Wednesday, March 29, 2023

খোলা হাওয়ায় বইমেলা, তবুও

খোলা হাওয়ায় বইমেলা, তবুও

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বই সভ্যতার প্রতীক । আর বইমেলা সভ্যতার অগ্রগতির প্রতীক । মেলা বহু প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে । ধর্মকে কেন্দ্র করে কিংবা কোন গোষ্ঠীর উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রাচীন মানুষেরা মেলার আয়োজন করতেন । এতে একটি বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানের দিনে সমস্ত মানুষ এক জায়গায় মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতেন । তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক মিলন ও কুশল বিনিময় । মেলাতে এক জায়গায় মিলিত হওয়ার পাশাপাশি ছিল একে অন্যের মধ্যে উপহার বিনিময় । এই উপহার মূলত ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় উপকরণ । এই উপকরণসমূহ বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের প্রয়োজন মেটানোর দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন । একজনের কাছে যে দ্রব্যটি নেই অন্যজন তা প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতেন । এভাবেই ক্রমে সমাজে চলে আসে বিনিময় প্রথাটি । পরে সমাজব্যবস্থায় অর্থনীতির বিষয় প্রভাব ফেললেই বিক্রয়ের পদ্ধতির প্রচলন ঘটে । মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীন অর্থনীতি ও একসময় চাঙ্গা হয়ে উঠত । সমাজের নানা পেশার মানুষ তাঁদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় পসরা সাজিয়ে বসতেন ।  গৃহস্থরাও তাঁদের সংবৎসরের প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রী মেলা থেকেই সংগ্রহ করতেন ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সম্পদের অভাববোধ থেকে যেমন গ্রামীণ মেলার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার অভাববোধ থেকে শুরু হয়েছে বইমেলা । তার মধ্যে যতটা না অর্থনীতি জড়িয়ে থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে জ্ঞানপিপাসা । বইমেলা সেই জ্ঞানপিপাসা মেটানোর একটা মাধ্যম । আদিম সংস্কৃতির উদাহরণ হল গ্রাম্যমেলা । আর নাগরিক সংস্কৃতির উদাহরণ বইমেলা । উভয়ের উদ্দেশ্য একটাই । মিলন । গ্রামজীবনে মিলন ধর্ম ও সামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে । সঙ্গে থাকে গ্রামীন অর্থনীতি । নাগরিক জীবনের মিলন মেধা, মনন ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে । জ্ঞানপিপাসুরা জ্ঞানান্বেষণে এই মেলায় মিলিত হন । মেলার মূল বৈশিষ্ট্য মিলন ব্যাপারটা এখানেও থাকে । পৃথিবীর সমস্ত দেশেই জ্ঞানচর্চা বিকাশের কেন্দ্রে রয়েছে বইমেলা । দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রেরই বড় বড় শহরে হয়ে থাকে বইমেলা । আন্তর্জাতিক মেলাসমূহের বিস্তৃতিও থাকে অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় ।

আগরতলা বইমেলার বয়স বেশিদিনের নয় । গত শতাব্দীর একাশি সাল থেকে রবীন্দ্রভবনের প্রাঙ্গনে শুরু হয় আগরতলা বইমেলা । একসময় স্থান সংকলনের অভাব হওয়াতে পরবর্তী সময়ে তা শিশুদ্যানে সরিয়ে নেওয়া হয় । আজ ছয় বছর হলো এই মেলা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে হাপানিয়া আন্তর্জাতিক মেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে । প্রথম দিনের তুলনায় আজ তার পরিসর অনেক বেড়েছে । অনেক জৌলুস, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে । স্টল সংখ্যা বেড়েছে ।  মঞ্চ ও পারিপার্শ্বিক অলংকরণে এসেছে আধুনিকতা । প্রযুক্তির ব্যবহার । এখন অনেক খোলামেলাভাবে বইমেলায় ঘোরাঘুরি করা যায় । বই বাছাই করা যায় । এ বছরে লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়ানটাও বেশ বড়ো করা হয়েছে । তবুও আশির দশকের বইমেলার সেই প্রাণ সেই উচ্ছলতা যেন পাইনা এখন । বয়সের জন্য কিনা জানিনা । 

বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য ছনবাসের গোলঘর তৈরি করে দেওয়া হত । প্রথম দিকে তো বইমেলায় প্রকাশক বিক্রেতার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও দশ শতাংশ ভর্তুকির ব্যবস্থা ছিল । কি জমাট আড্ডা বসত সেদিন বইমেলার মাঠে । গান, কবিতাপাঠ, কে কি বই কিনেছে তা নিয়ে আলোচনা । কোন প্রয়োজনীয় বইটা কোথায় পাওয়া যাবে, বড়দের কাছ থেকে তার সুলুক সন্ধান । মাঠের মাঝখানে ঘাসের বিছানায় ডাঁই করা মুড়ি-চানাচুর, বাদামের খোলস ছাড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা বসত । কোথায় হারালো সেসব ! 

এখন মেলায় বই কিনুন । বাড়ি চলে যান । সেই গোলঘর নেই । আড্ডার ঠেকও নেই । এককালে পাড়ার চায়ের দোকানে যেমন বেঞ্চ পাতা থাকত ।  আড্ডা দেওয়া যেত সময় না মেপে ।  শুধুমাত্র এক কাপ চায়ের বিনিময়ে ।  পরবর্তী সময়ে সেই চায়ের দোকানেও পরিবর্তন এসে গেছে । একটা টেবিলের উপর কেটলিতে চা ফুটছে । কয়েকটা বয়ামে বিস্কুট জাতীয় খাবার আছে । চা নিন । খাবার নিন । চলে যান । বসার ব্যবস্থা নেই । বসার ব্যবস্থা নেই বলেই এখন বইমেলায় জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় সামনের অনুষ্ঠান মঞ্চের দর্শক আসনগুলো । মঞ্চে হয়তো কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা বা কবিতা পাঠ চলছে । হঠাৎ তার মধ্যে বিশ্রমরত একজন কারো উদ্দেশ্যে তারস্বরে চিৎকার করে ওঠেন । মঞ্চের অনুষ্ঠানের ছন্দপতন ঘটে । দর্শকরা সব পিছনের দিকে তাকান । মঞ্চে কি চলছে তার খবর কে রাখে ! এই অবস্থাটার একটু পরিবর্তন আনা দরকার । মেলার্থীদের জন্য একটু বসার ছাউনি দরকার । গাছগাছালিহীন মেলাচত্বরে যা গরম ! মাথার ঠিক থাকার কথাও না । 

বইপত্রে অনেক নতুনত্ব থাকলেও আগের মতো ধ্রুপদী বইগুলো আর আসে না । আর যা দাম ধরলেই যেন ছ্যাঁকা লাগে । সরকার যদি আবার ভর্তুকীর বিষয়টা চালু করেন তাহলে বই পুনরায় মধ্যবিত্তের কিছুটা নাগালের মধ্যে আসবে । অন্যথায় সাধ থাকলেও সবার সাধ্যে কুলবেনা । 

আর একটা কথা বলে শেষ করছি । আগরতলা বইমেলা রাজ্যের বৃহত্তম বইমেলা । রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরের, দেশের বাইরের বহু প্রকাশক এখানে আসেন । রাজ্যের বাইরের নামী প্রকাশকরা এরপর ফিরে যান । মফস্বলের মেলাগুলোতে খুব একটা যান না । ফলে অনেক মূল্যবান বই মফস্বলের পাঠকরা প্রকাশকের কাছ থেকে সরাসরি কিনতে পারেন না । মফস্বলের বইপ্রেমীদের আরো বেশি করে আগরতলা বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে বিনি পয়সায় গাড়ির ব্যবস্থা নয় । আগরতলা থেকে অন্তত রাত আটটার দিকে রাজ্যের উত্তরে ও দক্ষিণে ফেরার জন্যে দুটো বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয় । তাহলে আগরতলা বইমেলার আরো শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে আরো উপচে পড়বে বইপ্রেমী মানুষের ভিড় ।

Monday, March 20, 2023

অন্তরে দহন অনন্ত

অন্তরে দহন অনন্ত 


ধুপ পুড়ে গেলে পোড়া ছাই পললহীন মৃত্তিকার মতো । যতক্ষণ আগুন ছিল ততক্ষণ ছিল দহন । দাহ্য শরীর জ্বলে জ্বলেই শেষ হয়ে যায় । অতলস্পর্শী তাপ সারা শরীরে মেখে ক্রমাগত পুড়ে যায় অবয়ব । দহনের ফসল তার গন্ধ । যে গন্ধ কোমলতায় ভিজিয়ে দেয় বাতাসের দিঘল শরীর । যে বাতাস বয়ে যায় চৈত্রসন্ধ্যার রুক্ষ মাঠ পেরিয়ে রাতপল্লীর নির্ধারিত আলপথে । দহনক্লিষ্ট ধূপের নিঃশ্বাস শব্দহীন নিঃশেষ হয় । নিঃশ্বাসে থাকে জীবনের ঘ্রাণ । শতশত নৈঃশব্দ্যের বুদবুদ নীরব অভিমানে অনিশ্চিত ঠিকানায় পাড়ি দেয় । যোজন যোজন দূরের অলিতে-গলিতে চলে খোঁজ । সমূহসন্ধান । দগ্ধধূপের ঘ্রাণের সুগন্ধময় অতিক্রমণ অনুভূত হয় নিস্তব্ধ বাসরঘরে, বৈভবের বহুতলে, একাকী চিলেকোঠায় । নগরীর সব বিষাক্ত নির্যাস স্নাত হয় ধূপগন্ধের মৃদু সৌরভে । দূর নাচমহলের নর্তকীর বন্দিশের অস্ফুট নূপুর কান্নার মতো । জ্বলে গেলেও যে শরীর কাঁপতে জানে না ।

কি দহন ছিল রাইকিশোরীর বুকে সে কেবল জানে ব্রজভূমির গোপযুবতিরা । দাবানল দৃষ্টিগোচর হয় । দাগ রেখে যায় তার দগ্ধক্ষেত্রের । লেলিহান আগুন রেখে যায় যে কালিকাপুর তা দু চার বর্ষণেও মুছে যায় না । প্রকৃতির বহ্নিজ্বালা চরাচরকেও ঝলসে দেয় অদৃশ্য বেদনায় । রাধা শুধু পোড়ে আর পোড়ে । জ্বলে যায় অন্তরে বাহিরে । আর সে জ্বলন জগত জানে না । সংসার জানে না । নিজের রক্তের ভিতরে বাসা বেঁধে থাকে কষ্টের কর্কট । বুকের ভেতর বনজদস্যুর যে তোলপাড় চলে, যেভাবে ভেঙে যায় তার প্রণয়ইমারত তা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না । একা একা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দিনলিপি ভেসে যায় যমুনার কালো স্রোতে, কালস্রোতে । অন্তরের গনগনে দাবানলে যে পুড়ে যায় সে কি চায় নশ্বর পরিণতি ? শেষ দহন ? রাধা ও তাই শেষবার্তা জানায় তমালকে ঘিরে । তমালের প্রসারিত শাখা যেন তাকে আলিঙ্গন করে নেয় । জড়িয়ে ধরে তার সহস্র বাহু দিয়ে । যে দৈহিক আশ্লেষ তার চঞ্চল নুপুরকে স্থবির করেছে, মানবিক প্রণয়কে হাহাকারে রূপান্তরিত করেছে, সেই হতাশার কাতরতা থেকে বেরিয়ে আসার নবীনমুদ্রা যেন তমালের প্রাচীন বল্কলের অভ্যন্তরে নিহিত আছে । অস্থির দহনযাতনার শেষে রাই খোঁজে অপার্থিব প্রেমাঙ্কুর । সুবিন্যাস্ত তমালের গায়ে ঝরে পড়া শ্রাবণকীর্তন যেন হয় রাধার অনাহত কৃষ্ণধূন । দহনকোকিলের তান  মায়ামেদুর করে তোলে ব্রজের আকাশ । শেষ বসন্তে ।

নিজের চেতনার অন্তর্মহলে পুড়ে পুড়েই নিমাই উদ্বাহু হয়ে যান কীর্তনের ভেতর । কবিতার মতো হাসেন, কবিতার মতো গেয়ে ওঠেন, আনন্দে মাতেন । তাঁর দহন তাঁকে তৃষ্ণার্ত করে । সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশাল জলধিপ্লাবন দিতে পারে না তাঁর তৃষ্ণার জল । তিনিও জীবনভর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজে ফেরেন শান্তির জল । দহনের নিবৃত্তি । তিনিও খুঁজে ফেরেন শীতলপদাবলী । যার সুর তাঁকে উদ্বেল করে মানবিকতায় । কারণ মানবের লাঞ্ছনায় তাঁর অন্তরে নীরব দাবানল । চিরঅচলায়তন ভাঙার জন্য তিনি খুঁজে নেন নীলাচল ।

দহনক্লান্তা লোকরমণী কাঁদেন ব্রজভুবনে । আর দগ্ধচিত্ত চিরায়ত পুরুষ ঝাঁপ দেন নীলাচলের নীলদরিয়ায় । দুজনেই অন্তর্দাহের মিথ । লৌকিক চরিত্র । দুজনকে ঘিরেই আমাদের পদাবলীপ্রবণ গান । বিচ্ছেদসঙ্গীত । আর এই বিচ্ছেদপদ উঠে যার খাগের কলমে তিনি পদকর্তা । তিনি কবি । তাঁর অন্তরেও সীমাহীন দাহ্যপ্রবাহ । শোকসিন্ধু । সিন্ধু উথলানো তাঁর কবিতা । এই দুই দহনপ্রতিমার উত্তাপ তাঁর অন্তরেও হয় সঞ্চারিত । সেই সঞ্চরণ থেকে কবির সৃজন । কবি অন্তরের অগ্ন্যুৎৎপাত ছড়িয়ে পড়ে কবিতার ভাষায় । অন্তর্গত চৈতন্য দহনে সৃজনের উন্মুখর বারুদশলাকা । তাই যে কবির অন্তরে দহন অনন্ত ।

Wednesday, March 15, 2023

রবীন্দ্রনাথ, ত্রিপুরা ও মণিপুরী নৃত্য

রবীন্দ্রনাথ, ত্রিপুরা ও মণিপুরী নৃত্য

বহু প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরার রাজপরিবারে নৃত্যগীতের একটি সাংস্কৃতিক ধারা বহমান থাকলেও বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার মহারাজাদের যোগসূত্র ঘটবার অব্যবহিত পর থেকেই আধুনিক ত্রিপুরার সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতি লাভ করতে শুরু করে । শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ ( ২৭  মার্চ,১৮৯৯ / ১৪  চৈত্র ১৩০৫ বঙ্গাব্দ ) থেকে ১৯২৬ ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দ ) খ্রিস্টাব্দ এই ২৮ বছরে মোট সাতবার আগরতলা ভ্রমণে আসেন  । রবীন্দ্রনাথ যখন ত্রিপুরায় আসেন প্রথমবার ১৮৯৯ সালে (১৩০৫ বঙ্গাব্দে ) মাঘ মাসে বসন্ত শ্রীপঞ্চমীতে মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের  আমন্ত্রণে, তখন কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকণ্ঠস্থল কুঞ্জবনের শৈলশেখরে কবির সম্মানে বসন্ত উৎসব ও মনিপুরী নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল এবং তা দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন । দ্বিতীয়বার কবি আসেন ১৯০১ সালে ( ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ) কার্তিক মাসে মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে, তৃতীয়বার ১৯০৫ সালে ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ) আষাঢ় মাসে, চতুর্থবার ১৯০৫ সালের কার্তিক মাসে, এরপর চৈত্র মাসে । ষষ্ঠবার ১৯১৯ সালে (১৩২৬ বঙ্গাব্দে ) কার্তিক মাসে এবং শেষবার তথা সপ্তমবার আসেন মহারাজ কুমার  ব্রজেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে  (১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন ) । শেষবার যখন তিনি আগরতলায় আসেন তখন মহারাজের বাড়িতে রাস নৃত্য আয়োজন করা হয় মনিপুরী নৃত্যের মাধুর্য কবিকে মুগ্ধ ও আপ্লুত করে । 


১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সিলেট শহরে গুরুদেব গিয়েছিলেন সিলেটবাসীর আমন্ত্রণে । ২০শে  কার্তিক বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে সিলেটের নিকটবর্তী 'মাছিমপুর' নামে মনিপুরীদের একটি গ্রামে মণিপুরী শিল্পকর্ম দেখতে যান কবি । গ্রামের মনিপুরীসমাজ গুরুদেবকে অভ্যর্থনা জানায় ছেলেদের 'রাখাল নৃত্য' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । রাত্রে মনিপুরী বালিকারা নাচ দেখায় গুরুদেবের বাংলোতে এসে । গুরুদেব সেই নাচ দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন । এ সম্পর্কে সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ 'শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে লেখেন—

"... রাত্রে মনিপুরী বালক বালিকারা বাংলোতে এসে উপস্থিত হলো কবিকে নাচ দেখাবার উদ্দেশ্যে । নৃত্য আরম্ভ হবার পূর্বে একজন মণিপুরী হারমোনিয়ামে সুর ধরবার উদ্যোগ করতেই কবি তাকে বারণ করলেন । নয়নাভিরাম জাঁকালো পরিচ্ছদ পরিহিত অপূর্ব লাবণ্যমণ্ডিত মণিপুরী বালিকারা তাদের বাহুগুলো নৃত্যছন্দে লীলায়িত করে, বলয়াকারে ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে তাদের জাতীয়নৃত্য দেখিয়ে তাঁর প্রশংসা অর্জন করল । কবি তাদের নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে ২০ টাকা পুরস্কার দিলেন । কথা প্রসঙ্গে এ নৃত্য সম্বন্ধে বললেন, 'graceful best form of physical exercise'. ( ্কবি প্রণাম দ্বিতীয় সংস্করণ নভেম্বর ২০০২ সিলেট ) ।

সিলেট থেকে ফিরবার পথে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ষষ্ঠবারের মতো আগরতলা সফরে এসেছিলেন । সেবার তিনি কুঞ্জবন বাংলোতে অবস্থান করেছিলেন । মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরের বাড়িতে কবির সম্মানে মনিপুরী রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় । এই রাসনৃত্যে ব্রজেন্দ্রকিশোরের কন্যা উত্তরা দেবীও অংশগ্রহণ করেন । সিলেট ও আগরতলায় মনিপুরী নৃত্যশৈলীর বিশেষ লাবণ্যময়তা দেখে কবি শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চর্চার উদ্যোগ নেন । ত্রিপুরার বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্যরাজার ছোট ভাই মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন । শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তনের কথা চিন্তা করে কবি তখন ত্রিপুরা থেকে একজন অভিজ্ঞ নৃত্যশিল্পীর ব্যবস্থা করতে বললেন ব্রজেন্দ্রকিশোরকে । মহারাজার সঙ্গে পরামর্শ করে মাস কয়েক পরে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর রাজপরিবারের  মনিপুরী নৃত্যশিক্ষক রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠালেন মাঘ মাসের প্রথম দিকে  । তার সঙ্গে ছিলেন সহকারি হিসেবে আরেকজন মৃদঙ্গবাদক । শান্তিনিকেতনে ৭-৮ থেকে ১৪-১৫ বছরের ছাত্রদের বেছে নিয়ে বুদ্ধিমন্ত সিংহ নৃত্যশিক্ষণের কাজ শুরু করেন । সেই প্রথম দলটিতে ছিলেন ভবিষ্যতের ভারতবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শান্তিদেব ঘোষ । রবীন্দ্রনাথ তখন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলকে উৎসাহ দিতেন,  নৃত্যানুশীলন পর্যবেক্ষণ করতেন । শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে প্রতিদিন বিকেলে নাচের ক্লাস হত । শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, 

'কিছু নৃত্যভঙ্গি আয়ত্ত করার পর গুরুদেব তাঁর 'আয় আয়রে পাগল, ভুলবি রে চল আপনাকে' গানটির ছন্দে ওইসব নৃত্যভঙ্গি মিলিয়ে নেবার নির্দেশ দিলেন । বুদ্ধিমন্ত সিংহ গুরুদেবের নির্দেশে গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গি গুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আমাদের শিখিয়েছিলেন । এইভাবে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে গুরুদেবের আগ্রহে প্রথম নিয়মিত নাচ শেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল ।' ( শান্তিদেব ঘোষ : রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, কোলকাতা ) ।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজঅন্তঃপুরে মণিপুরী নৃত্যগীতের যে চর্চা ছিল, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন । হয়তো এ কারণেই রাজা ও মহারাজকুমার এর কাছে কবি নৃত্যশিক্ষক চেয়েছিলেন । ছেলেদের নৃত্য শিক্ষার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কবি স্থির করলেন মেয়েদেরও নাচ শেখানোর ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু পুরুষ শিক্ষকের কাছে মেয়েদের নাচ শেখা তখনকার দিনে অভাবনীয় ব্যাপার ছিল । তাই রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজকে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৯শে মাঘ এক চিঠি লিখে অনুরোধ করেন—

"মহারাজ বুদ্ধিমন্ত সিংহকে আশ্রমে পাঠিয়েছেন সেজন্য আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি । ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে । আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মনিপুরী শিল্পকার্য শিখিতে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছে । মহারাজ যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে । আমাদের দেশের ভদ্রঘরের মেয়েরা কাপড়বোনা প্রভৃতি কাজ নিজের হাতে করিতে অভ্যাস করে ইহাই আমাদের ইচ্ছা । এই জন্য আসাম হইতে একজন শিক্ষয়িত্রী এখানকার মেয়েদের তাঁতের কাজ শিখাইতেছে । কিন্তু সিলেটে আমি মনিপুরী মেয়েদের যে কাজ দেখিয়াছি তাহাই ইহার চেয়ে ভালো । আমি বুদ্ধিমন্তের নিকট আমার প্রস্তাব জানাইয়াছি । সে মহারাজের সম্মতি পাইলে তাহার স্ত্রীকে আনাইয়া এখানকার মহিলাদিগকে মনিপুরী নাচ এবং শিল্পকার্য শিখাইবার ব্যবস্থা করিতে পারিবে এরূপ বলিয়াছে । এই জন্য এ সম্বন্ধে মহারাজের সম্মতি ও আদেশের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম ।"

সেদিন শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চা প্রবর্তনে কবি যে কতটা উৎসাহী ছিলেন তা এই পত্র থেকেই বোঝা যায় ।

কিন্তু বুদ্ধিমন্ত সিংহ বেশিদিন শান্তিনিকেতনে থাকেননি । গ্রীষ্মের ছুটিতে সহযোগীসহ দেশে গিয়ে হয়তো পারিবারিক বা অন্য কোন কারণে তিনি আর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি । কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি যে নৃত্য শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন, পরবর্তীকালে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোরের নিকট তাঁর স্বীকারোক্তিতে এর সত্যতা প্রমাণ করে । তিনি বলেছিলেন, প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের মেয়েরা তাঁর নির্দেশ মতো তাঁর সঙ্গে পদক্ষেপ ও অঙ্গচালন করতে চাইছিল না । রবীন্দ্রনাথ তখন বয়োবৃদ্ধ । তিনিই তখন অগ্রণী হয়ে বুদ্ধিমন্তের নির্দেশ অনুযায়ী অবলীলা ক্রমে নৃত্য শুরু করেন । তখন মেয়েদের লজ্জা ভাঙে । আজকাল উক্ত ঘটনা অভিনব বলেই মেয়েদের নিকট অনুভূত হবে । মনিপুরী নৃত্য তালবদ্ধ ও যৌথ নৃত্য । এই নৃত্যের মাধ্যমে শরীরের আড়ষ্ট ভাব কেটে যায় । ব্যায়াম ও নৃত্যের এক যুগ্ম সাধনায় শরীর সুন্দর ও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে । সম্ভবত এটাই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন যদিও পরবর্তীকালে এই প্রচেষ্টা বাদ যায় ।

 এরপর কয়েক বছর শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায় । কবি যখন আরেকবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান তখন সেই সুযোগে মহারাজা কবিকে আগরতলায় আসার আমন্ত্রণ জানান । কবি সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন । এবার রাজকুমারের বাড়িতে কবি রাসনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখেন । বালিকাদের সমবেত উদ্যোগে পরিবেশিত এই রাসনৃত্য প্রত্যক্ষ দর্শন করে কবি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি সেখানে স্থির করলেন শান্তিনিকেতনে পুনরায় নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তন করবেন । মহারাজাকে অনুরোধ করেন, একজন নৃত্য শিক্ষককে পাঠিয়ে দিতে । এবার মহারাজা রাজপরিবারের আরেকজন নৃত্যশিক্ষক পাঙম্বাম নবকুমার সিংহ ঠাকুরকে পাঠিয়ে দেন । নবকুমার এসেছিলেন তার অনুজ বৈকুন্ঠ সিংহকে নিয়ে । বাছাই করা একদল ছাত্রীদের নিয়ে তিনি নাচের প্রশিক্ষণ শুরু করেন । ক্লাস হত আড়ালে শান্তিনিকেতনবাসীদের অগোচরে । সেই সময় বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড লিটন সাহেব শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন । তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয় নবকুমারের শেখানো মনিপুরী নাচের একটি অনুষ্ঠানের দ্বারা । সেদিন মনিপুরী রাসলীলা নৃত্যের কিছুটা অংশ দেখানো হয়েছিল ।

১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কবির জন্মদিনে নবকুমারের প্রযোজনায় 'নটীর পূজা' নৃত্যনাট্যের প্রথম সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন হয় । এটি কবির 'পূজারিণী' কবিতার রূপায়ণ । 'নটীর পূজা'র মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে । ছাত্রীরাও তখন নিঃসংকোচে নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে । বুদ্ধিমন্তের সময়ে নাচ শেখার আগ্রহ থাকলেও মেয়েরা এগিয়ে আসতে চাইত না । 'নটীর পূজা'র সময় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে । ১৯২৭ সালে কলকাতায় পুনরায় অভিনীত হয় 'নটির পূজা' । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, 'নাটকটির শেষ অংশে ভৈরব রাগিনীতে রচিত 'আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো' গানটির সঙ্গে নন্দলালকন্যা শ্রীমতি গৌরী দেবীর মনিপুরী নৃত্য সহযোগে 'শ্রীমতি'র আত্মনিবেদনের অভিনয় সেদিন শিশু থেকে বয়স্ক দর্শকদের সকলেরই মনে গভীর রেখাপাত করেছিল ।' নৃত্যশিল্পী নটীরূপী গৌরীদেবীর নৃত্যভঙ্গিমার অপূর্ব দক্ষতা সেকালের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল । এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে সম্ভবত, সেই প্রথম উচ্চ ভদ্রবংশীয় কোন মেয়েকে সর্বসমক্ষে নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় । 'নটীর পূজা'তে রবীন্দ্রনাথ প্রথম একটি নৃত্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা সমগ্র নাটকের মূল সুরটিকে ধরে রাখে । পরবর্তী সময়ে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রচিত হয় 'তাসের দেশ' ও 'শাপমোচন' যাতে নৃত্যকে আরো বেশি প্রাধান্য দিয়ে সন্নিবিষ্ট করা হয় নাটকে । 'নটীর পূজা'র সময়কালে নবকুমারের জন্যই শিক্ষিত দেশবাসী মনিপুরী নাচের মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারেন বলে শান্তিদেব ঘোষ উল্লেখ করেছেন ।

 "এইভাবে গুরুদেবের গানের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র নৃত্যপ্রথা নবকুমারের শিক্ষকতায় 'নটীর পূজা'র অভিনয় থেকে শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রবর্তিত হয় '' । বলা যেতে পারে নবকুমার শান্তিনিকেতনের মণিপুরী নৃত্যশিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিলেন । ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে পৌষ মাসের  (১৯৩১ ) খ্রিস্টাব্দ নবকুমার সিংহ সৃষ্ট মনিপুরী নৃত্যের আঙ্গিকে ও ভীমরাও শাস্ত্রীর সংগীত পরিচালনায় প্রথম শাপমোচন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় । পরে কলকাতা নিউ এম্পায়ারে, শান্তিনিকেতনে ও সিংহলে এই নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছিল । এরপর মনিপুরী নৃত্যের আঙ্গিকে নবরূপায়ণ রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য 'শ্যামা' পরিবেশন করেন । শুধু যে বিভিন্ন রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যেই মনিপুরী ও অন্যান্য ধ্রুপদী ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রা ও শৈলী পরিবেশিত হয়েছে এমন নয় । রবীন্দ্রসংগীত সহযোগে যে সমস্ত নৃত্যের 'কোরিওগ্রাফি' রচনা করা হয়েছে সেখানেও ঠাকুর নবকুমার সিংহের মণিপুরী আঙ্গিকে সৃষ্ট নির্দেশনাকে রবীন্দ্রনাথ যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও মূল্য দিতেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত বিশারদ শান্তিদেব ঘোষ মহাশয় তাঁর লেখনীতে এইভাবে প্রকাশ করেছেন,  'গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি গানের ভাষা, অর্থ, উচ্চারণ, সুরের উঠানামা, লয়, বিস্তার এগুলির প্রতি যত্নশীল ছিলেন' । তাঁর এই কাজে নবকুমার ছিলেন একান্ত আপন । তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য সহযোগে এগুলি পরিবেশিত হলে সেসব সৃষ্টি হয়ে উঠত প্রাণবন্ত । বসন্তোৎসব, অভিসার, শারদোৎসব, পূজারিণী এমন অনেক গীতিনাট্যে নবকুমার সিংহের সুচিন্তিত নৃত্যশৈলীর যথার্থ প্রয়োগ আজও   আলোচনার বিষয় হয়ে আছে । সেই রীতি অধ্যবধি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য চর্চার মধ্য দিয়ে অনুসৃত হয়ে আসছে । 'ঋতুরঙ্গ' নামে আরেকটি সার্থক নৃত্যনাট্যের পরিচালনায় ছিলেন নবকুমার সিংহ । নবকুমার ও মনিপুরী নৃত্য সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' গ্রন্থে বলেছেন—

"... নটীর পূজায় মণিপুরী নাচের সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে ১৯২৭ সালে গুরুদেব নটরাজ গীতিকাব্যের আসর বসালেন দোলপূর্ণিমার দিনে শান্তিনিকেতনে । কেবলমাত্র তালযন্ত্রের নৃত্যছন্দে নাচ দেখানোর চেষ্টা পরবর্তীকালে 'শাপমোচন'-র অভিনয়ের সময়েই বিশেষভাবে শুরু হয় । মনিপুরী বোলের নাচ দিয়েই তার সূত্রপাত । গানের মাঝে মাঝে ছোট খোলের বোল দিয়ে অভিনয় থেকে কেবল নাচের ছন্দে দর্শকের মনকে একটু আন্দোলিত করাই হল এর কাজ । এটির সূত্রপাত করে যান 'শাপমোচন' এর যুগে (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ ) নবকুমার সিংহ, যিনি প্রথম নটীর পূজার যুগে মনিপুরী নাচ শান্তিনিকেতনের মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ।... গুরুদেবের গানকে নাচের অভিনয়ে রূপ দেবার তাঁর মত ক্ষমতা আমি আর কোন নর্তকের মধ্যে দেখিনি । এই সময়ে তাঁর সাহায্যে শান্তিনিকেতনের নৃত্যাভিনয়ের ধারা মনিপুরী পদ্ধতিতে প্রভূত উন্নতি লাভ করে ।"

শান্তিনিকেতনের সাফল্যের সূত্রে নবকুমার আহমেদাবাদ, মুম্বাই প্রভৃতি জায়গা থেকে ডাক পেয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩৪ এ সদলবলে সিংহলে ( শ্রীলংকা ) যান তখন তিনি নবকুমার এবং তাঁর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন নটীর পূজা এবং শাপমোচন অনুষ্ঠানে তাঁদের যোগদানের জন্য ।

নবকুমারের পর আরো অনেক নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে এসে মনিপুরী নৃত্য ধারাকে অবারিত ও প্রসারিত করে গেছেন । তাঁদের মধ্যে ছিলেন ত্রিপুরা থেকে সাপম বসন্ত সিংহ ও রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ, শিলচর থেকে সেনারিক সিংহ,তদানীন্তন শ্রীহট্টজেলার অন্তর্গত ভানুগাছ থেকে নীলেশ্বর মুখার্জি ( তিনি মনিপুরী ব্রাহ্মণ ) এবং ইম্ফল থেকে হাওবম আতম্বা সিংহ প্রমুখ । তাঁদের মধ্যে অনেকেই শুধু শিক্ষকতায় নয় মনিপুরী নৃত্যের আঙ্গিকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অনেক নৃত্যনাট্যের রূপায়ণে সফলতা লাভ করে অভিস্মরণীয় স্মৃতি রেখে গেছেন ।

নব কুমার সিংহের পর যিনি শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে ত্রিপুরা থেকে গিয়েছিলেন তাঁর নাম নীলেশ্বর মুখার্জি । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের কুলীন ব্রাহ্মণ নীলেশ্বর মুখার্জির জন্মভূমি শ্রীহট্টের ভানুগাছ সংলগ্ন বালিগাঁও । পড়াশোনা শ্রীহট্টের কমলগঞ্জ, ত্রিপুরার কৈলাশহর ও পরবর্তী সময়ে শিলচর । খোলবাদক হিসেবে যৌবনে চারদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল । ত্রিপুরা-শ্রীহট্ট অঞ্চলে মনিপুরী সমাজে গায়কবাদক হিসেবে নীলেশ্বর তখন এক উজ্জ্বল নাম । একসময় আমন্ত্রণ পেয়ে ত্রিপুরা রাজ দরবারেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন । ১৯৩৫ সালে নীলেশ্বর মুখখার্জী শান্তিনিকেতনে যোগ দেন । চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা প্রকাশের ৪৪ বছর পর ১৯৩৬ সালে নবরূপ পায় চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য । কলকাতার অ্যাম্পায়ার থিয়েটারে ১৯৩৬ সালের ১১-১৩ মার্চ চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় । রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন—

শান্তিনিকেতনের কলাচর্চার আদর্শ প্রচার ও বিশ্বভারতীর শূন্য তহবিল আংশিকভাবে পূর্ণ করা এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল । নকবিগুরু ৭৫ বছর বয়সে স্বয়ং অভিনয়ের বিরাট দল নিয়ে উত্তর ভারতে যাত্রা করেন । অভিনয়ের তারিখ ও হলের নাম :– ১৬-১৭ মার্চ পাটনা, হুইলার সিনেট হল ও এলিফিনিসটোন পিকচার প্যালেস । উনিশ মার্চ এলাহাবাদ, রিজেন্ট । ২২-২৩ মার্চ লাহোর,  প্লজ । ২৬-২৭ মার্চ, দিল্লি, রিগাল থিয়েটার । ২৯ মার্চ : মিরাট । ( রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক চতুর্থ খন্ড ) ।

নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা নাচের ব্যাপারে এক বিশেষ ভূমিকা ছিল নীলেশ্বর মুখার্জির । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহস্পর্শে শান্তিনিকেতনে কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন তিনি । তিনি ছিলেন মণিপুরী নৃত্যের শিক্ষক । এমনকি শান্তিনিকেতনের সেইদিনের ছাত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর কাছে নৃত্যের তালিম নিয়েছিলেন । ১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । সে সময়ের পত্রপত্রিকায় এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় । নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার নৃত্য সমাবেশে প্রথমে মনিপুরী শৈলীর প্রাধান্য থাকলেও গৌণভাবে এতে কথাকলি ও অন্যান্য প্রদেশের লোকনৃত্য এবং সেইসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের মিশ্র রীতির ধারা । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, "চিত্রাঙ্গদা ১৯৩৬ সালে প্রথম যেবার অভিনীত হয় তাতে মনিপুরী পদ্ধতি ছিল প্রধান। তার সঙ্গে সামান্য কিছু কথাকলি, ও লোকনৃত্যের ভঙ্গি মেশানো ছিল । কিন্তু কথাকলির উপযুক্ত শিক্ষক  পাওয়া যাবার পর অর্জুনের অভিনয়ে কথাকলি নৃত্যপদ্ধতি বেশ খানিকটা প্রাধান্য পেল নাচের সঙ্গে  ।'' চিত্রাঙ্গদায় যেসব শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন শান্তিদেব ঘোষ, নীলেশ্বর মুখার্জী, গোবর্ধন পাঞ্চাল, শিশিরকুমার ঘোষ, ডি বাল গঙ্গাধর, সন্তোষ ভঞ্জ চৌধুরী, শিবকুমার দত্ত, হীরেন ঘোষ, বিশ্বরূপ বসু, যমুনা দেবী, নিবেদিতা দেবী, মমতা দেবী, হাসু দেবী, দীপ্তি দেবী, ইন্দু দেবী, মনিকা দেবী, রমা দেবী প্রমুখগণ । পূর্ববঙ্গে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থের জন্য ১৯৩৮ সালে মার্চ মাসে শান্তিদেব ঘোষের দায়িত্বাধীনে যে শিল্পীদল গিয়েছিলেন তাতেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নীলেশ্বর মুখার্জি ।

১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিত্রাঙ্গদা প্রস্তুতি পর্বে ত্রিপুরা থেকে আরো একজন নৃত্য শিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন তাঁর নাম বসন্ত সিংহ । রাজপরিবারের নৃত্য শিক্ষক ছিলেন তিনি । মহারাজা বীর বিক্রমের রাজত্বকালে রাজধানী, বিশেষত রাজবাড়িতে আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে বসন্ত সিংহ সফলভাবে নৃত্য ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা যায় । বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর ত্রিপুরা থেকে অপর একজন নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন । তাঁর নাম রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ । খাঁটি মনিপুরী শৈলী বজায় রেখে তিনি নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন । শান্তিনিকেতনে চন্দ্রজিৎ যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেন । ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি যখন শেষবারের মতো আগরতলা এলেন তখন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে প্রতিদিন মনোজ্ঞ মণিপুরী নৃত্য পরিবেশিত হত । সেখানে  রাসনৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়েছিল । রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজঅন্তঃপুরের মেয়েরা এই নৃত্যে অংশ নিয়েছিল । সেদিন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়ির নৃত্যানুষ্ঠানে কিশোরবয়স্ক চন্দ্রজিৎ 'আবিরখেল' নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন । কবি তার নৃত্য দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন । ১৯০৬ সালে বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যশিক্ষকের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । ব্রজেন্দ্রকিশোর তখন চন্দ্রজিৎকে সেখানে পাঠিয়ে দেন । চন্দ্রজিত মাত্র দেড়-দুই বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন । মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে চন্দ্রজিৎ শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দিয়েছিলেন । তখন নৃত্যের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মৃদঙ্গ, খুব বেশি হলে সেতার ব্যবহৃত হত । কিন্তু হারমোনিয়াম তবলা কখনো না । 'চিত্রাঙ্গদা', 'তাসের দেশ' ইত্যাদি নৃত্যনাট্যে তাঁর ভূমিকা ছিল । রবীন্দ্রসংগীতের নৃত্যরূপ দিতে তিনি মণিপুরী রাসের 'ভঙ্গিপারেং' মুদ্রাগুলোর সাহায্য নিয়েছিলেন বলে জানা যায় । চন্দ্রজিতের সে যুগের ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন নন্দলাল কন্যা যমুনা, আম্বালাল সারাভাইকন্যা মৃণালিনী, রবীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা নন্দিতা প্রমুখ ।

একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষার জন্য আগরতলা থেকে মনিপুরী নৃত্যশিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন । ত্রিপুরার রাজানকুল্যের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজপরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ থাকার ফলেই তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে মনিপুরী নৃত্যের আন্তর্জাতিক সমাদর বা স্বীকৃতি এসেছে । জহুরি জহর চেনে । 'আজি হতে শতবর্ষ আগে' রবীন্দ্রনাথই চিনেছিলেন এই সম্পদকে । শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় মনিপুরী নৃত্যের সংযোজন এবং রবীন্দ্র সৃষ্টির সংমিশ্রনে আলোকিত হয়ে মনিপুরী নৃত্য সেদিন বিশ্বের অঙ্গনে স্থান করে নিতে পেরেছিল ।

তথ্যসূত্র :

১. রবি জীবনী-সপ্তম খন্ড, প্রশান্ত পাল পৃ. ৪৪২
২. রাজপ্রাসাদে মনিপুরী নৃত্য-গীতের চর্চা–জিতেন্দ্রজিৎ সিংহ ( উজ্জয়ন্ত ২০০১ ) পৃ. ১২৯-১৩০
৩. ত্রিপুরায় মনিপুরী নৃত্যচর্চা, নীলমণি দত্ত, ( ত্রিপুরা প্রসঙ্গ ১৯৭৫ ) পৃ. ১০০-১০১
৪. ত্রিপুরা রাজ পরিবার ও মনিপুরী সমাজ–রাজকুমার কমলজিৎ সিংহ ( উজ্জয়ন্ত ২০০১ )পৃ. ১৪৭
৫. ত্রিপুরায় রবীন্দ্র স্মৃতি–সত্য রঞ্জন বসু ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ) আগরতলা, পৃ ১–৬
৬. স্মৃতি ভারে পড়ে আছি আমি–নবকুমার সিংহ ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ২৪৫ )  আগরতলা
৭.  গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য–শান্তিদেব ঘোষ, কলকাতা
৮. উত্তর-পূর্ব ভারত ও রবীন্দ্রনাথ ( কোলকাতা ) বিকচ চৌধুরী ।
৯. উত্তর পূর্বাঞ্চল ও রবীন্দ্রনাথ–পান্নালাল রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা ) ।
১০. অন্য রবীন্দ্রনাথ–ড. দেবব্রত দেব রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা )
১১. রবীন্দ্র আলোকে মনিপুরী নৃত্য ও সাহিত্য–নোংথোম্বম কুঞ্জমোহন সিংহ ( প্রবন্ধ ) আগরতলা বইমেলা স্মরণিকা ২০১২-পৃ, ২২- ৩২
১২. চিত্রাঙ্গদা দেশের রবীন্দ্রনাথ–বিকচ চৌধুরী ( প্রবন্ধ ) গোমতী রবীন্দ্রসংখ্যা ২০১০-পৃ. ৭–১৪
১৩. শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় ত্রিপুরার ভূমিকা–পান্নালাল রায় ( প্রবন্ধ ) গোমতি রবীন্দ্র সংখা ২০১০পৃ. ১১০–১১১

Sunday, March 12, 2023

চাপাকথা

চাপাকথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মনে হয় দুহাতে আগলাও তুমি দশহাতের সংসার ৷ কতো কাজ তোমার!  তারই ফাঁকে ফাঁকে তুমি ব্যক্তিগত মোবাইলে হাত রাখো নিভৃতে ৷এদিক ওদিক দুচোখ ঘুরিয়ে খুঁজে নাও নিরাপদ চত্বর ৷ তোমার হাঁড়িতে যখন ভাতের টগবগ নাচন, যখন গরম তেলের কড়াতে ফোঁড়ন দাও ঘটা করে, একটা প্রতিবাদ ও ক্রোধের গুঞ্জন হেঁসেলের পরিবেশে হৈ চৈ করে ওঠে, তখন তুমি অসম্ভব চাপা স্বরে বলে ফেলো সব কথা, করুণ দিনলিপি লেখা ডায়েরির পাতার মতো উড়ে এসে অতি দ্রুত উজাড় হয়ে যায় আমার বুকে ৷ 
আমিও আমার মোবাইল সবসময় রাখি আমার বুকপকেটে ৷রিংটোনের চেনা সুর আমার হৃদয় জাগায় ৷ আর তোমার আহ্বান যাতে নিরুত্তর ফিরে না যায় তার জন্যে আমি উৎকর্ণ থাকি প্রতি মুহূর্তের সঙ্গে ৷
দেখা না হলেও প্রতিদিনের তোমার কথামালায় আমি বুঝি তোমার চোখে উদ্ভ্রান্ত বালিকার এলোকেশ চৈতের ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যায় ৷ আমার নিঝুমকথায় তোমার সাহসের ডানা উড়াল শেখে ৷গাঢ় হয় ভালোবাসার মরমি দিনের গুজরান ৷

সারাদিন লুকোচুরি খেলতে খেলতে দিগন্তে সন্ধ্যা দাঁড়ায় এসে একাকী ৷ ঘরে ফেরায় উদ্বেল পাখিদের লন্ঠন বাড়িয়ে দেয় আকাশ ৷ আর পাহাড়ের ঢালে কালো চাদর গায়ে নেমে আসে রাত ৷

তুমি তখনো দরজা ছেড়ে নড়ো না ৷চেয়ে থাকো পশ্চিমের বাসন্তী আকাশের আঁধারগায়ে ৷ তোমার মোবাইলে হঠাৎ পূরবীর বিহ্বল রিংটোন বেজে ওঠে ৷ কেন গো কিশোরী  ?

Saturday, March 11, 2023

রাজন্য ত্রিপুরায় বসন্তোৎসব ও হোলির গান

রাজন‍্য ত্রিপুরায় বসন্তোৎসব ও হোলির গান

                                                    অশোকানন্দ রায়বর্ধন


বসন্ত একটি ঋতু । বছরের ছয় ঋতুর শেষ ঋতু । শীতঋতুতে প্রকৃতিকে যে রুক্ষতা গ্রাস করে, শুষ্ক করে, বৃক্ষের পত্রাদি ঝরে শীর্ণতার রূপ ধরে,  বসন্ত এসে সেখানে প্রকৃতিতে রং লাগিয়ে দেয় । প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যেন সবকিছু সুন্দর হয়ে ওঠে । গাছে গাছে সবুজ কচি পাতায় ছেয়ে যায় । এই সবুজের আড়ালে বসে কোথাও মধুর সুরে কোকিল ডেকে ওঠে । বনে বনে রঙের উচ্ছ্বাস লাগে ।  কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে ওঠে । কোথাও বনের মধ্যে পলাশ ফুটে ওঠে । ফুলে ফুলে সুন্দর আর চিরসবুজ হয়ে ওঠা দুনিয়ায় রঙের পরশ লাগে । কৃষি মরশুমেরও সূচনা করে বসন্ত । অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয় ও চিরন্তন প্রেমের ঘোষণা করে বসন্ত । বসন্তে জীবন যেন বর্ণময় হয়ে ওঠে । নীল, লাল, হলুদ, গোলাপি আবির আর গুলালে মানুষ মেতে ওঠে বসন্ত উৎসবে, রঙের উৎসবে । প্রিয়জনকে রঙে রঙে রাঙিয়ে বর্ণময় করে তোলার উল্লাস জাগে । যেন সমস্ত রং উজাড় করে দিতে চায় মন আপনজনকে । বসন্তের এই দিনে আসে ফাগের উৎসব । যার আরেক নাম 'হোলি' । বসন্তউৎসব প্রেমের উৎসব । তারুণ্যের উৎসব । এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও মিথ ।

পৌরাণিক কাহিনিতে আছে শিব ও পার্বতীর বিবাহ উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাধা ও কৃষ্ণের উদ্যোগে এই উৎসব পালিত হয় । রাধা ও কৃষ্ণ ভারত উপমহাদেশের চিরন্তন প্রেমের প্রতীক ।‌ বৈষ্ণবদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রচলিত যে, ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোগিনীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতে ছিলেন । এ বিষয়ে একটি মজার কাহিনি প্রচলিত আছে  ।  কৃষ্ণের গায়ের রং ছিল কালো ।‌ তাই সে মা যশোদার কাছে প্রায়ই তার গায়ের রং নিয়ে অনুযোগ করত । বিশেষত রাধার গায়ের রং উজ্জ্বল ছিল বলে তাকে হিংসা করত কৃষ্ণ । একবার যশোদা রহস্যছলে  কৃষ্ণকে বললেন যে,  সে ইচ্ছে করলে রাধাকে নিজের পছন্দমতো রঙে রাঙিয়ে তার গায়ের রং পাল্টে দিতে পারে ।‌ চঞ্চল কৃষ্ণ তখন দুষ্টুমি করে রাধা ও তার গোপিনী বন্ধুদের রং লাগিয়ে দিলেন । রাধার প্রতি কৃষ্ণের ভালোবাসার এই চপলতাই হয়ে উঠল স্বর্গীয় প্রেমের এক চিরকালীন লোককথা ।‌ হোলি এভাবেই হয়ে উঠল চিরন্তন ভালবাসা ও বন্ধুত্বের প্রতীক । রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উপর ভিত্তি করেই হোলি হয়ে উঠেছে রং, আনন্দ ও ভালবাসার প্রতীক । বলা হয়ে থাকে এই ঘটনা থেকেই দোল উৎসবের সৃষ্টি । দোলের দিন শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে আবির গুলালে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে শোভাযাত্রা বের হয় । ভক্তমন্ডলী পরস্পরকে রং মাখিয়ে প্রমোদখেলায় মেতে ওঠেন । বসন্তের এই রঙের উৎসবকে ঘিরে আরো লৌকিক উৎসব প্রচলিত আছে । তার মধ্যে এক বিশেষ উৎসব হল, 'হোলিকা দহন' বা 'ন্যাড়া পোড়া' । দোলের পূর্ব দিন ছন, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু দিয়ে ঘর নির্মাণ করে তা জ্বালিয়ে দিয়ে বিশেষ বহ্নুৎসব পালন করা হয় । 

'হোলি' ভারতের একটি জাতীয় উৎসব । দেশের বিভিন্ন প্রদেশে প্রাচীনকাল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে । কোথাও 'হোলি', কোথাও 'ফাগ' নামে । তেমনি ত্রিপুরা রাজ্যেও বহু প্রাচীনকাল থেকে এই উৎসব 'হোরি' নামে পালিত হয়ে আসছে । ত্রিপুরার রাজ পরিবারকে কেন্দ্র করে হোলি উৎসব বা বসন্ত উৎসব উদযাপনের একটা ঐতিহ্য অতীত থেকেই গড়ে উঠেছে । রাজমালার প্রথম লহরে ত্রিলোচন খন্ডে 'দুর্গোৎসব দোলোৎসব জলোৎসব চৈত্রে' লেখা হলেও হোলি উদযাপন সম্পর্কে তেমন বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না । তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কাল থেকে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে হোলি উদযাপিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় । মূলত, মণিপুর রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই ত্রিপুরার রাজপরিবারও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে । ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য ( ১৭৮৫–১৭৯৭ খ্রি. ) মনিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন । ভাগ্যচন্দ্র রাজধর মানিক্যের হাতে কন্যা সম্প্রদানের পাশাপাশি ত্রিপুরার রাজবাড়িতে তাঁর ইষ্টদেবতা রাধামাধবের বিগ্রহও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । রাজকন্যার সঙ্গে নৃত্যের কুশীলব, গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রীরা সেই সময় আগরতলায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং রাধামাধবের নিত্যপূজা শুরু করেন । ফলে, বৈষ্ণবীয় বিনয় ও  মর্যাদার সঙ্গে সেই সময় থেকে এই রাজ্যে 'হোরি' উৎসব পালন করার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয় । সেদিনের রাজারা সমস্ত রকমের রাজোচিত গাম্ভীর্য, মর্যাদা ও অহংকারকে দূরে সরিয়ে প্রজাদের আন্তরিকতার সঙ্গে এই উৎসবে আহ্বান করতেন । প্রজা সাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই নির্মল আনন্দে শামিল হতেন । প্রজারা সেদিন রাজ সন্দর্শনে  নিয়ে যেতেন ভক্তিমিশ্রিত আবির । মহারাজ ও তার প্রতিদানে প্রচারের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন 'প্রসাদী রাঙ্গা ধূলিকণা' । সে সময় রাজবাড়ির হোলি  উৎসবে বাইরের অতিথিদের ও নিমন্ত্রণ জানানো হত‌ । রামগঙ্গা শর্মা লিখিত 'কৃষ্ণমালা' কাব্য থেকে জানা যায় যে, মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্যের সময়ে চট্টগ্রামের ইংরেজ গভর্নর হ্যারি ভারলেস্ট ও তার কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীকে রাজবাড়ির হোরি উৎসবএ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । কৃষ্ণমালায় আছে–

                                         আতর গোলাপ গন্ধে সভা আমোদিত ।।
                                         সুগন্ধি আবির চূর্ণ আমি ভারে ভারে ।
                                         কুঞ্জ কুঞ্জ করি রাখে সবার মাঝারে ।।
                                         পাত্রগণ সহিতে বসিল মহারাজ । 
                                         হারিবিলাস সাহেব প্রভৃতি ইংরাজ ।।
                                         সবে মিলি বসি তথা খেলাইলো হুলি ।
                                         ফল্গুচূর্ণ পরস্পরে অঙ্গে মারে মেলি ।। 
                                         সুললিত নানা বাদ্য চতুর্দিকে বাজে ।
                                         নর্তকী সকল নাচে মনোহর সাজে ।।
                                                                                      ( কৃষ্ণমালা, রামগঙ্গা শর্মা )

প্রকৃতপক্ষে সেই সময় থেকেই ত্রিপুরা রাজপরিবারে প্রত্যেকবছর বসন্তপূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন হোলি উৎসব উদযাপনের রীতি প্রচলিত হয়েছে ।

ত্রিপুরা রাজ্যের হোলি উৎসব মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের ( ১৮৬২খ্রি.–১৮৯৬খ্রি. ) আমলে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য নানাবিধ গুণে গুণান্বিত ছিলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য ভারতের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মন বীরচন্দ্র মানিক্যের গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন– 'নবযুগের প্রবর্তক গুণী মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য । তিনি বাংলা ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন, সুকবি, বৈষ্ণব সাহিত্যের সুপন্ডিত, সঙ্গীতজ্ঞ,  শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা, উর্দুভাষায় মাতৃভাষা ন্যায় আলাপে সক্ষম, কূটনীতি পরায়ণ, বাকপটু ও সর্বোপরি তিনি একজন সুনিপুণ চিত্রকর ও ফটোগ্রাফার । ( ত্রিপুরার শিল্পের ইতিবৃত্ত–ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মন ) । মহারাজা স্বয়ং ছিলেন বৈষ্ণব কবি । তিনি তাই হোলি উৎসবে মেতে উঠতেন । হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে তিনি গান রচনা করতেন । পরবর্তীকালে তাঁর গানগুলি 'হোরি' নামক কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশ পায় । বীরচন্দ্র মানিক্যের হোরি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কোনো তারিখ পাওয়া যায় না । তবে ধারণা করা হয় গ্রন্থটি ১৮৯১–৯২ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় রচিত হয় । বইটিতে ২৪ টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । হোরি কাব্যটি ভক্তিরসের নিদর্শন বলে ধরে নেওয়া যায় । তাঁর কবিতায় বৈষ্ণবীয়  পদাবলী সাহিত্যের লক্ষণ বিদ্যমান । বীরচন্দ্র তাঁর কাব্যে বৃন্দাবনের বসন্তপ্রকৃতির যে মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাঁর অসাধারণ কবিত্বশক্তির নিদর্শন পাওয়া যায়—

                                             আজু অপরূপ বৃন্দা বিপিকি মাঝে 
                                             বিহরই ঋতুরাজ মনোহরো সাজে,
                                             নবীন পল্লবে কিবা সুশোভিত ডাল 
                                             কত সারী সুক পিক গাওয়ে রসাল ।
                                             নানা জাতি ফুলদলে শোভিত কানন অন্তে, 
                                             মৃদু মৃদু বহতহি মারুত  বসন্তে ।

মহারাজা বীরচন্দ্রের কবিতায় রাধাকৃষ্ণের হরি খেলার চিত্র ফুটে ওঠে–

এক. 
                                            রসে ডগ মগ ধনী আধো আধো হেরি
                                            আঁচলে ফাগু লেই কুঁয়রী
                                            হাসি হাসি রসবতি মদন তরঙ্গে,
                                            দেয়ল আবির রসময় অঙ্গে 
                                            সুচতুর নাহ হৃদয়ে ধরু প্যারী 
                                            মুচকি মুচকি হাসি হেরত গৌরী ।

দুই.
                                             ফাগু খেলত রাধাকানু
                                             সব সখী রঙ্গিনি গায়ে সুতান
                                             চুয়া চন্দন পরিমল কুমকুম 
                                             লাল গোলাপ উড়াওত অফুরান,
                                             মদন বিমোহন হেরি সে মাতল
                                             গায়ে যুবতী মেলি হোরি ঝুমুরি,
                                              বীণা রবাব মুরজ মধুর বায়ত 
                                              নাচত রায় শ্যাম ঘেরি 
                                              নুপুর ঝর্ণা নানা মৃদঙ্গ তাতা থৈ তাথৈ তাথৈ 
                                              রুনু ঝুনু বোলে ঘুঙ্গুরী,
                                              ব্রজ বনিতাকূল রি ঝি রি ঝি নাচত 
                                              মারত ঘন পিচকারি । 
                                              বীরচন্দ্র দাস মন‌ ভরি গাওত 
                                              রায় কানু খেলত হোরি ।

বীরচন্দ্রের 'হোরি' কাব্যে কৃষ্ণসহ হোলি খেলায় রত রাধিকার মধ্যে যে ভাবরসের সঞ্চার ঘটেছে তাতে রাধিকাকে ধীরা রমণীর মত আবেগে আনতভাবা দেখা যায় । তার কবিতায় রাধা এবং কৃষ্ণের রূপ বর্ণনায়ও উৎকর্ষতার ছাপ রয়েছে ।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র রাধাকিশোর মানিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯খ্রি. )ত্রিপুরার রাজা হন । রাধাকিশোর মানিক্য নিজে ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক । ১৩০৬ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ 'কাহিনী' কাব্যটি রচনা করেন এবং তা মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের নামে উৎসর্গ করেন । রবীন্দ্রনাথ ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে বসন্ত পূর্ণিমার দিন শান্তিনিকেতনে শুরু করেন ঋতুরঙ্গ উৎসব । ১৯৩২ সাল থেকে এই উৎসব 'বসন্ত উৎসব' নামে পরিচিত হয় । রবীন্দ্র-সান্নিধ্যধন্য রাধাকিশোর বসন্ত উৎসবের প্রতি আগ্রহী ছিলেন । তাঁর নিজের একটি সৌখিন নাটকের দলও ছিল । তিনি তাঁর পিতার ন্যায় কিছু বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন । এগুলো তাঁর রাজত্বকালের সীমার মধ্যে রচিত । তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র দেববর্মা দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে 'ফাল্গুনী' নামে একটি গীতি সংকলন প্রকাশ করেন । সেখানে মহারাজা রাধাকিশোরের কিছু পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয় । পরবর্তী সময়ে 'বসন্তরাস' নামে আরো একটি গীতি সংকলন প্রকাশিত হয় । সেখানেও রাধাকিশোরের রচিত কিছু পদ স্থান পেয়েছিল । রাধাকিশোর তাঁর কিছু কিছু পদের ভনিতায় নিজেকে বৃন্দাবনচন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন । রাধাকিশোরের রচিত  পদাবলিসমূহ রাস উৎসব ও দোলযাত্রা উপলক্ষে সেই সময়ের কীর্তনীয়াগণ মৃদঙ্গ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান করতেন । তাঁর পদাবলীর একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো–

                                                  দেখো ফাগু খেলত নাগর রায় 
                                                  ফাগু লেই সখিগণ সঙ্গে 
                                                  হাসি হাসি সুন্দরও মনমথ রঙ্গে 
                                                  খেলত হোলি শ্যাম নাগর সঙ্গে 
                                                  চুয়া চন্দন ভরি পিসকারী মারত 
                                                  পুন পুন দেই চন্দন 
                                                  দুহাত ভরি আবির কুমকুম 
                                                  মারত নেহারি বদন 
                                                  সব সখি সঙ্গে আবির খেলত 
                                                  আজু শ্যামরাই ভৃঙ্গে 
                                                  লাল লাল গাহি খেলত ফাগু 
                                                  ঋতুপতি মনমথ রঙ্গে 
                                                  শ্রীশ্যাম সুন্দর রাধারানী সঙ্গে 
                                                  আনন্দে মগন ভেল
                                                  দীন রাধা কিশোর দুহু গুণগানে 
                                                  সমর্পিত প্রাণ হৈল । 

মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর ত্রিপুরার রাজা ( ১৯০৯–১৯২৩খ্রি. ) হন । তিনি ও তাঁর পিতা পিতামহের ন্যায় গুণের অধিকারী ছিলেন । তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের চিত্রশিল্পী । মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য কিছু বৈষ্ণব পদ ও 'দোললীলা' নামে একটি নাটিকা রচনা করেছিলেন । নাটিকাটির শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় যে তিনিও তাঁর পূর্বপুরুষদের ন্যায় বসন্ত উৎসবে আগ্রহী ছিলেন ।

ত্রিপুরায় হোলি উৎসবের যে পরম্পরা তৈরি হয়েছিল তা মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্যের (১৯২৩–১৯৪৭খ্রি. ) শাসনামলেও পরিলক্ষিত হয় । হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে বীরবিক্রমও কিছু রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক সংগীত রচনা করেছেন । মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য নিজের ডায়েরিতে বিভিন্ন হোলির গান রচনা করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন । তাঁর রচিত গানগুলি ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে 'হোলি' নামক কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় । পরবর্তী সময়ে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র  সহদেববিক্রম কিশোর দেববর্মন তাঁর রচিত গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ করেন । উৎসব সম্পর্কে মহারাজা বীরবিক্রম স্বয়ং বলেছেন, '' হোলি উৎসবটি যেন নর-নারীর প্রচেষ্টা, প্রেমকে পার্থিব জগৎ হইতে বহু উচ্চে লইয়া যাওয়া— প্রেম পূর্ণ প্রাণের আবেগকে যেন ভগবানে নিবেদন করা— ভগবান যিনি স্বয়ং প্রেমের প্রতিরূপ ।" বীরবিক্রম ব্রজবুলি ও বাংলা দুই ভাষাতে পদ রচনা করেন । 

রাজন্য আমলের সংগীতনিপুন ঠাকুর অনিলকৃষ্ণ দেববর্মা কয়েকটি হোলির গান রচনা করেছেন । সেকালের রাজঅন্তঃপুরের মহিলারাও হোলির গান রচনা করতেন । রাজমহিষীদের মধ্যে রাধাকিশোর মানিক্যের মহিষী মহারানি তুলসীবতী দেবী, বীরেন্দ্রকিশোরের মহিষী মহারানি প্রভাবতী দেবী ও তাঁদের কন্যা সুচারুবালা দেবী ও কিছু হোলির গান রচনা করেছিলেন । ত্রিপুরার রাজ পরিবার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আগরতলার ঠাকুরবংশীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ হোলির গান রচনা করেছিলেন । ত্রৈমাসিক 'রবি' পত্রিকার চৈত্র ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে এমন কিছু গান প্রকাশিত হয়েছিল । এমনকি ককবরক ভাষায় ও সেকালে হোলির গান রচিত হয় । এই 'রবি' পত্রিকাটিতে লেখা হয়েছিল, "হোলির দিন  তাহারা ( রাজা ও রাজপরিবারের সংশ্লিষ্ট সকলে, ঠাকুরলোক ও আগরতলার অধিবাসীবৃন্দ ) লালে লাল হইয়া নাচিয়া গাহিয়া বাঁশি বাজাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠে ।" সে সময় আগরতলা শহরে প্রায় পঞ্চাশটি হোলিগানের দল ছিল । তার মধ্যে কিছু মনিপুরীদের দলও ছিল । ঢোলক, মৃদঙ্গ, করতাল, বাঁশি ও হারমোনিয়াম সহযোগে হোলির গান গাওয়া হত । রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদেরও হোলি গানের দল ছিল । এবং তাঁরা নাচে গানে মেতে উঠতেন । 

হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরার রাজপরিবারে একসময় হোলিসঙ্গীতের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল । একদা রাজ্যে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আধারে রচিত গীতসমূহ হোলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল । সেই ধারা আজও রাজ্যে বিদ্যমান ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. ত্রিপুরায় শতাব্দীর প্রবন্ধ চর্চা– রমাপ্রসাদ দত্ত, ড. ব্রজগোপাল রায়
২.  শতাব্দীর ত্রিপুরা– নির্মল দাশ, রমাপ্রসাদ দত্ত
৩.  ঐতিহ্য ও ইতিহাসের পটে ত্রিপুরা (১ম খন্ড )– রমাপ্রসাদ দত্ত
৪.  প্রবন্ধ সংগ্রহ– করবী দেববর্মণ
৫. ত্রিপুরা রাজমালা– পুরঞ্জন প্রসাদ চক্রবর্তী
৬. ত্রিপুরার রাজআমলের বাংলা সাহিত‍্য– ড. রঞ্জিত চন্দ্র ভট্টাচার্য
৭. ত্রিপুরার রাজঅন্দরে সাহিত‍্য চর্চা– ড. মুকুল কুমার ঘোষ

Thursday, March 9, 2023

রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুর রাজপরিবার

রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুর রাজপরিবার

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের দীর্ঘকাল ব্যাপী সম্পর্কের ধারাবাহিকতা তৈরি হয় । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যথেকে শুরু করে তার প্রপৌত্র মহারাজা বীরবিক্রম— ত্রিপুরার এই চার রাজার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের এই সম্পর্কের সূত্র ধরে ত্রিপুরার সাহিত্যে আধুনিকীকরণের গতির সৃষ্টি হয় । ত্রিপুরার সাহিত্য সৃষ্টি সেই রাজমালার যুগ থেকে চিহ্নিত করা হয় । পয়ার এবং ত্রিপদী ছন্দের ধরাবাঁধা কাব্যে আটকে ছিল সে সাহিত্য । মহারাজা বীরবিক্রম তাকে অতিক্রম করতে চাইলেন । শুধু নতুন কিছু ছন্দ প্রয়োগে নয় । বিষয়বস্তু নিয়েও এগিয়ে গেলেন । ইতিহাস আর কিংবদন্তি ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন কবিতায় । বীরচন্দ্র রচিত কাব্য 'ঝুলন',  'হোরি',  'অকাল কুসুম',  'উচ্ছ্বাস',  'সোহাগ',  'প্রেম মরীচিকা' ইত্যাদি । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের যখন সূত্রপাত ঘটে তখন মহারাজা বীরচন্দ্র প্রায় প্রৌঢ় বয়স্ক । আর রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনের দিনান্তে অবস্থিত তখন ত্রিপুরা সিংহাসনে ছিলেন যুবক রাজা বীরবিক্রম ।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে বীরচন্দ্রের কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী যে কবিতা রচনা করেন তা ছিল অনেক বেশি আধুনিক । অনঙ্গমোহিনী দেবীর কাব্য 'শোকগাথা',  'প্রীতি',  ও 'কণিকা' বিশ শতকের প্রথম দশকে প্রকাশিত হয় । কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ করা গেলেও তাঁর কাব্য বিগত শতকের গোড়ায় আধুনিকতা এনে দিয়েছিল । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন । ত্রিপুরার পটভূমিকায় তিনি লিখেছেন 'রাজর্ষি',  'বিসর্জন' এবং 'মুকুট' ।

তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের কাছ থেকে । 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিকভাবে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৮ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় তা । প্রকাশিত হবার পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৯ বঙ্গাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর জীবনাবসান ঘটে ।‌ শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে রাজা তখন বিরহের কবিতা লিখে লিখে শোকভার লাঘব করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক এই সময়েই মহারাজার হাতে আসে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । এই কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে তিনি যেন একটা আশ্রয় পেলেন ।  তাঁর বিরহী অন্তরে নাড়া দেয় এই কাব্যগ্রন্থ । তিনি গভীর উৎসাহ নিয়ে পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । তিনি মনে মনে ভাবলেন, এ বোধহয় কোন বয়স্ক কবির লেখা । তাঁর পারিষদবর্গ তাঁকে জানালেন যে, রবীন্দ্রনাথ একজন তরুণ কবি এবং আরো বললেন, এই কবির পরিবারের সঙ্গে অর্থাৎ কবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মহারাজার পিতৃদেব কৃষ্ণকিশোর মানিক্যের গভীর সম্পর্ক ছিল একটা মামলা কে কেন্দ্র করে ।

 'ভগ্নহৃদয়' পাঠের পর কালবিলম্ব না করে মহারাজ বীরচন্দ্র তাঁর নিজস্ব সচিব শ্রদ্ধেয় রাধারমন ঘোষ মহাশয়কে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠালেন কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার জন্য । তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি 'ভগ্নহৃদয়'-র সুর বীরচন্দ্রের বিরহী প্রাণে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল ।  মুগ্ধ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত করেন 'কবি' উপাধিতে । রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রথম স্বীকৃতি লাভ । সেই প্রথম কোন খেতাবপ্রাপ্তি । জীবনে প্রথম সম্মান লাভের সঙ্গে সঙ্গে 'ত্রিপুরা' শব্দটি সেদিন থেকে রবীন্দ্রনাথের  অন্তরে গেঁথে যায় । তাঁর নোবেল প্রাপ্তির তিন দশক আগেই বিশ্ব যেদিন রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারেনি সেদিন শুধু ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছিলেন । চিনেছিলেন তার কাব্যপ্রতিভাকে । সেই সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় ৬০ বছরের সম্পর্ক ছিল ত্রিপুরার ।

১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১২ ফাল্গুন আগরতলার উমাকান্ত একাডেমির মিলনায়তনে স্থানীয় কিশোর সাহিত্যসমাজ রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল । সেই সংবর্ধনা ভাষণে কবি মহারাজা বীরচন্দ্রের সেই স্বীকৃতির কথা উল্লেখ করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন—

'জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি তিনি তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন তার অভিনন্দনের দ্বারা । তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তার বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনই আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন । যিনি উপরের শিখরে থাকেন, তিনি যেমন সহজে চোখে পড়ে না তাকেও দেখতে পান,  বীরচন্দ্র সেদিন আমার মধ্যে অস্পষ্টকে স্পষ্ট দেখেছিলেন ।'

সৃজনশীল জীবনের একেবারে উষালগ্নে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়'কে কেন্দ্র করে তাঁকে যে সম্মান এনে দিয়েছিল তা তিনি জীবনের অন্তিম পর্বেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন । ১৯৪১ সালের ২৫শে বৈশাখ ত্রিপুরার রাজদরবারে  সেদিন কবির জন্মদিনের উৎসব পালিত হয়েছিল । এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মহারাজা বীরবিক্রম ঘোষণা দিলেন শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বকবিকে 'ভারত ভাস্কর' সম্মান প্রদান করা হবে । পাঁচ দিন পর ৩০ বৈশাখ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে আয়োজিত হয় সেই বিশেষ অনুষ্ঠান । ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কবিকে জীবনের শেষ সম্মান 'ভারত ভাস্কর' প্রদান করলেন । একটি বিশেষ হুইলচেয়ারে বসিয়ে  কবিকে সভাস্থলে আনা হল । ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম সেই অনুষ্ঠানে কবির হাতে তুলে দিলেন  ত্রিপুরার মানুষের পক্ষ থেকে  সম্মান আর অর্ঘ্য । ত্রিপুরার এই সম্মান গ্রহণ করে কবি সেদিন যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা পাঠ করে শোনান কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই সংবর্ধনা ভাসনে কবি বলেছিলেন—

'ত্রিপুরার রাজবংশ থেকে একদা আমি অপ্রত্যাশিত সম্মান পেয়েছিলাম,  তা আজ বিশেষ করে স্মরণ করবার ও স্মরণীয় করবার দিন উপস্থিত হয়েছে ।  এরকম অপ্রত্যাশিত সম্মান ইতিহাসে দুর্লভ । সেদিন মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য এই কথাটি আমাকে জানাবার জন্য তাঁর দূত আমার কাছে প্রেরণ করেছিলেন যে, তিনি আমার তৎকালীন রচনার মধ্যে একটি বৃহৎ ভবিষ্যতের সূচনা দেখছেন । সেদিন এ কথাটা সম্পূর্ণ আশ্বাসের সহিত গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল । আমার তখন বয়স অল্প, লেখার পরিমাণ কম, এবং দেশের অধিকাংশ পাঠক তাকে বাল্যলীলা বলে বিদ্রুপ করত । বীরচন্দ্র তা জানতেন এবং তাতে তিনি দুঃখবোধ করেছিলেন । সেজন্য তাঁর একটা প্রস্তাব ছিল লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার অলংকৃত কবিতা সংস্করণ ছাপানো হবে । তিনি তখন ছিলেন কার্শিয়াং পাহাড়ে বায়ু পরিবর্তনের জন্য । কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তার মৃত্যু হয় ।'

'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কোভিদ সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা হলেও তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর 'রাজর্ষি' উপন্যাসের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের তাগিদে প্রেরিত এক চিঠির মাধ্যমে । একটি 'স্বপ্নলব্ধ' গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান চেয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রথম 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় রাজর্ষি । আষাঢ় থেকে মাঘ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় এর ২৬ টি অধ্যায় । রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন 'এ আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প' । রাজর্ষি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন—

'...  ... দুই এক  সংখ্যা বালক বাহির হইবার পর একবার দু-একদিনের জন্য দেওঘরে রাজনারায়ণ বাবুকে দেখিতে যাই । কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল, ভালো করিয়া ঘুম হইতেছিল না— ঠিক চোখের উপরে আলো জ্বলিতেছিল । মনে করিলাম, ঘুম ঘুম যখন হইবেই না তখন এই সুযোগে বালকের জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি । গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না, ঘুম আসিয়া পড়িল । স্বপ্ন দেখিলাম, কোন্ এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, 'বাবা, একি ! এ যে রক্ত ! বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোন মতে তাহার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে—জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প । এমন স্বপ্নে পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার কাছে আরও আছে । এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মানিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে 'বালকে' বাহির করিতে লাগিলাম ।'

এই গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের কাছে গোবিন্দ মানিক্যের রাজত্বকালীন ইতিহাস, উদয়পুরের ফটোগ্রাফ ইত্যাদি চেয়েছিলেন । রাজর্ষির আগে ত্রিপুরার ইতিহাসনির্ভর গল্প 'মুকুট' লিখেছিলেন তিনি । মুকুটে রয়েছে রাজা অমর মালিকের রাজত্বকাল, তার পুত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ, আরাকানরাজের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদির কথা । তাতে ধারণা করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে থেকেই ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিপুরার বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করতেন ।

মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলেই কলকাতায় যুবরাজ রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল । তবে সে সময়ে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । সিংহাসনে আরোহণের ( ১৯০০ খ্রি. )পর প্রথমদিকে তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন । তার মধ্যেও  রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । রাধাকিশোর মাত্র বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন । এই সময়ের মধ্যেই কবির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে । কবি ও রাজাকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন । 

রাধা কিশোর মানিকের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সেদিনের তারিখ ছিল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের বসন্ত শ্রীপঞ্চমীর দিন । সেবার তিনি রাজঅতিথি হিসেবে কর্নেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করেন যেহেতু তখনো রাজপ্রাসাদ সম্পূর্ণ নির্মিত হয়নি । কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকন্ঠে  কুঞ্জবনের শৈলশিখরে  কবির সম্মানে বসন্তোৎসবের ও মণিপুরী রাসনৃত‍্যের আয়োজন করা হয় ।

১৩০৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন ।এসময় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ‍্যালয় স্থাপনের ব‍্যাপারে মহারাজের সঙ্গে আলোচনা হয় । এই বিদ‍্যালয়ের জন‍্য মহারাজ বাৎসরিক একহাজার টাকা মঞ্জুর করেন । এছাড়া মহারাজ ত্রিপুরার অনেক ছাত্রকে ছাত্রবৃত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের জন‍্য । বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারেও কবি মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করেন । মহারাজ জগদীশচন্দ্রের জন‍্য দশ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন এবং কিছুদিন পরে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন । সেবার তিনি জুরি বৈঠকখানায় বসবাস করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ সংলগ্ন পাশাপাশি দুটো 'কাঁচা বাংলো' নির্মিত হয়েছিল । বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরের প্রায় ৩০০ ফুট উত্তরে এ জোড়াবাংলো অবস্থিত ছিল সেদিন ।

১৩১২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বার আগরতলায় আসেন । সেবারও জোড়াবাংলোয় অবস্থান করেছিলেন । সেটা ছিল আষাঢ় মাস । ১৭ আষাঢ় স্থানীয় উমাকান্ত একাডেমি হলে মহারাজ রাধাকিশোরের উপস্থিতিতে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতি হিসেবে সুচিন্তিত ও সারগর্ভ 'দেশীয় রাজ্য' প্রবন্ধটি পাঠ করেন কবি ।

১৩১২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি পুনরায় আগরতলায় আসেন । এবার তিনি ত্রিপুরার নবনিযুক্ত রাজমন্ত্রী রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কর্মভার গ্রহণ উপলক্ষে জগদীন্দ্রনাথ প্রভৃতি সহ চতুর্থবারের মতো এলেন এখানে । 

১৩১২ বঙ্গাব্দেই চৈত্র মাসে পঞ্চমবার পুনরায় রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় আসেন । এবারের আসার কারণ হিসেবে জানা যায় চৈত্র মাসে ইস্টার অবকাশের সময় বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের ( যা এরপর পুলিশি জুলুমে  দক্ষযজ্ঞে পর্যবসিত হয় ) অন্তর্ভুক্ত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবার জন্য । 

১৯১৯ খ্রি. অর্থাৎ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরদরবারের আমন্ত্রণে কার্তিক মাসে ত্রিপুরার পরম সুহৃদ ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে কোলকাতা যাবার পথে ষষ্ঠ বারের মতো ত্রিপুরায় আগমন করেন । কবির মনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর থাকার জন্য এই কুঞ্জবনের এক প্রান্তে  নয়াভিরাম ঘন সবুজ বনানীর কোলে চারিদিকে অজস্র ফুলের মাঝখানে একটি কাঠের ছোট্ট বাংলো তৈরি করা হয় । প্রত্যহ নিত্য নতুন বিহঙ্গের কলকাকলি মুখরিত এই স্থান কবির বড়ই প্রিয় ছিল । এই বাংলোর নাম শিল্পী মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর নামকরণ করেন 'মালঞ্চাবাস' । আবাসটি ছিল মোটা উলুছনের ছাউনিযুক্ত চৌচালা ঘর । বাঁশ বেতের অপূর্ব কারু শিল্পের নকশার কাজ করা বেড়া দেওয়া । মেঝেতে কাঠের পাটাতনের উপর সুদৃশ্য কাশ্মীরি কার্পেট বিছানো । রাতে জ্বলত চিনা ঝাড়লন্ঠন । দুদিকে গোলাপ ও কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় । কত দূর থেকে ভেসে আসা আদিবাসীদের সুরেলা জাদু কলিজার গানের সুরের সঙ্গে বাজত বাঁশির সুমিষ্ট আওয়াজ যা কবিকে করে রাখত আপ্লুত । কবির মনোরঞ্জনার্থে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ, নবকুমার সিংহ ও জিতেন্দ্র সিংহ প্রমুখদের তত্ত্বাবধানে মেয়েরা (লাইছাবি ) তাদের চিরাচরিত গোপরাস, বসন্তরাস, লাইহারাওবা নৃত্য পরিবেশন করেন । এদের সুললিত ব্রজবুলি ছন্দে গীতগোবিন্দের সুরে নৃত্যগীত কবিকে করে রেখেছিল আবিষ্ট । পুরুষ কীর্তনিয়া নর্তক দল পুংচলম,( শ্রীখোল ) ও করতাল চলন ( মন্দিরা ) নৃত্য প্রদর্শন করেন । এই অনুষ্ঠানের মূলভাব, রস ও পদলালিত্যের  ধ্বনিমাধুর্য কবিকে এত মুগ্ধ করেছিল যে উনি মহারাজকে অনুরোধ করেন এই মনিপুরী নর্তক দলের বুদ্ধিমন্ত সিংহ কে শান্তিনিকেতনে প্রেরণ করতে এবং ওখানে কলাভবনের পঠন পাঠন সূচিতে মনিপুরী নৃত্যকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দিতে । মহারাজ সানন্দে এই প্রথা গ্রহণ করে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত ও পরবর্তী সময়ে নবকুমার সিংহ, নীলেশ্বর মুখার্জী এবং বসন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনের প্রেরণ করেন । এই নৃত্যগুরুদের অসাধারণ অবদানেই রবীন্দ্রনৃত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল । এমনকি চিত্রাঙ্গদাসহ বেশ কয়েকটি নৃত্যনাট্য ও জনপ্রিয় হয়েছিল ত্রিপুরা থেকে যাওয়া নৃত্যগুরুদের কর্মকুশলতা নান্দনিক নৃত্যশৈলীতে ।

১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ই ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মার আমন্ত্রণে কবি সপ্তম ও শেষবার আগরতলায় আসেন । অল্পবয়স্ক মহারাজ বীরবিক্রম মানিক‍্যের সঙ্গে মহারাজকুমার বীরেন্দ্রকিশোরের এই আমন্ত্রণ তৎকালীন আগরতলার সাংস্কৃতিক জগতের সুধীমন্ডলীর পরম শ্লাঘার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেবার তিনি কুঞ্জবনপ্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন । এই সম্বন্ধে তিনি পরবর্তী সময়ে মন্তব্য করেছিলেন— .......''পৃথিবীতে প্রকৃতির লীলা ক্ষাত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈল শ্বেত ভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না ।'এইসময় প্রতিদিন মণিপুরী নৃত‍্য প্রদর্শিত হত । তাছাড়া মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বসতবাটিতে এক অনুষ্ঠানে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজ অন্তঃপুরের কুমারীগণ মণিপুরী নৃত‍্য, বসন্ত উৎসব ও রাসনৃত‍্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায় । স্থানীয় কিশোর সাহিত্য সমাজ তাঁকে ১২ ফাল্গুন তারিখে উমাকান্ত একাডেমী হলে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে ।

Friday, March 3, 2023

ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার উদ্ভবকাল, রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও ধারাবাহিকতা



ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার উদ্ভবকাল, রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও ধারাবাহিকতা


 ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার উদ্ভব :

পূর্বেই বলা হয়েছে ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় সংগীত এবং নৃত্যচর্চা ইত্যাদি সবই ত্রিপুরার রাজপুরুষদের হাতে বিকশিত হয়েছে । শুধু শাস্ত্রীয় বা উপশাস্ত্রীয় নয়, এমনকি লোকগান, বাদ্যযন্ত্র, সংগীত শাস্ত্রের চর্চা ত্রিপুরায় এই রাজপুরুষদের কল্যাণেই হয়েছিল ।

ত্রিপুরার সুশীলসমাজের সংস্কৃতি চর্চা তথা নৃত্যগীত, নাটক, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদির যে স্বরূপ আজ আমরা দেখি তার সুতিকাগৃহ ছিল ত্রিপুরার রাজবাড়ি । ত্রিপুরার উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চাই হোক,  বাউল-ভাটিয়ালি হোক রাজ পরিবারের হাত ধরেই তা জনসমক্ষে আসে । নৃত্য, বাদ্য, নাটক সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি এমন কিছু বাকি নেই যা রাজ পরিবারে চর্চিত হয়নি । নৃত্যের ক্ষেত্রে যদিও মনিপুরী নাচের প্রভাবেই ছিল সম্পূর্ণরূপে । এর কারণ আগে আলোচনাও করা হয়েছে । তবু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা কারণে অকারণেও রাজবাড়িতে বাইরে থেকে শিল্পীরা আসতেন । রাজ আতিথ্যে সেখানে থাকতেন । নৃত্যগীতের আসর বসত প্রায়শই । বিখ্যাত কত্থক শিল্পী কুলন্দর বক্স, অলকানন্দা, কনিজ, চাঁদাবাইজি, ইমামি বাইজি, গহরজান, মালেকজান, প্রমুখ সেই আসরের অংশ গ্রহণ করেছিলেন । বড় বড় ধ্রুপদিয়া, সরোদিয়া, সেতারশিল্পীদের এখানে নিত্য আনাগোনা ছিল । সবচেয়ে বড় কথা মহারাজারা নিজেরাও এসব কিছুতে বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন । ফলেই এগুলির প্রচার ও প্রসারে তাঁদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে । তাঁরা শুরু করে গিয়েছিলেন বলেই আজ আগরতলাকে ত্রিপুরাবাসী 'সংস্কৃতির শহর' বলতে গর্ব অনুভব করেন । এ ব্যাপারে রাজপুরুষদের দান অনস্বীকার্য । ছোট্ট একটি পার্বত্য রাজ্য অথচ এর আকাশ বাতাস চিরকাল সুরে ছন্দে বর্ণে গানে তালে লয়ে মুখরিত । এখানকার সুউচ্চ শিল্প বোধ সম্পন্ন রাজারা ছিলেন গভীর সংস্কৃতি অনুরাগী । যতটুকু জানা যায়, ত্রিপুরা রাজন্যাকূলে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা ও প্রসারের জন্য ও প্রজাদের নৃত্য ও সংগীত শিক্ষার জন্য প্রথম উদ‍্যোগ নেন মহারাজ ধন্য মানিক্য ( ১৪৯০–১৫২৯ ) । তিনি সংগীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য 'ত্রিহুত দেশ' (মিথিলা ) ও বঙ্গদেশ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে এনে তৎকালীন রাজপ্রাসাদ সংগীতমুখর করে তুলেছিলেন এবং তাঁদের স্থায়ীভাবে ত্রিপুরায় বসবাসেরও ব্যবস্থা করেছিলেন । ত্রিপুরার প্রাচীন রাজমালায় এর প্রামাণ্য তথ্য থেকে জ্ঞাত হওয়া যায়–
    
    ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্যগীত আনি ।
    রাজাতে শেখায় গীত নৃত্য নৃপমণি ।।
    ত্রিপুর সকলে ক্রমে সেই গীত গায় ।
    ছাগ অন্তে তারযন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।

রাজমালার এই তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় নৃত্যের ও প্রচলন হয়েছিল এই ত্রিপুরায় । পরবর্তী মানিক‍্য রাজাদের অনেকেই বহির্রাজ্যের নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পীদের তাদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করে এনেছেন তা আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি ।

  পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মনিপুরী সংগীত-নৃত্যের ধারা ত্রিপুরায় অনুপ্রবেশ ঘটে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে । এরপর ত্রিপুরার তৎকালীন রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই সমস্ত সংগীতের ভাব, রসধারা, সুরধ্বনি ত্রিপুরার মহারাজদের চর্চিত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে মিলেমিশে অন্য এক ঘরানার রূপ নেয় । এই অনুকরণ ঘটে মূলত মহারাজ বীরচন্দ্র দ্বারা বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ছন্দে রচিত গীতগুলিতে । তাঁর শ্রেষ্ঠ গীতগুলি হোরি বা হোলি গানের উপরে শুধু সীমাবদ্ধ ছিল না । বিভিন্ন কীর্তন ভজন নটসঙ্গীতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল ।

ত্রিপুরার মহারাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃজনী সংগীত রচয়িতা ও সুরকার অনিলকৃষ্ণ দেববর্মা ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা ও গুণী । তাঁর 'নাদলিপি' নামে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয়সংগীতের বিভিন্ন রাগ রাগিনীর উপর রচিত ( ১১শ খন্ড )–

  হেরিয়া বিলাস রসে খেলত কানাইয়া,
ঝোড়ত আবির কুমকুম রাইমুখ হেরিয়া ।    
                                                                                         

ত্রিপুরার সঙ্গীত ও নৃত্যচর্চায় বীরচন্দ্র মানিক্য ও তাঁর উত্তরসূরীদের  পৃষ্ঠপোষকতা । 


রাজা সকল দেশেই শিল্পসাহিত সংস্কৃতি চর্চার কিছু না কিছু পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন । কিন্তু শিল্পের অন্বিষ্ট সাধনায় সমর্পিত প্রাণ একের পর এক রাজ পুরুষের শান্ত, স্নিগ্ধ মুখমন্ডল এই ত্রিপুরাকে গৌরবান্বিত করেছে বারবার । সৃষ্টি ও পরিচর্যার অনুপম তাগিদে । এ রাজ্যের রাজপুরুষেরা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন নিভৃত শিল্পচর্চার অতুলনীয় সাধনায় । তারা কাব্য লিখেছেন, গান গেয়েছেন, ছবি এঁকেছেন, নাটক লিখেছেন, আবহসংগীত রচনা করেছেন, নৃত্যশিল্পের প্রসারে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছেন ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন অবিস্মরণীয় পালঙ্গমতায় । সৃষ্টিসুখের এই ফল্গুধারা সেদিন গোটা রাজঅন্তঃপুর থেকে সাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল । আজও ত্রিপুরার পাহাড় কন্দর থেকে রাজধানী আগরতলা পর্যন্ত এমন কোন আদিবাসী পরিবার পাওয়া যাবে না যেখানে বংশ-পরম্পরায় কোন না কোন শিল্পের চলমান ধারা অনুপস্থিত ।

ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদে চর্চিত ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীত বিভিন্ন সময়ে রাজপ্রাসাদ থেকে সাধারণের মধ্যে কিভাবে পৌঁছাত ও তার সঠিক মূল্যায়নে কিভাবে রাজানুকুলের পৃষ্ঠপোষকতা পেত  এ সম্বন্ধে কিছু প্রামাণিক তথ্যের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে । রাজন্যশাসিত ত্রিপুরায় বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তার কারণে রাজধানী রাঙ্গামাটি ( উদয়পুর ), অমরপুর, কৈলাগড়,( কসবা ), পুরাতন আগরতলা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করেছিলেন ত্রিপুরার রাজন্যবর্গ । এ সময়ে দিল্লি-ই সুবাণী মুঘলদের রাজত্ব । এদের রাজদরবারে তৎকালীন যুগে ভারতবিখ্যাত হিন্দু অথবা মুসলমান শাস্ত্রীয়সংগীতের ওস্তাদের সঙ্গে ত্রিপুরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল । সেই সূত্রে ত্রিপুরার রাজদরবার এদের পাদস্পর্শে ধন্য হয়ে যেত ।

উদয়পুর থেকে মহারাজ কৃষ্ণমানিক্য ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যপাট পুরাতন আগরতলায় স্থানান্তরিত করে নিয়ে আসেন । ১৮৩০ থেকে ১৮৪৯ সালে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মানিক‍্যের শাসনকালে নতুন রাজধানী পত্তন হয় আগরতলায় । কৃষ্ণকিশোর  ত্রিপুরার ইতিহাসে আধুনিক যুগের প্রবর্তক বলে পরিচিত । তিনি মহারাজ বীরচন্দ্র মানিকের পিতা । নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ পর্ব শেষ হবার পর এই দরবার কক্ষে নিয়মিত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর বসত । ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ঈশানচন্দ্র মানিক্য পুরাতন আগরতলা রাজধানীতে রাজ সিংহাসনে সমাসীন । রাজ্যের ঠুংরী গায়কেরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন । সেই সময়কার বিখ্যাত চিত্রকর 'আলম কারিগরে'র আঁকা একটি দুর্লভ চিত্র একদা উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের শোভা বর্ধন করত । এই চিত্রে দেখা যায় পুরাতন রাজপ্রাসাদের নাচ দরবারে মহারাজ ঈশানচন্দ্র তার সভাসদ নিয়ে বসে আছেন ও জনৈক্য নর্তকী নৃত্য করছেন । চিত্রটি খুবই সজীব ও এর ঐতিহাসিক মূল্য ছিল অপরিসীম । ত্রিপুরা রাজন‍্যবর্গ ও এদের পরিবার-পরিজনবর্গ প্রত্যেকেই ছিলেন সুদক্ষ সংগীত,নৃত‍্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক । ত্রিপুরার পার্শ্ববর্তী রাজ্য ছিল মনিপুর তথা মেখলি রাজ্য । সেখানে 'মৈতেই' ভাষায় শাস্ত্রীয় সংগীতের ও নৃত্যের চর্চা হত । ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ পাম হৈবার পুত্র চিং-থুম-খম্বা তথা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ কন্যা হরিশ্বরীর সঙ্গে তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিকের বিবাহের মধ্য দিয়ে পুরাতন রাজধানী আগরতলায় মনিপুরী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে শুরু করে । মনিপুরী সংগীতে বেশিরভাগ বৈষ্ণবীয়  ব্রজবুলি ছন্দে রচিত সংগীত যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রসধারায় সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ । পাশাপাশি এই সময়ে মনিপুরী নৃত্যের ধারাটিও ত্রিপুরার রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করে । আমরা  সকলে জানি, ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য ধারার অন্যতম হিসেবে মনিপুরী নৃত্য আজ সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু মনিপুরী নৃত্যশিল্পের এই বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির পেছনে এই ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যের বিশেষ অবদান রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানিনা । ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ষষ্ঠবারের জন্য ত্রিপুরায় আসেন তখন মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরীর বাড়িতে ওঠেন । কবির সম্মানে মনিপুরী রাস নৃত্যের আয়োজন করা হয় । রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী নৃত্যের বিশেষ লাবণ্যময়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান ও শান্তিনিকেতনে মনিপুরী চর্চার উদ্যোগ নেন । এই বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে ।

আজ থেকে দেড়শ বছরের বেশি সময়ে তথা ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) খ্রিস্টাব্দ মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য ছিলেন অসাধারণ সঙ্গীত জ্ঞানী । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ছিল তার অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি । বস্তুত বীরচন্দ্রের সময়ে রাজনীতি সমাজনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির চর্চা ও অনুশীলনে ভারতীয় চিন্তা চেতনার সঙ্গে পশ্চিমী প্রশাসনিক আইন-কানুন পুরনো রীতিনীতির সংস্কার ইত্যাদির কাজ শুরু হয় । পশ্চিমী ধ্যান ধারণায় দেশীয় সম্পদ যাতে অবহেলিত ও বিলুপ্ত না হয় সেদিকেও গভীর নজর ছিল মহারাজ বীরচন্দ্রের ।  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ছিল তাঁর অদ্ভুত দক্ষতা । এঁর সাহচর্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছেন কয়েকবার । বীরচন্দ্রের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ দুবার তাঁর সঙ্গে কার্শিয়াং ভ্রমনের সঙ্গী হয়েছিলেন । সঙ্গে ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন । প্রথমবার ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে । ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব এক গভীর দ্যোতনার সূচক । মহারাজ বীরচন্দ্রের দূরদৃষ্টি প্রতিভা সংস্কৃতি শিল্প ও সাহিত্যের যে বীজ একদা প্রোথিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্যতা ও তার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে। এই বীজ বিরাট মহীরুহতে পরিণত হয়ে ত্রিপুরায় সুসংস্কৃতির বাতাবরণ বইতে সাহায্য করেছিল । পরবর্তীকালে রবীন্দ্র প্রভাব যতটা বিস্তার লাভ করেছিল এখানে, তার তোরণ উন্মুক্ত করেছিলেন মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য । কুড়ি একুশ বছরের অখ্যাত এক তরুণ কবি তখন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর ভাবি কালের সৃষ্টি প্রতিভার সন্ধান দেশবাসী তখনও পায়নি । সেই সময় রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে বিমুগ্ধ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে তার দূত হিসাবে পাঠালেন সে সময়ের প্রখ্যাত দার্শনিক রাধারমন ঘোষকে । জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে কবিকে অভিনন্দন জানান তিনি । বৈষ্ণব দার্শনিক রাধারমন ঘোষ যার শাস্ত্রজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে কর্নেল মহিম ঠাকুর তার এক রচনায় উল্লেখ করেছেন । কবি ও গীতিকার মদন মিত্র এরা ছিলেন বীরচন্দ্রের নিত্যসঙ্গী ।
বীরচন্দ্রের আমলে ত্রিপুরায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম নাম করতে হয় যদুনাথ ভট্টাচার্যের, যিনি 'যদুভট্ট' নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন । বর্ধমানের বনবিষ্ণুপুরে ছিল তার বাড়ি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় যদুভট্টের নিকট সংগীতশিক্ষা করতেন । মহারাজ বীরচন্দ্রের সংস্রবে এসেই যদুভট্টের প্রতিভা বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায়। যার ফলে পরবর্তীকালে তিনি প্রসিদ্ধ গায়ক, সংগীত রচয়িতা ও বাদক হিসেবে খ্যাতির উচ্চশিখরে  আরোহন করতে পেরেছিলেন । যদুভট্টের গানে মুগ্ধ হয়ে মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য তাঁকে 'তানরাজ' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ।
 সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা রুদ্রবীণার উল্লেখ দেখি । কাবুল দেশের ভাষায় রুদ্রবীণাই 'রবাব' । তানসেনের বংশধর কাশেম আলী ছিলেন সেসময়ের ভারতের শ্রেষ্ঠ রবাব বাদক । প্রথম জীবনে কাশেম আলী রামপুরের রাজার ও নেপালের রাজার দরবারে ছিলেন । পরে বীরচন্দ্র মানিক্যের সময় ত্রিপুরার দরবারে আসেন । তিনি ভালো সুরধান ও সুরশৃঙ্গার বাজাতে পারতেন । পাখোয়াজ ও তবলাবাদক পঞ্চানন মিত্র ছিলেন মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারি । সঙ্গীতশাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কথা জেনে বীরচন্দ্র কেশব মিত্রকে আগরতলায় নিয়ে আসেন । তিনি পরবর্তীকালে বীরচন্দ্রের জটিল রাজকার্যের সহায়কও হয়েছিলেন । রাজকুমারদের শিক্ষক হিসেবে আগরতলা এসেছিলেন ক্ষেত্রমোহন বসু । সুগায়ক ক্ষেত্র মোহন বসু ভালো ধ্রুপদী সংগীত গাইতে পারতেন । কাশ্মীরবাসী  কুলন্দর বক্স ভালো নৃত্য জানতেন । তাঁর নৃত্যের বিশেষত্ব হলো যেকোনো সংগীতকে নৃত্যের মাধ্যমে ভাবের দ্বারা প্রকাশ করতে পারতেন । মহারাজ বীরচন্দ্র তাকে 'কত্থক' উপাধি দেন । এ সময় বীরচন্দ্রের সভায় একে একে স্থান পেয়েছিলেন গোয়ালিয়র রাজ্যের সুরশৃঙ্গার ও এসরাজ বাদক হায়দার খাঁ, মনোহর শাহী সংগীতজ্ঞ প্রতাপচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ঢাকার পাখোয়াজ বিশারদ রামকুমার বসাক, বর্ধমানের বেহালা ওস্তাদ হরিশচন্দ্র পাগলা, সেতার ও সুরধান বিশারদ নিশার হোসেন ও নবীন গোস্বামী গায়ক, ভোলানাথ চক্রবর্তী । সাধু তবলচি তবলা বাজাতেন বীরচন্দ্রের সভায় । ইমামি বাইজি ও চাঁদাবাইজি দীর্ঘকাল বীরচন্দ্রের রাজসভায় সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন । ইমামি বাইজি লখনৌ শহর থেকে এসেছিলেন আর বেনারস থেকে এসেছিলেন চাঁদা বাইজি । এছাড়াও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ মদনমোহন মিত্র, সুপ্রসিদ্ধ বীণাবাদক নবীনচাঁদ গোস্বামী,বেহালাবাদক হরিদাস প্রমুখ দিকপালগণ । বৈষ্ণব সাহিত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর বৈদগ্ধ যেমন  ছিল তেমনি অন্যদিকে ক্যামেরায় ও ক্যানভাসেও তিনি ছিলেন অতুলনীয় শিল্পী । তাঁর অপূর্ব সৃষ্টির খ্যাতি তখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল । সুদূর ফরাসি ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় তার শিল্পকৃতি সুউচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল । তাঁর বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হয়ে দেশ-বিদেশের গুণী শিল্পীরা ত্রিপুরার রাজসভায় স্বেচ্ছায় সভাসদ এর আসন গ্রহণ করেছিলেন । এমনকি সুদূর ফরাসি দেশ থেকে  Apollonius  নামে এক আলোকচিত্র শিল্পী বীরচন্দ্রের রাজ দরবারে সভাসদের পদ গ্রহণ করেছিলেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই কেননা তার দৃষ্টি ছিল সুদূরগামী । সেকালের এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র বর্ণময় এক রাজ্যের রাজসভা বিভিন্ন মেধাবী ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কি সম্পদ দিয়ে আকর্ষণ করেছিল সেটা আজও বিস্ময়ের বিষয় । ত্রিপুরার সংস্কৃতি ইতিহাস এইসব গুণীজনের অবদানে আলোক উজ্জ্বল হয়ে আছে ।

ত্রিপুরার সঙ্গে মনিপুরী রাজ পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়ার ফলে মনিপুরী সংস্কৃতি ও বৈষ্ণবধর্মের বিকাশ রাজ অন্তঃপুরেও ঘটেছিল । বীরচন্দ্রের মরমী কাব্যগ্রন্থ 'ঝুলন' ও 'হোরি' ইত্যাদিতেও তার ছাপ ধরা পড়েছে । তাছাড়া তাঁর অজস্র পদাবলীসংগীতেও বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব রয়েছে । বীরচন্দ্রমানিক্য তাঁর রচিত খেয়াল ও কীর্তনাঙ্গের গানগুলির সঙ্গে অন্তঃপুরের মহিলাদের নিয়ে নৃত্যের তালিম দিতেন । যেহেতু মহিলাদের অনেকেই ছিলেন বিবাহসূত্রে মণিপুর থেকে আগত । ফলে তাদের নৃত্যে মনিপুরী নৃত্য প্রাধান্য পেত  ।

 বীরচন্দ্রের পরবর্তীকালের তিন রাজা রাধাকিশোর, বীরেন্দ্রকিশোর ও বীরবিক্রমের আমলেও এই সুললিত সংস্কৃতির ধারা বয়ে চলেছিলেন ত্রিপুরার রাজারা । স্বয়ং বিশ্ববিশ্রুত শিল্পী বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষান্ত হননি । নিজেদের জীবনকেও উৎসর্গ করেছেন শিল্পচর্চার সুউচ্চ সাধনায় । 

বীরচন্দ্রের পুত্র মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য সঙ্গীত ও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন । ১৮৭৬ সালে যুবরাজ থাকাকালীন সময়ে 'বার্ষিকী' নামে এক সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন সেখানে তাঁর বাংলাভাষায় সমৃদ্ধ রচনার পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর নির্দেশনাতেই 'শিলালিপি সংগ্রহ' ও 'বৃহন্নারদীয় পুরাণে'র বঙ্গানুবাদ করা হয় । মহারাজ রাধাকিশোর মানিক্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সখ্যতা ছিল তা সর্বজনবিদিত । রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সেদিনের তারিখ ছিল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী দিন । সেবার তিনি রাজঅতিথি হিসেবে কর্ণেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করেন । যেহেতু রাজপ্রাসাদ তখনো সম্পূর্ণ নির্মিত হয়নি । কবিই সেই সময়কার স্বনামখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রাধাকিশোরের পরিচয় করিয়ে দেন । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার আশুতোষ চৌধুরী, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, মহারাজা যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্র নারায়ণ, স্যার সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিংহ, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, স্যার টি এন পালিত, রাসবিহারী ঘোষ, দ্বারকানাথ চক্রবর্তী । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নিজস্ব বিজ্ঞান ভবন স্থাপনকালে রাধাকিশোর যে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া রাজর্ষির মৃত্যুর আগে কেউ তা জানতে পারেনি ।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি পাঠে জানা যায়– ত্রিপুরার স্বর্গীয় নৃপতি রাধাকিশোর মানিক্য  বাহাদুর জ্যোতিবাবুকে সংগীত বিষয়ক এখানে মাসিক পত্র সম্পাদন করতে অনুরোধ করেছিলেন ।

মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর তৈল মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিল্প রীতিতে আঁকা একাধিক শিল্পরীতি রেখে গেছেন । সংগীত ও যন্ত্রশাস্ত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ ব্যুৎপত্তি । মনিপুরী খোল বাজনায় সে যুগে তার জুড়ি পাওয়া ভার । সেতারও এস্রাজ বাজানোয় তিনি ছিলেন দক্ষ ।

উত্তরাধিকার সূত্রে মহারাজ বীরবিক্রমও অশেষ গুণসম্পন্ন সংগীতানুরাগী ও স্বয়ং 
স্রষ্টা । তিনি একাধিক নাটক রচনা করেন ও নিজের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করেন । ১৯৩৪ সালে কলকাতার ত্রিপুরা হাউসে তার রচিত নাটক 'রাধাকৃষ্ণের লীলা বিলাস' সাড়ম্বরে অভিনীত হয় ও গুণীজনের প্রশংসা লাভ করে । হিন্দু মার্গ সংগীতে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর আমরা পাই তার রচিত 'হোলি' গ্রন্থে–

            চমকন লাগে তেরি বিন্দিয়া সেঁইয়া, 
            উড়ত অম্বর লালে বাদর,
           বিজুরি চমকে তেরী বিন্দিয়া, সেঁইয়া
           ঘটঘন গজরত দফা ডাম্বর,
          বরখে বারি পিচকারি রাঙ্গিয়া, সেঁইয়া ।

সেতার ও এস্রাজে পিতা বীরেন্দ্রকিশোরের মতো তাঁরও ছিল অপূর্ব দক্ষতা । গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর বাজনার রেকর্ড করেছিল । কিন্তু শত অনুরোধেও তিনি তা বাজারে বিক্রি করার অনুমতি দেননি ।

মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রযত্নে ধ্রুপদী চেতনার মধ্যে খেয়াল অঙ্গে কাব্যের ভাব ও লালিতে যে কীর্তন চর্চার ধারাবাহিকতা একটা সময় প্রচলিত ছিল তা পরবর্তী সময়ে উপজাতীয় সংগীত সংস্কৃতির উত্তরণেও প্রয়াসী হয় । শ্যামা সংগীত, ভজন ও পল্লীগীতির প্রতি ব্যাপক হারে মনোযোগ লক্ষ্য করা যায় পরবর্তীকালে । পল্লীগীতির  কদর অবশ্য রাজন্য আমলেও ছিল বিশেষত বাংলা ভাটিয়ালি গানের । রাজঅন্তঃপুরে তার প্রবেশ ঘটেছিল মহারাজা বীরবিক্রমের অনুরাগে । তাঁর একটি গান, 'নতুন বন্ধু, পুরান বন্ধুর প্রেম কি তুমি জানো না'— হয়তো আজ আর কারো স্মৃতিতে বেঁচে নেই ।

ত্রিপুরার রাজপুরুষদের এই শিল্পসৌন্দর্যবোধ ও গুনগ্রাহীতার ধারা আমরা  নিরন্তর প্রবহমান দেখি আধুনিক কালেও— মহারাজ বীরচন্দ্র থেকে বীর বিক্রম কিশোর অবধি এরা প্রত্যেকেই যে শুধু শিল্পরসপিপাসু ছিলেন তা নয় নিজেরাও বিভিন্ন অঙ্গনে ছিলেন বিস্ময়কর স্রষ্টা ।

ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা গ্রহণের জন্য পুলিণ দেববর্মা, তারাপদ রায় উত্তরপ্রদেশের লখনৌ ম্যারিস সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে পরবর্তী জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন । এছাড়া মহারাজ কুমারগণ, মহেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা, ব্রজবিহারী দেববর্মা ( লেবুকর্তা ), হেমন্ত কিশোর দেববর্মা, নরেন্দ্র দেববর্মা, প্রমুখরা নিজ নিজ সঙ্গীত জগতে যথেষ্ট বুৎপত্তি সম্পন্ন মননশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন । রাজন্যবর্গের যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারে ত্রিপুরার একদা প্রাতস্মরণীয় প্রবীর দেববর্মা, ( কর্তা ), ঠাকুর বংশীয় কৃষ্ণজিৎ দেববর্মা, বারীন্দ্র দেববর্মা, হিরু দেববর্মা, হিরন দেববর্মা, নারায়ন দেববর্মা, শাস্ত্রীয় সংগীতে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন । শ্রদ্ধেয় পন্ডিত রবি নাগ মূলত মহারাজ কুমার মহেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার আলয়ে থেকে ও শচীন দেববর্মার স্নেহ পরশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যথার্থ একজন সার্থক শিল্পী হয়েছিলেন । পরবর্তীসময়ে তিনিও অনেক গুণী শিল্পী তৈরি করেছেন ।

 ত্রিপুরার সংগীত সমাজ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মুখ্য পরিচর্চা ও অনুশীলনকারী । সমগ্র ত্রিপুরায় আজ যে শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের চর্চা চলছে সেটাও একদিন রাজানুকূল্যের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই পল্লবিত হয়ে উঠেছিল । সেই সংগীত-নৃত্যের মহীরুহের মূল কারিগর ছিলেন কিন্তু ত্রিপুরার রাজন্যকুল ।

রাজপ্রাসাদ ও হোলি উৎসব

ত্রিপুরায় হোলিকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টীয় ১৬০০ শতক থেকে মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য থেকে শুরু করে শেষ নৃপতি বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজ অন্তঃপুরের 'হোলি' নৃত্য গীত সহকারে পরিবেশিত হওয়ার যে বাতাবরণ একদা সৃষ্টি হয়েছিল এরই নির্যাস ক্রমে ক্রমে আমজনতার মাঝে প্রসারিত হতে থাকে । পরবর্তী সময়ে এই হোলিতে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে 'হোলি কাব্য গীতি' । মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্যের হোলি বা 'হোরি' কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় উনবিংশ শতাব্দীতে । এই গ্রন্থে চারটি পদ লিপিবদ্ধ আছে । রাসলীলাকে উপলক্ষ করে কবি হোরি খেলার সুন্দর চিত্র এঁকেছেন–

                    রসে ডগমগ ধনী আধ আধ হেরি
                    আঁচল সঁঞে ফাগু লে কুঁয়ারী 
                    হাসি হাসি রসবতী মদন তরঙ্গে 
                    দেয়ল আবির রসময় অঙ্গে
                    সুচতুর নাহ হৃদয়ে ধরু প্যারী 
                    মুচকি মুচকি হাসি হেরত গৌরি

বিংশ শতাব্দীতে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য নিজ ডায়েরিতে বিভিন্ন হোলির গান রচনা করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন । পরবর্তী সময়ে তাঁর এই সুযোগ্য দ্বিতীয় পুত্র মহারাজ কুমার সহদেববিক্রম কিশোর পিতা কর্তৃক একদা রচিত বইটির পুনর্মুদ্রণ করেন । এরই কিছু প্রামানিক তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে–

রাজ অঃন্তপুরে একদা হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে রাগ প্রধান হোলি সংগীত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল । এরই নিদর্শন নিয়ে আগরতলায় রাজ অঃন্তপুরের বাইরে ছোট ছোট হোলির গানের দল গড়ে উঠতে থাকে যেমন–

 ১) মহারাজ বীর বিক্রমের নিজস্ব ফাগুয়া সংঘ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে ।

 ২ ) মহারাজ কুমার নরেন্দ্রকিশোরের হোলির দল ।

৩ ) রাণী উজ্জলা দেবী শুধুমাত্র মহিলাদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি যথার্থ হোলির দল ।  'শ্রীগোপাল' এই নামে একটি নৃত্যনাট্য প্রতিবছর পরিবেশন করতেন ।

 ৪ )রানি সাহেবা হিমানী দেবীর হোলির দল । এর গানগুলি মুখ্য মহারাজকুমারী সুচারু দেবী কর্তৃক রচিত ।

৫ )১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে হরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা তথা হরি কর্তার নেতৃত্বে ত্রিপুরা ফাগুয়া সম্মিলনীতে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের যুবকদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় ।
৬ ) ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ কুমার হেমন্তকিশোর দেববর্মনের 'হেমন্ত ভবন' থেকে 'বসন্ত সমাগম' নামে একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল । এর গানগুলি রচনা করেছিলেন মহারাজকুমারী সুচারু দেবী । সুরারোপ করেছিলেন মহারাজকুমার হেমন্ত কিশোর । তাঁর কন্যা কুমারী ঝর্না দেববর্মা মাত্র এগার বছর বয়সে নিজের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গেয়েছিল । গানটি ছিল এরূপ–

                           রাগ–বাগেশ্রী
              শুনি কার প্রাণের মৃদু বাঁশরী,
               মনোবীণা তার উঠে ঝংকারী 
               সুরহিল্লোলে দুলিয়া দুলিয়া,
               তন্ময় হিয়া যায় উছলিয়া,
               তারি মাঝে ভাসে আশালতিকা 
               জড়ায়ে ফাগুয়া স্মৃতি মল্লিকা । 

এছাড়াও রানী হিমানি দেবী রচিত কিছু কিছু গান মহারাজ কুমার হেমন্তকিশোর সুরারোপিত মিশ্র রামকোষ, বসন্ত বাহার, শিবরঞ্জনী, ত্রিপুরারই সুরে গীত হত ।

 ১৯৪৩ থেকে ৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল মধ্যপাড়ার প্রবীরকর্তার হোলির দল । এরই একটি গানের কলি– ফাগুন খেলত নবনাগর, রসে ধস ধস তনু, আধো আধো হেরি, চুয়া চন্দন দেয় বেড়ি বেড়ি ।

একদা শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে যে সমস্ত গীত মহারাজ বীরচন্দ্রের রচনায় বিশেষ করে হোলিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল, এরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর প্রপৌত্র মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর ও তাঁর অপর প্রপৌত্রী মহারাজকুমারী বিভাষপ্রভা দেবী ( মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর মানিকের কন্যা ও মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্যের ভগিনী ) মনিপুরী নৃত্যকলার মাধ্যমে উক্ত সংগীতসমূহ পরিবেশন করে গেছেন । মহারাজ কুমারী বিভাষপ্রভা দেবীর রচনা 'গোলাপী-গোলাপ' ও 'কনকচাঁপা' নামের শাস্ত্রীয় সংগীত আশ্রিত গীতিনাট্যের পরিচালনায় ছিলেন শ্রীমতি উজ্জ্বলা দেবী ( মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোরের অপর কন্যা ) এবং গীতিনাট্যের সংগীত রচনা ও সুর সংযোজন করেছিলেন মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ বাংলা ১৩৩৭ সালের ১৪ই ফাল্গুন মহারাজ বীর বিক্রমের রচিত রাগ আশ্রয়ী 'কুহেলি' ও 'পাপিয়া' হোলীগীতি মুখ্যত ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল । যেমন–

বাংলায়–

                            আবিরে ডগমগ 
                            ভাগিনা কানাইরে 
                            ছিঃ ছিঃ  লাজে মরি 
                            নন্দ ঘোষ তোর পিতা বটে 
                             অয়ন ঘোষ তোর মামা 'রে 
                             তুমি তো ভাগিনা কানাই 
                             আমি তোর মামিরে

ব্রজবুলি–

                               কানৈয়া মোসে 
                               খেলো হোরি 
                               ভরি ভরি পিচকারি 
                               মোরি আঁচল পর মারি 
                               দেখতো সব লোকে 
                               কানৈয়া মোসে ।

 মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর রচিত হোলি পুস্তকটি ১৩৫১ ত্রিপুরাতে ( ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ তথা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ ) রচিত হয়েছিল ।

মহারাজ কুমার বিপিন ও বঙ্কিম দেববর্মা ভ্রাতৃযুগল তৎকালীন সময়ে মঞ্চস্থ নাটকে শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে সুর সংযোজন করতেন । ত্রিপুরার সঙ্গীত শিল্পীদলের কন্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে একচ্ছত্র আধিপত্য ত্রিপুরার রাজান্যকুলেরই অবদান । মহিলা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী গণের মধ্যে ঝর্না দেববর্মা,  আরতি কর ( চৌধুরী ) পথিকা দেববর্মা, কণিকা দেববর্মা রাজন্যযুগের শেষ শতকের সার্থক শাস্ত্রীয় কন্ঠশিল্পী । শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতে লহরী দেববর্মা, ত্রৈম্বক শর্মা, উৎপল দেববর্মা, অনাথবন্ধু দেববর্মা, কালিকিংকর দেববর্মা, রাজানুকূল্যের উত্তর সাধক ও সার্থক প্রতিনিধি । ত্রিপুরার রাজবংশে যথার্থ রাজ প্রতিনিধি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে শিক্ষা প্রাপ্ত ও বাংলার লোকসংগীত, আধুনিক রাগাশ্রিত,বাংলা, হিন্দি, বিভিন্ন শৈলীর সংগীতের সুরকার ও গায়ক শ্রদ্ধেয় রাজকুমার শচীন দেববর্মন ।


সমসাময়িককালের ত্রিপুরার নৃত্য চর্চা

ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যের সবকটি ধারা না হলেও কিছু কিছু নৃত্য ধারার প্রচলন পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য দেখতে পাওয়া যায় । প্রাচীনকাল থেকে এই ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় এ রাজ্যে সঙ্গীত-নৃত‍্য প্রবাহের ধারা দেখতে পাওয়া যায় । রাজন্য আমলে ত্রিপুরায় যে নৃত্যের একটি প্রবহমান ধারা ছিল তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি ।

বর্তমান পর্বে আমরা স্বাধীনতার ত্রিপুরা অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর ৫ ও ৬ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চার একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াস নেব ।

আমরা লক্ষ্য করেছি যে রাজন্য আমলের সুপ্রাচীন কাল থেকেই ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার একটা প্রবাহ গড়ে উঠেছিল এবং যে ধারাটি স্বাধীনতার কালেও অর্থাৎ পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পরবর্তী সময়ে কমবেশি চর্চার অবকাশ ছিল । সে সময়ে নৃত্যচর্চার প্রধান গুরু ছিলেন কৃষ্ণ জিৎ সিংহ, গুরুচন্দ্রজিৎ সিংহ প্রমুখ । তাঁরা প্রধানত মনিপুরী নৃত্যের বিষয়ে কমবেশি পারঙ্গম ছিলেন । তাঁরা ওই সময়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিয়মিত নৃত্যের তালিম দিয়ে কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে সুযোগ্য করে তুলেছিলেন । যার ফলশ্রুতি হিসেবে পরবর্তীকালে এই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী ও অধ্যবসায়ের গুণে বৃহত্তর ভারতবর্ষের নৃত্য আঙ্গিনায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন এই প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্যরা হলেন প্রতিমা চৌধুরী, হিরা দে, ডঃ পদ্মিনী চক্রবর্তী, রেনুকা সিনহা, শিপ্রা ভট্টাচার্য প্রমুখ । উল্লিখিত নৃত্যশিল্পীদের অনেকেই পরম সম্মান ও সুনামের অধিকারী হয়ে নৃত্যের আঙিনায় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় বিরাজমান আছেন । যেমন নৃত্যশিল্পী প্রতিমা চৌধুরী আগরতলায় তালিম নিয়ে পরবর্তীকালে বোম্বের স্বনামখ্যাত নৃত্যগুরু কল্যাণ সুন্দরমের নিকট উচ্চ পর্যায়ের তালিম গ্রহণ করে ভারতের নৃত্যজগতে প্রচুর সুনামের অধিকারী হয়েছেন । তেমনি ড. পদ্মিনী চক্রবর্তী ও হীরা দে পরবর্তী সময়ে আরো উন্নততর নৃত্যের তালিম গ্রহণ করে ত্রিপুরার নৃত্য চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেন । তাঁরা ত্রিপুরার ধ্রুপদী নৃত্য চর্চার ধারাকে একবিংশ শতাব্দীতেও  দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন ।

এই দশকের অন্যান্য নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে দুজনের নাম সবিশেষ উল্লেখনীয় । এঁরা হচ্ছেন স্বর্গীয় অনন্ত বিজয় দেববর্মা ও শ্রীমতি পূরবী চন্দ । তাঁরা উভয়ই শান্তিনিকেতন থেকে নৃত্য শিক্ষা করে ত্রিপুরায় নৃত্য প্রশিক্ষণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন । 

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ত্রিপুরায় আগমন ঘটেছে গুরু বিহারীরঞ্জন সিংহের । তিনি সুদুর জয়পুর থেকে কত্থক নৃত্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ত্রিপুরায় নৃত্য প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন । তখন থেকেই ত্রিপুরার নৃত্যাঙ্গনের এই বিশেষ দিকটির উন্মোচন ঘটে । পরবর্তীকালেও তাঁরই সুযোগ্য শিক্ষকের দ্বারা আবির্ভাব ঘটে সুদক্ষ কত্থক নৃত্যশিল্পী শীলা সেনগুপ্তা ও শিবানী চক্রবর্তীর । এ দুজন নৃত্যশিল্পী কত্থক নৃত্যে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন । বলা যায়, গুরু বিহারীরঞ্জন সিংহের সুদক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই দুজন খ্যাতনামা শিল্পীর নৃত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরম কৃতিত্ব প্রদর্শনের ফলে ত্রিপুরায় মনিপুরী নৃত্যের পাশাপাশি কত্থক নৃত্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের পরম আগ্রহ সঞ্চারিত হয় । ফলত, আগরতলা সরকারি মিউজিক কলেজে ১৯৬৫ সন থেকে শুরু হয় কত্থক নৃত্যের ক্লাস । এই বিষয়ে প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিখা চক্রবর্তী, নন্দা মুখার্জি, স্বপ্না চৌধুরী প্রমুখরা । তারপর ৭০ এর দশক নাগাদ এলেন উমাশঙ্কর চক্রবর্তী । শিপ্রা সেনগুপ্তা, বন্দনা দাস, জবা ঘোষ, অমিতাভ ভট্টাচার্য, অনিন্দিতা দত্ত, শিখা সাহা, হৈমন্তিকা দেববর্মন, রুপা সেনগুপ্তা প্রমুখ এক ঝাঁক নৃত্য শিক্ষার্থী । সেই সময় থেকে কত্থক নৃত্য সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে । সৃষ্টি হল সর্বোচ্চ নৃত্যের জোয়ার । এই জোয়ারে আবির্ভাব ঘটল সুমনা পাল ( অকাল প্রয়াতা ) নমিতা, নীলাঞ্জনা, ইন্দিরা এবং আরো অনেকের । ওই একই সময়ে  মনিপুর থেকে ত্রিপুরায় এলেন সুদক্ষ নৃত্যশিল্পী অঙ্গনতোম্বি সিং । তিনিও সরকারি মিউজিক কলেজে নৃত্য প্রশিক্ষকের পদে যোগদান করলেন । তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন রুনা পাল, সোমা দত্ত, বঙ্কিম সিংহ, প্রমুখরা । তাছাড়া রমেশ দত্ত ও কৃতিত্বের সঙ্গে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেছেন ।

৭০ দশকের শেষের দিকে ত্রিপুরায় ভরতনাট্যমের প্রথাগত শিক্ষা শুরু হয় সরকারি মিউজিক কলেজে শ্রীমতি পদ্মিনী চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে । এর আগে থেকে শ্রীমতি হীরা দে ভরতনাট্যম শেখাতেন আগরতলা রবীন্দ্র পরিষদে । কিন্তু সেখানে কোন সরকারি ডিগ্রী দেওয়া হতো না । এই সময় থেকেই আগরতলা শহরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ভরতনাট্যম চর্চার আগ্রহ সঞ্চারিত হয় । উল্লিখিত দুজন প্রশিক্ষিকার নিকট তালিম পাওয়া অনেক ছাত্রছাত্রী আজ এই নৃত্যের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন অথবা অনেকেই চলে গেছেন স্মৃতির অন্তরালে নানা কারণে । তাদের কিছু নাম এখানে তুলে ধরছি । যেমন শুক্লা বিশ্বাস, উমা চক্রবর্তী, গোপাল বিশ্বাস, অজন্তা বর্ধন রায়, মৌসুমী চ্যাটার্জী, শাশ্বতী দেব, নিবেদিতা তরফদার, সুহৃতা ঘোষ, এমিলি দেব, অ্যাঞ্জেলিনা, একতা, দীপশিখা, দেবলীনা, বিন্দিয়া, ঋতুপর্ণা, সায়নী, ছন্দশ্রী, পায়েল, ডিনা ঘোষ, পামেলা, অম্বালিকা, শর্মিষ্ঠা, জয়িতা সেনগুপ্ত ইত্যাদি । এরা সকলে ভরতনাট্যম অথবা রবীন্দ্র নৃত্য চর্চায় তালিম নিয়েছে ।

এর পাশাপাশি বিহারীবাবুর ছাত্র উমাশঙ্কর চক্রবর্তীর কিছু ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে উদ্যম সহকারে নৃত্য চর্চা করে যাচ্ছে বা একটা সময় নৃত্য চর্চা করেছে । তার মধ্যে পার্বতী ভট্টাচার্য, অম্লান চক্রবর্তী, শ্রী রূপা দাস, সর্বাণী নন্দী, কমলিনি চক্রবর্তী, দেবব্রত দেববর্মা, বিক্রম সিনহা, গৌতম গুপ্ত, রিতা সাহা, শাশ্বতী কর্মকার, চিন্ময় দাস, চন্দ্রতপা সাহা, দেবজ্যোতি লস্কর, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, মৌমিতা ভট্টাচার্য, শীলা সাহা, রেশমি দাস, মণিদীপা চক্রবর্তী, মানসী ঘোষ, সুস্মিতা বণিক, দীপিকা নন্দী, পূজায়িতা দেববর্মা, সুব্রত রায়, সঞ্জীব সিনহা, কুশল দেব প্রমুখ ।

আশির দশক থেকে ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার পরিসর বেড়ে যায় । আগরতলার বাইরেও সে সময়ে মফস্বলের বিভিন্ন শহর যেমন, কৈলাশহর, ধর্মনগর, উদয়পুর, সোনামুড়া, বিলোনিয়া, খোয়াই, সাবরুম বিশালগড় এমনকি প্রত্যন্ত কাঞ্চনপুরে, মোহনপুর, গোমতী জেলার অমরপুরেও নৃত্যশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেছে ।   আগরতলার বাইরে শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার কথা বলতে গেলে প্রথমেই ধর্মনগরের কথা উল্লেখ করতে হয় । সেখানে বেশ কয়েকটি নৃত্যশিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে । তার মধ্যে 'কলামন্ডল' নামটি অবশ্যই আলোচনা করতে হয় । জবা ঘোষ, সজল, চিরশ্রী আরো কয়েকজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী ভরতনাট্যম কথক ও মনিপুরী নৃত্য চর্চা করেছে বেশ সাফল্যের সঙ্গে । এছাড়া, এখানে কিছু মনিপুরী নৃত্যশিল্পী আছেন যাঁরা তাঁদের পরম্পরা ও মনিপুরী নৃত্য চর্চা করে যাচ্ছেন বেশ সাফল্যের সঙ্গে । তার মধ্যে গুরু বিপিন সিংহের সুযোগ্য ছাত্রী লক্ষ্মী সিনহার নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে । বেশ কিছু নামি মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক আছেন । শিল্পীও আছেন শ্রীমতি ঋতুপর্ণা সিংহ, শ্রীমতি আলপনা সিংহ, শ্রীমতি ভারতী সিংহ, শ্রীমতি অনিন্দিতা সিংহ । তাছাড়া কত্থক নৃত্যে অর্পিতা দেব গুপ্তা, অন্যান্য নাচে বাবুল সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে নৃত্য চর্চা বজায় রেখেছেন । কমলপুরে, ধলাই জেলায় মনিপুরীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভালো নৃত্যশিল্পী আছেন ।খোয়াই মহকুমায় মনিপুরী নৃত্যচর্চা চলে আসছে ।‌পাশাপাশি কত্থক নৃত্য প্রসার ঘটছে । মেলাঘর ও সোনামুড়াতেও আজকাল বেশ নৃত্য চর্চা হচ্ছে । বিশালগড়ে ও মোহনপুর ব্লকের বামুটিয়ায় মনিপুরীরা বাস করে তাই এই অঞ্চলে তাদের প্রথাগত নৃত্যের চর্চা দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে । এই অঞ্চলের ব্রজেন্দ্র সিংহ পুষ্প সিং শিক্ষক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন ।

এ রাজ্যের গোমতী জেলায় উদয়পুর একটি প্রধান নৃত্যচর্চার কেন্দ্র । ত্রিপুরার প্রথম কুচিপুড়ি নৃত্যশিল্পী ববি চক্রবর্তী এই উদয়পুরের সন্তান । তাছাড়া উমাশঙ্কর চক্রবর্তীর অনেক ছাত্র-ছাত্রী উদয়পুর এবং অমরপুরে রয়েছে । তাই এই অঞ্চলে কত্থক নৃত্যের প্রভাব খুব বেশি । উদয়পুরের নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মনিকা নন্দী,   চলেছে এবং তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে ।