বাঙালি হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো ৷ তারপরই যার স্থান হল সরস্বতী পুজো ৷ দুর্গোৎসবের যে সর্বজনীনতা রয়েছে সরস্বতীপুজোয় কিন্তু শিশুকিশোরের প্রধান্য লক্ষ্যণীয় ৷ সরস্বতীকে জ্ঞান, বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে মান্য করা হয় ৷ শিশুকিশোরদের সঙ্গে এই দেবীর একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় ৷ শিশুর বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার পাঠ শুরুর আগেই দিদির কিংবা পাড়ার বড়োদের হাত ধরে বিদ্যালয়ে আসার মাধ্যমে ৷ এর মধ্য দিয়ে তার বিদ্যালয়ভীতি অনেকটাই কেটে যায় ৷
তারপর বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণকালীন সময়ে প্রতি বৎসরই সে সরস্বতীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ৷ সরস্বতীপুজোয় অংশগ্রহণে মধ্য দিয়ে তার ভেতরে দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয় ৷ সৃষ্টি হয় সামাজিকতাবোধও ৷ সবাই মিলে চাঁদা সংগ্রহ, ঠাকুর বায়না করা, পুজোর বাজেট, বাজার করা, প্যান্ডেল তৈরি, পুজোর সরঞ্জাম জোগাড় করা, পুজো নির্বাহ করা, প্রসাদের ব্যবস্থা করা সবকিছুই শিক্ষার্থীরা নিজে দায়িত্ব নিয়ে করে থাকে ৷ দেবী সরস্বতীর প্রতি প্রত্যেক শিক্ষার্থীরও একটা আনুগত্যবোধ লক্ষ করা যায় ৷ দেবীর কৃপার উপর তাদের পড়াশুনার ফলাফলের একটা প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করে ৷ তাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নির্জলা উপবাস থেকে তারা পুজোয় উপস্থিত থেকে পুজোর শেষে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে থাকে ৷ তাই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা বিদ্যায়তনগুলো ছাড়া ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়ও হয়ে থাকে ৷
আর্যরা সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী ছাড়া শস্যের দেবীরূপেও আরাধনা করতেন ৷ ভাগবতে আলোচিত সাতটি নদীর মধ্যে সরস্বতীকে একটি নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ বৈদিকযুগে আর্যগণ সরস্বতী নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে ওই নদীজলে পুষ্ট ভূমিতে চাষবাস করে শস্য উৎপাদন করতেন ৷ ফলে তিনি বৈদিক সূক্তে অম্বিতমে, নদীতমে, দেবীতমে অর্থাৎ জননীশ্রেষ্ঠ, নদীশ্রেষ্ঠ ও দেবীশ্রেষ্ঠরূপে বন্দিত হয়েছেন ৷ কিন্তু সরস্বতীর এইসব দৈবীকল্পনা ছাড়িয়ে কবে যে তিনি বাঙালির একান্ত ঘরোয়া বীণাধারিণী কলানিপুণা ও বিদ্যাসাম্রাজ্যের তরুণী অধিশ্বরী হয়ে উঠলেন তার তথ্য বেদে নেই ৷ আমাদের লোকপুরাণ ও লোকবিশ্বাসই এই দেবীকে বাঙালির উঠোনে আসন পেতে দিয়েছে ৷ বাঙালির লৌকিক দেবদেবীরূপে যাঁরা সুপূজিত সেই হরপার্বতীর কন্যারূপেই অত্যন্ত ঘরোয়া সাজপোষাকেই শ্রীময়ী এই দেবী ৷
বসন্ত সমাগমের প্রাকলগ্নে বাঙালি কিশোরীর শরীরে আসন্ন যৌবনসমাগমের বার্তাটিও বয়ে আনে এই সরস্বতীপুজো ৷ কিশোরীটি এদিনই প্রথম শাড়ি পরার ছাড়পত্র পায় ৷ নারী হয়ে ওঠার অভিষেক ঘটে এই দিনটিকে ৷ 'বনে যে ফুটল কুসুম' এই বার্তাটি পৌঁছে যায় পাড়ার নবীন কিশোরসখাটির কাছে ৷ তার এতোদিনের বালকবেলার খেলার সাথীটিকে সে নতুন চোখে দেখে এই দিনটিতে ৷ হাওয়ায় ওড়া কিশোরীটির চুলের মতো তার মনের ভেতর কী একটা অনুভূতি এদিন উড়াল দেয় ৷ হালফিল সরস্বতীপুজোর দিনটিকে বাঙালির 'ভ্যালেন্টাইন ডে'ও বলা হচ্ছে ৷ নবীন কিশোর কিশোরীর বুকের ভেতর প্রথম প্রেমের কুঁড়িটি নাকি এদিনই ফুটতে শুরু করে ৷ এদিন থেকেই নারীজীবনের কোন গতিপথ তৈরি হয় তা আজকের দিনের কবি জয় গোস্বামীর পংক্তি দিয়েই উচ্চারণ করি -
আজ আরও ছোট হোক চুল
খাটো হোক অঙ্গের বসন
আরো যত্নে মাজা হোক ত্বক
আরো তীব্র বাঁকা হোক ভুরু
এইবার পথে বেরোলেই
কী জিনিস বেরিয়েছে, গুরু !
এইতো লক্ষ্মীশ্রী মুছে গেছে
আজ থেকে জেল্লা মার-মার
আজ থেকে স্বাধীনতা জারি
কাল ছিলে বধুমাতা, আজ
নারীমাংস, নারীমাংস, নারী...
পথে পথে সহস্র পুরুষ
মনে মনে নোংরা করবে তোকে
তাই নিয়ে অবুঝের মতো
গর্ব হবে তোর, হতভাগী
আমি কবি, দুর্বল মানুষ
কী ভাবে বাঁচাব তোকে, ভাবি...
( একটি দুর্বোধ্য কবিতা - জয় গোস্বামী )
No comments:
Post a Comment