খোলা হাওয়ায় বইমেলা, তবুও
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বই সভ্যতার প্রতীক । আর বইমেলা সভ্যতার অগ্রগতির প্রতীক । মেলা বহু প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে । ধর্মকে কেন্দ্র করে কিংবা কোন গোষ্ঠীর উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রাচীন মানুষেরা মেলার আয়োজন করতেন । এতে একটি বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানের দিনে সমস্ত মানুষ এক জায়গায় মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতেন । তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক মিলন ও কুশল বিনিময় । মেলাতে এক জায়গায় মিলিত হওয়ার পাশাপাশি ছিল একে অন্যের মধ্যে উপহার বিনিময় । এই উপহার মূলত ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় উপকরণ । এই উপকরণসমূহ বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের প্রয়োজন মেটানোর দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন । একজনের কাছে যে দ্রব্যটি নেই অন্যজন তা প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতেন । এভাবেই ক্রমে সমাজে চলে আসে বিনিময় প্রথাটি । পরে সমাজব্যবস্থায় অর্থনীতির বিষয় প্রভাব ফেললেই বিক্রয়ের পদ্ধতির প্রচলন ঘটে । মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীন অর্থনীতি ও একসময় চাঙ্গা হয়ে উঠত । সমাজের নানা পেশার মানুষ তাঁদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় পসরা সাজিয়ে বসতেন । গৃহস্থরাও তাঁদের সংবৎসরের প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রী মেলা থেকেই সংগ্রহ করতেন ।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সম্পদের অভাববোধ থেকে যেমন গ্রামীণ মেলার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার অভাববোধ থেকে শুরু হয়েছে বইমেলা । তার মধ্যে যতটা না অর্থনীতি জড়িয়ে থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে জ্ঞানপিপাসা । বইমেলা সেই জ্ঞানপিপাসা মেটানোর একটা মাধ্যম । আদিম সংস্কৃতির উদাহরণ হল গ্রাম্যমেলা । আর নাগরিক সংস্কৃতির উদাহরণ বইমেলা । উভয়ের উদ্দেশ্য একটাই । মিলন । গ্রামজীবনে মিলন ধর্ম ও সামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে । সঙ্গে থাকে গ্রামীন অর্থনীতি । নাগরিক জীবনের মিলন মেধা, মনন ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে । জ্ঞানপিপাসুরা জ্ঞানান্বেষণে এই মেলায় মিলিত হন । মেলার মূল বৈশিষ্ট্য মিলন ব্যাপারটা এখানেও থাকে । পৃথিবীর সমস্ত দেশেই জ্ঞানচর্চা বিকাশের কেন্দ্রে রয়েছে বইমেলা । দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রেরই বড় বড় শহরে হয়ে থাকে বইমেলা । আন্তর্জাতিক মেলাসমূহের বিস্তৃতিও থাকে অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় ।
আগরতলা বইমেলার বয়স বেশিদিনের নয় । গত শতাব্দীর একাশি সাল থেকে রবীন্দ্রভবনের প্রাঙ্গনে শুরু হয় আগরতলা বইমেলা । একসময় স্থান সংকলনের অভাব হওয়াতে পরবর্তী সময়ে তা শিশুদ্যানে সরিয়ে নেওয়া হয় । আজ ছয় বছর হলো এই মেলা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে হাপানিয়া আন্তর্জাতিক মেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে । প্রথম দিনের তুলনায় আজ তার পরিসর অনেক বেড়েছে । অনেক জৌলুস, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে । স্টল সংখ্যা বেড়েছে । মঞ্চ ও পারিপার্শ্বিক অলংকরণে এসেছে আধুনিকতা । প্রযুক্তির ব্যবহার । এখন অনেক খোলামেলাভাবে বইমেলায় ঘোরাঘুরি করা যায় । বই বাছাই করা যায় । এ বছরে লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়ানটাও বেশ বড়ো করা হয়েছে । তবুও আশির দশকের বইমেলার সেই প্রাণ সেই উচ্ছলতা যেন পাইনা এখন । বয়সের জন্য কিনা জানিনা ।
বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য ছনবাসের গোলঘর তৈরি করে দেওয়া হত । প্রথম দিকে তো বইমেলায় প্রকাশক বিক্রেতার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও দশ শতাংশ ভর্তুকির ব্যবস্থা ছিল । কি জমাট আড্ডা বসত সেদিন বইমেলার মাঠে । গান, কবিতাপাঠ, কে কি বই কিনেছে তা নিয়ে আলোচনা । কোন প্রয়োজনীয় বইটা কোথায় পাওয়া যাবে, বড়দের কাছ থেকে তার সুলুক সন্ধান । মাঠের মাঝখানে ঘাসের বিছানায় ডাঁই করা মুড়ি-চানাচুর, বাদামের খোলস ছাড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা বসত । কোথায় হারালো সেসব !
এখন মেলায় বই কিনুন । বাড়ি চলে যান । সেই গোলঘর নেই । আড্ডার ঠেকও নেই । এককালে পাড়ার চায়ের দোকানে যেমন বেঞ্চ পাতা থাকত । আড্ডা দেওয়া যেত সময় না মেপে । শুধুমাত্র এক কাপ চায়ের বিনিময়ে । পরবর্তী সময়ে সেই চায়ের দোকানেও পরিবর্তন এসে গেছে । একটা টেবিলের উপর কেটলিতে চা ফুটছে । কয়েকটা বয়ামে বিস্কুট জাতীয় খাবার আছে । চা নিন । খাবার নিন । চলে যান । বসার ব্যবস্থা নেই । বসার ব্যবস্থা নেই বলেই এখন বইমেলায় জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় সামনের অনুষ্ঠান মঞ্চের দর্শক আসনগুলো । মঞ্চে হয়তো কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা বা কবিতা পাঠ চলছে । হঠাৎ তার মধ্যে বিশ্রমরত একজন কারো উদ্দেশ্যে তারস্বরে চিৎকার করে ওঠেন । মঞ্চের অনুষ্ঠানের ছন্দপতন ঘটে । দর্শকরা সব পিছনের দিকে তাকান । মঞ্চে কি চলছে তার খবর কে রাখে ! এই অবস্থাটার একটু পরিবর্তন আনা দরকার । মেলার্থীদের জন্য একটু বসার ছাউনি দরকার । গাছগাছালিহীন মেলাচত্বরে যা গরম ! মাথার ঠিক থাকার কথাও না ।
বইপত্রে অনেক নতুনত্ব থাকলেও আগের মতো ধ্রুপদী বইগুলো আর আসে না । আর যা দাম ধরলেই যেন ছ্যাঁকা লাগে । সরকার যদি আবার ভর্তুকীর বিষয়টা চালু করেন তাহলে বই পুনরায় মধ্যবিত্তের কিছুটা নাগালের মধ্যে আসবে । অন্যথায় সাধ থাকলেও সবার সাধ্যে কুলবেনা ।
আর একটা কথা বলে শেষ করছি । আগরতলা বইমেলা রাজ্যের বৃহত্তম বইমেলা । রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরের, দেশের বাইরের বহু প্রকাশক এখানে আসেন । রাজ্যের বাইরের নামী প্রকাশকরা এরপর ফিরে যান । মফস্বলের মেলাগুলোতে খুব একটা যান না । ফলে অনেক মূল্যবান বই মফস্বলের পাঠকরা প্রকাশকের কাছ থেকে সরাসরি কিনতে পারেন না । মফস্বলের বইপ্রেমীদের আরো বেশি করে আগরতলা বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে বিনি পয়সায় গাড়ির ব্যবস্থা নয় । আগরতলা থেকে অন্তত রাত আটটার দিকে রাজ্যের উত্তরে ও দক্ষিণে ফেরার জন্যে দুটো বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয় । তাহলে আগরতলা বইমেলার আরো শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে আরো উপচে পড়বে বইপ্রেমী মানুষের ভিড় ।
No comments:
Post a Comment