*নবম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন : কিছু আবেগ, কিছু অভিজ্ঞতা*
*অশোকানন্দ রায়বর্ধন*
*উত্তরপূর্বের* বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে আসছে নিয়মিত ও অনিয়মিত । নিজেদের লেখালেখির সঙ্গে পরস্পর পরিচিত হওয়া, নিজেদের মধ্যে মনন,চিন্তার ভাব বিনিময় করা, এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির চর্চাকে অব্যাহত রাখা, লেখালেখির শৈল্পিক উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি এই অঞ্চলের বাংলাভাষা চর্চার সংকট, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির প্রকৃত স্বরূপ নির্ধারণ এবং নিরসনে প্রয়াসের ভাবনা বিনিময়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বাংলা ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে আজ বেশ কিছু বছর ধরে এই অঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের উদ্যোগে উদারবন্ধ, কৈলাশহর, শিলং, শিলচর, গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া আগরতলাসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলব্যাপী তাঁদের প্রয়াসকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে তাঁদের প্রয়াসকে নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন । লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের এই লড়াকু সৈনিকদের কোনো স্থায়ী সংগঠন না থাকলেও তাঁরা এক একটি প্রকল্প হাতে নিলে একডাকে সবাই সামিল হয়ে যান । ইতোমধ্যে তাঁরা উত্তরপূর্বের বিভিন্ন স্থানে নয়টি ফলপ্রসূ সম্মেলন সম্পন্ন করে ফেলেছেন । স্থায়ী কোনো ঠিকানা বা কমিটি না থাকলেও এই সংগঠনকে আজ আর অবহেলা করা যাবে না । কারণ এই সংগঠনের মাথার উপরে ছাতার মতো রয়েছেন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ সন্দীপ দত্ত ( তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি । বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য, কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ( তিনিও কার্যকারণে এবারের সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি । ) এবং কবি দিলীপ দাস ও প্রসূন বর্মন প্রমুখগণ ।
গত সাত এবং আট জানুয়ারি শিলচরে হয়ে গেল নবম উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন । শিলচর শহরের প্রাণকেন্দ্র ক্লাব রোড,দেবদূত মোড় কাছাড় নেটিভ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিস প্রাঙ্গনে । এই প্রতিষ্ঠানের জন্মেরও এক গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে । যেসময়ে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা সারা উত্তরবঙ্গ, সিলেট ও আসামে চাশিল্পকে কেন্দ্র করে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তার করে চলেছে সেই সময়ে প্রতিস্পর্ধী বাঙালি উদ্যোক্তা হিসেবে চাশিল্পে পদার্পন করেন দুজন বাঙালি উদ্যোক্তা । দীননাথ দত্ত ও বৈকুন্ঠচন্দ্র গুপ্ত মিলে ১৮৭৬ সালে গড়ে তোলেন এই প্রতিষ্ঠান । সেসময়ে সারা বাংলাদেশেই দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠার একটা আন্দোলন চলছিল । আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের 'বেঙ্গল ক্যামিকেল' তার উদাহরণ । তেমনি শিলচরের এটিও বাঙালিসৃষ্ট পাবলিক লিমিটেড চাশিল্প কোম্পানী । এই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত নেটিভ শব্দটি তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবেই রেখে দিয়েছেন । ইংরেজরা যে নেটিভ শব্দটি দিয়ে এদেশীয়দের কলঙ্কিত করেছে । এই বাঙালি প্রতিষ্ঠান এধরনের দেশীয় উদ্যোগে শিল্পের প্রতিষ্ঠা করার স্পরধা দেখিয়ে সেই কলঙ্ককে গর্বের বিষয় করে তুলেছেন । এতটাই ছিল তাঁদের জাতীয়তাবোধ । সেদিনের সেই দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান আজকের প্রতিষ্ঠান । দুদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন বরাক উপত্যকা নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র । যার মধ্যমণি হলেন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দীননাথ দত্ত মহোদয়ের দুই উত্তরসূরী শর্মিলা দত্ত ও চন্দ্রিমা দত্ত । শত ব্যস্ততার মধ্যেও সমস্ত কর্মকান্ডের উপর তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁদের । এই দুদিনের সম্মেলনে উপস্থিত প্রত্যেককেই আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন তাঁরা । ( এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাপুরুষ দীননাথ দত্ত তাঁদের প্রপিতামহ ) । সমগ্র অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিচালনায় আমাদের চিরন্তনী মাতৃশক্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন রাখেন তাঁরা । সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিটি সদস্য তাঁদের এই প্রয়াসে অভিভূত হয়ে গেছেন । উচ্চারিত হোক কিংবা অনুচ্চার, উপস্থিত প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে অনুভব করেছেন এই সর্বাঙ্গসফল এই প্রয়াসকে ।
সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ত্রিপুরা থেকে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সাহিত্যিকদের ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের একটা বড়ো অংশ শিলচরের উদ্দেশ্যে রওনা হন । বর্তমানে ট্রেনের সুবিধা থাকায় যে যার মতো করে জনশতাব্দী কিংবা আগরতলা-শিলচর এক্সপ্রেসে চড়েছেন । এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্যেশ্যে ত্রিপরার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখাকর্মী ও সম্পাদকদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন দিলীপ দাস ( সংসপ্তক ), দেবব্রত দেব ( মুখাবয়ব ), দেবাশিস চক্রবর্তী ( দেয়া ), জ্যোতির্ময় রায় ( প্রজন্ম চত্বর ), সুচিত্রা দাস( গিরিপথে হাওড়া ), খোকন সাহা ( ফোটামাটি ), বিপ্লব ওরাং ( উত্তরবার্তা ), অপাংশু দেবনাথ, সঞ্জীব দে ( বিজয়া ), জহরলাল দাস ( ভুবনডাঙা ), চন্দন পাল,সস্ত্রীক ( দেবদীপ ), রাহুল শীল, নবীনকিশোর রায়, সস্ত্রীক ( সময় সংকেত ), গোপালচন্দ্র দাস ( মনুতট ), দিব্যেন্দু নাথ ( দোপাতা ), অভীককুমার দে ( সমভূমি ), অমলকান্তি চন্দ ( রসমালাই ), রাজেশচন্দ্র দেবনাথ ( দৈনিক বজ্রকন্ঠ ), সঙ্গীতা দেওয়ানজী, সুচিত্রা দাস ( অনুস্বর ), সুস্মিতা দাস ( প্রতিভাস ), শ্রীমান দাস ( সৃষ্টি ), চয়ন সাহা ( ত্রিধারা ), অধ্যাপক, শৌভিক বাগচী, শান্তনু মজুমদার, শম্ভুশংকর চক্রবর্তী, গোপেশ চক্রবর্তী, অশোকানন্দ রায়বর্ধন ( জলীয় সংবাদ ) । এছাড়া বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কবি সেলিম মুস্তাফার 'পাখিসব করে রব' ধর্মনগরের কথা ও কবিতা গোষ্ঠীর 'জঠর'সহ আরো কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকসহ কবি সাহিত্যিকগণ । যার যার সুবিধামতো আসায় সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি সম্ভব হয়ে ওঠেনি । তবে সব মিলিয়ে পঁচিশটির মতো লিটল ম্যাগাজিন ও ত্রিশোর্ধ লেখক-লেখিকা, সাহিত্যকর্মী এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন । এই প্রতিবেদকের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল জলীয় সংবাদের সম্পাদক গোপেশ চক্রবর্তীর আন্তরিক উদ্যোগ ও সৌজন্যে । বিজয়া সম্পাদক ও কবি সঞ্জীব নিজ উদ্যোগ নিয়ে আমাদের অনেকের জন্যে আগরতলা- শিলচর এক্সপ্রেসে আগাম টিকিট সংগ্রহ করে রাখায় একসঙ্গে হৈ হৈ করে যাওয়া-আসার ফলে এক্সপ্রেস ডিগ্রিধারী লজঝরে ট্রেনেও কোনো ক্লান্তি অনুভব হয়নি । ট্রেনে যাওয়া আসার সময় আমাদের কেবিনগুলোতে চলে জমাটি আড্ডা গান । আসার সময় আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন সস্ত্রীক কবি চন্দন পাল । চন্দনগিন্নি তাঁর স্বভাবসুলভ মমতায় ট্রেনে সবার জন্যে টিফিন কিনে আনেন । বিলোনিয়া গিয়ে তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেননি এমন ঘটনা বিরল । অতিথিবৎসল এই ব্যস্ত গৃহিনী এই দুদিন খুবই আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন । আমাদের সাহিত্যচর্চা, যাপন, রাজনীতি, সময় ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে । ট্রেন যেখানেই থামে সেখানেই হৈ হৈ করে ট্রেন থেকে নেমে সেলফি তোলার ধুম পড়ে যায় । তারপর সোস্যাল মিডিয়ায় জানান দেওয়া । ছড়া কেটে যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা । এককথায় সাহিত্যমনস্কতাপুষ্ট হয়েই আমাদের ভাষাশহিদের শহর শিলচরে প্রবেশ ঘটে । শিলচর স্টেশন থেকে দেবদূত মোড়ের সন্নিকটে হোটেল কল্পতরুতে টুকটুকে চড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিলেন প্রজন্ম চত্বর সম্পাদক জ্যোতির্ময় রায়দা ।
কল্পতরু হোটেলে পৌঁছেই আমরা দেখি উদ্যোক্তারা পূর্বাহ্নেই আমাদের প্রত্যেকের জন্যে রুম বুক করে রেখেছেন । আমি ও টনিলাল পাঁড়ে ২৩২নং রুমে জায়গা পেলাম । টনিলাল পাঁড়ে আমাদের রাজ্যের একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক প্রয়াত জয়া গোয়ালার স্বামী । জয়া আমাকে দাদা ডাকত । সে হিসেবে আমার বোনাই তিনি । তিনিও বিপ্লব ওরাং নামে ত্রিপুরার চাবাগান অঞ্চলে প্রচলিত 'ছিলোমিলো' ভাষায় সাহিত্যচর্চা করছেন । তাঁর কবিতা ইতোমধ্যে উত্তরপূর্বসহ সমগ্র বাংলাভুবনে পরিচিত হয়ে গেছে । এবারের সম্মেলনেও এই কবিকে নিয়ে অনেককে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা গেছে । তাঁর সঙ্গে দুটোদিন একসঙ্গে নাওয়া-খাওয়া, আলোচনা, ঘোরাঘুরি করেছি । কর্মজীবনে তিনি ত্রিপুরা রাজ্যসরকারের ইন্টেলিজেন্স দপ্তরের কর্মী ছিলেন । তাঁকে চিনলেও পুলিশের লোক বলে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতাম । কিন্তু এই দুদিনের সান্নিধ্যে মানুষ টনিদা কবি বিপ্লব ওরাংকে চিনতে পেরেছি ভালোভাবে । এত সহজ, সরল, সাদামাটা ভালোমানুষ খুব কমই হয় । তাঁর কবিতার ভাষাও তেমনি সরল এবং সরল মানুষজন নিয়েই তাঁর কবিতা । হোটেলে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিচে নেমেই আমরা গেলাম একটু দূরের আমাদের সম্মেলনস্থলে । ভেতরে ঢুকেই অভিভূত হয়ে গেছি চত্বরটার সজ্জা দেখে । 'হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে' যেন প্রবেশ করলাম আমরা । গোটা চত্বরের আলোআঁধারির সৌন্দর্য একটা মায়াময় পরিবেশ ।মঞ্চে, গাছে গাছে, খুঁটিগুলোর গায়ে গায়ে ঝুলছে অজস্র নানারঙের ঘুড়ি । মনে হল, লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে হাজারো সাহিত্যসম্ভাবনা আকাশে উড়তে চায় এই ঘুড়িগুলোর মতো । রয়েছে নানারকম বাঁশ-বেতের তৈরি ডালা-কুলো-ডুলা ইত্যাদি গৃহস্থঘরের নানা কৃষিসরঞ্জাম । বাঙালির লোকজীবনের উপকরণ । সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা শর্মিলাদির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে এই বাঁশ-বেতের নিপুণ কাজগুলো গ্রামীন শিল্পীরা করেছেন । আমরা সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পর রাতের খাবার এবং রাত্রিবাসের জন্যে হোটেলে ফিরে এলাম ।
পরদিন সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের সময়সূচী ছিল সকাল দশটায় । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হতে প্রায় দেড়ঘন্টা দেরি হয়ে যায় । ফলে এইদিনের সমস্ত কার্যক্রমের উপর তার প্রভাব পড়ে । তবুও উদ্বোধন পর্বটি ছিল অভিনব ও অর্থবহ । সম্মেলনের প্রবেশদ্বারের সামনেই একটি ডালায় কিছু ধান রাখা ছিল । সবাই এই ডালার তিনদিক ঘিরে দাঁড়ানোর পর বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য্য, সাহিত্যিক প্রতিভা সরকার ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরার হাত দিয়ে ধানগুলোকে ভাগ করে দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন । আসলে এটা একটা প্রতীকী সূচনা । বাঙালির লোকজীবনে ধানই ধন । ধানই সংবৎসরের রসদ । ধানই জীবনের চালিকাশক্তি । রক্ত ও রস । ধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত আমাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি । আমরা ধান ফলাই সম্মিলিত শ্রমে । আর ধানফসল ভাগ করে নিই সবাই । ওঁ সহনাববতু । সহনৌ ভুনক্তু । সহ বীর্যং করবাবহৈ । তেজস্বীনাবধীতমস্তু । মা বিদ্বিষাবহৈ । ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ । (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ৩/১ ) । যার শেষ কথা আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি । ধান ভাগ হলেও প্রাণ ভাগ হবে না । প্রাণে প্রাণে মেলার বার্তা নিয়ে শুরু হল নবম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন । দুদিনের আনন্দযাপন । এরপরই অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে কুটির আকৃতির প্রতীকী নির্মানের দেওয়ালে ফুলের মতো ছড়ানো ছিল প্রাচীর পত্রিকার বিভিন্ন লেখা । এই প্রাচীর পত্রিকা ঢাকা ছিল বাঙালির লোকউপকরণ গামছা । এই গামছাগুলোকে দুপাশে সরিয়ে প্রাচীর পত্রিকা 'প্রাচীর ফুল'-র আবরণ উন্মোচন হয় । জানা যায় এই প্রাচীর পত্রিকার সমস্ত লেখা অনুলিপি করে সাজিয়েছেন মঞ্জরী হীরামণি রায় স্বয়ং । লেখার সঙ্গে সমস্ত ছবি এঁকেছে নবম শ্রেণির একটি ছাত্র । সম্মেলনস্থলের সমস্ত রঙিন ঘুড়িগুলো তৈরি করেছে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ছাত্ররা । তারপর সম্মেলনে আগত প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনের নাম লেখা রঙিন বেলুন সম্মিলিতভাবে সব সম্পাদকেরা আকাশে উড়িয়ে দেন ।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধন পর্বে অনেকগুলো বিষয় সংযোজিত হওয়ার ফলে পরবর্তী পর্বগুলো খুব দ্রুত শেষ করতে হয় । প্রথম পর্বে অতিথিবরণ, স্বাগত বক্তব্য, সম্মানিত অতিথিদের শুভেচ্ছা বক্তব্য, গ্রন্থ উন্মোচন ও নির্দিষ্ট বক্তাগণের আলোচনা ছিল । মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে প্রতিনিধিস্থানীয় গল্পকারগণ গল্পপাঠ করেন । গল্পকার দেবব্রত দেব ত্রিপুরার প্রতিনিধিত্ব করেন । মধ্যাহ্নভোজের পর ছিল কবিতাপাঠের আসর । কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কবি দিলীপ দাস । সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । কোম্পানির অফিসপ্রাঙ্গণ ঘিরে বসে উত্তরপূর্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লিটল ম্যাগাজিনের মেলা । বরাক নন্দিনীরা ঘুরে ঘুরে সবার সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখছেন । আড্ডা দিচ্ছেন । সবার জন্যে জলযোগের ,খাবার ব্যবস্থা করছেন । আবার অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বও পালন করছেন । তাঁদের নিরলস কর্মকান্ডে আমাদের চিরন্তনী মাতৃমূর্তি দশভুজার কথাই মনে করিয়ে দেয় । শুধু তাঁরাই নন । শিলচরের সব মানুষের মধ্যেই যেন আন্তরিকতার একটা ঘরানা । কবি বিপ্লব ওরাং পানগ্রামের বড়সিঙ্গা চাবাগানে কবি-প্রাবন্ধিক কাজল দেমতার সঙ্গে দেখা করার যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাদের হোটেলের উল্টোদিকের পা দোকানদার যুবকটি নিজে আগ্রহ নি অত্যন্ত সূন্দরভাবে যাত্রাপথ বুঝিয়ে দেন । অটোচালকও অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহার করেন । আমাদের রাজ্যের মতো দুর্ব্যবহার করা বা অচেনা যাত্রীকে ঠকানো মানসিকতা তাঁদের নেই । আমরা আরো বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে যাই আসার দিনের একটি ঘটনায় । সকালবেলা আমি, গোপেশ ও টনিদা স্বর্গদ্বার মহাশ্মশানে এগারো ভাষাশহিদের স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্যে আমরা রওনা হই । একসময়ে শিলং পট্টিতে গিয়ে আমরা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের মূর্তির কাছাকাছি গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলি । সেই সাতসকালে বিমান গোস্বামী নামে এক ভদ্রলোক তাঁর গাড়িতে করে আমাদের শ্মশানের সামনে পৌঁছে দেন এবং ফেরার রাস্তারও স্পষ্ট ধারণা দিয়ে দেন । এই ভদ্রতা তাঁদের জীবনধারার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ।
দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান । এরপর বিশিষ্ট বক্তাগণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন । মধ্যাহ্নভোজনের পরেই শুরু হয় সম্পাদকের বৈঠক । নামে সম্পাদকের বৈঠক হলেও সম্পাদকদের আলোচনার সুযোগ মোটেই ছিলনা । শুধু প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিচয়টুকুই দিতে পেরেছেন । সঞ্চালক বক্তাদের জন্যে কয়েক সেকেন্ড বরাদ্দ করেছেন অথচ নিজে অনেক সময় নষ্ট করেছেন কথা বলে । তাছাড়া তারস্বরে সঞ্চালনা অনুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত হয়নি । এরপর অনুষ্ঠিত হয় জমজমাট বিতর্কসভা । বিতর্কের বিষয় ছিল 'সামাজিক মাধ্যম লিটল ম্যাগাজিনের সংকট ডেকে আনছে' । পক্ষে ও বিপক্ষে চারজন করে প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন পক্ষে অংশগ্রহণ করেন সুজয় রায়, খোকন সাহা, রজতকান্তি দাস ও দোলনচাঁপা দাস পাল । বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন জয়দীপ ভট্টাচার্য, বাসব রায়, চয়ন সাহা ও অধ্যাপক তিমির দে। প্রত্যেকেই স্ব স্ব পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখে বিতর্কের আসর সরগরম করে তোলেন । বিতর্কের পক্ষে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেন দোলনচাঁপা দাস পাল এবং বিপক্ষে আলোচনায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার লাভ করেন বাসব রায় । দলগতভাবে বিপক্ষে আলোচক দল ( ১৮৭/১৪৭ ) বিজয়ী বলে ঘোষিত হয় । এই বিতর্কসভার বিচারক ছিলেন এই প্রতিবেদক ও শাশ্বতী ভট্টাচার্য । সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কবি সুজিত দাস । এদিন সন্ধ্যার আগে শুরু হয় কবিতাপাঠ । এই পর্বে সঞ্চালনা করেন কবি অপাংশু দেবনাথ ও দোলনচাঁপা দাস পাল । সবশেষে আলোচনার মাধ্যমে স্থির হয় যে, উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিনের আগামী সম্মেলন নাগাল্যন্ডের কোথাও অনুষ্ঠিত হবে । রাতে ধামাইল নৃত্য সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে । রাতের খাওয়ার পর্বে ছিল বরাক অঞ্চলে বিশিষ্ট 'চুঙ্গাপিঠা' ও ক্ষীর । চুঙ্গাপিঠা অনেকটা ত্রিপুরার 'বাঙ্গুই'র মতো । তবে প্রস্তুতপ্রণালী আলাদা । বিরৈন ( বিন্নি ) চালের এইপিঠা ক্ষির সহযোগে মধুরেন সমাপয়েৎ বহুদিন মনে থাকবে । গোটা সম্মেলনেই যেন লোকসাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে ধ্রুবপদের মতো জড়িয়ে দিয়েছেন বরাক নন্দিনীরা । এই সম্মেলন এ অঞ্চলে ভীষণ সাড়া জাগিয়েছে । সম্মেলনস্থলে লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে প্রজেক্ট তৈরি করার জন্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌসুমী বৈষ্ণব, রাখি চক্রবর্তীসহ একদল ছাত্রী । সম্মেলনে আকৃষ্ট হয়ে 'কথা-বিকল্প নামে সংসথার মন্দিরা নাথ, দীপ ভট্টাচার্য ও রাজদীপ দাস প্রত্যেক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাককে একটি করে ক্যালাঞ্চু ফুলের চারা ও এক প্যাকেট 'বিরৈন' চাল উপহার দিয়েছে ।
এক একটি সম্মেলন আমাদের সমৃদ্ধ করে । সম্মেলন থেকে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি । নবম সম্মেলনও আগামীদিনের জন্য অবশ্যই দিশারী হয়ে উঠেছে । উত্তর পূর্বের বিভিন্ন অংশে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে যে সংগঠন সেই উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিনের কোনো স্থায়ী সংগঠন নেই । ফলে বেশ কিছু সময়ের ব্যবধানে এই সম্মেলন হয়ে থাকে । কখনো কখনো স্থানীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে বৎসরান্তেও সম্মেলন করা সম্ভব হয় না । সেকারণে কোনো সম্মেলন করার প্রাক্কালে সঠিক সময়সূচী অনুসরণ করার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করা দরকার । অনুষ্ঠানসূচীতে লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনার পরিধি আরো বাড়ানো দরকার । কারণ এই অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার সমস্যা, সংকট, লেখালেখির গতিপ্রকৃতি, বিপনন ইত্যাদির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা দরকার । 'সম্পাদকের বৈঠক' শুধু মঞ্চে উপস্থিতি জাহির করা নয় । নিজেদের সমস্যা, সংকট ও নিরসনের উপায় নির্ধারণেও খোলামেলা ভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা করা দরকার । গল্পপাঠের ক্ষেত্রেও প্রতিনিধিস্থানীয় কবিদের রাখলে সময়ের সাশ্রয় হয় । এক্ষেত্রে অগ্রজ কবিদের তুলনায় তরুণ কবিদের বেশি করে সুযোগ দেওয়া দরকার । এর ফলে সময়টাকেঝঞ যথাযথ ব্যবহার করে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব । পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে এই সংগঠনের স্থায়ী কোনো কমিটি নেই । এবারের সম্মেলনে আলোচনাকালে কবি দিলীপ দাস একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন । এই প্রস্তাবকে নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে । এই কমিটির সদস্যরা দূরদূরান্তে থাকলেও বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ভার্চুয়াল মোডেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন । কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । নির্দিষ্ট সময়ান্তরে সম্মেলন সাপেক্ষে বিভিন্ন রাজ্যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনাচক্র, গল্প-কবিতপাঠের আসর করা যায় । প্রতিবেশী রাজ্যের প্রতিনিধিদেরও রাখা যায় । এভাবে কম খরচে লিটল ম্যাগাজিন চর্চার জারি রাখা যায় । এছাড়া ওয়েবিনারের মাধ্যমেও তা করা । তার জন্যে শুধু একটা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম দরকার । এব্যাপারে অধ্যাপক সুশান্ত করসহ আরো অনেক অভিজ্ঞজন রয়েছেন । তাঁরা সাহায্য করতে পারেন । লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখন্ডের কবি-সাহিত্যিকদের যেমন আমন্ত্রণ জানানো হয় তেমনি পূর্বোত্তরের আসাম সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ থেকেও প্রতিনিধিস্থানীয়দের আমন্ত্রণ করা যেতে পারে । এভাবেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও রূপায়ণের মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করার সাথে এই লেখালেখিরও আরও উৎকর্ষ সাধন সম্ভব ।