দেশভাগের বিভীষিকা : বাঙালি জাতিসত্তার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ত্রিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীন হলেও তার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়ে গেছিল । তার মধ্যে দেশের ভেতর দীর্ঘকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে । এই অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফলে উপনিবেশিক শাসনে আর্থসামাজিক কাঠামোয় গ্রাম বাংলার অধিকাংশ হিন্দু ও মুসলমান জনগণ বিশেষভাবে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিল । অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত এই সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জমা হয়ে উঠেছিল । সেই ধূমায়িত বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগ এর কাজটি করেছিলেন দুই ধর্মের মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ । তার ফলেই সারা দেশব্যাপী ৪০ এর দশকে ছড়িয়ে পড়েছিল হিংসার রাজনীতি এবং এই অবস্থায়ই চল্লিশের দশকের ধর্মীয় হিংসার উত্তাল তরঙ্গমালা দেশভাগের অবস্থা সৃষ্টি করেছিল ।
আপাতদৃষ্টিতে ভারত বিভাগের পশ্চাৎপট হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা-কলহকে দায়ী করা হলেও Transfer of Power Documents এর ভিত্তিতে মনে করা হয়, "ভারত সাম্রাজ্য বিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবিভাগও ব্রিটিশ নীতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল । ক্রিপস মিশনে আমরা দেখি এই ব্রিটিশনীতির অকালবোধন, ক্যাবিনেট মিশনে তার পূজারতি ও মাউন্টব্যাটেন মিশনে তার পূর্ণাভিষেক ( সুকুমার সেন / ভারত বিভাগ : ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা- উনিশ ) ।
মাউন্টব্যাটেন মূলত ভারতবর্ষকে ভাগ করার জন্যই এদেশে এসেছিলেন । এটলি মন্ত্রীসভা ১৯৪৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন । তখনও হস্তান্তরের দিনক্ষণ ধার্য হয়নি । ২৪শে মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন এবং দেশভাগের কথা ঘোষণা করেন । এভাবে 15 আগস্ট ১৯৪৭ ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনক্ষণ স্থির হয়ে যায় । ৮ই জুলাই ইংল্যান্ড থেকে প্রাক্তন ইংরেজ বিচারক সিরিল র্যাডক্লিফ ভারতে আসেন সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে । তিনি এর আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে আসেননি । মানচিত্র পাঠ করার ( cartographic knowledge ) প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতাও তাঁর ছিলনা । ভারতবর্ষের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধেও কিছুই জানেন না ।তিনি এলেন ভারতবর্ষকে ভাগ করার দায়িত্ব নিয়ে । তিনি সরেজমিনে তদন্তেও গেলেন না । টেবিলে বসেই মানচিত্রের উপর কলম চালালেন । তিনি মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন । এদিকে জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ দেশটাকে যতটা সম্ভব দ্রুত ভাগ করার জন্য চাপাচাপি শুরু করেন । ( দেশ ভাগ- দেশত্যাগ, অনুষ্টুপ, প্রথম প্রকাশ-১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, বর্তমান সংস্করণ- ২০০৭ পৃষ্ঠা-২২ ; লিওনার্দো মোসলে 'দি লাস্ট দেজ অফ দি ব্রিটিশ রাজ'– পৃষ্ঠা ২২১) । এই তাড়াহুড়োর ফল ভয়াবহ হল । দেশের দুইটা অঞ্চলের বুকে নেমে এলো অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় । দুইটা প্রদেশের মানুষের নতুন পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু'। তাদের ছেড়ে যেতে হলো পূর্বপুরুষের বসতি, নদী, মাঠ , প্রান্তর । আশৈশব হেঁটে যাওয়া পরিচিত বনবাদাড় । পেছনে পড়ে রইল স্বজনের শ্মশান ও কবর । অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হল রিফিউজি ক্যাম্প, ফুটপাত আর রেলস্টেশন কিংবা খোলা আকাশ । কারো কারো স্থান হল আন্দামানে কিংবা দণ্ডকারণ্যে ।
মাউন্টব্যাটেন, জওহরলাল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তৎপরতায় ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় । বাংলা ও পাঞ্জাবের উপর দিয়ে এই কয়দিন রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল । এই কয়দিন শুধু মৃতদেহ নিয়ে ট্রেনগুলি পারাপার করেছিল । বাংলা সীমান্ত দিয়ে লক্ষ লক্ষ হিন্দু।নর-নারী, বৃদ্ধ ও শিশু উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় প্রবেশ করে । অন্যদিকে সামান্য সংখ্যক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানের চলে যায় । ব্রিটিশ নীতির দূরভিসন্ধি ও কংগ্রেস-লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দেশের দু প্রান্তের দুটি জাতি তাদের জাতিসত্তা চিরতরে হারিয়ে খন্ডিত ও রক্তাক্ত স্বাধীনতা লাভ করে ।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে অখন্ড বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষের ভাগ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ নেমে এসেছিল । মান-সম্মান ও ধর্মনাশের ভয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নবসৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গে, সংলগ্ন আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় । পাকিস্তানের অন্তর্গত মানুষ ভারতে অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিতে আশ্রয় নেয় । ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তের দুটি জাতির নিজস্ব সত্তা ও দ্বিখন্ডিত হয়। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে সেদিন রক্তাক্ত স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিল । আর পূর্ব প্রান্তের বাঙালির জাতিসত্তা চিরতরে দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল । এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের নাম দেওয়া হয় 'মোহাজের' । আর পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সমস্ত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বলা হলো 'উদ্বাস্তু' বা 'বাস্তুহারা' । আবার কোথাও কোথাও এদের নাম দেওয়া হলো 'পাকিস্তানি' কোথাও বা 'ভাটিয়া' বা 'বাঙাল' নামে স্থানীয় জনগণের তাচ্ছিল্যের শিকার হয় ।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় মানুষের কাছে এক নতুন মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল । যেন তারা মানুষ নয় । যে নামে তারা পরিচিতি পাক না কেন এদের সবার ভাগ্যে উপেক্ষা, অবহেলা,অনাদর ছাড়া যেন আর কোন প্রাপ্তি থাকার কথা ছিলনা । তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল তারা ততটা উপেক্ষা অবহেলা বা অনটনের শিকার হয়নি । পূর্ব পাঞ্জাব থেকে যারা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের ভাগ্যেও বেশি দুর্দশা ঘটেনি। ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গে যারা ধর্ম হারাবার ভয়ে বা প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের পরিচয় দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে, 'সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার ভূখন্ডে ঢুকল ওরা চোরের মতো । ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষ পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটার মায়া কাটিয়ে ছুটেছিল এপার বাংলায় । সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা, পৈশাচিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আর সামনে ছিল অনুষ্ঠিত ভবিষ্যৎ । যে মাটি ছিল মায়ের মতো, যার ফসলে ওদের জন্মগত অধিকার, সেখানে ওরা পরবাসী । এপারে ঝোপেঝাড়ে, বিলে, অনাবাদি ভূখণ্ডে গড়ে উঠলো নতুন বসতি । যেসব জমি আগাছা ভরা, পরিত্যক্ত, যেখানে কোনদিন ভুল করেও যায়নি মানুষ, বর্ষা ডেকে আনে প্রাণঘাতী বন্যা, সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বসতি । সরকারি অনুদানের ছিটে ফোঁটা জুটল কপালে । কিন্তু বেঁচে থাকতে, মাটির উপর শক্ত দুপায়ে দাঁড়াতে তার ভূমিকা ছিল নগণ্য । যারা এল দান হাতে, ভাগ্য ফিরল তাদেরই, মানুষকে মানুষ বঞ্চিত করে, না খাইয়ে হাত-পা বেঁধে ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তার ইতিহাস রক্তাক্ত না হলেও মর্মান্তিক । একটি জাতিকে নিষ্ঠুরভাবে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র কত যে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল তার প্রমাণ সেদিনের অন্ধকারময় ইতিহাস । বাঙালিকে সেদিন ছিঁড়ে খেয়েছে বাঙালি-অবাঙালি সবাই । তাদের পরিণত করা হয় একটি জড়পিন্ডে । অক্ষম অপদার্থ অলস এক জেনারেশনে ! যাদের কোনো ভূমিকা নেই ! মানুষের যাবতীয় সদগুণকে পিষে মারা হল । ওদের পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু' ( কমল চৌধুরী : বাংলায় গণ আন্দোলনের ছয় দশক ( দ্বিতীয় খন্ড ), পত্র ভারতী, এপ্রিল ২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৫ ) । এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আগত উদ্বাস্তু সম্বন্ধে যা যা বলা হয়েছে সন্নিহিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও তা বিন্দুমাত্র অতিকথন নয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং সংলগ্ন আসাম, ত্রিপুরায় কিভাবে কত দুঃখ লাঞ্ছনা আর উপেক্ষা সহ্য করে কোনক্রমে প্রাণধারণ করেছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে তার তুলনা বাঙালির ইতিহাসে সম্ভবত অনুল্লেখিত থেকে যাবে ।
দেশভাগের পরের প্রথম নয় বছরেই পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ২১ লক্ষেরও বেশি মানুষ । ডিসেম্বর ১৯৪৯ এ খুলনা এবং ১৯৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বরিশাল ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার পর এক লাখের কাছাকাছি মানুষ ভারতে চলে আসেন ১৯৫০ সালের ১৮ই এপ্রিল 'নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি: বা :দিল্লি চুক্তি: সম্পাদিত হয় । দেশভাগের পরে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে কতজন উদ্বাস্তু এপারে এসেছিলেন সে বিষয়ে সঠিকভাবে বলা যায় না । তবে একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলা এসেছিলেন ২১ লক্ষ ৪ হাজার ২৪২জন । ১৯৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৩০ লক্ষ ৬৮ হাজার ৭৫০ জন । ১৯৭১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে ছিল ৪২ লক্ষ ৯৩ হাজার জন । ফলে এই বিরাট সংখ্যার জনগণ একপ্রকার নিঃস্বভাবেই ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন । 'নেহেরু লিয়াকত চুক্তি' বা দিল্লি চুক্তি' ১৮ এপ্রিল ১৯৫০ উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেনি । শরণার্থী আগমনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ৪৭ এর পর পঞ্চাশে, ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে হযরত বাল মসজিদের দাঙ্গার সময়, ৬৫ তে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রাক্কালে, এবং একাত্তরের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত অনবরত শরণার্থীরা ভারতে আসতে থাকে । এরা পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মানুষ । চোরাগোপ্তাভাবে সেই স্রোত আজও অব্যাহত রয়েছে ।
দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অনেক বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল । কিন্তু বাস্তবে উদ্বাস্ত আগমনের চাপ পাঞ্জাব অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গ ও সন্নিহিত রাজ্যসমূহে অনেক বেশি ছিল। এর কারণগুলি প্রথমত, পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আয়তনে অনেক ছোট প্রদেশ । দ্বিতীয়ত, লোক বিনিময়ের ফলে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের উদ্বাস্তুরা লাভবান হয়েছিল । দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে যে সংখ্যক উদ্বাস্তু পূর্ব পাঞ্জাবে এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি মানুষ পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। হলে তাদের ফেলে আসা সম্পত্তি বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে ব্যবহৃত হয়েছিল ।
দাঙ্গা ও দেশভাগ নামক বিপর্যয়ের ফলে যেসব মানুষ তাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছিল তারা সরকারি সাহায্য ততটা পায়নি, যতটা পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা । পশ্চিমবঙ্গের সরকারের আমলা থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ সবার কাছে শুধু প্রতারণা আর ঘৃণায় পেয়েছিল । উপরন্তু তাদের ভাগ্যে জুটেছিল অলস ও নিষ্কর্মা অপবাদ । পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা নানাভাবে প্রত্যাখ্যাত ও প্রতারিত হয়ে ক্যাম্প গুলিতে মনুষ্যেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল । জন্ম, মৃত্যু তথা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কোন প্রকার আব্রু ছিল না । কিন্তু তারপরও এসব মানুষ এদেশের মাটিতে এদেশে জন সমাজে শেকড়ের সন্ধানে নিরন্তর নিয়োজিত ছিল । উদ্বাস্তুদের ক্রমাগত আগমনে স্থানীয় সরকার গুলো যেমন অসহায় তেমনি কেন্দ্রীয় সরকার ও উদাসীন ফলে এদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা মিটে গিয়েছিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে । কিন্তু ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা আজও মেটেনি । পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যে স্থান সংকুলনের অভাবে উদ্বাস্তুরা কখনো আন্দামানে, কখনো দণ্ডকারণ্যে নির্বাসনের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে । নদী-নালা দেশের মানুষ এইসব উদ্বাস্তুদের পক্ষে আন্দামান বা দণ্ডকারণ্য নির্বাসনে তুলল শাস্তি । আন্দামান বা দণ্ডকারণ্যে এই অসহায় মানুষগুলি স্বেচ্ছায় যায়নি তাদের একরকম জোর করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল । সেখানেও পরিকাঠামোর অভাবে সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতার কারণে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন আরেকপ্রস্থ প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছিল । শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিম্নতম জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় । শরনার্থী শিবিরের দিনযাপনে নিদারুণ যন্ত্রণা ও গ্লানি থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই স্বেচ্ছায় শিবিরগুলো ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, শহরাঞ্চল ও শহরতলিগুলিতে নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে । আর একেবারে নিরুপায় যারা তারা রয়ে যায় । কিন্তু সেই সংখ্যাটি নেহাত কম নয় ।
প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছরে উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উপর জোর দেন । তাই ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী পাঁচ বছর 'পুনর্বাসনের যুগ' নামে অভিহিত হয় । ভাষাগত সমস্যা না থাকায় পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি ও সিন্ধ্রি উদ্বাস্তুরা, দিল্লি, হরিয়ানা হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিয়ে সেখানে তারা তাদের বাসস্থান গড়ে তোলে । কিন্তু বাঙালি উদ্বাস্তুরা ভাষাগত সমস্যা ও অন্যান্য কারণে পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা ও আসামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নেহরু সরকার উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগে যথেষ্ট তৎপরতা দেখা গিয়েছিল । এই প্রয়াস শুরু থেকেই সুপরিকল্পিত ও সুসংহতভাবে পরিচালিত হয় । কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য সেই আন্তরিকতা ছিল না । পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের সেদেশে তাদের সম্পত্তির অধিকার রয়েছে বলে অজুহাত খাড়া করে তাদের সমপরিমান ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় । অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের তাদের ক্য়ক্ষতির সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় । এই বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে বাঙালি উদ্বাস্তুরা একদল কায়িক শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হয় । নবসৃষ্ট এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আজও ঘুচেনি । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই দরিদ্র মানুষগুলো আজও বিদেশী, বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত। তাদেরকে আজ 'সন্দেহজনক বিদেশী' বলে সনাক্ত করে, আটক করে 'নো ম্যানস ল্যান্ডে নির্বাসনে কাটাতে হচ্ছে । পূর্ববাংলা থেকে আগত এই মানুষগুলো ও তাদের উত্তরপ্রজন্মের উপর অমানবিক আচরণ ও নির্যাতন ও অবিচার চলতে দেওয়া যায় না । পূর্বসূরিদের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে তাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটানোর সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার । তাদের জন্যে সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করার জন্যে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ নেওয়াও দরকার।
দেশভাগের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষ ও তার উত্তরপ্রজন্ম হয়তো স্বপ্ন দেখেন জাতিসত্তার পুনর্মিলনের । কিন্তু এ আর তো হবার নয় । বরং এই উপমহাদেশের মধ্যে কোনো ঐক্যবদ্ধ সংগঠন সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে যেমন পারস্পরিক প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তি-সম্প্রীতি নিবিড় বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় তেমনি পিতৃ-পিতামহের দেশটার স্মৃতিকেও বুকের গভীরে আঁকড়ে ধরে রাখা যায় ।