Showing posts with label মুক্তগদ‍্য. Show all posts
Showing posts with label মুক্তগদ‍্য. Show all posts

Wednesday, October 12, 2022

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বড় রহস্যময় শব্দের শিল্প । কবিতা তো শব্দের চারুরাগ । চেতনার অন্তর্লীন বিস্ময়ভুবন । হৃদয়ের মসলিন শিল্প। হাজার আলোকবর্ষ থেকে ভেসে আসা শব্দের নিজস্ব স্রোত ।অসীম অনন্ত লোক থেকে সুরেলা আওয়াজ তুলে আসে শব্দ । আসে ঢেউ তুলে তুলে । ভেসে এসে বসে যায় জীবনের আখড়ায় । বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সব জোট বাঁধে । অশরীরী কে একজন অলক্ষ‍্যে থেকে এগিয়ে দেন শব্দমালাকে ।

 পারিজাত গন্ধ নিয়ে শব্দের পরিব্রাজন । শব্দ বসে বসে কথা হয় । সে কথায় থাকে অদ্ভুত মোহময়তা । সম্মোহনজালিকা । শব্দের গাঁথুনিতে যে কথার নির্মাণ তা হয়ে ওঠে নশ্বরতাহীন দৈবী টংকার । জীবনের মৃদঙ্গে আওয়াজ তুলে শব্দ জেগে ওঠে মুগ্ধ নয়নে । কুয়াশার বলিরেখা ভেদ করে জেগে ওঠে আলোর নির্ঝর । এক একটা চিত্র ভাষ্য স্পষ্ট হয় কাগজের বুকে কালো অক্ষরের স্বপ্নসন্ধানে । অন্তরেখ মায়া নদী বাঁক নেয় অবচেতনের পলিতে । 

আত্মউৎস খুঁজে নেবার জন্য আধিপথের দিকে ধায় মাধুকরী । পথের শুরুরও খোঁজ করতে হয় । সেখানে আলো জ্বলে । অতীতের দূমহলে ঘর তার । মাঠ পেরুলে পাথার । পাথারের নাম তেপান্তর । তেপান্তরের পরে আসে রূপকথার নদী ও সমুদ্র । সেসব অতিক্রমণের সাথে সাথে হারিয়ে যায় চেনা পথ । পুরনো দিগন্তের পরিচয় । আদ্যরশ্মির রেখা । 

পরিচয় এর জন্যই উল্টোসাধন । আলোদলিলের সন্ধান কর্ম তুলে দেয় শৈশবের শিস । ক্রমাগত অন্ধকারের মধ্যে পর্যটন শেষে আদিবীজ ভেসে ওঠে ফসিল স্তুপের ভেতর ।  সে বীজ হাতে নিলে দেখা যায় উজ্জ্বল সূর্যোদয় । ফিনকি দিয়ে ছোটা রশ্মিরেখার আকাশ আলোকিত । সে আকাশ থেকে পরিচিত নির্যাস ভাসে বাতাসে । আকাশমুক্ত বলেই তার গায়ে মৃগগন্ধ লেগে থাকে ‌ আকাশ স্বাধীন হতে শেখায় । ডানার কৌশল জানে আকাশ । নির্মিত ডানার বুনন আকাশের গোপন বিদ্যা । নির্মাণ শেষে বীজমন্ত্র দিয়ে দেয় মুক্তির । কুয়াশার চাদর থাকে না । থাকে ভ্রমণকথা । আলোর বিম্বে স্পষ্ট হয় ডানার ভেতরের রক্তের চলাচল ।  হাওয়ায় ভাসমান ডানায় সচল হয় শোণিতের কার্যক্রম।

শোণিতেরর তৎপরতার ভেতর নির্মাণ হয় দৃশ্যের মানচিত্র । সত্তার আনন্দবোধ কিংবা বেদনাবেহাগ ।শোণিতের চলমান বিন্দুও শব্দ হয় । জীবনের প্রহেলিকাকে যন্ত্রণার রূপ দেয় । যন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি নেয় বিষাদবিগ্রহ । সে বিষাদের অর্চনা করতে করতে জীবনের সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় হয় । সৌন্দর্য বিস্মিত করে স্রষ্টাকে । সৌন্দর্যের অপার আলোর বিভার ভেতর দেখা যায় কাব্যপ্রতিমাকে । তাকে ঘিরে জ্যোতির বলয় । কবি তার আত্মাকে নিয়ে বসায় সে বলয়ে । কবি তখন হাসে আপন মনে । আপন নির্মাণখেয়ালে । কবিতার দীপান্বিতায় কবির স্নান হয়।

Friday, March 4, 2022

কবিতা অস্ত‍্যর্থক চেতনার মন্ত্র

কবিতা অস্ত‍্যর্থক চেতনার মন্ত্র



'মন রে কৃষিকাজ জানো না । এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা'– লোককবির অনুভব থেকে যে বার্তা এসেছে সেটাই সৃষ্টির প্রেরণা । কবিতা বা কাব্য অনুভূতি প্রতিটা মানুষের মননের গর্ভের অভ্যন্তরে নিহিত আছে । যে কোনো ধরনের শিল্প জীবন প্রবাহের মর্মমূলে যুক্ত থাকে তাকে নিরলস চর্চা এবং আয়াশ সাধ্য অভ‍্যাসের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি কে জাগিয়ে তুলতে হয় । এই যে মানবজমিন আবাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা মূলত মানবমনের গভীরে নিহিত সৃষ্টি পটভূমি । অনন্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেভাবে জমিকে ফসলের উপযোগী করে তোলা হয় ঠিক তেমনি মানুষের চিত্তভূমিকেও কর্ষণ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল করে তুলতে হয় । জীবন কর্ষণই হলো সৃষ্টির প্রয়াস । একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে কর্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তার সৃষ্টিকে মূর্তরূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয় । এভাবে  সৃষ্ট শিল্প ও সাহিত্য যখন পাঠকের মনে রস ও আনন্দ সৃষ্টি করে তখনই সেই সৃষ্টি সার্থক হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হয় । শিল্প প্রকাশেরও বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে । কবিতা তেমনি একটা মাধ্যম । একজন শিল্পী তার জীবন অভিজ্ঞতা কে আবহমান পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে শ্রম করে সেই শ্রমের ফসল হলো সাহিত্য । সাহিত্য রূপায়িত হয় অক্ষরের মাধ্যমে । অক্ষর শিল্প সাহিত্যের উপাদান । সাহিত্যের একটা ধারা কবিতা । স্বপ্ন ও কল্পনা, ধ‍্যান ও মননের জগত পরিশীলিত হয় যে প্রক্রিয়ায় তাকে প্রকাশ করার বিশেষ মাধ্যম হলো কবিতা ।

কবিতা বলি আর কথাসাহিত্যই বলি, দুই ক্ষেত্রেই সময়ের চিত্র এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তিসত্তার ভেতরে বিভিন্ন পরিবর্তন, অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট অথবা ইঙ্গিতে প্রকাশিত হয় । যদিও একই সময় বৃত্তের মধ্যে থেকে দুই সৃষ্টিই হয় তবুও এই দুটি মাধ্যমের নির্মাণশৈলী একেবারেই আলাদা । কথাসাহিত‍্যে সহজ গদ‍্যে শব্দ ব‍্যবহারের মধ‍্য দিয়ে জীবনবর্ণনায় উঠে সে সময় ও মানুষ । এখানে কিছুটা তথ্য থাকে আর কিছুটা কল্পনা । আর কথাসাহিত্যের  ভাষা বহুবিস্তৃত হলেও সর্বজনবোধ‍্য হয়ে থাকে । কিন্তু কিন্তু কবিতার শব্দ ব্যবহার শব্দকে পেরিয়ে তার কথকতা ভাষা ও ইশারা এক গভীর বাচনের সৃষ্টি করে ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথামালার ভাবনাবলয় সৃষ্টি হয় কবিতায় । শব্দের ভেতরের নৈঃশব্দ‍্যকে ভাব-ভাষা ও ইশারায় প্রকাশ করেন কবি । তার সৃজনপ্রক্রিয়ায় শব্দের ভেতরে ও বাহিরে যে গভীর অর্থ থাকে, গভীর বোধ থাকে, ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত একটা সম্পর্ক থাকে সেটাকে প্রকাশ করেন কবি । কথাসাহিত‍্যে যেমন বাহ‍্যিক বহুমাতৃক ও বহুবিচিত্র গতি থাকে । কবিতা তেমন নয় । কবিতা তার অন্তর্মন্ডলের পরিসরে স্বনির্মিত পরিসরে চেতনার বিপুলবিশ্বকে উন্মোচিত করেন  । সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন রেখার উপর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত গদ্য যে ছবি আঁকে গোটাকয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের জাদু সেই ছবিতে ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে । কাব্যের এই  মরমি ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীক এর সাহায্যে । শব্দ মাত্রেরই দুটো দিক আছে ; একটা তার অর্থের দিক,  অন্যটা তার রসপ্রতিপত্তির দিক । গদ‍্যের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক এই প্রথম দিকটার খাতিরে । গদ‍্যে শব্দগুলো চিন্তার আধার । কিন্তু কাব্য শব্দের শরণ নেয় ওই দ্বিতীয় গুণের লোভে;  কাব্যের শব্দ আবেগবাহী' । কবি এইশব্দ কে সাথে করে নিয়ে কাব্যের মরমী স্মৃতিতে পৌঁছার প্রয়াস নেন কিন্তু তাই বলে শব্দের অনুশাসন সর্বক্ষণ মেনে কবিতাকে নির্ধারিত শাসনে সর্বক্ষণ বেঁধে রাখার অভিলাসী হননা কবি । কবিতার পথে কবির সিদ্ধি আসে অবিরাম শব্দের উপত‍্যকায় নিরবচ্ছিন্ন শব্দের শোভাযাত্রায় ও তার সৃজনপথে রেখার পর রেখা এঁকে এগিয়ে যাওয়ার পদনিক্কনে । এই পর্যায়ে কবিতার স্তরের পর স্তরে চলে ধ্বনিবহুল শব্দের কারুকার্য । দৃশ্যের পর দৃশ্য যুক্ত হয়ে চিত্রময়তার নির্মান হয়, চিত্রের স্পর্শে ধ্বনিময় মাধুর্য সৃষ্টি করে । কবির বয়ান হল নৈশব্দের বয়ান ।

জীবনবীক্ষণেরর পরিশীলিত ফসল কবিতা । জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তার বহুবর্ণিল বিচ্ছুরণকে গ্রহণ করা যে অপার আনন্দ, সেই আনন্দের মধ্যে গভীর প্রেরণাবোধের মহল নির্মাণ হয় । অনুভবে থেকে যায় আবিষ্কারের উৎসবিন্দু । নবীন প্রেরণা থেকে অপার বিস্ময়ের মনোভূমি জেগে ওঠে অদ্ভুত নান্দনিকতায় । মনোভূমির সৃজনক্ষেত্রে বিশ্লিষ্ট হয় বাগ্ বন্ধ থেকে শব্দ, শব্দ থেকে অক্ষর, অক্ষর থেকে ধ্বনি, শব্দের ধ্বনিতরঙ্গে চিত্রের বর্ণময়তায় বাক‍্যবন্ধ নিবিড় স্পর্শময় হয়ে ওঠে । ধ্বনি থেকে অনুভব । এই অনুভবকে প্রিয়সৃজন হিসেবে  কবির অন্তর গ্রহণ করে । ‌ এই গ্রহণে কবির অন্তরে জাগে অপত‍্যবোধ ।আপন কবিতা লালনের যে তৃপ্তি তা কবি ছাড়া অন‍্যের বোধগম‍্য নয় । কবি তাঁর কবিতায় আশ্চর্যসৌষ্ঠব আনেন । তাঁর কবিতার ভাববস্তু ও আঙ্গিক সংকেতপ্রবণ শব্দে সাজিয়ে তোলেন । তখনই কবিতা হয়ে ওঠে সংকেতের শিল্প  । জীবনগূঢ়তার সূচনাবিন্দু । সেই বিন্দু থেকে চেতনা বলয় প্রতিভাত হতে থাকে । জীবনকে মহৎজীবনে উৎক্রমণের প্রয়াস নিরলস চলতে থাকে কবির কলমে । নতুন নতুন শব্দের সন্নিবেশে নান্দনিক নির্মাণই কবির সাধমন্ডল । নতুন শৈলীতে, নতুন প্রকৌশলে ব‍্যতিক্রমী গ্রন্থনায় কবিতাকে পৌঁছে দিতে হয় পাঠকের প্রাঙ্গনে । নবীন উচ্চারণের মিলিত প্রয়াসে আশ্চর্য নবীন বার্তা পৌঁছে যায় উৎসুক পাঠকের দরবারে ।

কবিকে চিহ্নিত করে কবিতানির্মানে কবির শব্দপ্রীতি ও ব্যঞ্জনা । শব্দকে   কবিতায় ব‍্যবহারের সেই প্রকৌশলে  শব্দচয়নের নতুনত্ব থাকে কিংবা চেনা শব্দকে তিনি নূতনভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন । পাঠক আপ্লুত হন তাঁর শব্দ ব্যবহারে বা শব্দের ব্যঞ্জনায় । সেই শব্দে সৃষ্ট কবিতায় পাঠক কখনো উৎফুল্ল হন । কখনো বেদনা বোধ বা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হন । কখনো তার উত্তরণ ঘটে মৃত্যু চেতনায় । আমাদের পরিপার্শ্বের চেনা অঙ্গনকে অপরূপ রূপে পরিচিত করেন কবি । কবিতার শব্দ চয়নের এবং ব্যঞ্জনায় পাঠকের অন্তরে কবির শব্দবন্ধ স্বপ্ন সৃষ্টি করে । অথবা মায়াবী নদীর তীরে নীল জ্যোৎস্নায় নিয়ে যায় পাঠককে । এক মায়লোকের সন্ধান পান পাঠক ।
 পাঠকও কবিতার মধ্য দিয়ে কবির প্রতি যে একাত্মতার অভিন্নতা অনুভব সৃষ্টি হয়ে যায় সেখানেই কবির জন্য তৈরি হয়ে যায় চিরায়ত স্থান । কবি হৃদয় দিয়ে কবিতার সঙ্গে একাত্ম হন আবার  তাঁর শব্দশৈলীর  মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গেও কবিতার সম্পর্ক তৈরি করেন । স্বাভাবিকভাবেই কবিতা এখানে পাঠক এবং কবির মধ্যে নিবিড়  নৈকট‍্য এনে দেয় । হৃদয়সংবেদে পাঠকের বোধের ভূমিতে পৌঁছায় ।

অনেক ক্ষেত্রেই থাকে প্রশ্নমনস্কতা । কবিতার কথায়ও উঠে আসে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন । কবিতা কি জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা ? জীবন জিজ্ঞাসা ? নাকি জীবন দর্শন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কবিতার অর্থ পাঠকের কাছে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয় ।

 মানুষের জীবন ও প্রকৃতি একই সুরে বাঁধা থাকে । মানুষ ও প্রকৃতির মধ‍্যে কোনো বিভাজন নেই । তা একই মহাশক্তির দুই রূপ । কবির অন্তরের মানবচেতনা তার কবিতার অক্ষরে বিন‍্যস্ত হয়ে বিশ্ববোধ গড়ে তোলে । এই পৃথিবীর চিরপরিচিত মানবসমাজ, গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য, আকাশ, ছায়াপথ, নীহারিকা, গাছপালা, বৃষ্টি, ঝড়, নদী-প্রান্তর, পাহাড
পর্বত, জলপ্রপাত, চাঁদ, ফুল, জল,পশু-পাখি এমনকি ক্ষুদ্রতম ঘাসের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন এবং তার মধ্য দিয়েই কবি প্রকৃতির সান্নিধ‍্যে সৌন্দর্য,মাধুর্য,প্রশান্তি ও মুগ্ধতার বোধের অনুভব করেন । জগৎ, জীবন ও প্রকৃতির মিলিত উৎসার ঘটে বিশ্ববোধে । রবীন্দ্রনাথ এই মহাবিশ্বের মহাকালের এই অখন্ড সত্তার মধ‍্যে ডুব দিয়েছেন । কবির প্রধান প্রকরণ হল তাঁর সমৃদ্ধ মানসলোকের পরিক্রমণদক্ষতা । মানসপথ ধরে কবি তাঁর কল্পনার বিস্তার ঘটান । দৃশ্য জগৎ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জগত ,প্রত্যক্ষগোচর জগত এবং বস্তুজগৎকে এক করে দেন কল্পনা শক্তির মাধ্যমে পাঠকের কাছে । এই বিস্তৃতির পথেই আসে কবির সাফল‍্য । প্রাচীন কালিদাস কিংবা জয়দেব  মানসভ্রমণে সাফল‍্যের সূত্র ধরে যুগ যুগ ধরে পাঠকের আকর্ষণবিন্দু হয়ে আছেন । রবীন্দ্রনাথও একেই বলছেন মনোভূমি । 'কবি তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ‍্যা চেয়ে সত‍্য জেনো ' ।

কল্পনালোকের পটভূমিতে মানুষ কবিতার মধ্যেই খুঁজে পেতে চায় বিশ্বাসবোধ,  জীবন এবং জীবনযাপনের রসদ । কবিকেও । কবিতা সৌন্দর্যের প্রতীক, শান্তির উপকরণ হয়ে মানুষকে স্নিগ্ধতা দেয় । আজকের এই মূল্যবোধহীন জীবনযাপনেও কবিতা আবহমান মানবতার রূপে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবোধকে দূরে সরিয়ে মানুষের অতৃপ্ত অন্তরে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে ।   কবিতার শরীর বেয়ে মাটির বুকে নেমে আসে । সময়ের প্রবলপ্রবহমানতায় ভ্রাম্যমাণ মানবতা এক যুগ থেকে অপর যুগে অখন্ড ঐক্যে উপনীত হয় । ভেতরের সুপ্ত কল্পনা স্বপ্নের বীজ হয়ে জেগে উঠে কবিতার মধ্যে । কল্পনা নতুনভাবে ব্যবহৃত হয় কবিতায় বাস্তবতার পটভূমি থেকে কতটা দূরে পৌঁছে কল্পনা নিয়ন্ত্রিত হয় তা কবির কারুকার্য এর মধ্যে উপলব্ধি করা যায় । কল্পনাভুবনেরর ভেতরে বেড়ে উঠতে  থাকে জীবনের আবহমান শুদ্ধবোধ । প্রকৃত কল্পনালোকের আলোর রেখা দর্শন পেলে মানুষ নিজের চলার পথকে সহজ করে নিতে পারে ।মানুষ নিজে তার ক্লীবকৈবল্যের প্রাচীর ভেঙে ক্রমশ সময়ের সুনাবিক হয়ে উঠতে পারে । কবি তাঁর কল্পনালোকের শক্তি দিয়ে উত্তরণ ঘটান জীবনের পরম পথে । কল্পনালোকের পথ ধরেই মৃত্যুকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হন কবি । একথা সত্য যে আজকের যুগ যত অগ্রসর হচ্ছে সমস‍্যাও ততই বাড়ছে । সাথে সাথে এও সত্য যে সমস্যা ও সংকট যত তীব্রতর হচ্ছে, কবিতার স্থায়িত্বও বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত । যার অন্তর্সূত্রে মানুষের বিশ্বাসও গভীর হচ্ছে কবির কাছে ।  সেই ভাবেই  উচ্চারিত হয় চেতনার অভিমন্ত্র । সে পথেই পাঠকের মননেও শ্রদ্ধায় নিত্য জাগরিত থাকেন কবি । তাঁর সৃষ্টির অচেনা ঝাঁপি অপরূপ আলোতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে । পাঠকের এখানেই কাঙ্ক্ষিত তৃপ্তি ।
জীবনকে উন্মোচন করে কবিতা ।

 জীবনকে দর্শনের পর্যায়ে নিয়ে যায় কবিতা । দর্শনচিন্তা কাব‍্যকে লাবণ‍্যময় করে তোলে । মানবসত্তার স্বরূপকে খোঁজার নিরন্তর প্রয়াস থাকে কবির ।মানবসত্তা দূরধিগম‍্য । অবিরাম সন্ধানপ্রয়াসের পরও তাকে জানা যায়না । ভাসমান হিমশৈলের মতো তার অধিকাংশই রয়ে যায় অজানা । এই দর্শনচিন্তা থেকেও নির্মান হয় কাব‍্যের শরীর । জীবনের যন্ত্রণার বেদনাবোধে ত্রস্ত হয় মানবিক সত্তা । জীবনের দ্বারপ্রান্ত থেকে মৃত্যুর শূন‍্যমন্ডল, হতাশা, নিত‍্য যন্ত্রণা,বিচ্ছিন্নতা, ক্ষয়, আত্মগ্লানি ও ক্লান্তির তিমির থেকে উঠে দৈবী পরিণতির কাছে আত্মসমর্পণ এবং  মানবিকতার পুনরুজ্জীবন মিলিয়ে বেঁচে থাকার পরম আর্তি একটি কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারে । অনাদিকাল থেকে কবিদের কবিতায় উঠে আসে মৃত‍্যু আর জীবনান্তের বিপরীতে জীবনের উত্তাপ আর বিষাদের মাঝে লুক্কায়িত উজ্জ্বল আলোবিন্দু । স্পন্দমান জীবনকে অনুভব করার নন্দিত সৃজনই কবিতার উপজীব‍্য । কবি চিরকাল তাঁর ধ্বনিময় অলৌকিক স্বরলিপি নির্মানের মাঝে প্রতীক্ষা করে থাকেন ভোরের উজ্জ্বল আলোর জন‍্যে । জীবনের সৌন্দর্যের জন‍্যে । মৃত‍্যুত্তীর্ণ এক  জীবনবোধের জন‍্যে ।

Thursday, February 24, 2022

মায়ালোক হতে ছায়াতরণী

মায়ালোক হতে ছায়াতরণী

বড়ো হাহাকৃত সময় । অস্থির, অবসন্ন, ক্ষীয়মাণ আর  উৎকেন্দ্রিক কাল এখন। চিরঐতিহ্যের শিকড় মূলত্রাণসমেত উৎপাটিত । বিশ্বের উন্মুক্ত আকাশ ঢেকে দিচ্ছে কৃষ্ণবাণিজ্যমাদল । মানুষের চিরায়তচেতনায় দখল নিচ্ছে বাণিজ্যস্বভাব, পণ‍্যকৃষ্টি । মু দ্রাপিপাসু জীবন কাগজের নোটের পিছনে হাওয়ায় ভাসছে দিকচিহ্নহীন । কবির সামনে তাই অনবরত পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যকল্প, চিত্রকল্প । ফলে তাঁর কবিতার অন্তর্প্রকরণ আসছে পরাভাষা । মুদ্রার টংকারের মতো ধাতব নয় এ ভাষা কবির  ভাষা হয়ে যাচ্ছে দূর পাহাড়ের নির্জন নিঃসঙ্গ নির্ঝরের নীরব ধ্বনিনিক্কন । নিরেট সভ‍্যতার জৌলুষকীর্তনের বিপরীতে বাস্তব অথচ বেদনায় আর্ত সত্যসংগীত । কালের কূটবয়নের মধ‍্যেই কবির সামনে মূর্ত কিংবা বিমূর্ত হয় চেতনাতালাশ । 

আত্ম চরাচরের বুকে বেদনার মন্ডল ঘিরে থাকলেও গীতিময় এক আবেশ আজও ব্যাপ্ত বলে প্রত্যাশিত জীবন। কবি তো চারণ । গীতিপ্রাণতার  মধ্য দিয়ে সময়কে চিনে নেন কবি নিজে । এটাকে কালচিহ্ন বলে অভিহিত করে তুলে ধরেন সবার কাছে । গড়ানো জলের মত যে বিসর্পিল গতি সময়ের । তার যে রহস্যময় অগ্রগমন,  তা দেশ ও কালের উপরিতলে পরিদৃশ্যমান নয় । অত্যন্ত গভীর সঞ্চালনশীল প্লেটের মত। যা সমাজকে নিয়ত ধ্বস্ত ও প্রকম্পিত করে  তুলেছে । সময়ের নিভৃত স্পন্দন কবির বোধের রিখটারে ধরা দেয় । কবির কারুকৃষ্টির কৃ্ৎকলা মুর্ত করে এই চিহ্নায়ণের ।  কালের বিস্তীর্ণ ক্ষতদাগ, পথচ‍্যুতি, বিচ্ছিন্নতা, মানবিকতার অবনমন ইত্যাদি কবি ব্যক্ত করেন তার মায়াবাচনে । 

নিস্পৃহা, নির্লিপ্তি অতিক্রম করে কবি তাঁর বয়নকে করে তুলতে চান হৃদয় ও মননের নান্দনিক মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ । কবিতাবস্ত্রের জমিনে রচিত মায়াশিল্প, জাদুভাষা । পরাকথা ও পুরাকথা একাকার হয়ে ছায়ানৌকা ভেসে ওঠে জীবনের বুকে । ছায়াময় চিত্র ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় । ফলে তাঁর কবিতাও হয়ে ওঠে অচেনা অথচ অপরিচিত । ভাষা জানা অথচ ভাব অজ্ঞাত । নির্মাণ পরিচিত অথচ নির্মিতি অজানা । ইন্দ্রিয়ানুভূত কল্পে আসে নতুন নতুন ভাষ‍্য । নতুন বিমিশ্রণ । ভেঙে যায়।বাচনিক শৃঙ্খলা । চিন্তা ও চেতনার জগতে দ্বন্দ্ব চলে অহর্নিশ । সময়ের প্রতিগতিতে সময়ের ভাষ্য হতে গিয়ে কবিতা পড়ে দ্বন্দ্বে । কবি পড়েন দোটানায় । তাঁর কবিতায় ঐতিহ্যানুগত‍্য এবং উৎপাতিত বিচ্ছিন্নতা পাশাপাশি এসে পড়ে । কবি প্রকাশিত হযন দ্বন্দ্বে ও বন্ধনে । এড়ানো সম্ভব হয় না ঐতিহ্যের অস্তিত্বকে । ছাড়াবার উপায় নেই সমকালের অনুষঙ্গকে ।

নির্লিপ্তির মধ্যে কবিতা আসেনা । কবির বাইরের পারিপার্শ্বিকের বৈচিত্র‍্যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কোন আলোড়ন নেই । আসলে তা নয় । পার্শ্বপৃথিবীর ছোট্ট বুদবুদ গভীর ভাবের ঘরে সমুদ্রসমান ঢেউ তোলে । তাঁর অন্তর্লোক তোলপাড় করে । কবির দৃষ্টি গভীরে যায় । শব্দকে কবি নিজের মতো সাজান । অন্তরের নিঃশব্দ ঝড়কে শব্দ দিয়ে অবলোকন করেন । শব্দ ব্যবহৃত হয় কবির অভীপ্সায়, অভিপ্রায়ে । নির্মেদ আর নিরাভরণ শব্দই কবিতায় হয় আভরণ । কলমে বিন্যস্ত হয়ে শব্দকুল সাংকেতিক হয়ে ওঠে । চাটুকারচর্চিত সমকালীন জগতে সাংকেতিক ভাষা ।  শব্দ তার গড্ডালিকারেখা অতিক্রম করে এবং চিরায়ত বৃত্তের দিকে অগ্রসর হয় । শূন‍্যতা ও আঁধারঘেরা কালখন্ডে জাগে সংকেতীশব্দখচিত কবিতার আকাশ । ভাসে কবির কবিতার অতলান্তিক রহস্যের কূটইঙ্গিত ।

কবিতা কর্ম এখন চারুখননক্রিয়া । বস্তুর পরিমণ্ডল থেকে পরাবস্তুর দিকে এগিয়ে যাওয়া । সেই পরাবস্তুর পথ অবচেতনলোকে কাল বদলাচ্ছে । বিজ্ঞান এসে বদলে দিচ্ছে কবির নান্দনিক অভিলোকন । যেমন চাঁদ কবির চেতনায় সুদূরের সৌন্দর্য । বিজ্ঞান ভেঙে দিচ্ছে সেই সৌন্দর্য । সত্যকে উদঘাটিত করে সে খুলে ফেলছে চাঁদের সৌন্দর্যসম্ভার । নির্মম হলেও মহাজাগতিক সত‍্যই এখানে প্রকাশিত হচ্ছে । ফলে থমকে যায় কবিতার নন্দনচেতনা । 'আট কুঠুরি নয় দরোজা'র মানবশরীর নিয়ে কবির অবিরাম খেলা । লোকায়তনন্দনে অভিলোকিত হয় এই খাঁচা । আর বিজ্ঞান দেহতাত্ত্বিক নশ্বরতার সত্যকে তোলার পাশাপাশি কাঠামোর বীভৎসতাও প্রকাশ করছে । তাহলে, কবিকে তো নতুন পথ নিতে হবে । নতুন সত্যসন্ধান করতে হবে । চাঁদের বিজ্ঞানবাস্তবতাকে অতিক্রম করে কবিকে যেতে হবে পরাবাস্তবতার পথে । শরীর কাঠামোর বস্তুজগৎ পেরিয়ে যেতে হবে হাড়ের অন্তর্লীন সৌন্দর্য আহরণের খনন তৎপরতায় ‌। হাড়ের তো বয়নশৃঙ্খলা আছে । আরো আরো সত্য আহরণের জন্য কবিতাভিযান অব্যাহত থাকবে কবির চর্চায় ।

সত্য নিয়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাওয়া কবির কাজ নয় । কাজ নয় অস্বীকার করাও । কবি শুধু খনিশ্রমিকের মত চেতন থেকে অবচেতন, বাস্তব থেকে পরাবাস্তব, অভিবাস্তবের খনিপ্রকোষ্ঠে বিচরণ করবেন । কলমগাঁইতিতে তুলে আনবেন সত্যঅতিক্রমী অভিসত‍্যকে । এ কাজে কবির যে জগৎ তৈরি হবে তাই মায়ালোক । এই আলোকিত অন্ধকারে ছায়াডিঙা বেয়ে কবি ভেসে বেড়াবেন । ভাসাবেন নিজেকে । কবি জানবেন নতুন করে 'আমি'কে । স্বীয় ও বিশ্ব সত্তাকে । জানবেন 'তুমি'কে । অনাদি অনন্তকে । এভাবেই কবি প্রতিনিয়ত নবীন হবেন । কবিতাও হবে নিত্যনতুন । কবিকার্যক্রম থেমে থাকবে না । কবিও গতিশীল হবেন । দৃষ্টিতে, নন্দনে । আহরণে ও সৃজনে ।

Sunday, February 6, 2022

সহস্র বরষার উন্মাদনার মন্ত্র

সহস্র বরষার উন্মাদনার মন্ত্র

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মানবিকতা হল মানুষের আচরণের এক সুন্দর প্রকাশ যা মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যকে সমৃদ্ধ করে । মনুষ্যসৃষ্ট সমাজ কাঠামোর কারণে এবং প্রকৃতিসৃষ্ট কারণে সমাজে বৃহৎ একশ্রেণির মানুষ দুস্থ ও অসহায় হয়ে পড়েন । সেই অসহায় মানুষজনের বেদনাদায়ক আর্তিতে বিচলিত হন কিছু মানুষ । কিছু মানুষ সুযোগ নেন মানুষের অসহায়তার । নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগ-ব‍্যাধি আর বাস্তুহারা মানুষ অসহায় চোখে চেয়ে থাকে সমাজের দিকে । সামান্য সহায়তার জন্যে । পাশে দাঁড়ানোর জন্যে । তাদের অসহায়তার উৎস তারা চেনে না । আর চিনলেও তারা তাকে চিহ্নিত করে না বা প্রতিবাদ করেনা । অদৃষ্ট নামের এক কাল্পনিক চাঁদমারিকে দোষারোপ করে । তাদের দুঃখদৈন‍্যবর্ষিত অন্ধকারে সামান্য সাহায্য নিয়ে কেউ পাশে দাঁড়ালে তাকে তারা দেবদূত মনে করে । তখন এই দুখি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নামই মানবিকতা । সম্মিলিত মানবিকতা একটি দর্শন । একটি বিশ্ববীক্ষা । মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, মানব প্রকৃতির দুটি দিক আছে । একটি আত্মকেন্দ্রিক । যার নাম স্বার্থসিদ্ধি । আর অপরটি নৈতিকতার দিক । যার নাম মানবিকতা ।

 মানবসমাজে একেকটা সময় আসে যে সময়টাকে বলে যুগসন্ধিক্ষণ । যে সময়ে একদিকে চলে মানবিকতার অবমূল্যায়ন । আর্ত মানুষের হাহাকার আর কান্নায় ভরে যায় বিশ্বজনপদ । বিশেষ কোনো রাষ্ট্রনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কখনো কখনো মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে । এই ব্যাপক অসহায়তার সুযোগে একশ্রেণির মানুষ প্রসারিত করে তার লোভের  থাবা । অর্থবিত্ত আর প্রতাপের দম্ভে সুযোগ-সন্ধানী মানুষেরা নিজের স্বার্থে ভূলুণ্ঠিত করে মানবাত্মা । এই মানুষগুলোর লোভের কাছে, অর্থগৃধ্নুতার কাছে শোষিত ও নিঃশেষিত হতে থাকে আর্ত মানুষ । বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষগুলো নির্মম হয়ে ওঠে এই সময়ে । যুগে যুগে মনীষীগণ মানবপ্রেমের বার্তা নিয়ে গেলেও একদল স্বার্থমগ্ন মানুষের কানে পৌঁছায় না সে বাণী। আর একদল মানুষ এই দুঃসময়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে অবহেলা করে এগিয়ে আসে মানুষের পাশে । আর্তের সেবায় । পরের জন্য  জীবন-মৃত‍্যুর ব‍্যাবধান ঠেলে সরিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে । তাদের কাছে জীবন আসে মানবিকতার রূপে । মানুষের কল্যাণ, সমাজের কল্যাণে তারা খুঁজে পায় জীবনের মহামন্ত্র । এভাবেই অন্ধ তিমির ভেদ করে আসে নতুন ভোর । নিরাশার বিপরীতে আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা এক নতুন সমাজ ।

আজকের সময়েও বিশ্বব‍্যাপী চলছে এক মহাসংকট । হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের বিচারবুদ্ধি, মূল‍্যবোধ । এই সময় চলেছে এক অনিশ্চিত হননের পথে । কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের নন্দন । প্রত্যয়ের অন্বেষা । মূল্যবোধ ও ঐকান্তিক বিষয়গুলো যেন মহার্ঘ হয়ে পড়ছে । চেতনার প্রকোষ্ঠে বাসা বাঁধে সংকীর্ণতা, লোভ আর নাশকতা । আত্মকেন্দ্রিক সুখ আর ভোগের উল্লাস প্রকট সর্বত্র । মননের সন্ন‍্যাস নেই । অল্পসুখের শান্তি নেই । বাহ্যিক চাকচিক‍্যের প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত । বিচ্ছুরণ নেই জীবন দর্শনের । অস্বচ্ছতায় আচ্ছন্ন জীবনবোধের গৈরিক বৈরাগ্য । কোথায় সুশৃংখল আত্মনিয়ন্ত্রণ ! কোথায় বিবেকের উজ্জ্বল আলোক ! ক্রমশ বেড়ে চলেছে নেতির মিছিল । চারিদিকে আলোহীন আশাহীনতার দরুন যন্ত্রণার আর্তনাদ । হতাশায় কুঁকড়ে যাওয়া মানবাত্মা, প্রান্তিক মানুষের উপর নির্যাতন, লোভের আঘাত, পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার বাতাবরণ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ভাঙন, মারণ রোগ, দারিদ্র, ক্ষুধা, ক্ষমতার দম্ভ, শক্তির আস্ফালন,সহিষ্ণুতার অভাব, সন্ত্রাসবাদ, অতিমারীর ঢেউয়ের পরে ঢেউ, ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, আত্মহননের প্রবণতা সমস্ত বিশ্বকে আজ অন্ধকার পথে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ।

এক অতিমারীর কবলে আজ বিশ্রস্ত গোটা বিশ্ব । গত দু'বছর যাবৎ পৃথিবী  করোনা নামক এক মারণ ভাইরাসের আক্রমণে জবুথবু । জীবন বিপর্যস্ত । সভ্যতা দাঁড়িয়েছে হুমকির মুখে ‌।  এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ আজ ত্রস্ত । সংশয়াপন্ন । এও এক ক্রান্তিকাল । সেই চিরাচরিত চিত্রটি আজও আবার প্রকট হয়ে উঠেছে । চারিদিকে আর্তরব । ত্রাসে, সংশয়ে, কর্মহীনতায়, প্রবাসে, রোগপ্রকোপে, চিকিৎসার অভাবে । সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় । এই দোলাচলে  স্বার্থান্বেষী মানুষ জেগে উঠেছে আবার আত্মমগ্নতায় । মানবতার লাঞ্ছনায় । দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ চেয়ে থাকে কবে যে 'সম্ভমামি যুগে যুগে' বাস্তবতা লাভ করে ।  কবে জানি 'ঐ মহামানব আসে' । শুনে আসা মানবিকতার পুরাকথা কবে প্রাণ পাবে করোনজর্জর পৃথিবীতে। হ‍্যাঁ । তুমুল অসহায়তার এই অথৈ পারাবারে সত‍্যিই দেখা গেছে মানবিক মুখ । কী এক অনুপ্রেরণায় মহল্লায় মহল্লায় তরুণ প্রজন্মের মানবিক মুখ ছুটে গেছে আর্তের পাশে । আক্রান্তকে পৌঁছে দিয়েছে নির্ধারিত চিকিৎসালয়ে । যোগাড় করেছে জীবনদায়ী ঔষধ, রক্ত । রাতবিরেতে ছুটে গেছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার কাঁধে বয়ে । নিভৃতবাসে যারা রয়েছে সেই উপার্জনহীন মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিয়েছে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় খাদ‍্যপণ‍্য ও ঔষধ । প্রতিবেশীর অসম্মানজনক ব‍্যবহার ও বেদনাজনক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে জুগিয়েছে 
সাহস । মৃত‍্যুর নিশ্চিত সম্ভাবনা জেনেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ‍্যকর্মীরা নিঃস্বার্থে দিয়ে গেছে সেবা । চোখের সামনে সতীর্থকে আক্রান্ত হতে দেখেছে । চিরতরে হারিয়েও গেছে কতজন । তবুও থেমে থাকেনি তারা । সেবা আর মানবিকতায় জীবন-মৃত্যুর পার্থক‍্যকে ঘুচিয়ে দিয়েছে তারা । করোনাকাল আবার মনে করিয়ে দিয়েছে মানবিকতার বার্তা । শুনিয়েছে মানবতার মুখ । মূল‍্যবোধের অবলুপ্তির আশংকায় কৃষ্ণগহ্বরের অতলে ডুবে গিয়েছিল মানবিকতার লক্ষ্মীপ্রতিমা । করোনামারীর ধ্বংসাত্মক রূপ মানুষকে প্ররোচিত করেছে মানবিকতার সন্ধান করতে । মানুষের সম্মিলিত বিবেকের সমুদ্রমন্থনেই উঠে এসেছে কমলাসনা মানবিকতা । অগণিত মৃত‍্যুর পরিসংখ‍্যানের অন্ধকারের বিপরীতে মানবিকতা উজ্জ্বল মুখ এই সময়ের প্রতিটি মানুষ তা চাক্ষুস করেছেন ‌। দেখছেন 'অসংখ‍্য মানুষের হাহাকার' নিবৃত্ত করে আবার জীবন জাগছে 'আলোয় আলোয়' ।

Thursday, January 6, 2022

চাঁদমঙ্গল

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

ফাটিয়া যাওত ছাতিয়া

ফাটিয়া যাওত ছাতিয়া 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

এক দীর্ঘ পদযাত্রার নাম জীবন । ভাবসাগর আর ভবসাগর অতিক্রমণের ভ্রমণবিন্যাস জীবনের ধারা ।  সবটাই পরিব্রাজন । হেঁটে যাওয়া কিংবা সাঁতার । জীবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের অন্তিমে ক্রমশ অনন্তের দিকে । ক্রমাগত পথ পেরোতে পেরোতে ফেলে আসা সাদা খইয়ের ধানের মতো স্মৃতির শুভ্র স্তবক । স্মৃতির দর্পণে ভাসে প্রিয় মুখ সব । যে মুখ জড়িয়ে আছে মায়াবন্দর । চলমান সময়ের স্রোতে ভালোবাসা এক একান্ত অনুষঙ্গ । জীবন পেরিয়ে যায় ভালোবাসার অলৌকিক জলপথ । যে পথের দু'ধারে স্বপ্ন সবুজ পাড় আর হৃদয়ের ছলাৎ ছলাৎ  জলধ্বনি । জীবননাইয়ার আলোআঁধারী নৌকো  তির তির করে এগিয়ে যায় । ভালোবাসার মরমি কথা মন ও মনন জুড়ে যখন বেজে যায় দুই দৈবীঘুঙুরের মতো । তখন জীবনের গান ও খোঁজে স্বরলিপির সাংকেতিক খাতা । ভালোবাসার গান বাঁধা হয় নিবিড় নান্দনিক স্বরলিপিতে । ভালোবাসা কি ? শুধু কি হৃদয়ে হৃদয় জড়ানো ব‍্যাকুল অনুভূতি ?  শুধু কি অন্তরঙ্গ আকর্ষণ ? নিভৃত মনের গোপন কথকতা ?  আবেশমুখর সময়ের দলিল ? প্রশ্ন জাগে বারবার । কখনো বিশ্বাস হয় । প্রত্যয় ভাঙে কখনোবা । নিরন্তর গূঢ়সন্ধান চলে নিবিড় বন্ধনের । যতক্ষণ মগ্ন থাকা যায়, ভালোবাসার কাছে নতজানু থাকা যায় । চেতনার গভীরে এক গাঢ়ছাপ স্পষ্ট হয়ে যায় । উল্কিপ্রকট মুহূর্তগুলো বিচ্ছুরিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে মেঠোপথময় অস্তিত্বের অবয়বে । শিমুল তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ে যায় ভালোবাসার স্বপ্ন । আকাশে ভাসমান মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে শুধুই ভাসে প্রিয় মুখ । ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী । ভালোবাসার বকুলসই । পরতের পর পরত অনিঃশেষ বস্ত্র জড়িয়ে যেতে থাকে শরীরে । ভালোবাসার নামে । সহস্র পেশির আকর্ষণেও খোলেনা যেন ভালোবাসার ব্যস্তবসন । জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে । শরীরময় । মন জুড়ে । 

ভালোবাসা এক প্রিয় গার্হস্থ‍্যের নাম । প্রতিদিন বেড়ে উঠে সে পরিপাটি হয়ে । অসীম যাতনার ভেতরেও অপার আনন্দ। ভালোবাসা এক করতে জানে । বিশাল জলপরিধি নিয়ে সেজে ওঠে ঘরকন্না ভালোবাসার নামে । চেতনার চিলেকোঠায় আলো দেখায় রহস্যময় প্রদীপের প্রজ্জ্বলিত সলতে  । কখনো কাঁপে বেদনায় তার শিখা । কখনোবা অত‍্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার রোশনাই । যাপিত জীবন ঘিরে ভালোবাসা মায়াকুহেলিকা রংধনু বিস্তার করে । ভালোবাসা এক অনন্য ফসল । নিরবধি চর্যার স্বপ্নভুবন । জীবনের মধুঘ্রাণ ভালোবাসায় বসত করে । পুরাকথার বুননের মত চেতনালগ্ন নীরবতা ভালোবাসার প্রান্তরে । সে প্রান্তর মধুবৃন্দাবন । বন-প্রান্তর, পাখপাখালি, লতাবিতান, ভ্রমণবিলাস, ময়ূর আর গোপজন মিলে ভালোবাসার আনন্দময়দান সেখানে । শ্রীরাধার কৃষ্ণপ্রীতি চিরকালীন ভালোবাসার উপমা । সেই শাশ্বতপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ একদিন ছেড়ে যান তাঁর ভালোবাসার গোবাট । কংসবধের নিমিত্ত চলে যান মথুরায় । অতলান্ত দুঃখের পারাবারে ভেসে যেতে থাকে রাধার ভালোবাসা । ফেলে আসা ভালোবাসার জন্য কৃষ্ণ কী ব্যাকুল হয়েছেন কোনদিন ? হয়েছেন কি কোনদিন বিরহভাবুক তার দয়িতার জন্যে ? সে কথা লেখেনা কোনো পুরাকাহিনি । কৃষ্ণ পারেননি মহান করে রাখতে  তাঁর প্রেমকে । শুধুই কামুক ছলনায় কলঙ্কিত হয়েছে তাঁর ফেলে আসা ভালোবাসা । অতীন্দ্রিয় উন্নয়ন নেই তাঁর ভালোবাসায় । প্রেমিকের পরিণতি ঘটেছে রাজনেতৃত্বে ।
 
কৃষ্ণপ্রস্থানের সাথে সাথে কিন্তু অবসান হয়নি রাধাপ্রেমের । কালিয়ার পরিত্যক্ত প্রেম রাধার অন্তর ভাসিয়েছে সীমাহীন অনন্ত বিরহে । যে বিরহ সৃষ্টি করেছে হৃদয়দ্রাবী মাথুরপদাবলি । একের ফেলে আসা ভালোবাসা অন্যের জন্যে হৃদয়মথিত বেদনার আর্তি । বিদীর্ণ হৃদয়ের কারুণ্যমিশ্রিত শাশ্বত আলেখ্য । সান্নিধ্যনিবাসে ভালোবাসা ঝড় তোলে । স্বপ্নজগতের সুগন্ধীবাসভূমে পৌঁছায় । আর ছেড়ে গেলে সেই ভালোবাসা বাস্তবের আঘাতে ভেঙে যায় । ফেলে আসা ভালোবাসার দুই দিক । একদিকে বিরহের শোকোচ্ছ্বাস । অন্যদিকে জীবন সংগ্রামের বাস্তবমাথুর । এক পিঠে অনন্ত সুখের ভিতর দুঃখবিধুর একাকীত্ব । আর অপর পিঠে জীবনের কঠিন ও শাশ্বত সত্য । জীবনপ্রবাহের সত‍্যলোক স্পষ্ট হয় তাতে ।হৃদয়পারাবারের দুই পাড় ভাঙে  দুইভাবে । দুই অনুভবে ।

নিভৃতনগরীর দামালজলধি

নিভৃতনগরীর দামালজলধি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সবার একটা নদী  আছে ।  সে নদীর দুই ধারা ।চোখের জমিনে বসত করে সেই নদী । সে এক নীরব নদী । অন্তর্গত গুহাজল । সে নদীর জোয়ার আসে ।মাঝে মাঝে সে নদী হয় খরধারা । সে কেবল গড়াতেই জানে । শব্দহীন কথা বলে সে নদী । বেদনায় কিংবা আনন্দে  ।  আবেগনির্ঝর । ব‍্যথাসই । ভালো  লাগার দোসরজন । মেরুকরণের উপকরণ ।মনের গভীরে লুকানো বৈভবকে বের করে আনে এই সুপ্তস্রোত । যখন বাঁধ ভাঙে তখন তীব্র তার গতি । ধূলিস‍্যাৎ করে দিতে পারে সব অভিমান সব দম্ভ । মনের উঠোনের কালিমাকাজল ধুয়ে নেয় গড়িয়ে পড়া অপাপবিন্দু । দীর্ণ অন্তরভুবন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয় তার উতলধারায় । গৌরমাতন ঝরায় জল । মহানামে গভীর হয় চোখের আর্দ্রতা । বাজে জলতরঙ্গ মাদলের বোলে । ঝরে জল অবিরল । জল কখনও অতিজাগতিক উল্লাস । বুকের মধ্যে আনন্দমৃদঙ্গ বেজে উঠলে বিমলবৃষ্টি নেমে আসে চোখ বেয়ে । প্রাপ্তির আনন্দ আনে নয়নবারি । আনন্দনির্ঝর জাগিয়ে তোলে ভালোবাসা । সে ভালোবাসা মানুষ মানুষীর প্রিয় বাঁধনকে করে সুদৃঢ়তর । আবার জীবনের প্রতি টানও বেড়ে যায় । পরমপুরুষের সঙ্গে ভক্তের হয় ভাবসম্মিলন । আনন্দধারা ভাসে চিরায়ত চকোর-চকোরী । প্রেমিকার চোখের দুঃখবারি চঞ্চল করে প্রেমিকের মন । আরো আরো বেশি করে ভালোবেসে মুছে দিতে চায় কষ্টের জল । জীবন বাজি রেখে শ্বাপদসংকুল যাত্রা শেষে নিষিদ্ধ স্ফটিক স্তম্ভ ভেঙে তুলে আনে আশ্চর্য কমল । বিশ্বাসের মধুগন্ধ প্রিয়নিলয়ের সুখ ।

আয় জল, আয় ঝেঁপে । বুকের পাড় ভেঙে আয় । তুই কেবল জলের বিন্দু  নোস । তুই তো উথালি-পাথালি শরীরের কোণে জমা মেঘবিন্দু । আয় জলসই । আবেগের ঝরনা রেখে যাক তোর জলছাপ । মায়াবিধৌত হৃৎকমলে প্রশান্তিপ্রলেপ । ধ‍্যানবদ্ধ শরীর যেন মেঘমল্লার শোনে নিভৃতে । বারিপ্রবাহে ডুবে ডুবে যায়রে শরীর ! যায় । যায় । বিচ্ছেদের ও আছে বেদনাবিলাপ । মাথুরবিরহের রাইগুঞ্জন বাজে হৃদিব্রজে । অনন্তপ্রতীক্ষার নদী ভরে যায় উত্তাল উচ্ছ্বাসে । জীবনের আকাশ মেদুর হয় ।অযাচিত বিদায়ের তীব্র তির কখনও বর্ষা নামে দেহজনপদে পদাবলির সুরে । মেঘলাগোঠের আর্দ্রভুবন গুমরে কাঁদে । আর্তবিলাপের প্রতীকপ্রবাহে ভিজে যায় রাধাপথ । বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসিত নিঃসঙ্গ মায়ের সিক্ত আঁচলে জমা হয় স্মৃতি । ইতিকথায় ভরপুর ঘোলাটে চোখ বেয়েও নামে মায়াঢল । জলমহল ভাঙে ছলনার মুখোশ । কাজললতার  অনুশাসন । স্তনযন্ত্রণা । দুঃখ যার চিরসখা কান্না তার পারানি । কান্নাপুকুরে ডুব দিয়ে উঠলে হয় শুদ্ধস্নান । অলৌকিক অবগাহন । এ তো জলের  জলধি । এ নদীতে খেয়া দেয় বোধনের নাইয়া । যে নিয়ে যায় নতুন জীবনের পারে । আলোকিত আকাশের দিগন্তরেখায় । ভোরমহল্লার আজান ভেসে আসে নির্মলভেলায় ।

বেহুলা পেরিয়ে গেছে যে গাঙুর, সেও এক কান্নানদী । শবসন্নিহিত মান্দাসনিঃসঙ্গ যাত্রায় মৃতনদীর চড়া আর বালিয়াড়িকে সজল করেছে তার অনন্ত অশ্রুসলিল । উৎসবমুখরিত দেবসভার উচ্ছল নক্ষত্র ভেসে গেছে তার নোনাজলে ।

প্রতিটি অশ্রুবিন্দু জীবনের রঙধনু । মনের গোপন নির্মানের মলাট উন্মোচন । এ নিছক জলবিন্দু নয় । জীবনতিলক । বৃষ্টি নিয়ে খেলা যায় । অশ্রু নিয়ে নয় । প্রাণ কখনও আকুল হয়ে ডাকে, 

        আয় ! অশ্রু আয় ।
           আয় রে, জোছনার গান ।
     ভালোবাসার শ্রাবণ রে তুই ।
 আয়, আয় বেদনামূর্ছনা । আদুরে উল্লাস ।

Thursday, December 2, 2021

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ভালোবাসা মুগ্ধ অন্তরের পদাবলি ।
 ভালোবাসা শুধু নিঃস্ব করে না । হৃদয়ের আত্মীয়ও করে । আর সেই ভালোবাসা যদি হয় কবিতায় সহবাস, তাহলে সেই হংসধ্বনি সমোচ্চার আন্দোলিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে । কবিতার অনুভবে যারা ঋদ্ধ তারা পরস্পরের আত্মার ধ্বনি শোনে । হৃদয় থেকে বেরিয়ে এ নিনাদ দেশকালের সীমা টপকে যায় ঋজুগতিতে । এক চিরায়ত বন্ধন সৃষ্টি হয় আত্মীয়তার মতো । স্থানিকতা থেকে মহাস্থানগড় । উৎস থেকে অনন্তবাথান । এক অদৃশ্য হাওয়াপথ তৈরি হয়ে যায় অমোঘ কলকন্ঠে । ঘন বনে ঢাকা  টিলাপথের শেষ প্রান্তের উত্তুঙ্গ টংঘর থেকে হাইটেক প্রাসাদের অন্তঃকোন অবধি ।

কবিতার দীঘল শরীর যখন বুনো নৈঃশব্দ্যের থেকে উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, তার শরীর থেকে সরে যায় সমস্ত প্রাকৃত বাকল । অন্তর্লীন রহস্যের সাত সমুদ্দুর উদোম খেয়াঘাটে যেন প্রণয়প্লাবন ছড়িয়ে দেয় । ফিনকি দিয়ে উঠে শীৎকারবগাথা । কামগান । বিগত শ্রাবণে অবিশ্রান্ত স্নানের পর তার শরীরে মেদুর কারুকথা ভেসে ওঠে । মুক্তোর রেণুর রুপালি জলজ ভ্রূণ কুহকবার্তায় টেনে আনে সৌররশ্মি । থেকে থেকে উড়ালপাঁচালি আর গোধূলিতানের নম্র সুর বেড়ে ওঠে মুগ্ধ চরাচরে । তখন ক্ষীরনদীর ধারা যেন অবিরল ভেসে যায় পাললিক জ্যোৎস্নার অলৌকিক চরাচর
পথে ।

তোমার আমার মাদকনির্যাস হে কবিতা, ভূর্জপত্রের ঠোঙায় ভরে রেখে দেবো অমোঘ জীবনে । আমি আজ আর্যপুত্র, তুমি আর্যনারী । আমাদের মিলনবাসনার পানশি ঝরেপড়া শিউলি তুলে নেবে ।  কামে ও প্রেমে টইটুম্বুর করে দেবে আমাদের প্রণয়সন্ধ্যা । জীবনের আসন্ন কৌমকোমল বার্তা অবিনাশী সমর্পণের মায়ায় বিদগ্ধ শিস দিয়ে যাবে বিষাদের হাটে । কলকল কথাপুঞ্জ অনিঃশেষ স্রোতে গড়িয়ে যাবে পাতাসবুজ অরণ্যের গা ঘেঁষে । শব্দের পর শব্দের সাতকাহন পলিমাটির গভীরে চলে যাবে । মানুষ আর মানুষীর চিরন্তন কথাই তোমার বশীকরণভাষা । এই ভাষাতেই অনন্তজীবন আর মৃত্তিকামৃদঙ্গের তান । দেহাতি চাঁদের ওলান থেকে ঝরে পড়া সন্ধ্যার নস্টালজিয়া নিঃসঙ্গে হেঁটে যায় অনন্তের আলপথে । একথা জানে আখড়ায় বাউলের কন্ঠ ।

লোকচরাচরে শেষ উপত্যকা পেরিয়ে মহাবিশ্বের রহস্যের দিকে যাত্রা কবিতার । সেই মহাসড়কে জোছনার ডিঙা আছে কিনা কে জানে ! সেখানে চলে কি জীবনতাঁতির অনন্তবয়ন ? সেখানে কি খলনারীর  ফাঁদ পেতে রাখে বিষকন্ঠী মরণবালা ? 

এ দুয়ের দ্রোহে আর প্রেমের কবিতার অভিযাত্রা । মহাকবিতার সৃজন । এ এক আঁধারঘেঁষা ছলাখেলা । এখানে কবি অবোধ খেলোয়াড় । তার উষ্ণীষ গড়ায় শব্দের ভূমিতে । জগত বালুকার বুকে লেখে সে জীবনের আদ্যপাঠ আর মরণের বিরহপত্রিকা । এইসব শব্দপুঞ্জে জেগে ওঠে আনন্দজলধারার কবোষ্ণ দুপুর ।
 রোদ্রের লালনগীতি সুরের প্লাবন নিয়ে মেঠোশরীরে উঠে আসে কাম নদীর জল ভেঙে । সঞ্জীবনীকথায় পাতাঝরা কথক পরকীয়া প্রহরে গোধূলিছায়ায় পবিত্র গলায় মায়া শোলক আওড়ায় । সমস্ত শব্দের অর্থ তখন মধুকূপী ঘাসের মতো শরতের বাতাসে নেচে ওঠে । উত্তরের দৈববাতাস হরিহর প্রতিমার যুগলমূর্তিকে ফিনফিনে কাঁপন দিয়ে যায় । কলঙ্কের টিপ খুলে চন্দ্রকরোটি যেন অষ্টমঙ্গলার ঘরের দেওয়া অবধি উঁকি দিয়ে দেখে । মানুষবিহীন খেয়াঘাটে তখন কাঁপতে থাকে অনাথ নৌকো আর মুমূর্ষু নদী । নিবিড় শীর্ণ গাংচিলেরা উড়ে যায় অগ্রগামী ভোরের দিকে । অফুরান পদাবলির বিরহগান মায়া সন্ধ্যায় তির তির করে কাঁপে । বাতাস আনমনা হয়ে যায় কবিতার জন্য ।

Wednesday, November 24, 2021

#কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক#

কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক

জীবনের দুই চেতনা । একটা বাইরের । আরেকটা ভেতরের । বহির্চেতনা আর অন্তর্চেতনা । বাইরেরর চেতনা মৌমাছির মতো আহরণ করে প্রকৃতি মকরন্দ ।আর সেই মকরন্দ জমা হয় অন্তরের মৌচাকে । রূপ নেয় মধুতে । জীবনের মধু-আর মননের মধু । বাইরের চেতনার আদিগন্তপাথার থেকে অন্তর্চেতনার মায়াঅলিন্দে । এই পরিনিমজ্জন ও পরিব্রাজন, এটাই মগ্ন চেতনার কেলিকুহেলি । মগ্ন চেতনার সহজসাধনায় প্রাণবিন্দু জেগে ওঠে । সৃষ্টি পা রাখে শিল্পের পৈঠায় । শিল্প হয়ে ওঠে প্রকৃত ও প্রাকৃত শিল্প । 

প্রতিটি সত্তা বাইরে ব্যক্তি । অন্তরে শিল্পী । কবিও অন্তর্লোকের শিল্পী । মগ্নসংসারের কারিগর ‌‌। মাটির তাল নিয়ে শিল্প গড়ে মৃৎশিল্পী ‌। এই মাটি যতক্ষণ ভূমিতে ততক্ষণ মাটি । শিল্পীর হাতে তা হয়ে ওঠে পার্থিব বস্তুর প্রতিরূপ ‌ প্রকৃতির নিপুণ সৌন্দর্যকে আহরণ করেন তিনি । আর আরোপ করেন তা নিজের সৃষ্টিতে । তাঁর মগ্নচেতনায় সৃষ্টিকে সুন্দর করার গোপন কৌশলগুলি জেগে ওঠে ।‌ শিল্পী সে কৌশল প্রয়োগ করেন তাঁর সৃষ্টিতে । বাইরের উঠোনের সৃষ্টিকে প্রাণিত করার তাগিদে অন্তরের প্রকোষ্ঠেও প্রবাহিত হয় আর এক সৃজনবাতাস । জেগে ওঠে কুলকুণ্ডলিনী, সৃষ্টিসম্ভবা ।

কবির অন্তরে বাহিরেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে নিরন্তর । কবির সামনেও আছে প্রকৃতি । সে চিরন্তনী নারী । যাকে ভালোবেসে আশ মেটে না । যাকে দেখে দেখে নয়নের পিপাসা পরিসমাপ্তি হয় না । যার রূপ অরূপ, অপরূপ, সাগরপ্রতিম । সেই গহীন সাগরে ডুবে মরতে চান কবি । কিংবা চান অলীক রত্ন সন্ধান করতে । সে এক অনিঃশেষ কল্পমৈথুনে যুগনদ্ধ  হন কবি ও প্রকৃতি । জগৎ সৃষ্টির আদিকারণ নারী । আর আদিরমণী প্রকৃতি । প্রকৃতি আদ‍্যাশক্তি । প্রকৃতির শক্তিতে পুরুষ  শক্তিমান । প্রকৃতির শক্তিতে কবি হন শক্তিমান । যার নাম কবিত্বশক্তি । প্রকৃতি ভিন্না । কবি ভিন্ন । আবার কবি ও প্রকৃতি অভিন্ন অবশ্যই ।

 কবি ও প্রকৃতির পারস্পরিক শৃঙ্গারফসল কবিতা । প্রকৃতির আশ্লেষে নিষিক্ত হয় শব্দডিম্ব । কবির শুক্ররক্তের কল্পনারসের সঙ্গে শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয় কাব্যভ্রূণ । এ এক পরাবোধিক প্রক্রিয়া । 'আলে গুরু উঅসই শিষ, / বাকপথাতীত কাহিব কিস / গুরু বোব সে শিষ কাল, / যত ভি বোলই / তত ভি টাল ।'–এর বর্ণনা বাক‍্যপথের অতীত । এর ভাষা অনুক্তপ্রয়াসী ।  এখানে এসেই মোড় নিতে হয় পথের । 'প্রভু কহে এহো বাহ‍্য, / আগে কহ আর ।'

কবি জীবনদাতা । কবি শব্দের জীবনদান করেন । শব্দের ব্যবহার হয় কবির হাতে গূঢ়ভাবে । সাংকেতিক অর্থে । কবির নিজস্ব ভুবনে শব্দ হয়ে ওঠে নবীন চিত্রভাষ্য । প্রতিটি শব্দের যে স্বাভাবিক চিত্রকল্প, চেনারূপ মানসপটে নিহিত থাকে তার মধ্যে কবির ব্যবহৃত শব্দ আনে নতুন ভাষা, নতুন রূপ,  নতুন ছলম । অর্থের দিক থেকেও এক নতুন জাদুকথার যেন সৃষ্টি হয় । কবির মননে এবং দর্শনে এক সান্দ্র ভাষাশৈলী তৈরি হয়ে যায়, যা কবির এক নিজস্ব ভাষাভূগোল । নিজস্ব ছন্দবাতায়ন । একান্ত আপন কাঁঠালিচাঁপায় সাজিয়ে তোলেন কবি । 

শব্দ যদি প্রকৃতির ভ্রূণ, কবি যা লেখেন প্রকৃতি নিয়ে লেখেন । কবির যা খেলাধুলো । শব্দকে নিয়েই সে সব । সব শব্দই যেন তার চেনা । শব্দ কে স্পর্শ করে তিনি অনুভব করতে পারেন ‌। শব্দের ঘ্রাণ তাঁকে মাদকতা দেয় । সৃষ্টির মাদকতা । শব্দের চিত্র তাঁর কল্পনাকে রৌদ্রমাখা আকাশে ওড়ার সাহস যোগায়  । শব্দের ছবি মেঘবজ্রকৃষ্টির নভোকালিমায় ভীরু বিরহী করে তোলে ।  শব্দকে কেমন ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা কবির নিজস্ব পাকশৈলী । তাঁর মননতাঁতে কবি শব্দ সাজান টানা ও পোড়েনে । তার উপর দেন কারুজ্যামিতিক চিত্রকথা আর অলংকারের ছন্দিত কোলাজ । আর তাও শব্দেই সৃষ্ট । একটা আশ্চর্য উদ্ভাসিত ধানভূমি তৈরি করেন কবি তাঁর বয়নে । এ বয়ন চলতেই থাকে তো চলতেই থাকে । কবি থেমে থাকেন না । বুননে বয়নে ভরাট হয়ে উপছে পড়ে তাঁর সৃষ্টি ‌। তাকেই বলি কবিতা । কবিতার কোন থামা নেই । কবিতার কোন অবকাশ নেই । এক মহা প্রান্তরকে ক্রমশ ছেয়ে ফেলার জন্য তার উড়াল কিংবা ভাসান কিংবা পদযাত্রা । 

তুমুল গৃহশ্রমে মগ্ন থেকেও কবি যেন নিঃসঙ্গ কীর্তনীয়া । গেয়ে ফেরেন ভোরাই একাকী । জনপদ থেকে জনকোলাহলে । বিষন্ন সায়াহ্নে কবি শব্দের ভিখারী হয়ে ওঠেন।  হয়ে যান শব্দের কাঙাল । প্রাত্যহিকের পরিখাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কবির অভিসার । কোন ঘেরাটোপ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না । কোন দুর্বার বেড়ি তা়ঁকে বেঁধে রাখতে পারে না । বাস্তববন্দি শিবিরে অন্তরীণ থেকে খুঁজে নেন উন্মোচিত পরিসর । 

কবির প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি ক্ষণের চর্যায়  তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পারলেও কোন ক্ষতি নেই । কবি প্রতিদিন তার শরীরভাষাকে অবগুন্ঠিত রেখে নিভৃতে চর্চা করেন কবিতাযাপনের । অনুশীলন করেন কবি হয়ে ওঠার । কবিতা নির্মাণের করণকলা অধ্যয়নের । তার যাবতীয় অধ্যাবসায় শব্দকে নিয়ে ‌‌। সামগ্রিক আয়াশ কবিতার জন্যে ।  জীবন ও সন্ন্যাস এই দুই পরস্পর বিপরীত চর্যার বিরোধাভাসকে কবি প্রয়াসঅভিঘাতে ক্রমশ চূর্ণ করে দেন ব্যবধানের দেয়াল ।  জীবনের মধ্যে থেকেও কবি সন্ন্যাসকল্প পুরুষ । এ দুয়ের রসায়নে কবি খুঁজে পেতে চান আশ্চর্য সব কাব‍্যরহস্য ।

 কবির অন্তরে এক অনন্ত দহন । 'মন পড়ে সখি জগজনে জানী । বন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী ' । কবিও পোড়েন ।কবির অন্তর পোড়ে । পুড়তে পুড়তেই কবি দেখেন জগত । কবি অনুভব করেন জীবন । মনপোড়া কবির উপলব্ধির ঘটে কাব্যিক উন্মোচন । দগ্ধচিত্তে দেখেন আদিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত আকাশ ।কবি চিনে উঠতে পারেন তাঁর চিরপরিচিত আসমুদ্র সংসারক্ষেত্রটিকে । তাঁর মাথার উপরে আকাশ শূন্য । তাঁর পরিচিত ভূমি প্রদেশ চলিষ্ণুতায় উচ্ছল । এই উচ্ছলতার যে জলধিসুনামি  তাই কবিকে তোলপাড় করে । জীবনের মুহূর্মুহূ বদলে যাওয়ার বর্ণের বিচ্ছুরণে হয় কবির অন্তরের ইন্ধন । কবি জ্বলে উঠেন বারবার । 

কবির দেহেও আছে ষটচক্র । কবির সাধনাও দেহতাত্ত্বিক । কবির শরীরেও আছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ি । কবি তাঁর সাধনায় প্রকৃতি ও জীবনরসের মায়াভ্রমণ ঘটান তার শরীরময় । নাভিপদ্মে নিদ্রিতা কুন্ডলিনীকে জাগান তিনি কাব্যিক ইশারায় । শব্দের পর শব্দের বাণসৃষ্টিতে  তিনি কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দেন । সেখানে ঘটে প্রকৃতি ও পুরুষের অদ্বয়মিলন । কবিও জীবনের মিলিত পরমানন্দ । এ আনন্দই কাব্যের মহাভাব । এ আনন্দ ই 'মহাসুহসঙ্গ' । এটা কবির অন্তরের স্থায়ী আনন্দ । যার জন্য কবির অনন্তবাসর । যার থেকে কবির সিদ্ধি । কবির  শরীরে তখন আসে কবিতার জোয়ার । কবি তাকে প্রবহমান রাখেন তার ইচ্ছানুরূপ । এভাবেই কবি পান স্থায়ী আনন্দ ।চিরসুখ । কবির পর্যটনসার ।

Thursday, October 28, 2021

চাঁ দ ম ঙ্গ ল

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

Tuesday, October 5, 2021

শরৎ শান্তি

শরৎ শান্তি

এখন শরৎকাল ৷ আমরা মেতে উঠছি উৎসবে ৷ 
আসলে কী শরৎকাল?  আসলে কী উৎসবের ঋতু এখন?
এই কিরাতপ্রদেশ থেকে এখনো অরণ্য যায় নি অগস্ত্যের পথে ৷
এখনো পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজ আবিরের মাখামাখি ৷ স্বাধীন সবুজের সমারোহ ৷
স্বাধীন বলছি এই জন্যে, এইসব অফুরান প্রাকৃতিক রঙগুলো 
আজ আর স্বাধীন নয় ৷এরা এক একটি রাজনৈতিক প্রতীক ৷
 সিঁথিরঙ লাল একদলের, সন্ন্যাসচিহ্ন গেরুয়া একদলের, তরুণ ঘাসের সবুজে চিহ্নিত হয় আর কোনো দল ৷
তবুও  কিরাতঅরণ্যের গায়ে মাখা সবুজ
তার চিরবান্ধব ৷ আজন্মপরিচয় ৷ আজো তার
শিখর থেকে নদীবিছানা সবুজকে জড়িয়ে আছে
 আশরীর৷
তারপরেও এই শরৎ কোন সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে আটকে আছে ৷
এখনো এই প্রদেশের দূরবর্তী কোনো শান্ত নিভৃত গাঁয়ে তাপমাত্রার পারদ
চৈত্রের দুপুরকে ছাড়িয়ে যায় ৷
আকাশের উদ্দাম নীল এখনো কালো মেঘের গর্জনের ভয়ে
পালিয়ে বেড়ায় ৷
রাতের ঘাসের কোনো তাগিদ নেই শিউলির জন্যে হিমের বিছানা পেতে রাখবার ৷ কুয়াশা ঝরে না মৃদু ও নিঃশব্দ ধারাপাতে ৷
 তবুও এই আগুনের আঁচে র মধ্যে আমরা উৎসবকে আবাহনের জন্যে অন্তরের বরণডালা সাজাই ঘরে ঘরে ৷ উৎসবের সিরিজ আমাদের সাথে এগিয়ে চলে  ধনী নির্ধন নির্বিশেষে ৷ ####################
এপারে মানুষ, ওপারেও মানুষ ৷ এই মানুষের হৃদয়ের রঙ লাল৷ ওই মানুষের হৃদয় রক্তিম বরণ ৷
তবু দুই পারের মানুষের মাঝে কাঁটাতার কেন?  কারা দিনরাত একে তাতিয়ে যায়, ওকে উস্কে যায় অবিরাম ৷
যাদের গোলায় মজুদ মারণাস্ত্রগুলো জং ধরতে ধরতে বাজারে তোলবার অযোগ্য হবার ভয়ে আর লোকসানের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না তারাই দিনরাত কানমন্ত্র দিয়ে যায় কখনো ডান কানে, কখনো বা বাঁ কানে ৷ বিষমন্ত্র শুন শুনে ক্রমশ তলিয়ে যায় দুপারের বিবেক ৷ হাত পা ছুঁড়তে শুরু করে পরস্পরের বিরুদ্ধে ৷ ক্রমে ক্রমে ক্রোধের পারদ চড়ে ৷ উৎসবের মঞ্চ ভেঙে পড়ে ৷ একে অন্যকে ঘায়েল করাই উৎসবের উন্মাদনা ৷ঢাকের কাঠি হয়ে যায় রণদামামা ৷অদৃশ্য নির্দেশকের বাঁশি বেজে ওঠে এক বীভৎস ইঙ্গিতের ভাষায় ৷ লুকায় শান্তি,  হারায় উৎসব ৷ মৃৎপ্রতিমা নয় ৷ মৃত্যুপ্রতিমা কাঁধে কাঁধে চলে শোকভাসানে যেন ৷ এই শরতের ধাবমান নীলের শরীরে চলো আমরা  গুঁজে দিই সাদা সাদা পালক ৷ শান্তির নিশানের মতো যারা উড়ে বেড়াবে সারা আকাশ জুড়ে ৷ 
এসো বন্ধু, এসো প্রিয় পড়শি, আমাদের ধুনুচি নাচের ধ্রুপদী ধোঁয়ায় একসাথে মেশাই ভালোবাসার মুখর সুবাস ৷
 বলো,  বলো হে সবাই একসাথে, একই ঐকতানে - শান্তি, শান্তি এবং শান্তি আসুক নেমে আমাদের প্রতিটি চৌকাঠে ৷