Sunday, January 12, 2025
এসো শান্তি, এসো মঙ্গল
Sunday, March 24, 2024
Sabroom ICP and Land Port : Probabilities, Opportunities and Challenges
Sunday, December 17, 2023
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা
Tuesday, November 28, 2023
মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা ও অপারেশন জ্যাকপট
Monday, October 16, 2023
বামুটিয়া প্রসঙ্গে
Sunday, October 30, 2022
কার্তিকের কাব্যকথা
Monday, January 4, 2021
কবিতা কেন লিখি
Tuesday, June 12, 2018
ম হা ল য়া
মহালয়া এক বিশেষ তিথি ৷ মহালয়া বলতে বোঝায় পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু ৷ পিতৃপক্ষ সূচিত হয় প্রধানত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরের পূর্ণিমা তিথিতে ৷ শেষ হয় অমাবস্যা তিথিতে ৷অপরদিকে উত্তরভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয় ৷ সংস্কার অনুযায়ী ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা পঞ্চদশী অর্থাৎ অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়কে বলা হয় পিতৃপক্ষ বা প্রেতপক্ষ বা অমরপক্ষ ৷ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, এই সময় প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষবর্গের আত্মারা মর্ত্যলোকে নেমে আসেন নিজেদের ফেলে যাওয়া গৃহ ও পরিজনের প্রতি মায়াবশত ৷ মহালয়ায় তাঁরা সকলে মরজীবনের পরিবেশে ফিরে আসেন বলে অর্থাৎ তাঁদের বিদেহী আ়ত্মারা ফিরে আসেন বলেই তাঁদের জীবিত উত্তরপুরুষেরা সেই দিনটিতে তর্পনের দ্বারা তাঁদের বিদেহী আত্মার পরিতৃপ্তি বিধান করে প্রতিটি গৃহেই আনন্দোৎসব পালন করে থাকেন ৷ ' আলয় ' যেদিন 'মহ' অর্থাৎ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে সেই দিনটাকেই বলাহয় 'মহালয়া' ৷
এতে বোঝা যায় যে মহালয়া হলো পূর্বপুরুষের পুজো বা প্রেতপুজোর এক বিশেষ তিথি ৷ এই পূর্বপুরুষ পুজো বা প্রেতপুজো মানবসংস্কৃতির ইতিহাসে মানুষের আদিম বিশ্বাসের সঙ্গে বহু প্রাচীনকাল থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ৷
পুরাণকাহিনিতে আছে, মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন তাঁর আত্মাকে খাদ্য হিসেবে গহনা নিবেদন করা হয় ৷ কর্ণ বিস্মিত হয়ে এর কারণ অনুসন্ধানের জন্যে দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন ৷ ইন্দ্র জানান যে, কর্ণ তাঁর জীবদ্দশায় কখনো পূর্বপুরুষের প্রতি খাবার, জল ইত্যাদি উৎসর্গ করেন নি ৷ উপরন্তু দাতাকর্ণ শুধুমাত্র সোনাই দান করে গেছেন আজীবন ৷ আর তাঁর সেই কর্মফলের কারণেই তাঁর ক্ষেত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৷ কর্ণ এই বিষয়টা জানতেন না বলে তাঁকে পনেরো দিনের জন্যে মর্ত্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো যাতে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের জল ও খাবার উৎসর্গ করতে পারেন ৷ হিন্দু পুরাণ মতে, এই পিতৃপক্ষ সময়কালে তিন পূর্ববর্তী প্রজন্মের আত্মা পিতৃলোকে ( স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি) অবস্থান করেন ৷ পরবর্তী প্রজন্মের কারও মৃত্যুর পর যমরাজা আত্মাকে পিতৃলোকে নিয়ে যান এবং প্রথম প্রজন্ম স্বর্গলোকে উন্নীত হয় ৷
পুরাণ মতে এদিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে ৷ অশুভ অসুরশক্তির কাছে পরাভূত দেবতারা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হন ৷ চারদিকে অশুভ শক্তির আস্ফালন ৷ এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার লক্ষ্যে দেবতারা সমবেত হন ৷ অসুরশক্তির বিনাসে তাঁরা এক মহাশক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ৷ দেবতাদের তেজোরশ্মি থেকে আবির্ভূত হলেন অসুরদলনী দেবী দুর্গা ৷ মহালয়ার কাল হলো ঘোর অমাবস্যা ৷ দেবী দুর্গার আবির্ভাবে তাঁর মহাতেজের জ্যোতিতে সেই অমাবস্যা দূরীভূত হয় ৷ প্রতিষ্ঠিত হয় শুভ শক্তির ৷ অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তথা ব্রহ্মান্ডের অর্থাৎ 'মহানিকেতন'র অধিশ্বরী ৷ তাঁরই আগমনী তিথির নাম 'মহালয়া'
Sunday, January 21, 2018
সরস্বতীপুজো : বাঙালির ভ্যালেন্টাইন
বাঙালি হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো ৷ তারপরই যার স্থান হল সরস্বতী পুজো ৷ দুর্গোৎসবের যে সর্বজনীনতা রয়েছে সরস্বতীপুজোয় কিন্তু শিশুকিশোরের প্রধান্য লক্ষ্যণীয় ৷ সরস্বতীকে জ্ঞান, বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে মান্য করা হয় ৷ শিশুকিশোরদের সঙ্গে এই দেবীর একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় ৷ শিশুর বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার পাঠ শুরুর আগেই দিদির কিংবা পাড়ার বড়োদের হাত ধরে বিদ্যালয়ে আসার মাধ্যমে ৷ এর মধ্য দিয়ে তার বিদ্যালয়ভীতি অনেকটাই কেটে যায় ৷
তারপর বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণকালীন সময়ে প্রতি বৎসরই সে সরস্বতীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ৷ সরস্বতীপুজোয় অংশগ্রহণে মধ্য দিয়ে তার ভেতরে দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয় ৷ সৃষ্টি হয় সামাজিকতাবোধও ৷ সবাই মিলে চাঁদা সংগ্রহ, ঠাকুর বায়না করা, পুজোর বাজেট, বাজার করা, প্যান্ডেল তৈরি, পুজোর সরঞ্জাম জোগাড় করা, পুজো নির্বাহ করা, প্রসাদের ব্যবস্থা করা সবকিছুই শিক্ষার্থীরা নিজে দায়িত্ব নিয়ে করে থাকে ৷ দেবী সরস্বতীর প্রতি প্রত্যেক শিক্ষার্থীরও একটা আনুগত্যবোধ লক্ষ করা যায় ৷ দেবীর কৃপার উপর তাদের পড়াশুনার ফলাফলের একটা প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করে ৷ তাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নির্জলা উপবাস থেকে তারা পুজোয় উপস্থিত থেকে পুজোর শেষে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে থাকে ৷ তাই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা বিদ্যায়তনগুলো ছাড়া ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়ও হয়ে থাকে ৷
আর্যরা সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী ছাড়া শস্যের দেবীরূপেও আরাধনা করতেন ৷ ভাগবতে আলোচিত সাতটি নদীর মধ্যে সরস্বতীকে একটি নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ বৈদিকযুগে আর্যগণ সরস্বতী নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে ওই নদীজলে পুষ্ট ভূমিতে চাষবাস করে শস্য উৎপাদন করতেন ৷ ফলে তিনি বৈদিক সূক্তে অম্বিতমে, নদীতমে, দেবীতমে অর্থাৎ জননীশ্রেষ্ঠ, নদীশ্রেষ্ঠ ও দেবীশ্রেষ্ঠরূপে বন্দিত হয়েছেন ৷ কিন্তু সরস্বতীর এইসব দৈবীকল্পনা ছাড়িয়ে কবে যে তিনি বাঙালির একান্ত ঘরোয়া বীণাধারিণী কলানিপুণা ও বিদ্যাসাম্রাজ্যের তরুণী অধিশ্বরী হয়ে উঠলেন তার তথ্য বেদে নেই ৷ আমাদের লোকপুরাণ ও লোকবিশ্বাসই এই দেবীকে বাঙালির উঠোনে আসন পেতে দিয়েছে ৷ বাঙালির লৌকিক দেবদেবীরূপে যাঁরা সুপূজিত সেই হরপার্বতীর কন্যারূপেই অত্যন্ত ঘরোয়া সাজপোষাকেই শ্রীময়ী এই দেবী ৷
বসন্ত সমাগমের প্রাকলগ্নে বাঙালি কিশোরীর শরীরে আসন্ন যৌবনসমাগমের বার্তাটিও বয়ে আনে এই সরস্বতীপুজো ৷ কিশোরীটি এদিনই প্রথম শাড়ি পরার ছাড়পত্র পায় ৷ নারী হয়ে ওঠার অভিষেক ঘটে এই দিনটিকে ৷ 'বনে যে ফুটল কুসুম' এই বার্তাটি পৌঁছে যায় পাড়ার নবীন কিশোরসখাটির কাছে ৷ তার এতোদিনের বালকবেলার খেলার সাথীটিকে সে নতুন চোখে দেখে এই দিনটিতে ৷ হাওয়ায় ওড়া কিশোরীটির চুলের মতো তার মনের ভেতর কী একটা অনুভূতি এদিন উড়াল দেয় ৷ হালফিল সরস্বতীপুজোর দিনটিকে বাঙালির 'ভ্যালেন্টাইন ডে'ও বলা হচ্ছে ৷ নবীন কিশোর কিশোরীর বুকের ভেতর প্রথম প্রেমের কুঁড়িটি নাকি এদিনই ফুটতে শুরু করে ৷ এদিন থেকেই নারীজীবনের কোন গতিপথ তৈরি হয় তা আজকের দিনের কবি জয় গোস্বামীর পংক্তি দিয়েই উচ্চারণ করি -
আজ আরও ছোট হোক চুল
খাটো হোক অঙ্গের বসন
আরো যত্নে মাজা হোক ত্বক
আরো তীব্র বাঁকা হোক ভুরু
এইবার পথে বেরোলেই
কী জিনিস বেরিয়েছে, গুরু !
এইতো লক্ষ্মীশ্রী মুছে গেছে
আজ থেকে জেল্লা মার-মার
আজ থেকে স্বাধীনতা জারি
কাল ছিলে বধুমাতা, আজ
নারীমাংস, নারীমাংস, নারী...
পথে পথে সহস্র পুরুষ
মনে মনে নোংরা করবে তোকে
তাই নিয়ে অবুঝের মতো
গর্ব হবে তোর, হতভাগী
আমি কবি, দুর্বল মানুষ
কী ভাবে বাঁচাব তোকে, ভাবি...
( একটি দুর্বোধ্য কবিতা - জয় গোস্বামী )
Friday, March 10, 2017
হোলি, দোল,বসন্তোৎসব : উৎস ও ক্রমবিকাশ
ৃ
আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি সর্বাধিক প্রচলিত ৷ এটি মূলত রঙের উৎসব ৷ ঋতুর উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও এই হোলি ৷ কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷ প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা ৷
স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷ হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ৷ দাদার আদেশে ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয় ৷
এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জ্বা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধি করে সখীদের সঙ্গে অাবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷এই কাহিনিরই একটু রকমফের রয়েছে অন্য আর একটি পুরাণে ৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ব্রহ্মার আদেশে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে রাধা ৷শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে রতিলীলায় মত্ত হলেন ৷ সারারাত কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় মথিত করলেন শ্রীমতী রাধিকাকে ৷ আবেগঘনাবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের দশন ও নখরাঘাতে এবং কৌমার্যখন্ডনে শ্রীমতী এমন রক্তাক্ত হলেন যে সকালে লজ্জায় কুঞ্জ থেকে বেরুতে পারছিলেন না ৷ উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে র জন্যে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁর অনুগতদের রং নিয়ে খেলার আদেশ দিলেন ৷ সকলে যখন রঙের খেলায় মত্ত সেইসময়ে রাধিকা বেরিয়ে এসে বাড়ি ফিরলেন ৷ রঙের উৎসবের উৎসকেন্দ্রিক আরও একটি মিথ পাওয়া যায় ৷ সেটিও কৃষ্ণকে নিয়েই ৷ ছোটোবেলায় রাক্ষসী পুতনার দুধ পান করে শ্রীকৃষ্ণের গাত্রবর্ণ নীল হয়ে যায় ৷ যৌবনবয়সে শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন তাঁ গায়ের রঙ নীল আর রাধিকার গায়ের রঙ গৌরবর্ণ ৷ তখন শ্রীকৃষ্ণ হীনন্মন্যতায় ভুগছিলেন ৷ ( স্মর্তব্য: যশোমতী মাইয়া সে বোলে নন্দলালা /রাধা কিঁউ গোরী, ম্যয় কিঁউ কালা) ৷ তাঁর এই অবস্থা কাটানোর জন্যে মাতা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশ দিলেন তাঁর ইচ্ছেমতো রঙে রাধাকে রাঙিয়ে দিতে ৷ রাধার গায়ে মুখে শ্রীকৃষ্ণের রঙ লাগানো থেকেই হোলির সৃষ্টি ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলে ৷
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রম্ এ ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়কজন কবিও কাব্যে বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷বাৎস্যায়নের কামসূত্র রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে ৷ তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে ৷এখানে দোলায় বসে আমোদ প্রমোদের উল্লেখ পাই ৷ চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি উৎসবকে শবরস্বামী তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন 'হোলক উৎসব' নামে ৷ সপ্তম শতকে রচিত রত্নাবলী এবং অষ্টম শতকের মালতীমাধব নাটকেও বসন্তোৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ জীমূতবাহনের কালবিবেক ছাড়া ষোড়শ শতকের রচিত রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷