Showing posts with label স্মৃতিকথা ।. Show all posts
Showing posts with label স্মৃতিকথা ।. Show all posts

Friday, September 1, 2023

সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে

সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আমার ফ্রেন্ডসার্কেল বিচিত্র । বাবার চাকুরিসূত্রে পরিযায়ী জীবনের কারণে প্রকৃত অর্থে জমাটি বাল্যবন্ধু আমার নেই । কিন্তু পরবর্তীকালে অসাধারণ সব অভিভাবক, সুহৃদ, বন্ধুবৎসল, শুভার্থী,প্রিয়জন পেয়েছি আমি । আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা যেমন রয়েছেন আমার বন্ধুবৎ তেমনি আমার এককালের ছাত্র এখন আমার বন্ধু । আমার জীবনশিক্ষক । আড্ডাগুরু, আখড়াই গোঁসাই তারাই । এদের নিয়েই প্রাতঃভ্রমণ আর জীবনসন্ধ্যাযাপন । 

বালককালের বেশ কজন বন্ধুর সঙ্গে সুখকর স্মৃতি এখনও হৃদয়ে জীবন্ত থাকলেও তাদের সঙ্গে বাকি জীবনে আর দেখা হয়নি । কখনো কোথাও কথাপ্রসঙ্গে কারো কারো সংবাদ পাই । ভালো আছে বা ভালো নেই । কেউ কেউ অসময়ে চলে গেছে ভবের বাজার থেকে । বাল্যবন্ধুর বিয়োগে যতটা শোকাতুর হওয়ার কথা তেমন কিছু মনে হয় না ।কেমন যেন আর দশটা মৃত্যুসংবাদের মতোই ভুলে যাই একদিন । মা বলতেন, মাটির বুকে থাকলে একদিন না একদিন দেখা হয় । নেই যখন আর দেখা হবে কি করে ! এটাই সান্ত্বনা । তবে দেখা হলে সেই বন্ধুটির নাক দিয়ে সিকনি পড়ত কিনা, পোস্টাপিস খোলা থাকত কিনা, কে গোরু চরাতে গিয়ে রহস্যময় সুরে রূপবান গান গাইত,গাছে চড়ায় কে তুখোড় ছিল, গুল্লি ও ডাগ্গি খেলায় কে বেশি কান্টামি করত অনর্গল স্মৃতি থেকে বলে দিতে পারতাম । তার মাঝেও অসীম অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ আলোরেখার মতো দুএকজনের সাথে যোগাযোগ হয় যায় কোনো সূত্র ধরে । হেলে পড়া জীবনবৃক্ষের মেদুর চাহনিতে দিগন্তরেখায় ভেসে ওঠা দু একটি মুখ । প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের কালে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে জীবনে যোগাযোগ হবে ভাবিনি তেমন কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । খোঁজও পেয়ে যাই কারো কারো ।

কুলাইতে শৈশব-কৈশোরকালের আমার প্রায় সমবয়সী আমার মেজোভাইয়ের সহপাঠী শিবাজী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় একদিন । দেখাও হয়ে যায় । শিবাজীর বাবা ডা. এম. এল. বোস । মা ডা. লীলাবতী বোস । ভারতভুক্ত ত্রিপুরার প্রথম মহিলা চিকিৎসক । শিবাজী এবং তার দিদি রত্নাদি, ছোটোবোন বুলা এখন পশ্চিমবঙ্গবাসী ।শিবাজী কোলকাতা হাইকোর্টের নামজাদা ব্যারিস্টার । মনটা আগের মতোই সরল । দুঁদে উকিলের মারপ্যাঁচ নেই । মাস ছয়েক আগে শুধুমাত্র আমার মোবাইল ফোনে সাড়া দিয়ে দিদিকে নিয়ে দমদমে আমার ছেলের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছে । পঞ্চাশ বছর পরে ওদের সঙ্গে দেখা । আমার শব্দভান্ডার গড়ে ওঠার পেছনে তাদের কোয়ার্টার্সের ছিল বিশাল ভূমিকা ।

 তখনকার দিনে প্রায় হাজার খানেক বইয়ের সংগ্রহ ছিল তাদের । শুকতারা, নবকল্লোল, দেশ, আনন্দবাজার, ইংরেজী হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ব্লিৎস নিয়মিত আসত তাদের বাড়িতে । আর ছিল অনেকগুলো বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ গ্রন্থ, দেব সাহিত্য কুটিরের মোটা মোটা পূজাবার্ষিকীগুলো । ছিল হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, টারজান ইত্যাদি কমিকসের বই । সিলেটি প্রবাদ আছে, ভাঙ খাইলা শিবে, নিশা ধরছে বল্ দর । ওদের সংগৃহীত ও আলমারিতে রাখা বইগুলো আমি মুখ গুঁজে পড়তাম । শিবাজী মানে কুশলের বাবা-মা পিসেমশাই-পিসিমা খুব খুশি হতেন আমার আগ্রহ দেখে । তাদের একটা ফ্যাট গাড়ি ছিল । আগরতলায় গেলে গাড়িভর্তি পূজাবার্ষিকী দেশ, আনন্দবাজার, অমৃত,নবকল্লোল, শুকতারা ইত্যাদি নিয়ে আসতেন ।

মান্য বাংলা উচ্চারণের ধারাটা আমি তেমনি রপ্ত করেছিলাম কুলাইয়েই আর এক চিকিৎসক পরিবারের কাছ থেকে । সেসময়ের সুচিকিৎসক ডা. কাজি আব্দুল মান্নান সপরিবারে আসেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে । কাকু ছিলেন হুগলির লোক । কাকিমা খোদ কোলকাতার বনেদি পরিবারের মেয়ে । তাঁদের ছোটো দুটি মেয়ে জলি ও মলি । তিনি এতোবড়ো চিকিৎসক কিন্তু তাঁর পারিবারিক অসুস্থতায় আমার বাবার পরামর্শ নিতেন । তাঁরা আসার কিছুদিন পর  কামাল ও বুড়ি নামে দুই ভাই ভাইঝিকে তাঁদের কাছে নিয়ে আসেন পড়াশুনো করানোর জন্যে । কাজী কামালুদ্দীন ছিল আমার সহপাঠী । ভাইঝি বুড়ি রহমতুন্নেসা আমাদের এক ক্লাশ নিচে পড়ত । কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তাঁদের সঙ্গেই কাটত আমার খেলাধূলা, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া যৌথপাঠ । সম্ভবত নিজের ছেলে না থাকায় কাকিমণি আমাকে ছেলের মতো যত্ন করতেন । ওখানে থাকলে আমার মা-বাবাও নিশ্চিন্ত থাকতেন । নইলে আমার নামে সারাদিন নালিশ আসত আমার গুণপনার জন্যে । কামালদের উচ্চারণে হুগলি অঞ্চলের প্রভাব ছিল । আমরা যারা নাটকে সিনেমায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ডায়ালগ শুনেছি তাঁরা অনুমান করতে পারব হুগলি অঞ্চলের উচ্চারণ কেমন । কাকিমা পুরোপুরি ঘটি । মাঝে মাঝে তাদের উচ্চারণের সমালোচনা করে বলতেন, কি বলছিস তোরা সব । দেখ তো, বাঙাল ছেলেটা কি সুন্দর করে আমার সঙ্গে কথা বলছে । তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কথোপকথনের ফলে আমি ক্লাশে উত্তরপত্রে সুন্দর চলিত বাংলা লিখতে পারতাম । পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতায় এসেও আমি ক্লাসরুমে চলিত বাংলায় পাঠদান করেছি ।আমি ভাবতাম আমার উচ্চারিত একটা শব্দও যদি শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয় তাহলে তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে । ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা খুবই দরকার । 

যাই হোক, একটা সময় কামাল ওরা ওদের বাড়ি চলে যায় । কামাল পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত । খুব সুন্দর ছিল হাতের লেখা । স্কুলে যাওয়ার সময় চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে যেত । যতটা মনে পড়ে ঠিকানা লেখা থাকত– কাজি আব্দুল ওয়াহাব, গ্রাম গোলানন্দপুর, আরামবাগ, হুগলি । দীর্ঘ বছর এই বন্ধুটির কোনো সন্ধান জানিনা । গতবছর পুজোর সময় দৈনালীর অনুষ্ঠান এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক আব্দুল গফফার । তিনি হুগলির লোক । তাঁর কাছেও কথাটা পেড়েছিলাম । হয়তো হয়ে যাবে কামালের সাথে দেখা—'হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে–/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে–তখন হলুদ নদী/নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়–মাঠের ভিতরে ।'

প্রায় সাতান্ন বছর পরে কয়েকমাস আগে আচমকাই যোগাযোগ হয় শৈশবের এক সহপাঠীর সঙ্গে এই ফেসবুকের একটি সূত্র ধরে । রাজ্যের একজন গুণী ব্যক্তিত্ব লোকসঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, লোকযন্ত্রশিল্পী, ভ্রমণপিপাসু, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার স্বপনকুমার দাশ । ফেসবুকে সবসময় সজাগ থাকেন । তাঁর একটা পোস্টের সূত্র ধরে যোগাযোগ হয়ে যায় ছোটোবেলার সহপাঠী নিখিল দাসের সঙ্গে । সেও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার । সাহিত্যরসবেত্তা ও তুখোড় সমালোচক । ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিল একসময় । ফেসবুকে পরিচয় হতেই শৈশবস্মৃতি উগরে দিয়েছি । এখনও দেখা হয়নি সে বল্যবন্ধুর সঙ্গে । কোনোদিন 'হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !'