ত্রিপুরারারাজ্যে মণিপুরিদের আগমন ও মণিপুরি সংস্কৃতির প্রসার
একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির ক্ষেত্রে অপর কোন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, ভাষা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠে । ফলে এর মধ্যে একটি সমৃদ্ধ একাত্মবোধ গড়ে ওঠে এবং সেখানে সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে এরকম ভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির আগমন আদান-প্রদান এবং মেলবন্ধন ঘটেছে । ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইরূপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে ত্রিপুরারাজ্য হয়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য । ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতেই হয় যে, রত্নফা যখন মানিক্য উপাধি নিয়ে ত্রিপুরায় ফিরে এলেন তখন তার সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের । যাদের সহযোগে সেদিন ত্রিপুরায় গড়ে উঠেছিল এক মিশ্রসংস্কৃতির বাতাবরণ । যেহেতু পণ্ডিতদের দ্বারা আমদানি হয় সংস্কৃত সাহিত্য ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির । সঙ্গে সঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের ত্রিপুরায় সে সময় সীমানা ছিল ব্রহ্মদেশের প্রান্ত সীমা থেকে শ্রেষ্ঠ ঢাকার কিছু অংশ চট্টগ্রাম নোয়াখালী নিয়ে । তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ত্রিপুরাতে হিন্দু বৌদ্ধ শৈব ও শাক্ত সংস্কৃতি নিদর্শন পাওয়া যায় । এককথায় ত্রিপুরার সংস্কৃতিতেও 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' পরিবেশ যথেষ্টই রয়েছে ।
ত্রিপুরার রাজারা সংস্কৃতিবান, বিদ্যোৎসাহী, উদার মনোভাবাপন্ন এবং গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় সতত সচেষ্ট হিসেবে সর্বজনবিদিত । নৃত্য ও গীতের সুধাসাগরে মহারাজারা শুধু নিজেরাই নিমজ্জিত ছিলেন না, রাজ অন্দরে পুরনারীদের সংগীত ও অন্যান্য চারুকলার চর্চায় প্রচন্ড উৎসাহ প্রদান করতেন । ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস কালিপ্রসন্ন সেন সম্পাদিত 'শ্রীরাজমালা'য় উল্লেখ রয়েছে–
'ত্রিহুত দেশ হ ইতে নৃত্যগীত আনি ।
রাজ্যতে শিখায় গীত নিত্য নৃপমণি ।।
ত্রিপুর সকলে সেই গীত ক্রমে গায় ।
ছাগ অন্তে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।
অর্থাৎ মহারাজা ধন্যমাণিক্য মিথিলা বা তিরহুত দেশ থেকে শিল্পী এনে রাজ্যে নৃত্যগীতের প্রচলন করেছিলেন ।
ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ হলো মনিপুরী জনগণ রাজ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মনিপুরী গণ রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের ন্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধির পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যা হল ----------- আর তার মধ্যে ----------- মনিপুরী । রাজ্যের ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলপুর, খোয়াই ও সদর মহকুমাতে মনিপুরীগণ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।
মনিপুরীরা মূলত মনিপুরের অধিবাসী । সাধারণত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা সাংস্কৃতিক বিনিময়ে এবং রোগ মহামারীর আক্রমণ কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য স্থানে বা অন্য রাজ্যে অভিবাসনে বাধ্য করে ত্রিপুরা রাজ্যের মনিপুরীতে প্রথম অভিবাসন উপরোক্ত কোন একটি কারণের ফলে হয়েছে । রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মনিপুরিগণ দেশ ত্যাগ করে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮২৪ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরূপে মনিপুরের এক প্রাক্তন রাজার আমরা সন্ধান পাই । ১৭৬২ সালে কৃষ্ণ মানিকের আমলে চট্টগ্রামের রেসিডেন্ট মি. ভেরেলিস্টের পত্র থেকে জানা যায় যে মনিপুর রাজ বিখ্যাত গরীবনওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র জগত সাই সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে ভেরেলিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনরায় ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসন দখল করার জন্য । কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের তৎপরতায় তিনি সফল হননি কিন্তু জগৎসাই সম্ভবত কসবা অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন কেননা পরবর্তীকালে ভাগ্যচন্দ্রের আগরতলা আগমন কালে কসবাতে জগৎশাই ভাগ্যচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন বলে জানা যায় । তারপরে অবশ্য জগতসাইয়ের আর কোন সংবাদ জানা যায় না এবং তার বংশধর বা পরিবার-পরিজন এর ত্রিপুরায় পাই না । রোগ মহামারী বা অর্থনৈতিক কারণের জন্য মনিপুরীদের ত্রিপুরার অভিবাসনের কোন সংকেত ইতিহাস আমাদের দেয় না ।
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । ত্রিপুরার অনেক রাজা মণিপুরের রাজকন্যা বিবাহ করেছেন দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য মনিপুরাধিপতি ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিবাহ করেন । কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছেন, ''মণিপুরের রাজবংশের শহীদ ত্রিপুরার রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ ।" এই উক্তি পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না । কেননা আমরা দেখি যে ত্রিপুর বংশধর তইদাক্ষিণের পুত্র দাক্ষিণ মেখলি রাজকন্যা বিবাহ করেন অবশ্যই এই বিবাহ বর্তমান ত্রিপুরার রাজনৈতিক সীমার মধ্যে ঘটেনি । বরঞ্চ বলা চলে ত্রিপুরার মানিক্য রাজাদের সঙ্গে মনিপুর রাজবংশের প্রথম সম্বন্ধ হয় রাজধরমানিক্যের সঙ্গে । এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা । কেহ কেহ মনে করেন কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী মণিপুরের রাজদুহিতা । কৈলাস চন্দ্র জাহ্নবীদেবীর অপর নাম 'রানী তম্পা' বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু কমলজিৎ সিংহ উল্লেখ করেছেন যে জাহ্নবী দেবীর অপর নাম 'সিজা তম্ফা' ।এই নামীয় কোন মহিলা মনিপুরী ভিন্ন অপরকেও হতে পারে না । কৈলাস চন্দ্রের রাজমালা তে সিজাতমফার উল্লেখ নেই । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরাতন রাজমালা শ্রীরাজমালার মুল পাঠে এবং 'দেশীয় রাজা'তে কৃষ্ণমানিক্যের পত্নীর নাম জাহ্নবী দেবী লেখা আছে কিন্তু আখাউড়া স্টেশনের নিকটে রাধানগর গ্রামে অবস্থিত রাধামাধব মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী । মুদ্রার সাক্ষ্যেও আমরা তার নাম জাহ্নবী দেবী পাই । কর্নেল দেববর্মা মহাশয় তাকে অসূর্যম্পশ্যা একজন ত্রিপুরী রমনী বলে তার অনেক গুণের উপর আলোকপাত করেছেন । অন্য প্রমাণাভাবে কমলজিৎ সিংহ এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছেন । কৃষ্ণ মানিক্য ( ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩খ্রিস্টাব্দ ) শমসের গাজীর উপদ্রবে সিংহাসন দখল করতে না পেরে অনেকদিন কাছাড় ও মনিপুরের রাজসভায় সাহায্য লাভের আশায়রাজ্যত্যাগ করেছিলেন ।
ইতিহাসের এই সমস্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এভাবেই খুব সম্ভবত রানী হরিশেশ্বরীর স্বজন, সেবক ও সেবিকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম মনিপুরী অভিবাসন কেন্দ্র । রাজধানীর পাশে মেখলিপাড়া গ্রামে । কমপক্ষে চারটি বিভিন্ন বংশের মনিপুরিগণ এখানে বসবাস করছেন । এরা হলেন মরুংবম, হনজবম, খুমনথেম, লাইপুবমনা নামক বংশের উত্তরপুরুষ । রাজকীয় বহরের অন্তর্ভুক্ত না হলে একসঙ্গে একই স্থানে চারটি বংশের মানুষ সমবেত হয়ে বসবাস করতে পারত না । রাজমালা পাঠে জানা যায় যে,বৈবাহিক সূত্রে মনিপুর রাজবংশের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কিত হন রাজধর মানিক্য ( ১৬১১ খ্রি.)। তিনি ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রথম রাজধর মানিক্য । সেই সূত্রে তিনি নিজে ত্রিপুরার নৃপতিদের মধ্যে প্রথম বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি সার্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ নামে পরম বৈষ্ণব পুরোহিত ও ২০০ জন ভট্টাচার্য বৈষ্ণবের সঙ্গে সর্বদা ভাগবত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতেন ।
এভাবেই রাজঅন্তপুরে মণিপুরী মহিলাদের আগমনের ফলে মনিপুরী কৃষ্টি সংস্কৃতি ও মণিপুরি নৃত্যধারার বিস্তার লাভ করে । ত্রিপুরারাজ্যের রাজ অন্তঃপুরের বাইরেও প্রসারলাভ করে মণিপুরি নৃত্যশৈলী । মহারাজগণের উৎসাহে রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা রাজবাড়ির অঙ্গনের মধ্যেই নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করতেন । রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে হোলি এবং ঝুলন উপলক্ষে দুইদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত । প্রতিটি নৃত্যই মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হত । মণিপুরি নৃত্যগুরুগণ বিভিন্ন সময়ে রাজকমারীদের নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন ।বিশেষ করে রাসোৎসব উপলক্ষে রাজপরিবারের মেয়েরা মণিপুরি 'মহারাস' নৃত্য পরিবেশন করতেন । এককথায় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে সেকালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ও ধ্রুপদী নৃত্যের পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল ।
No comments:
Post a Comment