )
না, প্রবুদ্ধ কোন কৃষ্ণপথ রেখে যান নি শোক প্রস্তাবের জন্য । পার্থিবপ্রস্থানের আগে ছিল তাঁর ছিল আশাময় পুলওভার । হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনুভব করেন, 'আরোগ্যের পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তাটুকু বেহেশ্ ত । নিজেকে যিনি তাঁরই দেহসচিব বলে আমৃত্যু ঘোষণা দিয়ে গেছেন তিনি তাঁর চিকিৎসাশয্যায় স্বনাম নিয়ে করছেন রসিকতা । লিখেছেন– 'আমি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নই । আমি গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ৬৫২ এ । প্রচন্ড নৈসর্গিক বিশ্বাস রেখেছেন তার শল্যচিকিৎসকের উপর যার ছুরি জাদুবিভায় মৃত্যু কেটে ফালা ফালা করে জীবন ছিনিয়ে আনবে । জন্মছকের বিশ্লেষণের প্রতিও তাঁর একসাগর আস্থা জীবনের উপরেই তো আলো ফেলে হে কবি ! পার্থিব পরিমণ্ডল আর এই আলো হাওয়ার বাউন্ডুলে পরিক্রমণের আর্তিই প্রতীক হয়ে আসে বারংবার । কিন্তু যে আত্মশবরক্ষক, সেই বুঝতে পারে এক রিক্ততার আলোকবর্ষের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তাকে মহাজগতের চক্রবালের আলোপ্রান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে । ক্রমশ সরে যাচ্ছে প্রিয়জনের যৌথস্বর, কবিতার কোলাহল । সামনে শুধু নীল উপত্যকা । পায়ে পায়ে উড়ছে ডার্করুম মঘানক্ষত্র, ইন্দ্রজাল কমিকস, মায়াতাঁত, নৈশশিস, আত্মবিষ, যক্ষের প্রতিভূমিকা, অসুস্থ শহর থেকে,এসিড বাল্ব আর স্বনির্বাচিত কবিতার পাতা ।
কফি হাউসের সেই আড্ডা থেকে উঠে আসা 'রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর'ই জানান দিয়েছে শিরোনামে যাকে ধরেছ সেই শিরোপা ধারণ করবে আগত কবিতাকনভোকেশনে । 'বাংলাকবিতা' যার জন্মদানের জন্য উন্মুখ হয়েছিল বহুকাল । তীক্ষ্ণ শ্লেষ আর আত্মকশা, সুতীব্র নাগরিক বয়ান যার, তার সমূহ উচ্চারণ অমোঘ হয়ে ওঠে বাংলাকবিতায় । প্রবুদ্ধসুন্দরকে নিয়ে বারবার আত্মরতিতে মাতেন কবি প্রবুদ্ধসুন্দর ।
পিতৃসত্বা তাঁর জীবনজিন ।তিনি বলেন, ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার / শুনেছি বাবার দৌড় এটুকুই ছিল । / আমি ঢাকা অব্দি গেছি । / বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরন / এ জীবনে আর কিছু নেই । ( উদাহরণ ) । ছিন্নমূল বাবার জীবনসংগ্রামকে দেখেছেন অন্তর দিয়ে । 'উনিশ শো একান্ন সালে যে গাছটি/ আখাউড়া স্টেশন পেরিয়ে প্যারীবাবুর বাগানের / সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে এসেছিল / সেই গাছটি আমার বাবা । / আজও মূলত্রাণ উল্টে ধরলে দেখা যায় / বাবা পায়ের পাতায় মরা রক্ত জমে / কেমন কালচে হয়ে আছে । আর যে আশ্রয়ভূখন্ডে বাবার স্থিতিবাসনা তাকে নিয়েই গর্বে তিনি উচ্চারণ করেন 'দূরদর্শনের টাওয়ারটি আমাদের আইফেল / বটতলা শ্মশানটি আমাদের মহানিমতলা / পাশে বয়ে যাওয়া নদী সেই গ্রিক পুরাণের লিথি / ধলেশ্বরে্য মিশনই আমাদের বেলূড়ের মঠ / জম্পুই হিলসই আমাদের ছোটো ভূস্বর্গ কাশ্মীর / সর্বোচ্চ বেতলিংসিব আমাদের শৃঙ্গ এভারেস্ট' ( শ্লাঘা ) । এক মর্মসচেতন রসানুভূতি রেখেই কবি অনায়াসে বলে যান– 'যে পা গুলো একদিন প্রণামের যোগ্য মনে হয়েছিল/সেগুলো শয়তানের খুর হয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে ( জ্যোতিষবচন ) । সৃজনের পরও যেন তৃপ্ত নন কবি । এজন্মের অসম্পূর্ণ প্রণয়ের সংক্ষোভে বলেন, 'পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু হয় / সমুদ্রমন্থন শেষে রাহুর কবন্ধ আমি / অমরত্ব নয়, চাই, চাঁদের প্রণয় ( পরজন্ম ) । চন্দ্রলুব্ধ কাঙ্খায় ভরে আছে কবির পরজন্মের স্বপ্ন । স্বপ্ন নিয়েই অন্তরার পথে এগোতে এগোতে কবি জীবনের কাছে আহ্বান জানান–'শুধু এগিয়ে দেয়ার পথে নিচু স্বরে বোলো / দরজা ভেজানো থাকবে / টোকা দেওয়ার দরকার নেই / আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে ( দরজা ) ।
জীবন ও অতিজীবনের মাঝখানে কবিতার তাঁবুতে যাপন আপনার । অবাধ বিচরণ না হলে এই গোষ্ঠের কী অনুপুঙ্খ বর্ণনাসফল হয় হে 'নীল উপত্যকার রাখাল' ! আপনিই পেরেছেন মায়াবি পরিভ্রমণের ধারাভাষ্যে তুলে দিতে 'সন্ধ্যার সেই শান্ত উপহার' । আপনার পর্যবেক্ষণে ও বাচনবিভঙ্গে সমগ্র কাব্যজগৎ রক্তেপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে জোছনার আলোছায়া গড়ে । সীমান্তবর্তী এই পার্বতীভূগোলের কবিতায় এক অত্যুজ্জ্বল বাঁক আপনি যা কালের মানচিত্রে চিহ্নিত হয়ে গেছে । অমরত্বের পথিক কবি আপনি তবু বলেন–
আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোক সভা না হয়, পল্লব
আমি চাই না,পাপেট ও বামন, শিরদাঁড়াহীন সুশীলেরা সভায় বলুক এসে মূলস্রোতে নয়,আত্মহননের পথ
বেছে নিয়েছিল প্রবুদ্ধসুন্দর ( ইচ্ছাপত্র ) ।
তাইতো কবি, আপনার অনির্দেশ যাত্রার পথে আমরা থামাবো না আপনার অনন্তরথ । কোন শোকসভাও নয় । শুধু আপনার শব্দের বিছানার এক প্রান্তে রেখে যাব এক স্বয়ংক্রিয় নির্দেশশলাকা । যার সংকেতে 'সন্ধ্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে উঠে একটি নক্ষত্র / বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ / কোনও একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে / বোঝা যাবে সেই নক্ষত্রের আলো / পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে সামান্য আগে ( আলো ) ।