নৃত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার ধারা
নৃত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
নৃত্য হল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের প্রকাশ । নৃত্য হচ্ছে সংগীত ও ভালোবাসার সন্তান । নৃত্য সর্বজনীন কলা । এর সঙ্গে আছে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধুর সম্পর্ক। আদিম যুগ থেকে মানবজাতি স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে নৃত্য করছে । আদিম যুগের গুহাবাসী মানুষের নৃত্য ছিল শিকারভিত্তিক । পরবর্তী নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ যখন চাষবাস শিখে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল তখন এল কৃষিভিত্তিক নৃত্য । এরই সাথে তখন ধর্মীয় কার্যকলাপে নৃত্য চর্চার প্রচলন আরো বাড়ল । অথচ এই আদিম মানুষের সংস্কৃতিতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না । সংস্কৃতি অনুশীলনে ছিল অকৃত্রিম আন্তরিকতা যার অভাব আমাদের মধ্যে দেখা যায় । এরপর ক্রমশ হিন্দু বৈদিক যুগ, জৈন, বৌদ্ধ, মৌর্য, শুঙ্গ, কুশান যুগ, যুগ, গুপ্তযুগ, মুসলিম যুগ রাজত্ব করেছে ভারতের বুকে । ফলে সংস্কৃতির ধারায় ঐতিহ্যপূর্ণ ভারতবর্ষের ইতিহাস
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতের ভূমিতে । ফলে ভারতবাসীর ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি কখনো লুণ্ঠিত হয়েছে, কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে মিশ্র সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে । তবে সংস্কৃতির পরিবর্তনের বা পরিবর্তিত রূপের পিছনে রয়েছে মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক কারণ তা অনুস্বীকার্য ।
ভারতবর্ষের প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । তা হল নৃত্ত, নৃত্য ও নাট্য । ভরতমুনি তার নাট্যশাস্ত্রে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য বিস্তৃতভাবে আলোচনা না করলেও পরবর্তীকালে পন্ডিত ধনঞ্জয় তার দশরূপক গ্রন্থে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ।
সাহিত্যগত উপাদানে নৃত্যের উৎস প্রসঙ্গে এক অলৌকিক শক্তিকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন এবং নৃত্যের উৎসে সেই শক্তির প্রভাব স্বীকার করা হয়েছে । একথা অনস্বীকার্য যে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব আর সেই কারণেই তাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক একটি দিক যা অন্য জীবের ক্ষেত্রে নেই । ক্রমে নৃত্যে অলৌকিক শক্তিকে তুষ্ট করা থেকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এবং ধীরে ধীরে মনোরঞ্জনমুলক পর্যায়ে পর্যবসিত হয় । ফলে তা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সৃজনশীল । দীর্ঘ সময় ধরে এক সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নৃত্য ক্রমে উপজাতীয় নৃত্য, আদিবাসী নৃত্য, লোকনৃত্য থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যে পরিণত হয়েছে ।
প্রস্তাবিত গবেষণার ভিত্তি হবে ভারতীয় সমস্ত শাস্ত্রীয়নৃত্য এবং এই নৃত্য গুলির প্রাসঙ্গিকতার কথা ভেবেই বিভিন্ন মতবাদের আলোচনার মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে । ভরতনাট্যম, কত্থক, কথাকলি, কুচিপুডি, ওড়িশি মোহিনীআট্টম, মনিপুরী, সত্রিয়া এই আটটি নৃত্য ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্য নামে পরিচিত । ভারতবর্ষের কিছু কিছু রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি সাধারণত এক একটি রাজ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছে । যদিও আমাদের ভারতবর্ষে সর্বমোট ২৯ টি রাজ্য কিন্তু শাস্ত্রীয় নৃত্যের বা উচ্চাঙ্গ নৃত্যের সংখ্যা আটটি আর এই আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য সাতটি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যের এইসব শাস্ত্রীয় নৃত্য কম বেশি অনুশীলন করা হয়ে থাকে । বর্তমানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়ে বিদেশেও অনেক কাজ চলছে পরিবেশিত হচ্ছে এবং গবেষণামূলক কাজও হচ্ছে । বহু বিদেশী ভারতবর্ষে এসে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা করছেন ।
ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার ধারা
ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মোট আটটি রাজ্য রয়েছে এবং তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য হল ত্রিপুরা । এই ত্রিপুরা রাজ্য এখন শিক্ষা সংস্কৃতি ও খেলাধুলা সবদিক থেকে অনেকটা উন্নত । ত্রিপুরা রাজ্যেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলির কমবেশি চর্চা করা হয় । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই রাজ্যে সাতবার এসেছিলেন ত্রিপুরা সংস্কৃতিচর্চার উপর মুগ্ধ হয়ে । যদিও এই সংস্কৃতির প্রসারন ও অনুশীলন ত্রিপুরার রাজাদের আনুকূল্যে তা বিকাশ লাভ করে ।
ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য এই রাজ্যের আয়তন ১০৪৯১'৬৯ বর্গ কিলোমিটার এবং সর্বমোট লোকসংখ্যা ২০১১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী ৩৬ লক্ষ ৭১ হাজার ৩২ জন । এই রাজ্যের মধ্যে মিশ্র জাতির বসবাস । তাই এই রাজ্যে মিশ্রসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । এ রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ লোক বাঙালি এবং ৩০% লোক উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত । ত্রিপুরার আদিম উপজাতিরা প্রাচীন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত । ত্রিপুরায় সর্বমোট ১৯ টি উপজাতি নিয়ে ত্রিপুরার উপজাতি জনসমষ্টি গঠিত । এরা সবাই সংবিধান স্বীকৃত তপশিলি ভুক্ত উপজাতি । এই ১৯ টি উপজাতির মধ্যে ১২ টি স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায় এবং ৭টি বহিরাগত উপজাতি সম্প্রদায় । স্থানীয় উপজাতিরা হল :- ত্রিপুরী, রিয়াং, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, মগ, চাকমা, হালাম,কুকি, গারো, লুসাই, উসই । আর সাতটি বহিরাগত উপজাতিরদের মধ্যে হল–খাসিয়া ভুটিয়া লেপচা সাঁওতাল মুন্ডা ভিড় ওঁরাও ।
নৃত্যকলা ও উপজাতীয় সংস্কৃতি :-
নৃত্যকলা উপজাতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । উপজাতীয় সমাজের নৃত্যকলার চর্চা শুরু হয়েছিল সংগীত চর্চারও বহু পূর্বে । সঙ্গীত ও নৃত্যের চর্চা নিছক অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত না হয়ে জীবনে প্রয়োজনের তাগিদেই এই দুই ধরনের কলাবিদ্যার জন্ম হয়েছিল। সঙ্গীত ও নৃত্যকলা জীবনের স্পন্দন ও জাদুকরী শক্তির উৎস । এই শক্তি সঞ্চয় করে উপজাতিদের প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হয় । বলতে গেলে সঙ্গীত-নৃত্যের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত দেবতাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার মানসিক শক্তি অর্জিত হয়, নৃত্যকলার মাধ্যমে দেবতাদের রোষবহ্নি নির্বাপিত হয় ।দেবতারা খুশি হয়ে ক্ষণজীবী ভক্ত মানুষদের সাহস ও শক্তি দান করেন । দেবতাদের অনুকম্পা লাভ করে উপজাতীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবনের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ বর্ষিত হয় । আদিবাসী নৃত্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত নৃত্যগবেষক শ্রীমতি গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,
'
আদিবাসীদের নৃত্য ও সংস্কৃতির মূল্য যাচাই করতে গেলে তাদের জীবনের গুণগতমান সামাজিক গঠন ও মানসিক শক্তির বিষয়ে বোধগম্য হতে হবে । আদিবাসীরা জীবনের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায় ।ঋ কর্মময় জীবন এবং অবসর বিনোদন এ দুটোকে আলাদাভাবে দেখতে তারা নারাজ । নৃত্যকলাকে জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে হিসেবে তারা গণ্য করে । জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো । নৃত্য আদিম যুগের নৃত্যকলা জীবন ধারণের সহায়ক বলে পরিকল্পিত হত । সে যুগে নৃত্যকলা জীবন সংগ্রাম ও উন্নতি সাধনের মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । সেই আদিম যুগে নৃত্য পরিবেশনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত এবং উৎসাহব্যঞ্জক । তাদের নৃত্যভঙ্গিমা প্রায়শই পশুপাখির স্বাভাবিক চলন ভঙ্গি থেকে অনুকৃত । দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করতে মহামারী রোধ করতে বৃষ্টিপাত ঘটাতে অথবা শিকার ধরার প্রেরণার মুখ্য মাধ্যম হিসেবে নৃত্য পরিবেশনা অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হত । আদিবাসী নৃত্যের মুদ্রা রচিত হয় অনেক সময় পশু পাখির চলনভঙ্গির অনুকরণে ।
সুপ্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের ভাষা, সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা । কিন্তু একসাথে মিলেমিশে বসবাস করাতে এখানে মিশ্রসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । এখানে সমস্ত সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা লোকনৃত্য রয়েছে । সেই লোকনৃত্য গুলি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেমন, বিবাহ, জন্ম ইত্যাদিতে এবং ভৌতিক বা ধর্মশ্রিত নৃত্য যেমন, দেবতা অপদেবতাদের পূজা, মৃত আত্মার আবাহন, সম্মোহন, নবান্ন, শিকার প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলিতে পরিবেশন করে থাকেন ।
ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপজাতীয় লোকনৃত্য হল :-
উপজাতি নৃত্য :-
ত্রিপুরি মামিতা, লেবাং বুমানি, গড়িয়া
রিয়াং হজাগিরি
চাকমা বিজু
গারো রাংসুগালা, ওয়ানগালা
বাঙালি ধামাইল
মগ ক্যামুং, সইং, ছিমুইং
হালাম হৈ-হক
লুসাই চেরো / বাঁশ নৃত্য
সাঁওতাল বাহা ইত্যাদি ।
ত্রিপুরা রাজ্যের এই সমস্ত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আচরিত ধর্ম, পূজিত দেবদেবী, অনুষ্ঠিত নৃত্যকলা এবং পালিত পূজা পার্বণ উৎসব অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস রয়েছে । এদের আদি ধর্ম ছিল নিছক সর্বপ্রাণবাদ বা জড়বাদ । কিন্তু কালের স্রোতে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বিবর্তনে, সংমিশ্রনের ও পরিবর্তনের ধারায় মিলেমিশে তা একাকার হয়ে গেছে । তাই আজকের যুগে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্ম সংস্কৃতির অবয়বে পুরোপুরি আদি ধর্মের চিহ্ন খোঁজা বৃথা । নিম্নে ত্রিপুরারাজ্যে প্রচলিত কয়েকটি বিশিষ্ট লোকনৃত্যের উপর আলোকপাত করছি ।
বরক/ত্রিপুরীসমাজের লোকনৃত্য :-
লেবাং বুমানি নৃত্য– ত্রিপুরী সমাজের পরিবেশিত অন্যতম ও অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্য । ত্রিপুরীরা মূলত জুমচাষী । তারা জুমখেতে ধানসহ নানাবিধ কৃষিজ ফসল ফলায় । জমি ক্ষেত্রে যখন ধান গাছে শিস আসে তখন লেবাং ( পঙ্গপালের মতো ) নামে জাতীয় কীট এই শিসের নরম অংশ খাওয়ার জন্য আক্রমণ করে ।জুমখেত লেবাং দ্বারা আক্রান্ত হলে ত্রিপুরার জুমিয়ারা এই কীট তাড়ানোর জন্য দলবদ্ধভাবে উদ্যোগ নেয় । এই লেবান নামক কীটকে নৃত্যের মাধ্যমে বিতাড়নের তাগিদ থেকেই দলবদ্ধ এই নৃত্যের নামকরণ হয়েছে লেবাং বুমানি । 'বুমানি' ককবরক শব্দ । যার অর্থ তাড়ানো । মূলত প্রয়োজনের তাগিতেই এই লেবানবো মানে নৃত্যের উদ্ভব ।
লেবাং তাড়াবার এই নৃত্যে নৃত্য পরিবেশন কারীরা শুধুমাত্র লেবাং বিতাড়নের মুদ্রাই নৃত্যে পরিবেশন পরিবেশন করে না । তারা ফাঁকে ফাঁকে লেবাং কীটগুলো হাতের মুঠোয় আটকে রেখে মজাও করে । লেবাং নৃত্য পরিবেশিত হয় এক টুকরো আস্ত বাঁশের তৈরি শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রের তালে তালে । তারা দুই হাতে দুটো বাঁশ নিয়ে নিতে তালে তালে ঐক্যবাদন সৃষ্টি করে । তালবদ্ধ জোর শব্দের আকর্ষণে লেবাং ঝাকে ঝাকে জুমখেতে নামতে থাকে । এবং তখন মৃত্যুকারীদের জুমক্ষেতের উঁচু-নিচু অংশে লেবাং ধরার বা মারার ভঙ্গি করতে হয় । এই অনুকৃত মুদ্রাই লেবাং বুমানি নৃত্য ।
গড়িয়া নৃত্য– বরক বা ত্রিপুরী উপজাতিদের আর একটি বিশিষ্ট নৃত্য হল গড়িয়া নৃত্য । গড়িয়া নৃত্য ত্রিপুরার জনপ্রিয় লৌকিক নৃত্য । গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গড়িয়া নৃত্যের উদ্ভব । ত্রিপুরার গড়িয়া পূজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, জুম ক্ষেতকে শস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য গড়িয়া বা শস্য দেবতাকে আরাধনা করা । ত্রিপুরী ও অন্যান্য সমাজেও গড়িয়া দেবতাকে সম্পদ ও সমৃদ্ধির ( God of wealth and prosperity ) দেবতা রুপে কল্পনা করা হয় । গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গড়িয়া নৃত্যের উদ্ভব । সেজন্য গড়িয়া নৃত্যে দেবভক্তির ভাবনারসের সঙ্গে অনুষ্ঠানগত চিত্তবিনোদনের আনন্দরসের মিশ্রণ ঘটেছে । গড়িয়ানৃত্যে বিভিন্ন ধর্মীয় আচারগত মিশ্রণ ও ঘটেছে । কিন্তু গড়িয়ানৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রার ভঙ্গি প্রত্যক্ষ করলে ধর্ম ও আচার নিরপেক্ষ শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রমোদনৃত্যই বলে প্রতিমান হবে । বলাবাহুল্য গড়িয়ানৃত্যের অনুকৃত মুদ্রা বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা ও পশুপাখির নানা অঙ্গভঙ্গিকে অনুকরণ করে গড়িয়া নৃত্যের মুদ্রার সৃষ্টি । শোনা যায়, প্রাচীনকালে গড়িয়ানৃত্যের মুদ্রার সংখ্যা ছিল ২২টি । এক একটি মুদ্রা বা ঢঙের জন্য একেকটি বোল । ঢোল ( ত্রিপুরী ভাষায় খাম ) বাজিয়ে বা বোল বাজিয়ে নৃত্যের ঢং বলে দেওয়া হয়। বোলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাচের ভঙ্গিও যায় পাল্টে । নাচের মুদ্রার মধ্যে কোনটা স্নানের, কোনটা কাপড় কাচার, কোনোটা আয়না দেখে কেশবিন্যাস, কোনটা শিশুকে স্তন্যপান করানো ইত্যাদি থাকে । গড়িয়ানৃত্যে ঐন্দ্রজালিক অথবা রহস্যময়তার ভাব নেই । শুধু এই নৃত্যধারাকে বৈচিত্র্যময় ও রমনীয় করার জন্য পশু পাখির বিচিত্র চলন ভঙ্গিমার অনুকরণ করে নাচের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলা হয় ।
মশক নৃত্য– ককবরক ভাষায় 'মশক' শব্দের অর্থ 'হরিণ' । হরিণ শিকারকে কেন্দ্র করে এই নৃত্য ত্রিপুরীদের প্রাচীন শিকারজীবনের কথা মনে করিয়ে দেয় । হরিণ শিকার করে ক্লান্ত হয়ে সঙ্গীসাথীদের সাথে বাড়ি ফেরার পথে তারা আনন্দের সঙ্গে গান এবং নৃত্য করতে করতে থাকে । নাচের তালে তালে বাড়ি ফেরার এই ভঙ্গি হল মশক নৃত্য ।
মামিতাং নৃত্য– জুমের পাকা ফসল ঘরে তোলার পরেই ত্রিপুরীদের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের আয়োজনের সাড়া পড়ে যায় । এ নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরীদের মধ্যে নৃত্য পরিবেশনের রীতি রয়েছে । ফসল তোলার পরে একটা নির্দিষ্ট দিনে এই উৎসব পালন করা হয় । উৎসবের সময় শস্য আধারের বেদীতে মুরগি বলি দেওয়া হয় । পূজার শেষে আত্মীয়-স্বজন মিলে পানভোজনে মিলিত হয় । উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য নর-নারীরা মিলিতভাবে নৃত্য পরিবেশন করে । নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এই নৃত্য বলে তাকে 'মামিতা নৃত্য' বলা হয় ।
রিয়াংদের নৃত্য :-
বিভিন্ন ধর্মীয় অসামাজিক অনুষ্ঠানে রিয়াংরা নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন ত্রিপুরীদের মতিয়াংরাও গড়িয়া উৎসব ও নৃত্য পালন করে রিয়ানরা সাধারণত দল বেঁধে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে এতে যে কোন বয়সের নর নারী যোগ দেন তারা নৃত্য পরিবেশন করার সময় তাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক কণ্ঠ যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগের নৃত্য পরিবেশন করেন
হজাগিরি নৃত্য:- রিয়াং নৃত্যের এক বিশেষ রূপ আজকাল ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । এমনকি প্রজাতন্ত্র দিবসে নতুন দিল্লিতে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় । এই নৃত্যের প্রধান বিষয় হলো দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে নৃত্য প্রদর্শন । এই নৃত্যে বিশেষ দক্ষতা ও শিল্প নৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় । কলসির মাথার উপর দাঁড়িয়ে রিয়াং রমনিরা জ্বলন্ত প্রদীপ সহযোগে মাথার উপর বোতল দাঁড় করিয়ে নানারকম দেহ ভঙ্গিমা করে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে । এই নৃত্য 'হজাগিরি' নামে প্রসিদ্ধ । হজাগিরি বাংলা 'কোজাগরী' শব্দের সমার্থক । লক্ষ্মী পূজার সময় এই হজাগিরি নৃত্য পরিবেশিত হয় বলে কেউ কেউ এর সঙ্গে কোজাগরী নৃত্যের সাদৃশ্য পান । এই নৃত্যে আর্থ-সামাজিক কার্যকলাপ এবং জন্তু-জানোয়ারের আচার-আচরণ, ভঙ্গিমাও ফুটিয়ে তোলা হয় । পশু শিকার, মৎস্য শিকার, বনের শাকসবজি আহরণ, জুম সাফাই, দেহের আঘাত জনিত ব্যথা, ফসল তোলা, ধান ভানা, ও দেবদেবীর প্রতি বলিদান ইত্যাদি কার্যকলাপকে নৃত্যের বৈচিত্র্যময় ভঙ্গিমা বা মুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা হয় । উপযুক্ত চর্চা ও সংস্কারের মাধ্যমে এই নৃত্যকে লোকনৃত্য পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব ।
চাকমাদের নৃত্য :-
ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট উপজাতীয় জনগোষ্ঠী চাকমাদেরও নিজস্ব লোকনৃত্য রয়েছে । চাকমারা ধর্মের দিক থেকে বৌদ্ধ । তাদের ধর্মবিশ্বাসে জগতের উৎপত্তি মূলে রয়েছে ত্রিশক্তির ক্রিয়া । বসুমতি, চুমুলাং ও পরমেশ্বরী । ত্রিপুরীদের মতো তারাও চৌদ্দ দেবতায় বিশ্বাসী । আসামে যেমন বিহু, ত্রিপুরায় বুইসু, বাংলায় বিষুব বা চৈত্র সংক্রান্তি, তেমনি চাকমাদের বর্ষশেষের উৎসব বিজু । বর্ষবিদায়কে কেন্দ্র করে জাতিউপজাতিদের এই উৎসব পালন দীর্ঘকাল থেকেই চলে আসছে ।চাকমাদের মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে পালন করা হয় বিজু উৎসব এবং বিজু উৎসবকে যে নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় তাকেও 'বিজু নৃত্য' বলা হয় । বর্ষবরণ উৎসবের সময় চাকমা যুবকযুবতীরা দলবদ্ধভাবে বিজু নৃত্য পরিবেশন করে । বিজু নৃত্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে বিজুর তালে তালে পরিবেষণ করা হয় ।
গারোদের নৃত্য :-
গারোদের সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে । প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে ।সামাজিক অনুষ্ঠানের শেষে পানভোজন, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশিত হয় ।গারো সমাজে প্রচলিত নৃত্যগুলির মধ্যে লোকনৃত্য, রণনৃত্য এবং নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম নৃত্য পরিবেশিত হয় । তাছাড়া গৃহপ্রবেশ উপলক্ষেও নৃত্য পরিবেশিত হয় । গারোদের প্রচলিত নৃত্যগুলি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল :-
গানানৃত্য ( নেতার অভিষেক নৃত্য )–গারো সমাজে নেতা বা প্রধান আনন্দময় নৃত্যের পরিবেশনার মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন । প্রথমে নেতাকে আংটি পরানো হয়ে থাকে । আংটি হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতীক । এই অভিষেক মিত্তে পুরোহিতের নির্দেশে সমাজের গণ্যমান্য সবাই যোগদান করে থাকে । আংটি পরার পর নেতা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন ।
রণ নৃত্য– রণনৃত্য দলবদ্ধ নৃত্য বিশেষ । একসঙ্গে ২০-২৫ জন লোক একে অপরের পেছনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কোমরে ধরে গোল হয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে গান করতে থাকে । রণনৃত্যে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করার জন্য মাদল ও পিতল নির্মিত ঘন্টা বাজানো হয় । স্ত্রীলোকেরাও এই নৃত্যে যোগদান করে থাকে । তবে পুরুষের কাছ থেকে অনতি দূরে সারিবদ্ধ হয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে দুবাহু প্রসারিত করে বা পরপর বাহু দুটি ঊর্ধ্বে প্রসারিত করে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে । সাধারণত প্রতিটি দলে একজন দল উপস্থিত থাকে দলপতি । তরবারি ও বর্ম হাতে সুর তুলতে থাকে । গারো ভাষায় দলপতিকে গ্রিকা বলা হয় । দলপতিকে গ্রিকগিপা বলা হয় । এই নৃত্য প্রাচীন যুগের যুদ্ধবিগ্রহের স্মৃতির রেশ ফিরিয়ে আনে ।
মগদের নৃত্য :-
মগরা খুব উৎসবপ্রিয় । ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতিদের মতো মগরা ও নানা উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য করে থাকে মুখ সমাজে সংগীতের যেমন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে তেমনি নৃত্যকলার ও মোটামুটি পাঁচটি বিভাগ রয়েছে ।
ক্যমুং–ক্যমুং নৃত্য মগদের আদিম নৃত্যকলা বলে পরিগণিত হয় । আদিকালের নৃত্যকলা সৃষ্টির পূর্বে মগরা ধান ভাঙার ঢেঁকির শব্দ ও তালের ছন্দ ও গতির মধ্যে সংগীত ও নৃত্যের রূপ আবিষ্কার করে । অতীতে এই নৃত্য পরিবেশন কালে অনেকগুলো ঢেঁকির শব্দের সঙ্গে পরিবেশন করার রীতি ছিল । পরবর্তীকালে ঢেঁকির পরিবর্তে বাঁশের মাধ্যমে শব্দ ও তাল সৃষ্টি করে অধিকতর চিত্রাকর্ষক ও গতিময় করে তোলা হয় ।
সইং–সইং নৃত্য পরিবেশিত হয় কোন বিখ্যাত ধর্মীয় বা রাজার মৃত্যু উৎসবে । মৃত ব্যক্তির কফিন বহন করে নিয়ে যাবার সময়, শবযাত্রীরা বিভিন্ন নৃত্যদলে কাঠি হাতে নিয়ে সইং নৃত্য পরিবেশনার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে । এই নৃত্যে বত্রিশ প্রকার মুদ্রা ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
য়ইং–এই নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য নানা রকম দেহ ভঙ্গিমা প্রদর্শন । য়ইং নৃত্যে হেলে দুলে নৃত্য কৌশল দর্শকদের মুগ্ধ করে বলে এর নাম য়ইং । এই নৃত্য একক, দ্বৈত কিংবা দলীয়ভাবে পরিবেশিত হতে পারে ।
ছিমুইং–ছিমুইং আকা বাংলাদেশের প্রদীপ নৃত্য বলে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে মূলত এই নৃত্য বিবাহ পার্বনে বর-কনে উভয় পক্ষের পিতা-মাতা ও গুরুজনদের সম্মানার্থে পরিবেশিত হয়ে থাকে । পরবর্তীকালে ধর্মীয় পূজা পার্বণেও এই নৃত্য পরিবেশিত হয় ।
বাইং–আধুনিক সমাজের নৃত্যকলার অনুকরণে এই নৃত্যের উদ্ভব । এই নাচকে মারমাদের মুখোশনৃত্য বলা হয় । কেননা অনেক সময় বানর, বাঘ কিংবা অন্যান্য জন্তুর মুখোশ ধারণ করে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় ।
হালামদের নৃত্য :–
ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতিদের মত আলেমদের মধ্যেও নাচ গানের প্রবণতা দেখা যায় । জুম ফসল ঘরে তোলার পর হালামরা লক্ষ্মী পূজা করে থাকে । ত্রিপুরীরা লক্ষ্মীকে ধনের দেবী হিসেবে পূজা করেন । ত্রিপুরী সমাজে এই পূজাকে বলা হয় 'মাইলুংমা' পূজা । হালামরাও তেমনি লক্ষ্মী পূজা করে থাকে । তবে তাদের পূজাপদ্ধতি আলাদা ।
হৈ-হক নৃত্য- লক্ষ্মীপূজা উদযাপনের সময় দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য হালাম নারী-পুরুষ গোল হয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে নৃত্য করে । এই নৃত্য হৈ-হক নৃত্য নামে তাদের সমাজে প্রচলিত । এই নাচ তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও নৃত্যের বিচিত্র তাল নয় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তাদের জাতিগত পরিচয় ।
লুসাইদের নৃত্য :–
অন্যান্য অধিবাসীদের মত লুসাইদেরও মূল ধর্মকে সর্বপ্রাণবাদ বা অ্যানিজম বলা হয় । লুসাইরা ভীষণ আমোদপ্রিয় । নৃত্য সংগীতের মাধ্যমে এরা জীবনকে উপভোগ করে । এদের জীবনবৃত্ত নৃত্য ও সঙ্গীতের সুরে সুরে গাঁথা ।লুসাইদের নৃত্যের ধারা বিচিত্র । ভিন্ন ভিন্ন নৃত্যের মধ্যে তাদের মনের ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে । তাদের উল্লেখযোগ্য নৃত্য—
চেরো নৃত্য বা বাঁশ নৃত্য-চেরো বা বাঁশ নিয়ে লুসাইদের প্রসিদ্ধ লোকনৃত্য ।কারো অকালমৃত্যু ঘটলে সে মৃতব্যক্তির আত্মাকে অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করে তাকে কল্পিত স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য এই নৃত্যের আয়োজন হয় । বাঁশ নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দুজন বা চারজন লোক দুই প্রান্তে মুখোমুখি বসে উভয় হাতে লম্বা দুটো বাঁশ ধরে একবার বন্ধ একবার ফাঁক করতে থাকে । যখন বন্ধ করা হয় তখন দুটো বাসে ঠোকাঠুকি লেগে অদ্ভুত ছন্দ ও তাল ঝংকৃত হয় । সেই তালে তালে নৃত্যরত যুবক-যুবতীরা দুটো বাঁশের মাঝখানে একবার পা ফেলে একবার বের করে । বাঁশ দুটোকে যে মুহূর্তে ফাঁক করা হয় সেই মুহূর্তে পা ফেলে দিয়ে বন্ধ করার পূর্ব মুহূর্তে পা বের করে দেবার যে কৌশল তার ছন্দের তালে তালেই সম্পন্ন হয় । এটি অত্যন্ত উপভোগ্য নৃত্য । বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকির শব্দ ওতার তালে পা ফেলা ও পা তোলার মধ্যে এক শিহরণ জাগানো আবহের সৃষ্টি করে ।
সোলকিয়া নৃত্য-মূলত এই নৃত্য বিজয় সূচক নৃত্য । শিকারিদল বন্য পশু-পাখি শীকার করে বাড়ি ফিরলে বিজয় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শোলাকিয়া নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে । এই নৃত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয় সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ডানপাটিকে নাড়া দিয়ে বাঁপাটিকে ঝুঁকিয়ে তালে তালে হাঁটু গাড়ার ভঙ্গিমা করে । এই নৃত্যের সঙ্গে ঢাক ও ভেরি বাজানো হয় । বাজনার তালে তালে নাচে ছন্দ বেশ জমে ওঠে ।
পয়ান্তু নৃত্য– পয়ান্তু নৃত্যটি বাচ্চাদের ক্রীড়ানৃত্য । এরা গান বাজনা ও খেলার ছলে এই নৃত্য পরিবেশন করে । বর্তমানে এর প্রচলন নেই ।
ত্রিপুরায় লোকনৃত্য গুলির পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় বা মার্গীয় নৃত্যগুলিরও চর্চা হয়ে থাকে । ভারতের মোট আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলির উৎপত্তি এবং ত্রিপুরায় কিভাবে নৃত্যগুলির প্রসারণ ঘটেছে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল :-
ভরতনাট্যম :-
ভারতবর্ষের মার্গ নৃত্যধারার মধ্যে অন্যতম হল ভরতনাট্যম । বর্তমানে এই পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় বা মার্গীয় নৃত্য পদ্ধতি দক্ষিণভারতের তামিলনাডুতে বেশি চর্চা করা হয় । ভরতনাট্যম দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর তাঞ্জোর প্রদেশের নাচ । ত্রিপুরাতে ভরতনাটম শিক্ষা শুরু হয় বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে । তখনকার সময়ে শ্রীমতি হীরা দে বলে একজন নৃত্যশিল্পী কলকাতায় এসে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে স্নাতকোত্তর হন । এবং তারপর ত্রিপুরায় গিয়ে ভরতনাট্যম শিক্ষা দিতে থাকেন । এখন যদিও আরও অনেক নৃত্যশিল্পীরা ভারতের আরো অন্যান্য জায়গা থেকে অনুশীলন করছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় নৃত্য প্রদর্শনও করছেন ।
কত্থক :-
বর্তমানকালে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নৃত্যধারা কত্থক । প্রাচীনকালে দেবতাদের লীলা ও পৌরাণিক উপকথার বর্ণনা করার জন্য কত্থক গ্রন্থিক, গাথাকার প্রভৃতি সম্প্রদায় ছিল । তারা সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে কাহিনি প্রচার করতেন । কত্থককে আগে বলা হতো নটোবরী নৃত্য । কত্থক সাধারণত উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয়নৃত্য বলে আমরা জানি অর্থাৎ উত্তর ভারতের লখনউ জয়পুর ও বেনারস অঞ্চলের নাচ কত্থক । কত্থকনৃত্য সর্বপ্রথম ত্রিপুরাতে প্রদর্শন করেন গহরজান । তখনকার সময় ওনার নৃত্য প্রদর্শন ও গজল ঠুমরির উপর রচিত শিল্পীরা আকৃষ্ট হয় । এবং তখন থেকেই কত্থক নৃত্যশিল্প শিক্ষা শুরু হতে থাকে ত্রিপুরা রাজ্যে । বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যে আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি নৃত্যচর্চা হয় কত্থক নৃত্য । অর্থাৎ নিরীপ্ত শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের বেশি আকর্ষণ কত্থক নৃত্যের প্রতি আজকাল ত্রিপুরা রাজ্যের বহু কত্থক নৃত্যশিল্পী ভারতবর্ষ এবং অনেক জায়গায় সুনাম অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে চিন্ময়ী দাস, দেবজ্যোতি লস্কর প্রমূখ শিল্পীরা উল্লেখযোগ্য ।
কথাকলি :-
কথাকলি নৃত্য কেরল রাজ্যের অন্যতম নৃত্যকলা । কথাকলি নৃত্য পরম বৈষ্ণব কালিকটের জামুরিন বংশীয় মানব রাজ কর্তৃক প্রবর্তিত কৃষ্ণনাট্যম নৃত্যনাট্যের অন্যতম রূপ । পরবর্তীকালে কথাকলি রূপে পরিচিত । পরবর্তীকালে কোট্টারার রাজা নিজ দেশে গণেশ মন্দির প্রাঙ্গণে নতুন নৃত্যনাট্যের প্রবর্তন করেন যা রামনাট্যম নামে পরিচিত । এবং রামনাট্যমকে কথাকলি নৃত্যের উৎস ও প্রাথমিক স্তর বলে মনে করা হয় । কথাকলি নৃত্যটি ত্রিপুরা রাজ্যে তেমন প্রচলন নেই । শুধু পরিবেশিত হয় ত্রিপুরার বহিরাগত শিল্পী দ্বারা । কারণ এখানে উপযুক্ত নৃত্যশিক্ষকের অভাব । শ্রীযুক্ত অনন্তবিজয় দেববর্মা নামে একজন নৃত্যশিল্পী শান্তিনিকেতনে বাইশ বছর কথাকলি নৃত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন তারপর উনি ত্রিপুরায় এসে যখন নৃত্য শিক্ষা দিতে শুরু করেন তখন দুর্ভাগ্যবশত মারণব্যাধি কর্কট রোগ শিল্পীর জীবন কেড়ে নেয় । তারপর আর কেউ এই কথাকলি নৃত্যশিক্ষা নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি ।
কুচিপুডি :-
কুচিপুডি দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । ত্রয়োদশ শতকে সিদ্ধান্ত যোগী কুচিপুডি নৃত্য নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন । কৃষ্ণা নদীর তীরে অন্ধ্রের কুচলাপুরম গ্রাম থেকে এই কুচিপুডি নৃত্যের উদ্ভব হয় । পূর্বে কোন কুচিপুডি নৃত্যশিল্পী ত্রিপুরায় ছিলেন না । কিন্তু বর্তমানে ববি চক্রবর্তী নামে একজন মহিলা নৃত্যশিল্পী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যশিক্ষার গ্রহণ করে এবং ত্রিপুরারাজ্যে ছাত্রছাত্রীদের কুচিপুডি নৃত্যশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন । এবং নিজে কুচিপুডি নৃত্য প্রদর্শন করে সবাইকে এই নৃত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছেন ।
ওড়িশি :-
উড়িষ্যার নৃত্যধারা ওড়িশি সারা পৃথিবী বিখ্যাত । দ্বাদশ শতাব্দীতে মহেশ্বর মহাপাত্র রচিত অভিনয়চন্দ্রিকা গ্রন্থে ওড়িশি নৃত্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা যায় । আচার্য অট্টহাস ওড়িশার দেবদাসীদের মধ্যে এই নৃত্যের প্রচলন করেন । ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতো নৃত্যকলা ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল । ওড়িশি নৃত্যের কোন নৃত্যশিক্ষক ত্রিপুরায় পূর্বে ছিলেন না । কিন্তু বর্তমানে সর্বপ্রথম দেবব্রত দেববর্মা নামে একজন নৃত্যশিল্পী উড়িষ্যা থেকে এই নৃত্যশৈলী শিক্ষা গ্রহণ করে ত্রিপুরায় এসে শিক্ষার্থীদেরকে যথাযথ শিক্ষাদান করছেন এবং ওড়িশি নৃত্যের প্রতি আকর্ষিত করে তুলছেন । এই নৃত্যশিল্পী নিজেও ত্রিপুরা রাজ্য এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই নৃত্য প্রদর্শন করছেন । সর্বানি নন্দী নামে আরেকজন নিরীক্ষা শিল্পী ও বর্তমানে ওড়িশি নৃত্যে ত্রিপুরা রাজ্যে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন ।
মোহিনীআট্টম :-
ভারতের কেরালা প্রদেশ ধ্রুপদী নাচের জন্য বিখ্যাত । ধ্রুপদী নৃত্য কথাকলি এবং তার বিশিষ্ট তিনটি উপধারা রয়েছে । কৃষ্ণনাট্যম, রামনাট্যম ও মোহিনীঅট্টম । যদিও মোহিনীঅট্টমে ভরতনাট্যমের কিছু মিশ্রণ রয়েছে । কথাকলির গাম্ভীর্য ও ভরতনাট্যমের সৌন্দর্য দুইই পাওয়া যায় মোহিনীঅট্টমে । ত্রিপুরা রাজ্যের কোন নৃত্যশিল্পী আজ পর্যন্ত মোহিনীঅট্টম নৃত্যশিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেননি । তাছাড়া কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলেও যথাযথ নৃত্যশিক্ষকের অভাবে এই নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ।
সত্রিয়া :-
আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সত্রীয়া নৃত্যধারাটি আপন ঐতিহ্য ও শৈলীতে অন্যতম স্থানের অধিকারী । এই নৃত্যধারার প্রবর্তক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মহৎ সন্ন্যাসী শ্রী শ্রী শংকরদেও । পঞ্চদশ শতকে তিনি এই নৃত্য ধারার প্রবর্তন করেন যা অংকিয়া নট নামক নাট্য থেকে অনুপ প্রেরিত ক্রমে চর্চা ও উন্নত সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়ে এই নৃত্য ধারা এক অন্যতম স্থান লাভ করেছে । মূলত কৃষ্ণ রাধা সম্পর্কিত কাহিনি এর মূল উপজীব্য বিষয় । তবে তাছাড়াও বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, রাম-সীতার কাহিনিও এতে পরিবেশিত হয়ে থাকে । অতীতে মূলত এই নৃত্য ধারা শুধুমাত্র পুরুষ সন্ন্যাসীদের দ্বারা চর্চিত হলেও নৃত্যশৈলী ও পরিবেশনগত ক্রম ও বিবর্তনের দ্বারা বর্তমানে বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ভিন্ন মহিলা ও পুরুষ উভয় জনধারায় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে । সত্রিয়া ত্রিপুরা রাজ্যের পার্শ্ববর্তী রাজ্য অসমের নৃত্যধারা অর্থাৎ অসম রাজ্য এই নৃত্যের উৎপত্তিস্থল । ত্রিপুরারাজ্যে এখনো কেউ তেমনভাবে এই নৃত্য চর্চা করতে শুরু করেনি ।
মণিপুরী:-
ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলের আরেকটি ছোট রাজ্য মনিপুর । মনিপুরের নৃত্য হচ্ছে মনিপুরী নৃত্য । মনিপুরের নৃত্যের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না । তবে যেটুকু পাওয়া গেছে, তাকে ভিত্তি করে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বলা যায় তেত্রিশ খ্রিস্টাব্দে পেরিতাম নামে এক ব্যক্তি পশ্চিম ভারত থেকে মনিপুরে গিয়ে আর্য সভ্যতা প্রচার করেন । ১৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা খোয়াইতুম্পক জন্মবাদের প্রচলন করেন । মণিপুরীরা হিন্দু নিষ্ঠাবান গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । মণিপুরী নাচ চার ভাগে বিভক্ত । অস্ত্রবিদ্যা, চলন, গঠন ও রাজনৃত্য । খোল, করতাল, মন্দিরা সহযোগে এই নৃত্য হয় । মনিপুরী নাচে কীর্তন গান ব্যবহৃত হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে রাজন্য আমল থেকেই মনিপুরী নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় এসে মণিপুরী নৃত্য দর্শন করে অভিভূত হয়ে তা শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় সংযোজন করেন এবং বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন ।
এভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, বহু প্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুররাজ্যে নৃত্যচর্চার একটি ধারা প্রবহমান রয়েছে । রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সেখানে শাস্ত্রীয় নৃত্যের ধারাটি প্রবাহিত হয় । ত্রিপুরারাজ্যের ভারতভুক্তির পর সেই ধারাবাহিকতা আরও বেগবান হয়ে উঠে যা আজও গতিশীল ।