Wednesday, October 22, 2025

ঊনবিংশ শতকের যুবসমাজ ও দেবী কালিকা

🌺 ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব

ভূমিকা–

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল বাংলার সমাজজীবনের এক নবজাগরণের যুগ। সমাজে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে জন্ম নিল এক নতুন চিন্তাধারা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। অন্যদিকে তেমনি সমাজের অন্তরাত্তায় জেগে উঠেছিল জাতীয়তাবোধ ধর্ম চেতনা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান । এই আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বাঙালির এক মহান প্রতীক রূপে উদ্ভাসিত হন মা কালিকা । এই সময়ের যুবকরা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ইংরেজ শাসনের ফলে দমিত জাতির চেতনায় মা কালী হয়ে ওঠেন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রতীক । কালীর রুদ্র ভয়ংকর অথচ মাতৃত্বময় রূপ যুবকদের মনে জাগিয়ে তোলে এক অন্তর্গত শক্তি তারা অনুভব করেন মা কালী ধ্বংস করেন কেবল অশুভকে অন্যায়কে । তিনি যেন তাঁদেরও সাহস যোগান অন্যায় ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ।সংহার ও সৃষ্টির মিলিত শক্তির দেবী । কিন্তু এই নববোধের ভেতরেই এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল— আধুনিকতার আকর্ষণ ও ঐতিহ্যের টান। উনবিংশ শতাব্দীতে মা কালীর পূজা বাঙালি যুব সমাজের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে মূলত বিভিন্ন জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রচলন শুরু হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের মত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে এই পূজা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই সময়ের যুবকেরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তির সাথে উপাসনা করে ।
এই যুগের যুবসমাজ, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল, তারা নিজের জাতীয় ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক খুঁজতে গিয়ে ফিরে তাকায় মা কালিকা-র দিকে।
তিনি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন আত্মশক্তির মূর্তি, জাতীয় গৌরবের প্রতীক ও নবজাগরণের মাতৃরূপ।

নবজাগরণ ও যুবসমাজের মানসিক পরিবর্তন

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজে নানা সামাজিক কুসংস্কার জাতপাত অন্ধবিশ্বাস ও নারী নির্যাতন চলছিল । শুরুতে বাংলা সমাজে একদিকে রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যুক্তিবাদী চিন্তার উত্থান, অন্যদিকে সমাজে গভীর কুসংস্কার, জাতিভেদ ও অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব ছিল প্রবল।
এই বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল সেই সময়ের যুবসমাজ।
তারা একদিকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত, অন্যদিকে নিজের শিকড়ের সন্ধানে ব্যাকুল। এই প্রেক্ষাপটে মা কালীর অনুমুক্ত নির্ভীক ও রক্তমাখা রূপ সমাজের চোখে হয়ে ওঠে সংস্কার ভাঙ্গা শক্তির প্রতীক রূপ । যেমন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'আমাদের চাই না ভীরু ভক্তি চাই কালীর মতো শক্তি ও সাহস ।' এই আহ্বান যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আত্মবিশ্বাসে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে ।
এই সন্ধানেই তারা আবিষ্কার করে মা কালিকা-র রূপে নিজের ঐতিহ্য, শক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীককে।

 মা কালিকা : শক্তি ও জাগরণের দেবী–

মা কালিকা শাক্তধর্মে শক্তির চূড়ান্ত রূপ।
তিনি একাধারে ভয়ংকর ও করুণাময়ী, বিনাশিনী ও জননী।
তাঁর রূপের মধ্যে নিহিত আছে সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অদ্বিতীয় দ্বন্দ্ব—
যা জীবনদর্শনকেই প্রতিফলিত করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে মা কালী হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের আদর্শ দেবী । শোনা যায় অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুবগোষ্ঠীর অনেক যুবক গোপনে কালীপূজার আসরে অস্ত্র প্রতিজ্ঞা নিতেন দেশের স্বাধীনতার জন্য । ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল । তাঁদের কাছে কালী মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ন্যায় শক্তি । এই সময় যুবকরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তি ও ভালবাসার সাথে পূজা করতেন যা তাদের আধ্যাত্মিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল । যুবকরা নিজেদের মুক্তি সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় কালীর কাছে প্রার্থনা করতেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতা, গান ও নাটকে কালীর প্রতীকী উপস্থিতি সমাজ চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল । বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সংগীতেও মাতৃভূমি কল্পিত হয়েছে দেবী মূর্তি রূপে । পরবর্তীকালে এই ভাবনা বিকশিত হয়ে কালীমূর্তিতে জাতীয় মাতার রূপ ধারণ করে । কালী সাধক কবিরাজ রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্তের গানে কালী শুধু ভক্তির দেবী নন । তিনি এক দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র । তাঁদের গানের যেমন আছে ভক্তির আবেগ তেমনি আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।কালী পূজা বাঙালি যুব সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল । যার ফলস্বরূপ অনেক সাহিত্য ও সংগীত তৈরি হয়েছিল সে সময়ে ।

রামপ্রসাদ সেন তাঁর গানে লিখেছিলেন– 
> “কালো তোমার রূপ রে কালী, তাতে যে আলো ঝরে।”

এই ‘কালো’ রূপের মধ্যে যে আলো, সেই আলোই ঊনবিংশ শতাব্দীর তরুণদের চিন্তায় আনল আত্মপ্রত্যয়ের জ্যোতি।
তারা বুঝল, কালী মানে কেবল অন্ধকার নয়—অন্ধকার ভেদ করা আলোর শক্তি। এই সময়ের সাহিত্য ও সমাজে নারীর প্রতিচ্ছবি নতুন করে দেখা হচ্ছিল । মা কালীর চিত্র, যিনি একাধারে ভয়ংকরী ও মমতাময়ী, যুবসমাজকে শেখান নারীর শক্তিকে শ্রদ্ধা করতে । তাকে দেবীরূপে নয় । শক্তির প্রেরণার উৎস রূপে দেখতে । এর মধ্য দিয়ে সমাজে নারী পুরুষের সমতার ভাবনা জন্ম নেয় । এই ভাবনাই পড়ে নারী মুক্তি আন্দোলনের দর্শনকে প্রভাবিত করে ।

স্বামী বিবেকানন্দের কালীভাবনা ও যুবচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দ-এর দর্শনে।
তাঁর কাছে কালী ছিলেন ভয়ের নয়, বরং শক্তির দেবী।
তিনি বলেছিলেন—

> “যে কালীকে তুমি ভয় পাও, সেই কালীই শক্তির মূর্তি। তাঁর পূজা মানে নিজের মধ্যে সেই শক্তির জাগরণ।”

বিবেকানন্দের আহ্বান ছিল স্পষ্ট—

 যুবকরা যেন নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে চিনতে শেখে, নিজের জাতি ও সমাজের মুক্তির জন্য সেই শক্তিকে কাজে লাগায়।
এই ভাবনা যুবসমাজকে দার্শনিক শক্তির পাশাপাশি কর্মের অনুপ্রেরণাও দিয়েছিল।

 বঙ্কিমচন্দ্র ও দেশমাতার কালীরূপ–

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর চিন্তায় মা কালিকা এক নতুন অর্থে উদ্ভাসিত হন।
তাঁর “বন্দে মাতরম্‌” কবিতায় মাতৃভূমিকে কালীস্বরূপ কল্পনা করা হয়েছে—
তিনি অন্নদা, করুণাময়ী, কিন্তু প্রয়োজনে ভয়ংকর রণদুর্গা।
এভাবেই কালী দেবী হয়ে উঠলেন দেশমাতার প্রতীক।

এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবাদে ও আত্মবিসর্জনের চেতনায়।
মা কালিকা এখানে ধর্মীয় সত্তা নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।

 অরবিন্দ ঘোষ ও বিপ্লবী চেতনা–

শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ-এর চিন্তায় কালী রূপান্তরিত হন বিপ্লবের দেবী হিসেবে।
তিনি লিখেছিলেন—

> “যখন জাতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন কালী আসেন ধ্বংস করতে, যাতে নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয়।”

এই ভাবনাই পরবর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের যুবকদের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
তারা কালীকে দেখেছিল অন্যায় ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে।

কালীপূজা : সমাজসংহতি ও আত্মচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালীপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল সামাজিক সংহতির প্রতীক।
শিক্ষিত যুবকরা নিজের পাড়ায়, সমাজে একত্রিত হয়ে কালীপূজার আয়োজন করত।
এই মিলনই জাতিগত ঐক্যের এক প্রতীক হয়ে ওঠে।
কালীপূজার আধ্যাত্মিকতা থেকে জন্ম নেয় সমষ্টিগত আত্মশক্তির ধারণা।

                       নারীশক্তি ও কালীভাবনা–

মা কালিকা নারী হয়েও সর্বশক্তিময়—এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় নারীর মর্যাদা নিয়ে।
এই সময়েই নারীশিক্ষা ও নারীসমতার আন্দোলন শুরু হয়, যার পেছনে ছিল শক্তিস্বরূপা কালীচেতনার প্রভাব।
নারী আর দুর্বল নয়—তিনি সৃষ্টি, করুণা ও সাহসের প্রতীক।

মানসিক ও নৈতিক প্রভাব–

যুবসমাজ মা কালিকার ভক্তি থেকে শুধু ধর্মীয় আশ্রয় নয়, পেয়েছিল মানসিক দৃঢ়তাও।
কালী তাঁদের শিখিয়েছিলেন—
ভয় নয়, আত্মবিশ্বাসই জীবনের মূলমন্ত্র।
অতএব, কালীভক্তি হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে এক নৈতিক পুনর্জাগরণের পথ।

উপসংহার–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক—
আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক।
তিনি ছিলেন একাধারে ভক্তির দেবী ও কর্মের অনুপ্রেরণা, জাতীয়তাবাদের মাতা ও ব্যক্তিসত্তার শক্তি।

বিবেকানন্দের ভাষায়—

> “শক্তি যদি জাগে, তবেই জাতি বাঁচে।”

মা কালিকার উপাসনার মধ্য দিয়েই এই যুগের যুবসমাজ সেই শক্তি খুঁজে পেয়েছিল—
যা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল, জাতীয় চেতনা জ্বালিয়েছিল,
এবং বাঙালির নবজাগরণের ভিত রচনা করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজের কাছে মা কালী ছিলেন শুধু উপাস্য দেবী নন, বরং চেতনার প্রতীক, শক্তির উৎস ও বিপ্লবের প্রেরণা । তাঁর রুদ্ররূপে সেসময়ের যুবক দেখেছিলেন সংস্কার ভাঙা ও প্রতিবাদের শক্তি । তাঁর মাতৃরূপে পেয়েছিলেন সান্তনা ও মমতা ।

 সংক্ষেপে বলা যায়,
ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল
আত্মশক্তির জাগরণ, দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা, এবং নবজাগরণের আত্মা। মা কালী হয়ে উঠেছিলেন এক যুগের মানসিক মুক্তির প্রতীক যা পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ প্রশস্ত করে ।

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা 

   ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অগ্নিযুগ শব্দটি এসেছে সেই সময়ের বিপ্লবী যুবকদের আত্মোৎসর্গ ও অনলস দেশপ্রেমের জন্য । এটি মূলত ১৯০৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়কে নির্দেশ করে । যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর বাংলার যুবসমাজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় । এই বিপ্লবীদের মানসিক জগতের গভীরে যে শক্তি কাজ করেছিল তার অন্যতম উৎস ছিল মা কালিকা । সংহার, শক্তি ও মুক্তির চিরন্তন প্রতীক । তিনি রুদ্ররূপে ধ্বংস করেন অন্যায় । আবার মাতৃত্বের রক্ষা করেন সৃষ্টিকে । বিপ্লবীরা এই রূপেই দেখেছিলেন তাঁদের আদর্শ দেবীকে । যিনি অন্যায়ের বিনাশে অনুমোদন দেন, দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করার সাহস যোগান । তাঁরা বিশ্বাস করতেন যেমন কালী অসুর বধ করেন তেমনি পরাধীনতার অশুভ শক্তিকেও বিনাশ করতে প্রেরণা দেন ।

শোনা যায়, অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুব বিপ্লবীগোষ্ঠী কালীপূজার রাতেই গোপনে অস্ত্র স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করতেন । মেদিনীপুর শহরের কর্নেলগোলা কালীমন্দিরেই দীক্ষা নিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল ।

আজও যখন অন্যায় দেখি, নিপীড়ন দেখি, দুর্নীতি দেখি, তখন মনে হয় আমাদের দরকার সেই আগুন, সেই সাহস যা একদিন অগ্নিযুগের যুবকদের জাগিয়েছিল মা কালিকার আহ্বানে।

 হে চেতনার যোদ্ধাগণ, চলুন আমরা আজও সেই মন্ত্র জাগি–

এলো আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, 
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে ।।

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির 

ত্রিপুরার উদয়পুরে অবস্থিত মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির একটি প্রাচীন কালীমন্দির । ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা ধন্য মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । তবে ত্রিপুরারাজ্যে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার আরো প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । আমরা জানি যে, প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । সেই হিসেবে কুমিল্লা ও একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় চন্ডীমন্দির বা চন্ডীমুড়া মন্দির নামে একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । চন্ডীমুড়ায় দুটি মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত । দক্ষিণ পাশের মন্দিরটি চন্ডী মন্দির ও উত্তর পাশের মন্দিরটি শিব মন্দির । চন্ডী মন্দিরটি দেবী কালিকার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । এই চন্ডীমন্দির সম্বন্ধে একটি পুরাণ কাহিনি প্রচলিত রয়েছে । দেবী চন্ডী যখন শুম্ভ নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের সাথে যুদ্ধ করছিলেন তখন বেশ কিছু অসুর জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গায় পালিয়ে আসে । দেবী তখন এখানে অসুরদের বধ করেন । দেবীর দেহতাপের ফলে পাহাড়ের মাটির রং লাল হয় । ফলে এই পাহাড়ের নাম লালমাই পাহাড় হয় ।

সপ্তম শতাব্দীর খড়্গবংশীয় মহারাজ দেবখড়্গ তাঁর রানি প্রভাবতীর ইচ্ছাতে এই মন্দির ও একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ও তার রানি হিন্দু ছিলেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ হয়েও মা চন্ডীর উপাসনা করতেন । বৌদ্ধরাজ দেবখড়্গের স্ত্রী প্রভাবতী দেবী অমর কীর্তি স্থাপনে বদ্ধপরিকর হয়ে এখানে দুটি মন্দির স্থাপন করেন । একটি চন্ডীমন্দির ও অপরটি শিব মন্দির চন্ডীমন্দিরে অষ্টভুজা সর্বানী মহাসরস্বতী । অপরটিতে শিবমূর্তি স্থাপন করেন । এরপর সময়ের সাথে মন্দির দুটি হারিয়ে যায় । ত্রিপুরার যুবরাজ চম্পক রায় দেওয়ানের ভগ্নী দ্বিতীয়া দেবী এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন । তিনি পাহাড়ের দক্ষিণ পূর্বে একটি দিঘি খনন করেন । যার নাম দুতিয়ার দিঘি ।

জয় মা । সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা ।

গাড়ুই ব্রত

 গাড়ুই ব্রত

           গাড়ুই ব্রত লৌকিক ব্রত । এর প্রতি পরতে পরতে লোকজীবনের ছাপ রয়েছে ।ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ধানের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় নব্য প্রস্তর যুগে ( ৭০০০-৬০০০ খ্রি.পূ. ) ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে । এরপর সিন্ধু সভ্যতায় (৩০০০-২৫০০ খ্রি. পূ.) ধান চাষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন । এটি একটি গ্রীষ্মকালীন ফসল হিসেবে চাষ করা হত । প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমূহের উপর সর্বশেষ গবেষণায় জানা গেছে যে, সিন্ধুসভ্যতায় ধারণার চেয়েও আগে থেকেই ধান চাষ হত । গবেষণা আরও জানাচ্ছে যে, সিন্ধুসভ্যতার মানুষেরা মিশ্রকৃষির ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য ছিল । তারা গ্রীষ্মকালে ধান, মিলিট ও শিম্ব জাতীয় শস্য উৎপাদন করত এবং শীতকালে গম, বার্লি ও ডাল জাতীয় শস্য উৎপাদন করত ।

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহে ধানকে 'ব্রীহি' বলা হত । ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদসহ বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থে এটিকে একটি প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । বৈদিক যুগে ধানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য বিবেচনা করা হত এবং ব্যাপকভাবে চাষ করা হত । বৈদিক ধর্মীয় ভাবাপন্ন হওয়ার আগে কৌম মানুষেরা লৌকিক দেবদেবীর পূজার্চনা করত । সেখানে বৈদিক ব্রাহ্মণের প্রবেশ ঘটেনি । পরবর্তীসময়ে এইসব ব্রাত্য দেবদেবীরা দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন । বাংলার লোকধর্মীয় পূজাপদ্ধতিতে নৈবেদ্য বা পূজার উপকরণ হিসাবে গৃহস্থের উৎপাদিত ফসলের অংশ বা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সহজলভ্য উপকরণগুলোকেই নিবেদন করতে দেখা যায় । এরকম পূজায় বা আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত অনেক বিষয়ের মধ্যেই আমাদের অতিক্রম করে আসা প্রাচীন সভ্যতার কিছু কিছু বিষয় অজান্তেই থেকে যায় । এরকম শিলনোড়ার ব্যবহার প্রস্তরযুগের নিদর্শন, পূজার সামগ্রী কোশাকুশি তাম্রযুগের স্মৃতিবাহক । গাড়ুই ব্রতে জুমের চালের ব্যবহার বাঙালির কৌমজীবনের অধ্যায়ের ক্ষীণ নিদর্শন । বাঙালি যতই জাতের বড়াই করুক । আদিতে তারা কৌম ও সংকর জাতি । বিবর্তনের সেই অধ্যায়টা অজানা বলে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে মরি । পূজার উপকরণ আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় যাতে আমরা বুঝি ।

Tuesday, October 7, 2025

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

গত পরশুদিন আমরা গেছি ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিক্কাবাল্লাপুর পাহাড়ে ঈশা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত আদিযোগী শিবমূর্তি দেখার জন্যে । বিশাল পাহাড়কে পেছনে রেখে দিগন্ত খোলা আকাশ এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে বিশাল ধ্যানমগ্ন শিবমূর্তি । সমস্ত চরাচর জুড়ে এক নীরব নিস্তব্ধ প্রসন্নতা বিরাজ করে এখানে । প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আদিযোগী মূর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আলো ও শব্দের যুগলবন্দী মোহময় ধারাভাষ্য । সঙ্গে সদগুরুর প্রবচন । প্রায় ১৫ মিনিটের এই অনুষ্ঠান অন্ধকার প্রান্তরে মৌনতার মাঝখানে যেন দৈববাণী ও আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে এক অনৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে যোগেশ্বর শিবের মিথসমূহ একে একে উন্মোচিত হয় আলো ও শব্দের মোহজালে তখন সমগ্র চত্বরে মহাবিশ্বের ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ জড়িয়ে ধরে যেন সমস্ত সত্তাকে । মৌনী যোগেন্দ্রর সঙ্গে একাত্মবোধ জেগে ওঠে । ভারতের নানাপ্রদেশের মানুষের ছায়ামিশ্রণের এক প্রান্তর । এখানে হিংসাবিদ্বেষ নেই । পরিচয়হীন আত্মপরিচয়ে এক । 'আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়' ।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ফেরার পথে ছেলে ও বৌমা আমাদের নিয়ে এল সেই চত্বরের বাইরে একটা বড়ো খাবারের দোকানে । কি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ঢাল কেটে ধাপে ধাপে গ্রাহকদের বসার জায়গা করা হয়েছে অনেকটা গ্যালারির মতো । আলো ঝলমল ও খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরপুর ।  পাহাড়ের উপরের অংশটা নিয়ে দোতলা । সেখানেও পরিপাটি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা । এককথায় পাহাড়ের ঢালটাকে কি সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে । আমরা হলে টিলা কেটে সমান করতাম । এখানকার মানুষ প্রকৃতিচেতনায় সমৃদ্ধ । সারা ব্যাঙ্গালোরে এতো বিশাল বিশাল ইটকাঠের ইমারত টাওয়ার থাকলেও বন কিন্তু চোখে পড়ার মতো । একটু পরপরই গাছগাছালিতে ঘেরা পার্ক রয়েছে । সর্বক্ষণ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।  রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই এখানে কর্মরত কয়েকটি ছেলেকে দেখে আমার রক্তের ভেতর একটা দোলা দিয়ে গেল । ছেলেগুলো আমাদের খাবার পরিবেশন করল । বাসনপত্র নিয়ে গেল ধোয়ার জন্যে । সবাই মিলে কাজ করছে এখানে । 

একটা ছেলে একটু দূরে বসে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল আনমনে । আমি আমার খাওয়া সেরে তার পাশে বসলাম । পরিবারের সবাই আমাকে লক্ষ করছে । আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম, ভাই, তূমহারা ঘর কাঁহা ? ও বলল, ত্রিপুরা। নুং বরক দে ? আমি প্রশ্ন করলাম । সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বড়ো বড়ো করে জবাব দিল,  ইঁ , নুং ? আমাকে প্রশ্ন করল । আং ব ত্রিপুরা হা নি । আমি বললাম । প্রশ্ন করলাম নিনি নক বিয়াং । বলল, মনুঘাট । আমবাসানি কান্দার' । আং সাব্রুমনি সে ।  আমিও আমার স্থাননাম বললাম । আমার আধভাঙা ককবরক শুনে মনে হল সে খুশি । দেববর্মা দে নুং । ইঁহি । ত্রিপুরা। তাম' নিনি মুং । চিকনিয়া ত্রিপুরা । ও বলল । 

চিকনিয়া জানাল কয়েকমাস যাবত এখানে কাজ করছে । বেতন মাসে সতেরো হাজার টাকা । দুবেলা খাবার ও থাকার জায়গা মালিকের দেওয়া । সে নাকি সাব্রুমেও ছিল কিছুদিন । মাগরুমে একটি ব্রিজ  তৈরির কাজ করেছিল কিছুদিন । আমি বললাম, তোমাদের দেখেই আমি আমার পরিবারকে বলেছি এরা ত্রিপুরার হবে । ছেলেটি হাসল । সারল্যের হাসি । আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে । ঘরের মানুষের সঙ্গে যেমন কথা বলছি । আপনি বাঙালি আমি ত্রিপুরা কিছু মনে হচ্ছে না । সুন্দর বাংলা বলে ছেলেটা । আমাকে পেয়ে আরও বলল, এখানে কাজ করছি ভালোই। কিন্তু ওরা কানাড়ায় কথা বলে । আমরা না বুঝলে গালাগাল দেয় । এছাড়া আর সবই ভালো । আমি বললাম, চলো একটা ছবি নিই দুজনে । সঙ্গে সঙ্গে ও খুশি । আমার পাশে এসে বসল । সেলফি তুললাম । তারপরেই তার ডাক পড়ল । সে উঠে চলে গেল কাজে । 

আমি মহেশ্বর শিবের মতো স্থানু হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম । আমার রক্তের ভেতর যেন ইতিহাসের কোন অনাদিকালের নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণের এক ফল্গুর কল্লোল উঠছে । আমিও সেই । আদিযোগী ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

আজ বিজয়া দশমী । দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিন । ভারতের অন্য সব প্রান্তে এই দিনটি দশেরা উৎসব হিসেবে শ্রদ্ধা ভক্তির সঙ্গে পালিত হয় । রামায়ণ মহাকাব্যে বর্ণিত রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বিজয়ের এই দিনটিকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় হিসেবে পালিত হয় । কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূরে চামুন্ডেশ্বরী মন্দির, কুর্গের মাদিকেরীসহ সর্বত্র এই দশেরা উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় । দশেরাকে কর্নাটকের আঞ্চলিক উৎসবও বলা হয় । নবরাত্রির দিন থেকে এই উৎসব শুরু হয় । আজ ব্যাঙ্গালোর জুড়েই দেখলাম দশেরার প্রস্তুতি । বাজারে প্রচুর ফুল ফল ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে । সবাই সাধ্যমত ফুল, ফল, ফুলের মালা, আমের পল্লব, কলার চারা নিয়ে যাচ্ছেন । সকাল থেকেই বাড়িঘর সাজানো হয়েছে ফুল ও ফুলের মালায় । সদর দরজার দুপাশে লাগানো হয়েছে কলার চারা । মাঝখানে আলপনা । প্রতিটি বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো চালকুমড়ো ও নারকেল ফাটিয়ে রাখা হয়েছে । অনেকটা আমাদের দক্ষিণ ত্রিপুরায় চৈত্র সংক্রান্তির দিনের আমের কুশি কেটে সত্তুরওড়ানোর মতো । যানবাহনগুলোকে ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে । এদিকে বাঙালিদের পুজো প্যান্ডেলে বিজয়া দশমীর বিদায়ের সুর । সর্বত্র একটা নীরবতা । আনন্দ ও বেদনার পাশাপাশি অবস্থান । কি অদ্ভুত রসায়ন ! জীবনটাও এমনই ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৫ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি দুর্গাপুজো (৫ )

এবারে আমি পরপর দুটি এপিসোডে বর্তমানে যেখানে আছি অর্থাৎ আমার বড়ো ছেলের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকার একটা বড়ো দুর্গাপূজোর বিষয়ে কিছু জানিয়ে এবং তারপরে এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির একটি বিষয় যার সঙ্গে আমাদের দুর্গোৎসবের কিঞ্চিত সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ করে ব্যাঙ্গালোরের পূজা পরিক্রমা শেষ করব ।

দুর্গাপুজোর থিমে অনেক সময় চলচ্চিত্র বা সিনেমার বিষয় উঠে এসেছে । বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলার বড়ো বড়ো বারোয়ারি পুজোকমিটিও থিম পুজোগুলিতে।

এরকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

1. সত্যজিৎ রায় স্মরণে থিম –

অনেক পুজো কমিটি “পথের পাঁচালী”, “অপু ট্রিলজি”, বা “গুপী গাইন বাঘা বাইন”–এর দৃশ্য দিয়ে থিম সাজিয়েছে।
বিশেষত ২০১৯-এ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একাধিক পুজো তাঁকে কেন্দ্র করে থিম নিয়েছিল।
2. বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ –
কিছু পূজায় ৫০–৬০–৭০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার, গান, সেট, দৃশ্য ব্যবহার করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে।
যেমন: উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয় ছবি সাগরিকা, হারানো সুর, পিকনিক ইত্যাদির আবহ।
3. বলিউড ও বিশ্বসিনেমা থিম –
মাঝে মাঝে “শোলে”, “মুঘল-এ-আজম”, এমনকি “হ্যারি পটার” বা “অ্যাভেঞ্জার্স”-এর চরিত্র নিয়ে থিম তৈরি হয়েছে।
তবে এসব সাধারণত আকর্ষণ করার জন্য, আধ্যাত্মিকতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হয়।
4. সামাজিক বার্তা মূলক সিনেমা –
“পথের পাঁচালী” বা “মেঘে ঢাকা তারা”-র মতো সিনেমার দারিদ্র্য, সংগ্রাম, সমাজ-বাস্তবতার দিক তুলে ধরা হয়েছে।
থিমের মাধ্যমে বলা হয়, দেবী শক্তি শুধু পুজো নয়, বাস্তব জীবনের সংগ্রামে পাশে থাকার প্রতীক।

তেমনি একটি চলচ্চিত্রের থিমকে নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছেন ব্যাঙ্গালুরুর আরোহন সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন। কাঠগুড়ির পাশে বেলাথুরে তাঁদের পুজোমণ্ডপের এবারের থিম 'দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার' । থিমটি নেয়া হয়েছে 2019 সালের হিট বাংলা ছায়াছবি 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' এর বিষয়েকে নিয়ে । কাহিনি ইতিহাসের একটা ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে থ্রিলারধর্মী করে তোলা হয়েছে । কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর জগৎ শেঠের কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ উপঢৌকন পেয়েছিলেন । সেই সম্পদ যাতে ইংরেজের হাতে না পড়ে সেজন্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার মন্দিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম সেই রহস্যময় সম্পদ খুঁজে পায়নি । ইতিহাসের অধ্যাপক সুবর্ণ সেন, ভাইপো আবির এবং তাঁর বন্ধু ঝিনুককে নিয়ে সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন । কাহিনির সেই দেবীদ্বারের আদলে তৈরি তাঁদের মন্ডপ । প্রতিমাও দৃষ্টিনন্দন । মন্ডপের ভেতরের সৌন্দর্যায়ন করেছেন সংগঠনেরই একঝাঁক শিল্পী । ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো ও প্রতিদিন মধ্যাহ্নে সবার জন্যে প্রসাদের ব্যবস্থা করেছেন । বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল জমাটি । প্রতি সন্ধ্যায় বহিরাগত শিল্পীরা ও সংগঠনের সদস্যগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন । অষ্টমীর রাতে বরিষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে এক অভিনব ফ্যাশন শোএর আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা । ব্যাঙ্গালোরে সব পুজো প্যান্ডেলে দেখলাম বয়স্ক নাগরিকদের বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয় । পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিক অসুস্থতা, ডায়ালিসিসের কষ্ট সহ্য করেও অনেকে মঞ্চে ক্যাট ওয়াক করেছেন । এই ফ্যাশন শোএর বিষয় নেওয়া হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাজপোষাক ।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা সাহিত্য ও শিল্পকলা, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । সেই পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আধুনিকতায় এগিয়েছিলেন । এই পরিবারের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালিদের আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরাতে শিখিয়েছিলেন । ঠাকুরবাড়ির বউদের শাড়ি পরার ধরনই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি রমণীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় । পাশাপাশি এই পরিবারের সদস্য সদস্যারা অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন । ঠাকুর পরিবারের প্রথিতযশা পুরুষ ও রমণীদের চরিত্রাভিনয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এই ফ্যাশন শো । বিষয়টি অভিনব ও গবেষণালব্ধ । আধুনিক অঙ্গনে একটা সময়কে তুলে ধরা হয়েছে । এই সংগঠনের তরুণ সদস্যরাও কম যান কিসে ? তাঁরাও দল বেঁধে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালিবাবুটি সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন এই সন্ধ্যায় । গত ত্রিশে সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজা পত্রিকার পাঁচের পাতায় আরোহন কালচারাল এসোসিয়েশনের প্রতিমার ছবি ছাপা হয়েছে যত্নের সঙ্গে ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৪ )

প্রবাসে দেবীর বশে :  ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৪ )

সার্জাপুরের এক প্রান্তে ন্যাশনাল পাবলিক স্কুল কূডলুর পাশেই হচ্ছে বর্ষা বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পূজো । অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত তাদের এই পুজো মণ্ডপ । বাংলা এবং কর্নাটকের সংস্কৃতির মধ্যে এক আশ্চর্য মেলবন্ধনকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন তাঁরা । তাঁদের মণ্ডপসজ্জায় তাঁদের এবছরের পূজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে ভাবনাটি তুলে ধরেছেন তার নাম দিয়েছেন 'চিত্রাগাণা' । বাংলা এবং কর্ণাটকের দুইটি বিশিষ্ট লোককথাভিত্তিক চিত্রকলার সংমিশ্রণ এখানে ঘটিয়েছেন । তাঁদের মন্ডপের সামনের দিকটাতেই এই থিম এর মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র ছৌ মুখোশ এবং কর্নাটকের 'যক্ষগাণা'  ( Yakshagana ) চিত্রশৈলীর মুখোশের নিদর্শন রেখে দুটি প্রদেশের শিল্পমাধ্যমের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা । পুরো মন্ডপ জুড়ে কর্ণাটকী লোককথা 'যক্ষগাণা' ও বাংলার ছৌ নৃত্যের মুখোশ । মন্ডপের ভেতরেও অসাধারণ সব কাজ ।পুজোর মাধ্যমে কর্নাটকের ও বাংলার ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ ঘটিয়েছেন তাঁরা । এই সার্জাপুরের আর একটি পুজো করছেন SORRBA. তাঁরা এই পুজোর মাধ্যমে পঞ্চদুর্গা ও দশেরা  উদযাপন করছেন । প্রতিমাটি খুবই সুন্দর । কাঠখোদাই কাজের ধরনের । চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশও মনোরম ।

ব্যাঙ্গালোর তথ্যপ্রযুক্তির মহানগর । ইলেকট্রনিক সিটি । কাজেই এখানকার পুজোতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারিক চমক তো থাকবেই । ইস্ট বেঙ্গালুরু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ( EBCA ) এর এবারের পুজোর থিম "প্রযুক্তির আলোয় প্রথাগত পূজা"  । এবছর তাঁরা তাঁদের পুজোয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাবনা নিয়ে এসেছেন । এবার তাদের ভাবনা হল ত্রিমাত্রিক নবদুর্গা যা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতেও আর কেউ কখনো উপস্থাপন করেনি বলে উদ্যোক্তারা দাবি করছেন । পূজা মন্ডপে নবদুর্গার নয়টি বিশেষ  প্রতিমার উপরের দিকে একটা করে কিউ আর কোড লাগানো আছে । পূজা মন্ডপে আগত দর্শণার্থীরা এখানে এসে তাদের মোবাইলে নবদুর্গার এই প্রতিকৃতিগুলির স্ক্যান করতে পারছেন এবং এই বিগ্রহ সমূহ তাদের মোবাইলের পর্দায় জীবন্ত দেখতে পারছেন । পরিবেশবান্ধব এই পুজোমণ্ডপ এবং দেবীপ্রতিমা নির্মাণ করেছেন কৃষ্ণনগরের এক শিল্পী কৌশিক দাঁ । ঠিক এমনই উত্তরণ সর্বজন সমন্বয়ের পুজোয় প্রতিমা তৈরি হয়েছে শিল্পী পৃথ্বীরাজ চৌধুরীর এক বিখ্যাত মা দুর্গার পেইন্টিংকে ভিত্তি করে চিত্রকরের 2D চিত্রকে 3D রূপে এখানে তুলে ধরা হচ্ছে প্রথমবার । আর সেই চিত্রকে মাথায় রেখে এবছর তাদের থিম হচ্ছে "কালীঘাটের চিত্রশিল্প"  । গুঞ্জুর লেক-এর উল্টোদিকে এস আর অক্ষতা প্যলেসে ( S R AKSHATA PALACE ) হচ্ছে ব্যাঙ্গালুরু সিলেটি কালচারাল এসোসিয়েশনের পুজো । এখানে  উত্তরপূর্বের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি ও ত্রিপুরার ধর্মনগর, খোয়াই, কৈলাশহর ও কমলপুরের অনেকেই এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত আছেন । তাঁরা সবাই কর্মসূত্রে এখানে আছেন । কেউ স্থায়ী আবাস করে নিয়েছেন ।  বয়স্ক মাবাবাকে নিয়ে এসেছেন ।কেউ বছরে এক দুবার বাড়ি যান । এককথায় উত্তরপূর্বের এই বিস্তীর্ণ সিলেটি ভাষাভাষী মানুষ এখানে সম্মিলিত হন পুজোকে কেন্দ্র করে । সিলেটি সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ । তারই প্রতিফলন রয়েছে তাদের পুজোয় । তাদের পুজোর ব্যানারে সিলেটি নাগরী লিপির নিদর্শন রেখেছেন । যথাযথ নিয়মে হোম যজ্ঞ সহকারে এখানে তাঁরা পুজোর আয়োজন করেন । সেই সঙ্গে থাকে ঢালাও প্রসাদের ব্যবস্থাও । 
এছাড়া আরো অনেক পুজো সারা ব্যাঙ্গালোর জুড়ে রয়েছে । ভক্তি নিষ্ঠা থিম মিলিয়ে কোনোটাই এড়িয়ে যাবার মতো নয় । কিন্তু সব মন্ডপই  অনেক দূরে দূরে একটা দুটো দেখতে গেলেই দিনের একাংশ চলে যায় ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৩ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৩ )

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব । বাংলার প্রতিটি গ্রাম নগরে দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । সে ধারা আজও বহমান । আজ ভুবনায়নের যুগে বাঙালি মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময় । বাঙালি যেখানেই গেছেন তাঁদের সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন। সমস্ত রকমের সামাজিক অনুষ্ঠানসহ পূজাপার্বণ ও পালন করে আসছেন অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে । সেইমতো আজ দুর্গোৎসব হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে এবং বিদেশেও । দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যকে তাঁরা ফুটিয়ে তুলছেন নানাভাবে । যখন যেখানে থাকছেন সেখানকার সংস্কৃতিকেও ধারণ করছেন আবার তার সাথে নিজেদের সংস্কৃতিকে মিশিয়ে এক মোহনায় নিয়ে আসছেন সৃষ্টিশীলতায় ও নিষ্ঠায় ।

হুগলির গুপ্তিপাড়াতে ১৭৯০ সালে ১২ জন বন্ধু মিলে যে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন তাই 'বারো ইয়ারি' বা 'বারোয়ারি' পূজা নামে পরিচিত হয় । প্রথমদিকে দুর্গাপুজো করতেন রাজরাজড়ারা, ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ বা জমিদারগণ । সেখানে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না । বারোয়ারি পুজো শুরু হওয়ার পর থেকে দুর্গাপুজো সর্বজনীন রূপ নেয় । সেই থেকে বাঙালি যেখানেই গেছেন সেখানেই তাঁরা সমবেতভাবে দুর্গোৎসব পালন করছেন । ।

ভারতের বড়ো বড়ো শহরের মধ্যে ব্যাঙ্গালুরু অন্যতম । এই শহরে বাস করেন বহু বাঙালি । পিতৃমাতাভূমি ছেড়ে এসে এই প্রজন্মের অনেকে এখানে স্থায়ী বসত গড়ে নিয়েছেন । অনেকে রুটিরুজির প্রশ্নে এখানে এসে থাকছেন । যেখানে বাঙালি রয়েছে সেখানেই রয়েছে বাঙালি সমিতি, সংগঠন । তাঁরা শরৎকালে দুর্গোৎসবে মেতে উঠেন । সংবৎসর অন্যান্য পুজো, অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । ঐতিহ্যের অনুসারী হন । সেই সঙ্গে বাঙালি খোঁজেন তাঁদের আত্মপরিচয়ের শেকড় । সেই শেকড়ে ভর করেই তাঁরা পা বাড়ান আরেক ভবিষ্যতের দিকে । সে কারণেই ব্যাঙ্গালুরুর রামমূর্তিনগরের শ্রীহট্ট সম্মিলনী এবছর তাঁদের পুজোর ভাবনা রেখেছেন 'অস্তিত্ব' । তাঁরা দেবীপুজোর মাধ্যমে তাঁদের অস্তিত্বকে জানান দেন এবং এই নতুন ভূখণ্ডকে আপন করে নেওয়ার ভাবনায় ক্যাপশন দেন– "বাড়ি ছাইড়া বাসাত আইলাম / বাসারে আমার ঘর বানাইলাম" । স্মৃতিকাতারতা আর বাস্তবতার স্বীকারোক্তি এই উচ্চারণ ।

যতটুকু জানা যায়, ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের কয়েকজন অধ্যাপক সম্মিলিত উদ্যোগে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন । মূলত এই পুজো থেকেই বাঙালিরা এখানে নানা পুজোপার্বণ ও সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু করেন । ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের মাধ্যমে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন তার কাজ শুরু করে এখানে । তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । ব্যাঙ্গালুরুর নানা প্রান্তে শুরু হয় বাঙালিদের নানা সংগঠন, পুজো ও সামাজিক অনুষ্ঠান ।

কোলকাতা, আগরতলার পুজোতে যেমন দুর্গাপুজোর মন্ডপে ফুটে উঠে বিষয়ভাবনা তেমনি ব্যাঙ্গালোরের পুজোতেও জাঁকিয়ে বসেছে এই থিম । এখানে কদর রয়েছে থিম মেকারদেরও । পুজোর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে থিম মেকার ও শিল্পীরা এসে মন্ডপ সাজিয়ে দেন । এখানে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের এবারের থিম শোভাবাজারের রাজবাড়ি । ১৭৫৭সালে ইংরেজদের হাতে শোভাবাজারের পতন ঘটার পর বিজয়োৎসবের আনন্দে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কোলকাতার শোভাবাজারের জমিদার নবকৃষ্ণ দেবের পুজোর মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা করা হয় । তাঁদের এবছরের মন্ডপ শোভাবাজারের রাজবাড়ির আদলে ।এবছর তাঁদের পুজো ৭৫ বছরে পড়ল ।

ব্যাঙ্গালুরুর প্রাচীন পুজোর মধ্যে এ বছর একাত্তরে পা দিল জয়মহল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো । তাদের এ বছরের থিম হারিয়ে যাওয়া শৈশব ( Lost Childhood ) ।

আরটি নগর প্যালেস গ্রাউন্ডে কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের থিম 'মুক্তি' । মণ্ডপসজ্জায় রয়েছে বর্তমান জটিল জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি । কর্পোরেট জীবন যেভাবে মানুষের ব্যক্তিগত সময়, আনন্দ, সুখ ও বিনোদনকে কেড়ে নিচ্ছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর্তি রয়েছে এই মন্ডপের ভিতরের শিল্পকলায় । এই চত্বরেরই আর একটি পুজো ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশন নারী ক্ষমতায়নের থিমকে মাথায় রেখে নারী জাতিকে সম্মান জানাতে পুজো পরিচালনা, পুরোহিত ও ঢাকের বাজনায় অংশ নিয়েছেন একদল মহিলা । গ্রীন গ্লেন লেআউট অ্যাসোসিয়েশনের এবারের পূজোর থিম 'নটরাজ' । বর্তমানে চলা সারা বিশ্বময় অস্থিরতা, ধ্বংস, তান্ডবকে মাথায় রেখে তাঁরা বিশ্ববাসীর কাছে এই সংকটময় মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণের বার্তা পৌঁছে দিতে চান । নটরাজের তাণ্ডব হিংসার বিরুদ্ধে শান্তির জয়বার্তা ঘোষণা করছে । কোরমঙ্গলার সারথি সোসিও কালচারাল এর পুজোর ২৩ তম বছরের থিম 'মিলে সুর তুমহারা হামারা' । বেশ কিছু বছর আগে দূরদর্শনে বিভিন্ন ভাষায় এই গানটি প্রচারিত হত । সেই ভাবনাকে নিয়ে নানা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে । পূর্ব ব্যাঙ্গালোরে কেটিপিও গার্ডেনে পূর্বা ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশনের পুজোয় সাবেকিয়ানার ছাপ রয়েছে । বিশাল চত্বর নিয়ে তাঁদের পূজো মন্ডপে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হচ্ছে । জনভোগের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে ।  বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি তাঁদের যত্ন লক্ষণীয় ।

ইন্দিরানগর ঐক্যতান হেব্বেল কালচারাল সোসাইটি তাঁদের এবারের সাতান্নতম বর্ষের দুর্গোৎসবে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে ভগবত গীতার মাধ্যমে তুলে ধরতে চান । তাঁরা মনে করেন গীতার বাণীর মাধ্যমে ব্যক্ত শিক্ষা বা বোধ আজকের দিনে খুবই অর্থবোধক যেখানে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রশ্নের সম্মুখীন । মন্ডপসজ্জায় গীতা  থেকে উদ্ধৃত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে সেই সময়ের পরিবেশকে স্পষ্ট করা হয়েছে । সারা প্যান্ডেল জুড়েই গীতার শ্লোকের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী দর্শকের সামনে মেলে ধরা হয়েছে । নেল্লুরহাল্লি, হোয়াইট ফিল্ড কালচারাল এসোসিয়েশন তাদের মন্ডপ করেছেন কেদারনাথ মন্দিরের আদলে । এরকম বিবিএসইটির এ বছরের থিম হল পশ্চিম ভারতের রাজকীয় রাজস্থান । রাজস্থানের ঐতিহ্য প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি প্রদর্শন রয়েছে এখানে । তেমনি পূর্ব ভারতকেও তুলে আনা হয়েছে ব্যাঙ্গালুরুর পূজামন্ডপে । সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্গালুরু বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজোর থিম 'পুরাতন বাংলার রাজবাড়ীর দুর্গোৎসব' । নর্থ বেঙ্গালুরু কালচারাল সমিতি এ বছর তাঁদের আয়োজিত দুর্গোৎসবের থিম করেছেন ভারতের ধ্রুপদী ইনডোর গেম দাবাকে কেন্দ্র করে দাবার জগৎ ( World Of Chess ) । তাঁরা এবছর সমস্ত গ্র্যান্ড মাস্টারদের স্মরণ করতে চাইছেন । এই পুজোর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দাবার ৬৪ ঘর বা ঘুঁটির সঙ্গে শক্তির ৬৪ রূপ, মায়ের ৬৪ যোগিনীর সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাইছেন । তারা বলতে চাইছেন দাবা শক্তিরই অভিন্ন রূপ ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজা ( ২ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্পুগাজো ( ২ )

ছেলে এবং বৌমা আজ আমাদের নিয়ে বেরুল ব্যঙ্গালোরে পুজো দেখার জন্যে । আজ দেখলাম দুটো পুজো । আরটিনগর সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন এবং হোয়াইট ফিল্ডের পিবিসিএতে  ( Purba Cultural Association ) । ব্যাঙ্গালোরে এবার ছোটো বড়ো মিলে পুজো হচ্ছে ২৭২ টির মতো । পুজো মন্ডপগুলো অনেক দূরে দূরে । তাই শরীরের উপর চোট না দিয়ে বড়ো শ্রীমান তার গাড়ি নিয়ে যে কয়টা পুজো পারে দেখাবে ।

এখানকার পুজোতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো প্রবল উন্মাদনা না থাকলেও আন্তরিকতা ও একতা আছে । লক্ষ্যণীয় দুএকটি বিষয়ের মধ্যে  আরটিনগরের পুজোতে দেখলাম ঢালাও ভরপেট খাবারের আয়োজন । খাবারে ছিল ফ্রায়েড রাইস, লুচি, ছোলার ডাল, কাশ্মীরী আলুর দম,চাটনি ও মিস্টি । প্রতিমা সুন্দর । থিমও আকর্ষণীয় । মনে রাখার মতো ব্যাপার হল বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য প্রসাদ গ্রহণের আলাদা লাইন, বিশ্রামের বিশেষ ব্যবস্থা নজর কেড়েছে । 

ব্যাঙ্গালোরের পুজো কেবলমাত্র ভক্তি, শ্রদ্ধা, উৎসব আর আনন্দ নয় । বিনোদনের পাশাপাশি বিপননও জমজমাট । বিশাল জায়গা জুড়ে পুজো মন্ডপ । প্রায় প্রতিটি মন্ডপেই রয়েছে । নানারকমের খাবারের দোকান, কাপড়ের বিশাল সম্ভার, ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স, হাউজিং নির্মান সংস্থার প্রতিনিধিরা, ঘরগেরস্থালির সামগ্রীর দোকান, শিশুদের খেলনার দোকান, তাদের বিনোদনের দোলনা, টয়ট্রেন, ইত্যাদি মিলিয়ে এককথায় ছোটদের বিনোদনের ব্যবস্থাসহ একটা ছোটোখাটো মেলার মতো এলাহি ব্যবস্থাপনা ।  এসবের প্রতিনিধিরা মেলায় স্টল খুলে ব্যবসা করার জন্যে স্পনশরশিপ নিতে হয় । তার জন্যে পুজো কমিটিকে ভালো টাকা দিতে হয় । এটাই পুজো কমিটির একটা বড়ো আয় । সদস্য চাঁদা ছাড়া এই আয় দিয়েই তাদের পুজোর খরচাপাতি, সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান, জনকল্যাণমূলক কাজকর্মসহ সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে যায় । আমাদের অঞ্চলের মতো চাঁদাবাজির দুর্নাম কুড়োতে হয়না । আমাদের অঞ্চলের পুজোতেও এই পদক্ষেপ অনায়াসেই নেওয়া যায় । আইডিয়াটা দারুণ । আজ এটুকুই । সবাইকে শারদ শুভেচ্ছা‌।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজো ( ১ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজো ( ১ )

প্রাচীন ভারতে দেবীপূজার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকেও দেবী পূজার বহু প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । মহীশূরের চামিন্ডা পাহাড়ে অবস্থিত চামুন্ডেশ্বরী মন্দির অন্যতম শক্তিপীঠ । দেবী এখানে মহিষাসুর বধরতা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গারূপে বিরাজিতা । কিংবদন্তি অনুযায়ী মহিষাসুর মহীশূর রাজ্যের রাজা ছিলেন মহীশূর নামটি এসেছে প্রাচীন কন্নড় শব্দ  মহীশূরু থেকে । 'মহীশূরু' শব্দের অর্থ মহিষাসুরের গ্রাম । বহু শতাব্দী ধরে দেবী চামুন্ডেশ্বরী মহীশূর রাজ্যের রক্ষাকর্ত্রী দেবী  হিসেবে পূজা পেয়ে আসছেন। এই দেবী চামুন্ডা মহাশক্তির ভয়াল রূপ । তিনি অতি ভীষণা ও শক্তিশালী দেবী । তিনি আদ্যাশক্তি বা সর্বপ্রথম সৃষ্টিকর্তা নারীত্বের প্রতীক । তাঁকে মহাদেবী দুর্গার এক রূপ হিসেবে গণ্য করা হয় । আবার তিনি মা কালীর অবতার রূপেও পূজিতা । কথিত আছে, চন্ড ও মুন্ড নামে দুই দুর্ধর্ষ অসুরকে বধ করার ফলে তিনি 'চামুন্ডা' নামে পরিচিত । আবার মহিষাসুরকে নিধন করার জন্যে তিনিই আবার 'মহিষাসুরমর্দিনী'। তিনি চামুণ্ডা, চামুন্ডী, চামুন্ডেশ্বরী ও চর্চিকা নামেও পরিচিতা । হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন–এই তিন ধর্মেই তাঁর ভিন্ন ভিন্ন রূপে পূজা প্রচলিত আছে । চামুন্ডা দেবী তান্ত্রিক শক্তিরও গূঢ় আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক । মৃত্যু ধ্বংস, জরা ও অসুস্থতার দেবী রূপেও তিনি পূজিত হন । অন্যদিকে তিনি প্রতিকূলতা, অন্ধকার ও দুষ্টশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়েরও প্রতীক।

চামুন্ডা অত্যন্ত প্রাচীন মাতৃকা । সিন্ধুসভ্যতায় প্রাপ্ত প্রত্নফলক অনুযায়ী, একজন বৃক্ষবাসিনী মাতৃকার সামনে ছাগবলি হত। সেই বলি গ্রহণ করতে সপ্তমাতৃকা উপস্থিত থাকতেন । এই সপ্তমাতৃকার  অন্যতম ছিলেন চামুন্ডা । প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার অবসানের দীর্ঘ আড়াই হাজার পরে পৌরাণিক যুগেও দেবী চামুন্ডা সপ্তমাতৃকার একজন হিসাবে পূজিতা হতে দেখা যায় । বর্তমান সময়ের দুর্গাপূজায়ও নবপত্রিকার নব আভরণের অন্যতম মানপত্রে বা মানকচুতে দেবী চামুন্ডার আধিষ্ঠান কল্পিত হয় ।

দুর্গাপূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী দুর্গা চামুন্ডা রূপে আবির্ভূতা হন । এই ক্ষণটাই মহাশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ । সন্ধিপূজার সময় দেবীকে নিবেদন করা হয় ১০৮ টি পদ্ম ও ১০৮ টি প্রদীপ । পদ্ম ভক্তির প্রতীক । দীপ জ্ঞানের প্রতীক । এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় নৈবেদ্যের থালা, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপাচার, সবচেয়ে গভীর আরাধনা সবই নিবেদিত হয় দেবীর চরণে । এই ক্ষণে দেবীর প্রণাম মন্ত্র–

ওঁ দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালা বিভূষণে ।
চামুন্ডে মুন্ডমথনে নারায়ণী নমোহস্তু তে ।
দেবী চামুন্ডা তথা মহিষাসুরমর্দিনীকে কেন্দ্র করে মহীশূরসহ সমগ্র কর্ণাটকে নবরাত্রি ও দশেরা উপলক্ষ্যে উৎসব পালিত হয় ।

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালি হিন্দুদের প্রধানতম উৎসব ও শ্রেষ্ঠ পূজা হল দুর্গাপূজা । পুরাণ শাস্ত্রকারদের মতে দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া, উমা, চন্ডী, ভগবতী, ভবানী, অম্বিকা, পার্বতী, শিবানী, কাত্যায়নী, মহিষাসুরমর্দিনী, অদ্রিজা প্রভৃতি বহু নামে পরিচিত ও পূজিত হন । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবী ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও দেবী দুর্গার কাহিনী ও লীলা বর্ণনা সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় ।

দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে শুধু দেবীআরাধনেই নয় । এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব । এর মধ্যে যেমন আছে পৌরাণিক বিশ্বাস, মিথ তেমনি রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি, লোকাচার ও সামাজিকতার গভীর মেলবন্ধন । সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির জীবনে উৎসব এবং শ্রেষ্ঠতম পূজা হিসেবে দুর্গাপূজার প্রচলন রয়েছে । বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা । দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরী মল্ল রাজবংশের কুলদেবী । মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন । মল্লরাজবাড়ীর পূজায় দেবীপটের যে ব্যবহার দেখা যায় তা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির । বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না ।

 দুর্গাপূজার সূচনা কাল নিয়ে বহু মত থাকলেও বাংলায় ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রথম পূজা শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন । ১৫৮২ সালে রাজশাহীর তাহেরপুরের জমিদার বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম কংসনারায়ণ রায় তাঁর মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে মার্কন্ডেয় পুরাণের দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন । তিনি সেসময়ে দুর্গাপূজায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন বলে জানা যায় । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব রবার্ট ক্লাইভ এর সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন । সেকালে পূজা ও অনুষ্ঠানে বিপুল অর্থ ব্যয় হত বলে প্রথম দিকে মূলত রাজরাজড়া ও জমিদারদের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন সীমাবদ্ধ ছিল । ধীরে ধীরে বাঙালি জমিদারদের মধ্যে এই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয় ।

 সাম্প্রতিককালে প্রচলিত দুর্গাপূজা দুই ভাবে হয়ে থাকে । ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক কাঠামোতে যেখানে পূজার শাস্ত্রীয় বিধান নিয়মনিষ্ঠা অধিক পালন করা হয় । এবং বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে এলাকায় ভিত্তিক দুর্গোৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে । ১৭৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করে । ১২ ইয়ার বা ১২ বন্ধুর পূজা নামে পরিচিত এই পূজা একসময় বারোয়ারী নামে প্রতিষ্ঠা পায় । ১৮৩২ সালে কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ বারো ইয়ারের এই পূজা পদ্ধতি কলকাতা শুরু করেন । পরবর্তীতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বারোইয়ারী পূজা । ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মীয় উৎসাহিণী সভা, ভবানীপুর বলরাম বসু ঘাট লেনে, রামধন মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে বারোয়ারী পূজা হয় । অনেকের মতে একদিন দুর্গোৎসবের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে অস্তমিত করার উৎসব পালিত হয়েছিল । আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়  ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোসের দুর্গোৎসবে । তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গাপূজার উৎসবে আমন্ত্রণ জানান । স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গা পূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । কবি নজরুলের 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা এবং বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম' সংগীত যার গুরুত্ব অপরিসীম । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম গানটি দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই রচনা করেছিলেন যা একসময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল ।

 শরৎকালে যে দুর্গাপূজা হয় সেক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনি বা রীতি রেওয়াজ থাকলেও বাঙালি জনজীবনে তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ । সেকালের বাঙালিজীবনের ক্ষেত্রে দেখা যেত, এই সময়টা ফসল তোলার প্রাকমুহূর্তের অবসরকাল । মাঝে মাঝে তখন সবুজ ধানের ক্ষেতে ফসলের পুষ্টতা এসেছে । প্রকৃতি ও অপরূপ সাজে সজ্জিত । নীল আকাশে হালকা হালকা সাদা মেঘের আনাগোনা । নদীর চড়ায় বালির স্তুপে কাশফুলের দোলা । ইত্যাদি মিলে প্রকৃতি তার বর্ষণঋতু অতিক্রম করছে । এই সময় শ্রমজীবী মানুষের বিশ্রামের মধ্যে কিছুটা বিনোদনের উৎস খুঁজে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে । সেই হিসেবে শরৎঋতুর এই দুর্গোৎসব বাঙালির জীবনের অবসরের শূন্যতাকে পূরণ করে ।

দুর্গাপূজার শুরুর কাল থেকেই এই পূজার মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ছিল । সেকালে এই পূজা উপলক্ষে সাধারণ জনগণ এবং রাজা ও জমিদারবর্গের পরিবারের সদস্যরা কাছাকাছি আসার সুযোগ পেত । দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে বিরাজ করা ভীতি ও দূরত্ব তখন অপসারিত হয়ে যেত । সেকালে বাঙালি জীবনে সামাজিক সম্প্রীতির সূচনার ক্ষেত্রে দুর্গাপূজার মুখ্য ভূমিকা ছিল । অর্থনৈতিক কারণে দুর্গাপূজা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।
সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতি না থাকলেও বিভিন্নভাবে তারা তাদের বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে দুর্গাপূজার বিশাল কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়ার সুযোগ ছিল । প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপসজ্জা ইত্যাদিতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতেন । সেকালের দুর্গাপূজা ছিল মূলত পরিবারের সম্প্রদায়ের ও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে সম্মিলিত আয়োজন । গ্রামের জমিদার এবং অভিজাত সম্প্রদায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে তার প্রজাদের উদার আহ্বান জানাতেন এই বিরাট কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য । ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গ্রামের জমিদার ও বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিত্বের বাড়িতে লোকসমাগম হত । গ্রামের দুর্গাপুজায় কয়েকদিন ধরে পুজামণ্ডপে ঢোলের বাজনা, আরতি, শঙ্খ, উলুধ্বনি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা ইত্যাদিতে মুখরিত থাকত । এছাড়াও সেই পূজাকে কেন্দ্র করে কীর্তন, রামায়ণ গান, যাত্রাপালা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকত । এইসব বিনোদনমূলক আয়োজন গ্রামীণ সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখত । দেবী দুর্গার পূজায় যেমন আছে ভক্তি ও পৌরাণিক তাৎপর্য তেমনি আছে লৌকিক আনন্দ, সামাজিক ঐক্য ও মানবিক সহমর্মিতা এবং সেবার বহুমুখী দিক । দেবী দুর্গা যেন গ্রাম বাংলারই কোন গৃহস্থ পরিবারের কন্যা যাকে দূর দেশে বিবাহ দেওয়া হয়েছে । এই ঘরের মেয়ে পূজার সময় সন্তান-সন্ততি সহ শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে যান । দশমীতে সকলকে কাঁদিয়ে মেয়ে আবার কৈলাসে তার স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসেন । গ্রামীন সংস্কৃতিতে পূজার কয়েক দিন বিবাহিতা কন্যাকে বাপের বাড়িতে নাইওর আনার রীতি রেওয়াজ এখনও রয়েছে । প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, মা দুর্গার চালচিত্রের যে বর্তমান রূপ সেখানে দেবী তার চার সন্তান–লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশসহ বিরাজমান । এর মধ্য দিয়েও দেবীপ্রতিমায় এক পারিবারিক রূপের প্রকাশ ঘটে । এই পূজার আনন্দেরই অঙ্গ হিসেবে দশমীর দিন গৃহস্থ ঘরে ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করার রীতিও রয়েছে । সংবৎসরের পরিশ্রমী কৃষিজীবী মানুষ কাজের তাড়ায় ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ পান না বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য আসেনা । পুজোর এই কয়দিন আনন্দের ফাঁকে তাঁরা রসনার তৃপ্তি করে থাকেন এই উৎসবের মাধ্যমে । গ্রামের পূজোয় দেবীর পূজারমন্ডপ তৈরি, প্রতিমানির্মাণ থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই গ্রামের সমস্ত মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্পন্ন করে থাকেন ।

শহরের দুর্গাপূজা অনেক বেশি আধুনিক এবং ব্যয়বহুল । সেখানে দুর্গাপূজায় থিমভিত্তিক প্যান্ডেল, আলো ও প্রতিমার চমকপ্রদ উপস্থাপনা লক্ষ্য করা যায় । প্রতিমানির্মানে ও মন্ডপসজ্জায় যেমন সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকে তেমনি সামাজিক বার্তা ও সমসাময়িক বিষয়ও উঠে আসে । দেবী দুর্গা এখানে শুধু মহিষমর্দিনী, অসুর বিনাশিনী নন । তিনি নারীশক্তির প্রতীক । সমাজের অন্যায়, অবিচার, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেও উপস্থাপিত হন । পূজা-ভাবনা বা দেবীভাবনার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বাঙালির চিন্তাভাবনার বিবর্তনের সুকুমার দিকটাকে তুলে ধরে । আজকের দিনের দুর্গাপূজায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিশুদের মধ্যে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, সমাজ সচেতনতামূলক সিনেমা প্রদর্শনী ও নানারকম সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় । এর মাধ্যমে পূজায় ধর্মীয় দিকটা পালনের পাশাপাশি বিনোদনের ক্ষেত্রেও আজকের দিনে গুরুত্ব দেওয়া হয় । বর্তমান সময়ে দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণে রক্তদান শিবির, বস্ত্র দান, দুস্থ শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণসামগ্রী বিতরণ, স্বাস্থ্যপরীক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্গাপূজাকে আরো বেশি করে মানবসেবার উৎসব হিসেবেও পরিগণিত করার প্রয়াস নেওয়া হয় । দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা, বইমেলা, শারদসংখ্যা প্রকাশ আজকের দিনের নিয়মিত চর্চার বিষয় । পূজার সময় বিভিন্ন পূজা কমিটি শারদোৎসব উপলক্ষে বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করে থাকেন । তাতে পাড়ার খুদে লেখকলেখিকা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখালেখি প্রকাশ করার একটা সুযোগ থাকে । পূজাকে কেন্দ্র করে  সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার আবহ সৃষ্টির এই দিকটিও অনেক মূল্যবান ।

দেবীপূজা বা দেবীভাবনার এই বিবর্তনকে লক্ষ্য করলে দেখি যে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে । দুর্গাপূজা আজ শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালিরা আছেন সেখানেই তা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে । ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠীর হাতেই দেবী পূজার প্রচলন হয় হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য ও বিস্তৃত হয় । মাতৃ তান্ত্রিক দ্রাবিড় সভ্যতায় বিভিন্ন মাতৃ দেবীর পূজার প্রচলন ছিল । তারই ক্রম বিবর্তন আজকের দুর্গোৎসব । অতীত ও বর্তমানের দুর্গাপূজার মধ্যে বেশ কিছু ফারাক থাকলেও তার মূল স্রোত কিন্তু একই ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের বিবর্তন দুর্গাপূজার রূপকে বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত করছে এবং নতুন ভাবে উপস্থাপন করছে । দেবীপূজার পাশাপাশি বাঙালির মননেও চিন্তা ভাবনায় নানা কল্যাণকর ভাবনা যে রূপ পাচ্ছে এবং তা নতুন নতুন ভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে সেটাই হল পূজার আধুনিকতা । দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে এক চিরন্তন উৎসব যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে চলছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে । ফলে দুর্গাপূজা শুধুমাত্র দেবী আরাধনা নয় নানাবিধ নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুর্গাপূজা মানবসেবার উৎসবে পরিণত হচ্ছে এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে আলো ঝলমলে শহরে প্যান্ডেলের সর্বত্রই দুর্গাপূজা একতা ও সম্প্রীতির বাণী প্রকাশ করছে ।