অন্তরালে চলে যাওয়া রাজ্যের বহুমুখী প্রতিভা
ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী সাব্রুমের কৃতি সন্তান । তিনি ১৯৫০ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি এই মহকুমার ব্রজেন্দ্রনগর গ্রামের রানিবাজারস্থিত বিখ্যাত দামোদর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা প্রয়াত সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন দামোদরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । সেকালে এই দামোদরবাড়িকে কেন্দ্র করেই গোটা এলাকায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হত । সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী নিজে হাতে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতেন । ফলে ড. চক্রবর্তী শৈশব থেকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠেন । তাঁর বাবা মুখে মুখে তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করতে পারতেন । কখনো কখনো তিনি কবিগানের আসরে কবিয়াল এর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতেন । তিনি একজন দক্ষ যাত্রাশিল্পীও ছিলেন । তাঁর রত্নগর্ভা মা রোহিনী চক্রবর্তী গৃহাভ্যন্তরেই নিভৃতে সাংসারিক কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকতেন ।
বাবার এইসব গুণগুলো তার মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল । ছোটোবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন । পড়াশোনার পাশাপাশি অল্পবয়সেই তিনি গল্প, কবিতা লেখায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন । চিত্রশিল্পেও ছিল তাঁর দক্ষতা । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তাঁর আঁকা শরৎচন্দ্রের একটি পোট্রেট দেখে সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার তাঁকে আগরতলায় নিয়ে গিয়ে শিক্ষাদপ্তরের গবেষণা বিভাগে দায়িত্ব দেন । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারিতে তিনি এনসিসি-র কমিশনড অফিসারেরও দায়িত্ব পালন করতেন । বাংলা বিষয়শিক্ষক হিসাবেও ছিল তাঁর অপরিসীম দক্ষতা । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি এমবিবি কলেজ থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্ত ডিগ্রি লাভ করেন । তারপর দীর্ঘবছর যাবত টানা গবেষণাকর্মে লিপ্ত থেকে বহু ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে ২০০২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক ড. পল্লব সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ও স্নেহসান্নিধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন । তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ববঙ্গের লোককাহিনি' । কিন্তু আর্থিক দুর্বলতার কারণে এই বিশাল অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে আজও প্রকাশ করতে পারেননি ।
অল্পবয়স থেকেই ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী রাজ্যের লেখালেখির জগতে সারা ফেলে দেন । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পিটিআই'র ত্রিপুরার প্রতিনিধি অনিল ভট্টাচার্যের সহযোগী হিসেবে রণাঙ্গনের এক নম্বর সেক্টরে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন । তিনি একজন অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফারও । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে খবর সংগ্রহের সময় তাঁর ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতাও বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে । সে সময়ে তার রিপোর্টিং ও ছবি যুগান্তর সহ দেশ-বিদেশের বহু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় । আজ সেটা বিস্মৃত অধ্যায় ।
কবিতায় তাঁর নিপুন হাত । বিশেষ করে তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতাগুলো একসময় বাচিক শিল্পীদের মুখে মুখে ফিরত । তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'স্বাধীনতা কিতা' ২০০৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় । শুধু কবিতা নয় । তিনি বহু গল্প, নাটক এবং বিশেষ করে আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত সিরিজ শ্রুতি নাটকগুলোর জন্য প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে লোক আঙ্গিকে তাঁর লেখা নাটক মহুয়া নৈদেরচান আগরতলার মঞ্চে সেদিন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । স্বনামে ও ছদ্মনামে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন । একসময় 'সত্যপীর' নাম নিয়ে দৈনিক সংবাদে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ' নামে অনেকগুলো সিরিজ ফিচার লিখেছিলেন । আজকের ফরিয়াদে দীর্ঘদিন লেখেন 'সিধু জেঠার পাঁচালি' । তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ একমাত্র গল্পের বই 'বসুধা' । তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে 'উজান', 'বাঘের পাঁচালি' ইত্যাদি নাটকগুলো ২০০৪-২০০৫ সালে ভীষণ সাড়া জাগিয়েছিল । তিনি ত্রিপুরার প্রথম টেলিফিল্ম 'ভাঙন' করে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে ভীষণ সাড়া ফেলে দেন । তিনি সপরিবারে ও মহকুমার প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে একেবারে আনকোরা কিছু গ্রামীণ শিল্পীদের নিয়ে সাব্রুম থেকে তৈরি করেন 'ভাঙন' । আগরতলা প্রেসক্লাবে প্রথম প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয় হয় সেদিন । ছবিটি দেখার পর দৈনিক সংবাদের সম্পাদক প্রয়াত ভূপেন দত্তভৌমিকসহ সেসময়ের আগরতলার বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন । পরবর্তী সময়ে কিছুদিন তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেন ।
রাজ্যের সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই গুণী সন্তান বার্ধক্যজনিত কারণে আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন । তাঁর বহুমখী প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন রাজ্যে আজও হয়নি ।
অনুলিখন : অশোকানন্দ রায়বর্ধন
No comments:
Post a Comment