সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আমার ফ্রেন্ডসার্কেল বিচিত্র । বাবার চাকুরিসূত্রে পরিযায়ী জীবনের কারণে প্রকৃত অর্থে জমাটি বাল্যবন্ধু আমার নেই । কিন্তু পরবর্তীকালে অসাধারণ সব অভিভাবক, সুহৃদ, বন্ধুবৎসল, শুভার্থী,প্রিয়জন পেয়েছি আমি । আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা যেমন রয়েছেন আমার বন্ধুবৎ তেমনি আমার এককালের ছাত্র এখন আমার বন্ধু । আমার জীবনশিক্ষক । আড্ডাগুরু, আখড়াই গোঁসাই তারাই । এদের নিয়েই প্রাতঃভ্রমণ আর জীবনসন্ধ্যাযাপন ।
বালককালের বেশ কজন বন্ধুর সঙ্গে সুখকর স্মৃতি এখনও হৃদয়ে জীবন্ত থাকলেও তাদের সঙ্গে বাকি জীবনে আর দেখা হয়নি । কখনো কোথাও কথাপ্রসঙ্গে কারো কারো সংবাদ পাই । ভালো আছে বা ভালো নেই । কেউ কেউ অসময়ে চলে গেছে ভবের বাজার থেকে । বাল্যবন্ধুর বিয়োগে যতটা শোকাতুর হওয়ার কথা তেমন কিছু মনে হয় না ।কেমন যেন আর দশটা মৃত্যুসংবাদের মতোই ভুলে যাই একদিন । মা বলতেন, মাটির বুকে থাকলে একদিন না একদিন দেখা হয় । নেই যখন আর দেখা হবে কি করে ! এটাই সান্ত্বনা । তবে দেখা হলে সেই বন্ধুটির নাক দিয়ে সিকনি পড়ত কিনা, পোস্টাপিস খোলা থাকত কিনা, কে গোরু চরাতে গিয়ে রহস্যময় সুরে রূপবান গান গাইত,গাছে চড়ায় কে তুখোড় ছিল, গুল্লি ও ডাগ্গি খেলায় কে বেশি কান্টামি করত অনর্গল স্মৃতি থেকে বলে দিতে পারতাম । তার মাঝেও অসীম অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ আলোরেখার মতো দুএকজনের সাথে যোগাযোগ হয় যায় কোনো সূত্র ধরে । হেলে পড়া জীবনবৃক্ষের মেদুর চাহনিতে দিগন্তরেখায় ভেসে ওঠা দু একটি মুখ । প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের কালে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে জীবনে যোগাযোগ হবে ভাবিনি তেমন কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । খোঁজও পেয়ে যাই কারো কারো ।
কুলাইতে শৈশব-কৈশোরকালের আমার প্রায় সমবয়সী আমার মেজোভাইয়ের সহপাঠী শিবাজী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় একদিন । দেখাও হয়ে যায় । শিবাজীর বাবা ডা. এম. এল. বোস । মা ডা. লীলাবতী বোস । ভারতভুক্ত ত্রিপুরার প্রথম মহিলা চিকিৎসক । শিবাজী এবং তার দিদি রত্নাদি, ছোটোবোন বুলা এখন পশ্চিমবঙ্গবাসী ।শিবাজী কোলকাতা হাইকোর্টের নামজাদা ব্যারিস্টার । মনটা আগের মতোই সরল । দুঁদে উকিলের মারপ্যাঁচ নেই । মাস ছয়েক আগে শুধুমাত্র আমার মোবাইল ফোনে সাড়া দিয়ে দিদিকে নিয়ে দমদমে আমার ছেলের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছে । পঞ্চাশ বছর পরে ওদের সঙ্গে দেখা । আমার শব্দভান্ডার গড়ে ওঠার পেছনে তাদের কোয়ার্টার্সের ছিল বিশাল ভূমিকা ।
তখনকার দিনে প্রায় হাজার খানেক বইয়ের সংগ্রহ ছিল তাদের । শুকতারা, নবকল্লোল, দেশ, আনন্দবাজার, ইংরেজী হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ব্লিৎস নিয়মিত আসত তাদের বাড়িতে । আর ছিল অনেকগুলো বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ গ্রন্থ, দেব সাহিত্য কুটিরের মোটা মোটা পূজাবার্ষিকীগুলো । ছিল হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, টারজান ইত্যাদি কমিকসের বই । সিলেটি প্রবাদ আছে, ভাঙ খাইলা শিবে, নিশা ধরছে বল্ দর । ওদের সংগৃহীত ও আলমারিতে রাখা বইগুলো আমি মুখ গুঁজে পড়তাম । শিবাজী মানে কুশলের বাবা-মা পিসেমশাই-পিসিমা খুব খুশি হতেন আমার আগ্রহ দেখে । তাদের একটা ফ্যাট গাড়ি ছিল । আগরতলায় গেলে গাড়িভর্তি পূজাবার্ষিকী দেশ, আনন্দবাজার, অমৃত,নবকল্লোল, শুকতারা ইত্যাদি নিয়ে আসতেন ।
মান্য বাংলা উচ্চারণের ধারাটা আমি তেমনি রপ্ত করেছিলাম কুলাইয়েই আর এক চিকিৎসক পরিবারের কাছ থেকে । সেসময়ের সুচিকিৎসক ডা. কাজি আব্দুল মান্নান সপরিবারে আসেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে । কাকু ছিলেন হুগলির লোক । কাকিমা খোদ কোলকাতার বনেদি পরিবারের মেয়ে । তাঁদের ছোটো দুটি মেয়ে জলি ও মলি । তিনি এতোবড়ো চিকিৎসক কিন্তু তাঁর পারিবারিক অসুস্থতায় আমার বাবার পরামর্শ নিতেন । তাঁরা আসার কিছুদিন পর কামাল ও বুড়ি নামে দুই ভাই ভাইঝিকে তাঁদের কাছে নিয়ে আসেন পড়াশুনো করানোর জন্যে । কাজী কামালুদ্দীন ছিল আমার সহপাঠী । ভাইঝি বুড়ি রহমতুন্নেসা আমাদের এক ক্লাশ নিচে পড়ত । কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তাঁদের সঙ্গেই কাটত আমার খেলাধূলা, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া যৌথপাঠ । সম্ভবত নিজের ছেলে না থাকায় কাকিমণি আমাকে ছেলের মতো যত্ন করতেন । ওখানে থাকলে আমার মা-বাবাও নিশ্চিন্ত থাকতেন । নইলে আমার নামে সারাদিন নালিশ আসত আমার গুণপনার জন্যে । কামালদের উচ্চারণে হুগলি অঞ্চলের প্রভাব ছিল । আমরা যারা নাটকে সিনেমায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ডায়ালগ শুনেছি তাঁরা অনুমান করতে পারব হুগলি অঞ্চলের উচ্চারণ কেমন । কাকিমা পুরোপুরি ঘটি । মাঝে মাঝে তাদের উচ্চারণের সমালোচনা করে বলতেন, কি বলছিস তোরা সব । দেখ তো, বাঙাল ছেলেটা কি সুন্দর করে আমার সঙ্গে কথা বলছে । তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কথোপকথনের ফলে আমি ক্লাশে উত্তরপত্রে সুন্দর চলিত বাংলা লিখতে পারতাম । পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতায় এসেও আমি ক্লাসরুমে চলিত বাংলায় পাঠদান করেছি ।আমি ভাবতাম আমার উচ্চারিত একটা শব্দও যদি শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয় তাহলে তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে । ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা খুবই দরকার ।
যাই হোক, একটা সময় কামাল ওরা ওদের বাড়ি চলে যায় । কামাল পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত । খুব সুন্দর ছিল হাতের লেখা । স্কুলে যাওয়ার সময় চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে যেত । যতটা মনে পড়ে ঠিকানা লেখা থাকত– কাজি আব্দুল ওয়াহাব, গ্রাম গোলানন্দপুর, আরামবাগ, হুগলি । দীর্ঘ বছর এই বন্ধুটির কোনো সন্ধান জানিনা । গতবছর পুজোর সময় দৈনালীর অনুষ্ঠান এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক আব্দুল গফফার । তিনি হুগলির লোক । তাঁর কাছেও কথাটা পেড়েছিলাম । হয়তো হয়ে যাবে কামালের সাথে দেখা—'হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে–/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে–তখন হলুদ নদী/নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়–মাঠের ভিতরে ।'
প্রায় সাতান্ন বছর পরে কয়েকমাস আগে আচমকাই যোগাযোগ হয় শৈশবের এক সহপাঠীর সঙ্গে এই ফেসবুকের একটি সূত্র ধরে । রাজ্যের একজন গুণী ব্যক্তিত্ব লোকসঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, লোকযন্ত্রশিল্পী, ভ্রমণপিপাসু, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার স্বপনকুমার দাশ । ফেসবুকে সবসময় সজাগ থাকেন । তাঁর একটা পোস্টের সূত্র ধরে যোগাযোগ হয়ে যায় ছোটোবেলার সহপাঠী নিখিল দাসের সঙ্গে । সেও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার । সাহিত্যরসবেত্তা ও তুখোড় সমালোচক । ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিল একসময় । ফেসবুকে পরিচয় হতেই শৈশবস্মৃতি উগরে দিয়েছি । এখনও দেখা হয়নি সে বল্যবন্ধুর সঙ্গে । কোনোদিন 'হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !'
No comments:
Post a Comment