রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুর রাজপরিবার
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের দীর্ঘকাল ব্যাপী সম্পর্কের ধারাবাহিকতা তৈরি হয় । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যথেকে শুরু করে তার প্রপৌত্র মহারাজা বীরবিক্রম— ত্রিপুরার এই চার রাজার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের এই সম্পর্কের সূত্র ধরে ত্রিপুরার সাহিত্যে আধুনিকীকরণের গতির সৃষ্টি হয় । ত্রিপুরার সাহিত্য সৃষ্টি সেই রাজমালার যুগ থেকে চিহ্নিত করা হয় । পয়ার এবং ত্রিপদী ছন্দের ধরাবাঁধা কাব্যে আটকে ছিল সে সাহিত্য । মহারাজা বীরবিক্রম তাকে অতিক্রম করতে চাইলেন । শুধু নতুন কিছু ছন্দ প্রয়োগে নয় । বিষয়বস্তু নিয়েও এগিয়ে গেলেন । ইতিহাস আর কিংবদন্তি ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন কবিতায় । বীরচন্দ্র রচিত কাব্য 'ঝুলন', 'হোরি', 'অকাল কুসুম', 'উচ্ছ্বাস', 'সোহাগ', 'প্রেম মরীচিকা' ইত্যাদি । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের যখন সূত্রপাত ঘটে তখন মহারাজা বীরচন্দ্র প্রায় প্রৌঢ় বয়স্ক । আর রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনের দিনান্তে অবস্থিত তখন ত্রিপুরা সিংহাসনে ছিলেন যুবক রাজা বীরবিক্রম ।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে বীরচন্দ্রের কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী যে কবিতা রচনা করেন তা ছিল অনেক বেশি আধুনিক । অনঙ্গমোহিনী দেবীর কাব্য 'শোকগাথা', 'প্রীতি', ও 'কণিকা' বিশ শতকের প্রথম দশকে প্রকাশিত হয় । কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ করা গেলেও তাঁর কাব্য বিগত শতকের গোড়ায় আধুনিকতা এনে দিয়েছিল । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন । ত্রিপুরার পটভূমিকায় তিনি লিখেছেন 'রাজর্ষি', 'বিসর্জন' এবং 'মুকুট' ।
তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের কাছ থেকে । 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিকভাবে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৮ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় তা । প্রকাশিত হবার পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৯ বঙ্গাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর জীবনাবসান ঘটে । শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে রাজা তখন বিরহের কবিতা লিখে লিখে শোকভার লাঘব করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক এই সময়েই মহারাজার হাতে আসে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । এই কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে তিনি যেন একটা আশ্রয় পেলেন । তাঁর বিরহী অন্তরে নাড়া দেয় এই কাব্যগ্রন্থ । তিনি গভীর উৎসাহ নিয়ে পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । তিনি মনে মনে ভাবলেন, এ বোধহয় কোন বয়স্ক কবির লেখা । তাঁর পারিষদবর্গ তাঁকে জানালেন যে, রবীন্দ্রনাথ একজন তরুণ কবি এবং আরো বললেন, এই কবির পরিবারের সঙ্গে অর্থাৎ কবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মহারাজার পিতৃদেব কৃষ্ণকিশোর মানিক্যের গভীর সম্পর্ক ছিল একটা মামলা কে কেন্দ্র করে ।
'ভগ্নহৃদয়' পাঠের পর কালবিলম্ব না করে মহারাজ বীরচন্দ্র তাঁর নিজস্ব সচিব শ্রদ্ধেয় রাধারমন ঘোষ মহাশয়কে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠালেন কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার জন্য । তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি 'ভগ্নহৃদয়'-র সুর বীরচন্দ্রের বিরহী প্রাণে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল । মুগ্ধ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত করেন 'কবি' উপাধিতে । রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রথম স্বীকৃতি লাভ । সেই প্রথম কোন খেতাবপ্রাপ্তি । জীবনে প্রথম সম্মান লাভের সঙ্গে সঙ্গে 'ত্রিপুরা' শব্দটি সেদিন থেকে রবীন্দ্রনাথের অন্তরে গেঁথে যায় । তাঁর নোবেল প্রাপ্তির তিন দশক আগেই বিশ্ব যেদিন রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারেনি সেদিন শুধু ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছিলেন । চিনেছিলেন তার কাব্যপ্রতিভাকে । সেই সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় ৬০ বছরের সম্পর্ক ছিল ত্রিপুরার ।
১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১২ ফাল্গুন আগরতলার উমাকান্ত একাডেমির মিলনায়তনে স্থানীয় কিশোর সাহিত্যসমাজ রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল । সেই সংবর্ধনা ভাষণে কবি মহারাজা বীরচন্দ্রের সেই স্বীকৃতির কথা উল্লেখ করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন—
'জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি তিনি তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন তার অভিনন্দনের দ্বারা । তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তার বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনই আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন । যিনি উপরের শিখরে থাকেন, তিনি যেমন সহজে চোখে পড়ে না তাকেও দেখতে পান, বীরচন্দ্র সেদিন আমার মধ্যে অস্পষ্টকে স্পষ্ট দেখেছিলেন ।'
সৃজনশীল জীবনের একেবারে উষালগ্নে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়'কে কেন্দ্র করে তাঁকে যে সম্মান এনে দিয়েছিল তা তিনি জীবনের অন্তিম পর্বেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন । ১৯৪১ সালের ২৫শে বৈশাখ ত্রিপুরার রাজদরবারে সেদিন কবির জন্মদিনের উৎসব পালিত হয়েছিল । এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মহারাজা বীরবিক্রম ঘোষণা দিলেন শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বকবিকে 'ভারত ভাস্কর' সম্মান প্রদান করা হবে । পাঁচ দিন পর ৩০ বৈশাখ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে আয়োজিত হয় সেই বিশেষ অনুষ্ঠান । ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কবিকে জীবনের শেষ সম্মান 'ভারত ভাস্কর' প্রদান করলেন । একটি বিশেষ হুইলচেয়ারে বসিয়ে কবিকে সভাস্থলে আনা হল । ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম সেই অনুষ্ঠানে কবির হাতে তুলে দিলেন ত্রিপুরার মানুষের পক্ষ থেকে সম্মান আর অর্ঘ্য । ত্রিপুরার এই সম্মান গ্রহণ করে কবি সেদিন যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা পাঠ করে শোনান কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই সংবর্ধনা ভাসনে কবি বলেছিলেন—
'ত্রিপুরার রাজবংশ থেকে একদা আমি অপ্রত্যাশিত সম্মান পেয়েছিলাম, তা আজ বিশেষ করে স্মরণ করবার ও স্মরণীয় করবার দিন উপস্থিত হয়েছে । এরকম অপ্রত্যাশিত সম্মান ইতিহাসে দুর্লভ । সেদিন মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য এই কথাটি আমাকে জানাবার জন্য তাঁর দূত আমার কাছে প্রেরণ করেছিলেন যে, তিনি আমার তৎকালীন রচনার মধ্যে একটি বৃহৎ ভবিষ্যতের সূচনা দেখছেন । সেদিন এ কথাটা সম্পূর্ণ আশ্বাসের সহিত গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল । আমার তখন বয়স অল্প, লেখার পরিমাণ কম, এবং দেশের অধিকাংশ পাঠক তাকে বাল্যলীলা বলে বিদ্রুপ করত । বীরচন্দ্র তা জানতেন এবং তাতে তিনি দুঃখবোধ করেছিলেন । সেজন্য তাঁর একটা প্রস্তাব ছিল লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার অলংকৃত কবিতা সংস্করণ ছাপানো হবে । তিনি তখন ছিলেন কার্শিয়াং পাহাড়ে বায়ু পরিবর্তনের জন্য । কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তার মৃত্যু হয় ।'
'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কোভিদ সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা হলেও তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর 'রাজর্ষি' উপন্যাসের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের তাগিদে প্রেরিত এক চিঠির মাধ্যমে । একটি 'স্বপ্নলব্ধ' গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান চেয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রথম 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় রাজর্ষি । আষাঢ় থেকে মাঘ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় এর ২৬ টি অধ্যায় । রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন 'এ আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প' । রাজর্ষি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন—
'... ... দুই এক সংখ্যা বালক বাহির হইবার পর একবার দু-একদিনের জন্য দেওঘরে রাজনারায়ণ বাবুকে দেখিতে যাই । কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল, ভালো করিয়া ঘুম হইতেছিল না— ঠিক চোখের উপরে আলো জ্বলিতেছিল । মনে করিলাম, ঘুম ঘুম যখন হইবেই না তখন এই সুযোগে বালকের জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি । গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না, ঘুম আসিয়া পড়িল । স্বপ্ন দেখিলাম, কোন্ এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, 'বাবা, একি ! এ যে রক্ত ! বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোন মতে তাহার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে—জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প । এমন স্বপ্নে পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার কাছে আরও আছে । এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মানিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে 'বালকে' বাহির করিতে লাগিলাম ।'
এই গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের কাছে গোবিন্দ মানিক্যের রাজত্বকালীন ইতিহাস, উদয়পুরের ফটোগ্রাফ ইত্যাদি চেয়েছিলেন । রাজর্ষির আগে ত্রিপুরার ইতিহাসনির্ভর গল্প 'মুকুট' লিখেছিলেন তিনি । মুকুটে রয়েছে রাজা অমর মালিকের রাজত্বকাল, তার পুত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ, আরাকানরাজের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদির কথা । তাতে ধারণা করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে থেকেই ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিপুরার বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করতেন ।
মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলেই কলকাতায় যুবরাজ রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল । তবে সে সময়ে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । সিংহাসনে আরোহণের ( ১৯০০ খ্রি. )পর প্রথমদিকে তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন । তার মধ্যেও রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । রাধাকিশোর মাত্র বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন । এই সময়ের মধ্যেই কবির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে । কবি ও রাজাকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন ।
রাধা কিশোর মানিকের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সেদিনের তারিখ ছিল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের বসন্ত শ্রীপঞ্চমীর দিন । সেবার তিনি রাজঅতিথি হিসেবে কর্নেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করেন যেহেতু তখনো রাজপ্রাসাদ সম্পূর্ণ নির্মিত হয়নি । কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকন্ঠে কুঞ্জবনের শৈলশিখরে কবির সম্মানে বসন্তোৎসবের ও মণিপুরী রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় ।
১৩০৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন ।এসময় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে মহারাজের সঙ্গে আলোচনা হয় । এই বিদ্যালয়ের জন্য মহারাজ বাৎসরিক একহাজার টাকা মঞ্জুর করেন । এছাড়া মহারাজ ত্রিপুরার অনেক ছাত্রকে ছাত্রবৃত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের জন্য । বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারেও কবি মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করেন । মহারাজ জগদীশচন্দ্রের জন্য দশ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন এবং কিছুদিন পরে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন । সেবার তিনি জুরি বৈঠকখানায় বসবাস করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ সংলগ্ন পাশাপাশি দুটো 'কাঁচা বাংলো' নির্মিত হয়েছিল । বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরের প্রায় ৩০০ ফুট উত্তরে এ জোড়াবাংলো অবস্থিত ছিল সেদিন ।
১৩১২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বার আগরতলায় আসেন । সেবারও জোড়াবাংলোয় অবস্থান করেছিলেন । সেটা ছিল আষাঢ় মাস । ১৭ আষাঢ় স্থানীয় উমাকান্ত একাডেমি হলে মহারাজ রাধাকিশোরের উপস্থিতিতে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতি হিসেবে সুচিন্তিত ও সারগর্ভ 'দেশীয় রাজ্য' প্রবন্ধটি পাঠ করেন কবি ।
১৩১২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি পুনরায় আগরতলায় আসেন । এবার তিনি ত্রিপুরার নবনিযুক্ত রাজমন্ত্রী রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কর্মভার গ্রহণ উপলক্ষে জগদীন্দ্রনাথ প্রভৃতি সহ চতুর্থবারের মতো এলেন এখানে ।
১৩১২ বঙ্গাব্দেই চৈত্র মাসে পঞ্চমবার পুনরায় রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় আসেন । এবারের আসার কারণ হিসেবে জানা যায় চৈত্র মাসে ইস্টার অবকাশের সময় বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের ( যা এরপর পুলিশি জুলুমে দক্ষযজ্ঞে পর্যবসিত হয় ) অন্তর্ভুক্ত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবার জন্য ।
১৯১৯ খ্রি. অর্থাৎ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরদরবারের আমন্ত্রণে কার্তিক মাসে ত্রিপুরার পরম সুহৃদ ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে কোলকাতা যাবার পথে ষষ্ঠ বারের মতো ত্রিপুরায় আগমন করেন । কবির মনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর থাকার জন্য এই কুঞ্জবনের এক প্রান্তে নয়াভিরাম ঘন সবুজ বনানীর কোলে চারিদিকে অজস্র ফুলের মাঝখানে একটি কাঠের ছোট্ট বাংলো তৈরি করা হয় । প্রত্যহ নিত্য নতুন বিহঙ্গের কলকাকলি মুখরিত এই স্থান কবির বড়ই প্রিয় ছিল । এই বাংলোর নাম শিল্পী মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর নামকরণ করেন 'মালঞ্চাবাস' । আবাসটি ছিল মোটা উলুছনের ছাউনিযুক্ত চৌচালা ঘর । বাঁশ বেতের অপূর্ব কারু শিল্পের নকশার কাজ করা বেড়া দেওয়া । মেঝেতে কাঠের পাটাতনের উপর সুদৃশ্য কাশ্মীরি কার্পেট বিছানো । রাতে জ্বলত চিনা ঝাড়লন্ঠন । দুদিকে গোলাপ ও কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় । কত দূর থেকে ভেসে আসা আদিবাসীদের সুরেলা জাদু কলিজার গানের সুরের সঙ্গে বাজত বাঁশির সুমিষ্ট আওয়াজ যা কবিকে করে রাখত আপ্লুত । কবির মনোরঞ্জনার্থে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ, নবকুমার সিংহ ও জিতেন্দ্র সিংহ প্রমুখদের তত্ত্বাবধানে মেয়েরা (লাইছাবি ) তাদের চিরাচরিত গোপরাস, বসন্তরাস, লাইহারাওবা নৃত্য পরিবেশন করেন । এদের সুললিত ব্রজবুলি ছন্দে গীতগোবিন্দের সুরে নৃত্যগীত কবিকে করে রেখেছিল আবিষ্ট । পুরুষ কীর্তনিয়া নর্তক দল পুংচলম,( শ্রীখোল ) ও করতাল চলন ( মন্দিরা ) নৃত্য প্রদর্শন করেন । এই অনুষ্ঠানের মূলভাব, রস ও পদলালিত্যের ধ্বনিমাধুর্য কবিকে এত মুগ্ধ করেছিল যে উনি মহারাজকে অনুরোধ করেন এই মনিপুরী নর্তক দলের বুদ্ধিমন্ত সিংহ কে শান্তিনিকেতনে প্রেরণ করতে এবং ওখানে কলাভবনের পঠন পাঠন সূচিতে মনিপুরী নৃত্যকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দিতে । মহারাজ সানন্দে এই প্রথা গ্রহণ করে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত ও পরবর্তী সময়ে নবকুমার সিংহ, নীলেশ্বর মুখার্জী এবং বসন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনের প্রেরণ করেন । এই নৃত্যগুরুদের অসাধারণ অবদানেই রবীন্দ্রনৃত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল । এমনকি চিত্রাঙ্গদাসহ বেশ কয়েকটি নৃত্যনাট্য ও জনপ্রিয় হয়েছিল ত্রিপুরা থেকে যাওয়া নৃত্যগুরুদের কর্মকুশলতা নান্দনিক নৃত্যশৈলীতে ।
১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ই ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মার আমন্ত্রণে কবি সপ্তম ও শেষবার আগরতলায় আসেন । অল্পবয়স্ক মহারাজ বীরবিক্রম মানিক্যের সঙ্গে মহারাজকুমার বীরেন্দ্রকিশোরের এই আমন্ত্রণ তৎকালীন আগরতলার সাংস্কৃতিক জগতের সুধীমন্ডলীর পরম শ্লাঘার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেবার তিনি কুঞ্জবনপ্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন । এই সম্বন্ধে তিনি পরবর্তী সময়ে মন্তব্য করেছিলেন— .......''পৃথিবীতে প্রকৃতির লীলা ক্ষাত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈল শ্বেত ভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না ।'এইসময় প্রতিদিন মণিপুরী নৃত্য প্রদর্শিত হত । তাছাড়া মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বসতবাটিতে এক অনুষ্ঠানে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজ অন্তঃপুরের কুমারীগণ মণিপুরী নৃত্য, বসন্ত উৎসব ও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায় । স্থানীয় কিশোর সাহিত্য সমাজ তাঁকে ১২ ফাল্গুন তারিখে উমাকান্ত একাডেমী হলে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে ।
No comments:
Post a Comment