ক্রমাগত শোকের মাইলস্টোন পেরিয়ে আমাদের পথচলা ৷ এক, দুই, তিন...প্রিয়জন, স্বজন, বন্ধুজন ৷ এভাবেই মহাপ্রস্থানের পথে, অচিনপথের যাত্রী, নিরুদ্দেশের পথিক হয়েযেতে হয় ৷ একজীবন কর্মকান্ডের শেষে মিশে যেতে হয় পঞ্চভূতে ৷ এক একটা ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায় বালিয়াড়ির বুকে লেগে থাকা পদচিহ্ন ৷ আর পরবর্তী পদছাপ অপেক্ষায় থাকে মুছে যাবার ৷ প্রতীক্ষায় ভীরু দিন গুজরান ৷ তারপর ৷ তারপর কে ৷ কে হারিয়ে যাবে দিকচক্রবালের অন্তরালে ৷ ফর হোম দি বেল টোলস্ ৷
গতকাল চলে গেলেন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু সঙ্গীত শিক্ষক অরুণ নন্দী ৷ এই ছোট্ট শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উজ্জ্বল মাণিক্য ৷ বছরের প্রায় সময়ই কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে রাখতেন নিজেকে ৷ কতো গীতিনাট্য, নৃতনাট্যের স্ক্রিপ্ট করিয়ে নিয়েছেন আমাকে দিয়ে ৷ অত্যন্ত সৃজনশীল মনের শিল্পী ছিলেন তিনি ৷ তাঁর মঞ্চ উপস্থাপনা ছিল নিখুঁত ৷ সাব্রুমের বৈশাখি মেলায় অরুণ নন্দীর সংস্থার উপস্থাপনা মানে জনঢল ৷ দর্শকের বাঁধভাঙা উপস্থিতি ৷ আর ছিল অসাধারণ কৃতজ্ঞতাবোধ ৷ অনুষ্ঠানমঞ্চে নিজে মাইক্রোফোন নিয়ে ঘোষণা করতেন মঞ্চে নৃত্যনাট্য কিংবা গীতিনাট্যটি স্ক্রিপ্ট রচনাকার হিসেবে এই অধম কলমচির নাম ৷ যা অনেকের কাছ থেকে আমি পাইনি কোনদিন ৷ চুপচাপ আমার কাছ থেকে লেখা নিয়ে নীরবে কাজ সারেন ৷ অনেকে নিজের নামে ছাপাবার জন্যেও লেখা নেন ৷ আমিও লিখে দিয়েই থাকি ৷ আমি তো আর লিখে অন্ন যোগাই না ৷ স্নেহভাজন কারো যদি উপকারে আসে মন্দ কী ৷ মরা মরা করেও যদি রামনাম মুখে আনে ৷ ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে যদি লেখার অনুপ্রেরণাটা আসে ৷ এই আশায় ৷ কিন্তু ওরা আত্মতৃপ্তিটাকেই মোক্ষম মনে করে ৷ কিন্তু অরুণ ছিলেন একদম অন্যরকমের ৷ অনুসন্ধিৎসা ছিল ভীষণ ৷ একবার চন্ডিদাস নৃত্যনাট্য লেখার সময় বাঁশুলিসেবক কথাটি ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে আমাকে রীতিমতো শাস্ত্রপাঠ করিয়ে ছেড়েছিলেন ৷ বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস পড়ার সময় চন্ডিদাস বাঁশুলিসেবক এইটুকুই জেনেছিলাম ৷ তার গভীরে যাইনি ৷ অরুণের জন্যে অনেকটা পড়াশুনো করতে হয়েছিল আমাকে ৷ মনে পড়ে সাব্রুমে সুভাষদা ( সঙ্গীতার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রধানশিক্ষক এবং এই সময়ের ত্রিপুরার খুদে আইকন সঙ্গীতশিল্পী রোদ্দুর দাসের পিতামহ) , প্রণব মজুমদার ( রাজ্যের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব) অরুণ নন্দী প্রমুখ সঙ্গীতের আসরে বসলে রাত শেষ হয়ে যেত ৷ সেইসব আসরে কিছুদিনের জন্যে রাজ্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও ঋজু ব্যক্তিত্ব শুভংকর চক্রবর্তীও থাকতেন ৷
অরুণ নন্দী জীবিকানির্বাহের জন্যে তবলা ও সঙ্গীত শিক্ষাদানকে বেছে নিয়েছিলেন ৷ একটি বাইসাইকেলকে সম্বল করে সারাটা সময় শহরের এমাথা থেকে ওমাথা ট্যুইশানি করে দিনগুজরান করতেন ৷ অন্যসময় টুকটাক কাজ করতেন ৷ এতো টানাটানির মধ্যেও শিল্পসত্তাকে বিসর্জন দেননি ৷ আমার সঙ্গে একটা 'পাৎরাজি'র ( অম্লমধুর) সম্পর্ক ছিল ৷ আমাকে 'বড় মাস্টর', 'বড় লেখক' বলে খেপাতেন ৷ আমরা দুজনে কথাবার্তা বলতাম গ্রামের উপজাতিদের উচ্চারিত বাংলাভাষায় ৷ 'আর ত' কতা অইত' না রে অরুণ তোমার লগে ৷'
সাতাশি অষ্টাশি সালের একদিন ৷ সেদিন ছিল একত্রিশে মার্চ ৷ আমি সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারিতে লম্বা হলরুমটাতে দ্বিতীয় ঘন্টায় একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছি ৷ অরুণকে দেখলাম আমাদের স্টাফ রুমের দিকে যাচ্ছেন ৷ একটু যেন আমার দিকে তাকালেন ৷ বারোটা পঁচিশে আমার ক্লাশ শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে স্টাফরুমে যেতে সবাই আমাকে ঘিরে ধরলেন ৷ বললেন এক্ষুনি অরুণের সঙ্গে উদয়পুর ট্রেজারিতে যেতে ৷ অরুণ সাব্রুম থানার কোন একটা কাজ করেছিল তার বিল এসেছে আজই ৷ ট্রেজারিতে বিল জমা দিয়ে টাকা তুলতে হবে ৷ আজই অর্থবছরের শেষদিন ৷ কিন্তু ওর বিলে ট্রেজারির উল্লেখ রয়েছে উদয়পুর ৷ কাজেই সাবরুম ট্রেজারি থেকে তোলা যাবেনা ৷ থানা থেকে উদয়পুরে যোগাযোগ করেছে ৷ বলেছে তিনটার মধ্যে উদয়পুর ট্রেজারিতে জমা করতেই হবে বিল ৷ তখন সাবরুমে যানবাহনও কম চলত ৷ শুধু একটার টিআরটিসি টা আছে ৷ সেটা তিনটায়ও পৌঁছাবেনা ৷ আমি যদি আমার স্কুটার নিয়ে তার উপকার করি ৷ সবাই বলছেন ৷ হেডস্যারও স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামের সুবাদে অরুণকে চিনতেন ৷ এই বিপদে তিনিও এগিয়ে এলেন ৷ আমাকে ছুটি দিলেন ৷ তাঁরাও জানতেন আমার সেই যৌবনের দিনগুলোতে অনেক অসাধ্যসাধন করেছি ৷ স্কুটারে গিয়ে উদয়পুর থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ এনে দিয়েছি অনেককে ৷
সেদিন অরুণের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের পর স্কুটার হাঁকালাম ৷ পথে কোথাও থামিনি ৷ কিন্তু বীরচন্দ্র মনু পেরিয়ে লাচি ক্যাম্পের সামনে স্কুটার গেল একেবারে অফ হয়ে ৷ হাতেও সময় কমে আসছে ৷ আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ৷ বোকার মতো স্কুটার ধাক্কাচ্ছি ৷ ক্যাম্পের একজন জোয়ান এগিয়ে এলেন ৷ আমরা কোথা থেকে এসেছি জানার পর বললেন, অনেকদূর চলেছে বাইক ৷ ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে ৷ একটু বিশ্রাম নিলে আবার চলবে ৷ ঠিকই কিছুক্ষণ পরে আবার বাজাজ সুপার স্টার্ট নিল ৷ একটানে তিনটে বাজার তিন মিনিট থাকতে উদয়পুর ট্রেজারিতে পৌঁছলাম ৷ সাব্রুম থানা থেকে আগে যোগাযোগ করে রাখায় অরুণকে বেগ পেতে হলনা ৷ কাজ হয়ে গেল ৷ রাতটা আমার শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে একদম রিল্যাক্স মুডে সাবরুম পৌঁছাই ৷ অরুণের সঙ্গে মহার্ঘ সেই দুটো দিনের কথা আমি কোনদিন ভুলবনা ৷
সাব্রুম একসময় যাত্রা নাটকের জন্যে বিখ্যাত ছিল ৷ যাত্রার আসরে অরুণের কনসার্ট, নাগারাটিকারার, কঙগো-বঙ্গোর ধ্বনি মূর্ছনা আজো বুকের ভেতর তোলপাড় হয় ৷ আর নাট্যানুষ্ঠানে ওর আবহরচনা নাটককে অন্য মাত্রায় নিয়ে পৌঁছাত ৷
একবার আকাশবাণী বিলোনিয়া থেকে স্টেশন ইনচার্জ মৃণালকান্তি দেববর্মণ দাদা আমাকে বললেন সাব্রুম থেকে দুএকজন শিল্পীকে পাঠাতে ৷ অরুণ নিজে গেলেন ৷ সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর ছাত্রী দূর্বা নন্দীকে ৷ দুজনেই মৃণালদার মন জয় করে ৷ অরুণের ছাত্রী দূর্বাতো পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এম মিউজে স্ট্যান্ড করে ৷ বিবাহসূত্রে দূর্বা এখন রাজ্যের বাইরে আছে ৷ সেখানেও দূর্বা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ৷ তালিম দিয়ে যে কোনজনকে শিল্পী বানিয়ে ফেলতে পারা এবং প্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অরুণের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ৷ আমার সাম্প্রতিককালে দেখা সাব্রুমের সঙ্গীতশিল্পী গৌতম ঘোষ এবং রাজ্যের বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. সুব্রত দেব তার উজ্জ্বল উদাহরণ ৷
কদিন আগেও অরুণ অনুষ্ঠান করেছেন ৷ মনে বয়নি এমন মারণব্যাধি তাঁকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে ৷ সাব্রুমের সাংস্কৃতিকপরিমন্ডলের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল অরুণের প্রয়াণ ৷ মনটা মেনে নিতে পারছেনা ৷ 'তবু যেতে দিতে হয়' ৷
Saturday, July 7, 2018
একদিন মাটির ভিতর....
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment