অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ ত্রিপুরা অংশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ জনপদ ছিল ৷ সময়ে সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ত্রিপুরার রাজারা, রাজপরিবারের সদস্যরা কিংবা রাজা কর্তৃক নিয়োজিত বিভিন্ন রহ
রাজপুরুষগণ বসতি স্থাপন করে রাজকার্য পরিচালনা করে গেছেন ৷ কোনো কোনো সময় মাণিক্য রাজারা ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠীর লোকজনও এখানে রাজত্ব করেছেন বা বসতি স্থাপন করেছেন ৷ বর্তমানে বিলোনিয়া, সাব্রুম ও শান্তিরবাজার নিয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা ৷ এই জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও প্রচুর ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে ৷ যে ইতিহাস আজও উন্মোচিত হয়নি ৷ যাও সামান্য আলোচনায় এসেছে তাও সম্পূর্ণ নয় ৷ এখনও বহু অনালোচিত, অনালোকিত রয়ে গেছে ৷ কিছু কিছু ঐতিহাসিক উপাদানের ও প্রত্ননিদর্শনের উপর আলোচনা হয়েছে যা বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো ৷
বিলোনিয়া মহকুমার বিস্তীর্ণ জনপদ দীর্ঘকাল যাবত অনেক বেশি সমৃদ্ধ ৷ মহকুমা শহর বিলোনিয়াকে কেন্দ্র করে তার তিনদিকে বিস্তীর্ণ জনপদ ছড়িয়ে রয়েছে ৷ পশ্চিম দিকে পশ্চিম পাহাড় ও দক্ষিণে বিস্তৃত নলুয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই মহকুমার বিস্তৃতি ৷ সম্প্রতি তার পূর্বাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে শান্তিরবাজার মহকুমা ৷ বিলোনিয়া ও শান্তিরবাজার মহকুমার মাঝ বরাবর ও সাব্রুম সীমান্তসংলগ্ন অংশ জুড়ে রয়েছে ‘টাক্কা তুলসী’ পাহাড় স্থানীয় ভাষায় ‘ তুলইস্সা টিলা’ ৷ এই টাক্কা তুলসী পাহাড়ে ও তার দুই পাশে ছিল প্রাচীন জনপদ ৷ ফলে এই পাহাড়ের এবং তার দুই পারে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থাকা অসম্ভব নয় ৷ রয়েছেও প্রচুর ৷ সমগ্র বিলোনিয়া বা শান্তিরবাজারকে নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করলে বিশাল তথ্যভান্ডার উন্মোচিত হতে পারে ৷
বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা এই পাহাড়ের এবং তার দুই পাশের জনপদসমূহের প্রাচীনতা নিয়ে দুচারটি উদাহরণ তুলে ধরব ৷ ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে আমরা ত্রিপুরার প্রাচীন কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে রাজমালা, শ্রেণীমালা, চম্পকবিজয়, কৃষ্ণমালা ও গাজীনামা ইত্যাদি গ্রন্থের আশ্রয় নিতে পারি ৷ এইসব প্রাচীন পুথিপত্রে মতাই, রাজনগর, মুহুরীনদী, লাউগাঙ, ফেনীনদীসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নাম পাই ৷ রাজন্য আমলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সোনামুড়া বিভাগের উপবিভাগ হিসেবে বিলোনিয়াতে রাজাদের একটি কার্যালয় গড়ে ওঠে ৷ এই সময় দক্ষিণের সাব্রুমসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিলোনিয়া উপবিভাগের অধীন ছিল ৷ পরবর্তী সময়ে উনিশশো দশ সালে সাব্রুমে আর একটি উপবিভাগ চালু হয় ৷
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ই়তিহাসে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যায় প্রাচীন রাজমালা গ্রন্থে ৷ এই গ্রন্থের শুরুতে কিছু পৌরাণিক অনুষঙ্গ দিয়ে ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের রাজত্বকালের প্রাচীনত্ব নিরূপনের প্রয়াস থাকলেও মোটামুটি মোগল শাসনামলের সময়কাল থেকে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় ৷ বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগের কাল থেকে পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বংলার সুলতানদের যুদ্ধবিগ্রহ, সমঝোতা ইত্যাদির বিবরণ পাওয়া যায় ৷ পরবর্তী সময়ে ইংরেজ আমলের কথা ও ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসের তথ্য রাজমালায় রয়েছে ৷ পাশাপাশি প্রাচীন আরাকানের সাথে ত্রিপুরার রাজার সম্পর্ক, যুদ্ধবিগ্রহের কথাও এই গ্রন্থে পাওয়া যায় ৷
আশ্চর্যের বিষয় হল, মতাই, লাউগাঙ, ,মুহুরীনদী ইত্যাদি নাম রাজমালায় থাকলেও সন্নিহিত প্রাচীন জনপদ পিলাক সম্বন্ধে রাজ্যের প্রাচীন সাহিত্যসমূহ একেবারে নিশ্চুপ ৷ অথচ এখানে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজারা রাজত্ব করার কথা কোথাও কোথাও উল্লেখ রয়েছে পিলাক নামটি ব্যবহার না করে ৷ এটি একটি রহস্যময় ঘটনা ৷ অথচ দক্ষিণ ত্রিপুরার জোলাইবাড়ি সংলগ্ন ‘পিলাক’ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আকর ৷ একমাত্র ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণের ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্থে পিলাকের বিভিন্ন মূর্তি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে ৷ পরবর্তী সময়ে প্রিয়ব্রত ভট্টাচার্য, রত্না দাস, ড. জগদীশ গণচৌধুরী, ড. অনাদি ভট্টাচার্য,ড. রঞ্জিত দে, দীপক ভট্টাচার্য ও ড. আশিসকুমার বৈদ্য প্রমুখ গবেষকগণ পিলাকের উপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন ৷ দীপক ভট্টাচার্য লেখালেখির পাশাপাশি পিলাকের উপর একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্রও নির্মান করেন ৷ এর ফলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় ৷ তারাও এই অঞ্চলে খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করেন ৷ একসময় রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এখানে পিলাক উৎসবেরও আয়োজন করা হয় ৷ পিলাক উৎসবের শুরুর সময় প্রকাশিত স্মরণিকায় এই প্রাবন্ধিকের ‘কিংবদন্তী ও স্থাননামে পিলাক প্রসঙ্গ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ৷ দুর্ভাগ্যবশত স্মরণিকার সেই সংখ্যাটি প্রাবন্ধিকের হাতে আসেনি ৷ সেই স্মরণিকাটি কোথাও সংরক্ষিত আছে কিনা তাও জানা যায়না ৷ সেই স্মরণিকায় বেশ কয়েকজন লেখকের বেশ কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ ছিল ৷ সেখানে এই প্রাবন্ধিক তাঁর সংগৃহীত একটি মগ কাপ্যা অর্থাৎ লোকসঙ্গীতের উল্লেখ করেছিলেন ৷ এই মগ লোকসঙ্গীতটিতে একটি করুণ লোককথা ছিল যা থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলে একসময় মগ জনগোষ্ঠীর ‘প্লেঙ’ শাখার রাজার বা গোষ্ঠীপতির রাজত্ব ছিল ৷ এই ‘প্লেঙ’ শব্দটির ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত রূপ— প্লেঙ> প্লেঙ্ক>পেলেক>পেলাক>পিলাক নামে পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে বলে এই প্রাবন্ধিক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ৷
এই অঞ্চলের যে জনগোষ্ঠীকে ‘মগ’ বলে অভিহিত করা হয় তারা কিন্তু নিজেদের মগ পরিচয় অস্বীকার করেন ৷বরং তারা নিজেদের আরাকানি বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন ৷ এই আরাকনীদের বিভিন্ন গোত্র রয়েছে ৷ তার মধ্যে মূল আরাকানে যাঁরা বাস করেন তাঁরা নিজেদেরকে ‘রখঁইঙসা’ বা ‘রখঁইসা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন ৷ এই রখঁইঙসা’ বা ‘রখইঁসা’ থেকেই রখঁই>রখঙ>রাহাঙ>রোসাঙ>রোহাঙ শব্দের উৎপত্তি ৷ আরাকানের প্রাচীন রাজবংশ ‘রোসাঙ’র নাম বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র মাত্রই জানেন ৷ এছাড়া তাঁদের আর একটি গোত্রের নাম ‘খিয়ঙসা’ বা ‘খ্যঙসা’ ৷ ‘খিয়ঙ’ বা ‘খ্যঙ’ শব্দের অর্থ হল নদী ৷ এবং ‘সা’ অর্থ সন্তান ৷ অর্থাৎ এই গোত্রের মানুষজন নদীতীরবাসী ৷ বিভিন্ন মগ জনপদে দেখা গেছে যে পাহাড়বেষ্টিত হলেও তাঁরা নদীতীরবর্তী অঞ্চলেই বসবাস করেন ৷ ফলে অনেকসময় নদীর নাম মিলিয়েই তাঁদের গোত্র বিভাজন হয় ৷ এভাবে তাঁরা বিভিন্ন নদী-পর্বত ইত্যাদির নামে তাঁদের গোত্রের নাম রাখেন ৷
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলায় মগদের বিশাল জনপদ রয়েছে ৷ বাংলাদেশে তাঁরা মারমা ও রাখাইন নামে পরিচিত ৷ এই জেলায় বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে ৷ তার মধ্যে শঙ্খ ও মাতামুহুরী প্রধান ৷ মাতামুহুরী নদীকে মারমারা ‘মুহুরী সং’ বলেন ৷ শঙ্খ নদী উত্তর-আরাকান থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে বান্দরবন শহরের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ৷ শঙ্খনদীর উপরের অংশকে মারমারা ‘সাবক সঙ’ এবং বান্দরবন শহরের পার্শ্ববর্তী অংশকে ‘রাগ্রে সঙ’ বলেন ৷ বান্দরবন শহরের রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘রাগ্রেসা’ বলে পরিচয় দেন ৷ ‘রাগ্রে সঙ’ নদীর নামে ‘রাগ্রেসা’ ৷ ‘রাগ্রে সঙ’ মানে মারমাদের ভাষায় ‘স্বচ্ছ জলের নদী’ ৷ মারমারা যাকং ‘সঙ’ বলেন ( ক্ষ্যঙ>ক্ষঙ>ক্ সঙ>সঙ) তাকেই মগ জনগোষ্ঠী ‘খ্যঙ’ বলেন ৷ অঞ্চলভেদে উচ্চারণের পরিবর্তন সব ভাষাতেই লক্ষ করা যায় ৷ মগজাতির ইতিহাসে দেখা যায় যে, 1782 খ্রিস্টাব্দে মারাচি নামে জনৈক আরাকানি গোষ্ঠীপতি কয়েকশো সঙ্গীসাথী নিয়ে ‘প্লেঙ সঙ’ নামে নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে ব্রিটিশ অন্তর্ভুক্ত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন ৷ ‘প্লেঙ সং’ নামানুসারে খাগড়াছড়ি জেলার মারমা জনগোষ্ঠীর নাম হয়েছে ‘প্লেঙসা’ ৷ তাদের বসতি এলাকার নাম ‘প্লেঙ থঙ’ ৷ ‘থঙ’ বলতে মারমা বা মগরা আবাসস্থল বোঝেন ৷ উল্লেখ্য বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় শহর সংলগ্ন একটি ছড়া আছে ৷ যেই ছড়াটির নাম ‘পিলাক ছড়া’ ৷ এই তথ্যটি বাংলাদেশের অগ্রণী দৈনিক ইত্তেফাকের রামগড় প্রতিনিধি বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব নিজাম উদ্দীন লাভলু সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রতিবেদককে জানান ৷ পার্শ্ববর্তী দেশের একজন নাগরিকের এই মহানুভবতার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমাদের নেই ৷ এই তথ্যটি পাওয়ার ফলে এই প্রতিবেদক পিলাক সম্পর্কিত আলোচনায় নতুন দিশা পান ৷ কারণ ইতিপূর্বে গবেষকগণ পিলাক নামে আর কোনো স্থান নেই বলে তাঁদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন ৷ অন্যত্রও একটি স্থানের নামের অস্তিত্বের ফলে পূর্বতন বক্তব্যের সারবত্তা থাকেনা ৷ পিলাক নামটি যে মগ জনগোষ্ঠীর দেওয়া নাম সেবিষয়েও একটা দৃঢ়তা আসে ৷ লক্ষ্যণীয় যে মগ বা মারমা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘পিলাক’ ও ‘মুহুরী’ দুটি শব্দই পাওয়া যাচ্ছে ৷ দক্ষিণ ত্রিপুরায়ও পিলাক জনপদ, পিলাক ছড়া, মুহুরী নদী এবং ‘প্লেঙসা’ গোত্রের জনগণ রয়েছে ৷ ইতিহাসের অজ্ঞাত অতীতকালে হয়তো এখানে তাদের রাজধানী ছিল ৷ একটা ক্ষীণ সূত্রকে যদি এখানে আলোচনার জন্যে তুলে ধরা হয় তাহলে হয়তোবা একটু আলোকরেখা দেখা যেতে পারে ৷ রাজমালায় বর্ণিত আছে আনুমানিক 590 খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুররাজা হিমতি ফা বা যুঝারফা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ‘লিকা’ রাজাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী রাঙামাটি দখল করেন ৷
রাঙামাটি দেশেতে যে লিকা রাজা ছিল ৷
সহস্র দশেক সৈন্য তাহার আছিল ৷৷
ত্রিপুর সৈন্য যুদ্ধ করে পরিপাটি ৷
ভঙ্গ দিয়া সব লিকা গেল রাঙ্গামাটি ৷৷
(শ্রীরাজমালা, প্রথম লহর যুঝার খন্ড)
তখন ‘লিকা’রা আরও দক্ষিণে সরে আসেন ৷ ঐতিহসিকগণ এই ‘লিকা’ জাতিকে মগ বলে চিহ্নিত করেন ৷ তাহলে এই মগরাই পশ্চাদপসরণ করে এই পিলাক অঞ্চলে তাদের নতুন বসতি স্থাপন করে ৷ যেহেতু এই যুদ্ধের ফলে মাণিক্য রাজাদের সঙ্গে, মগদের একটা শত্রুতা তৈরি হয়েছিল সেকারণেই ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস ও সাহিত্যে লিকা বা মগদের পরবর্তী রাজধানী পিলাকের নাম সচেতনভাবেই অনুল্লেখিত রয়ে গেছে ৷
আবার এই অঞ্চলে যে মাণিক্য রাজাদের কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে রাজধানী স্থাপন করে এই অঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনা করতেন তার নিদর্শনও রাজমালায় পাওয়া যায় ৷ যেমন—
জয়মাণিক্য মহারাজা পাত্রমিত্র লৈয়া ৷
উদয়পুরের দক্ষিণে মতাই রহে গিয়া ৷৷
মতাইতে রাজধানী করিল রাজন ৷
ত্রিপুর পাহাড় দক্ষিণ করয়ে শাসন ৷৷
গোবিন্দ মাণিক্যের ভাই জগন্নাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র রুদ্রমণি সুবা জয়মাণিক্য নাম ধারণ করে আনুমানিক 1738-1744 খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন ৷রাজমালায় উল্লেখ আছে যে যুঝারফার পরবর্তী পঁচিশতম রাজা ডাঙ্গরফা নামে ত্রিপুরার একজন (আনুমানিক 1280-1300 খ্রি) প্রাচীন রাজা ছিলেন ৷ তাঁর রাজধানী ছিল রাঙামাটি (বর্তমান উদয়পুর) ৷ তিনি তাঁর আঠারোজন পুত্রের মধ্যে একমাত্র রত্নফা ছাড়া বাকি সতেরোজনকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে শাসনভার অর্পন করেন ৷ কালিপ্রসন্ন সেনের রাজমালায় তার উল্লেখ রয়েছে—
নিজ রাজ্যভূমি রাজা সকলি দেখিল ৷
সপ্তদশ পুত্রে রাজ্য ভাগ করি দিল ৷৷
লোমাই নামে পুত্র বড় শিষ্ট ছিল ৷
মুহুরী নদীর তীরে নৃপতি করিল ৷৷
লাউগঙ্গা মুহুরীগঙ্গা তথায় নদী বসে ৷
আর ভ্রাতৃসঙ্গে রাজা বসে সেই দেশে ৷৷
অন্য আর একটি রাজমালাতে রয়েছে—
লোমাই নামে পুত বড় শিষ্ট হয় ৷
তার স্থান দিল রাজা মোহরী তীরয় ৷৷
লাউগঙ্গা মুহুরীগঙ্গা তাতে নদী আছে ৷
ভ্রাতৃর সহিত তানে দিলা সেই দেশে ৷৷
এখানে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, লাউগাঙ ও মুহুরী নদীর সঙ্গমস্থলের কাছাকাছি ত্রিপুরার রাজাদের রাজ্যপাট ছিল ৷ বর্তমান লাউগাঙ বাজারের অনতিদূরেই এই দুটি নদীর সঙ্গমস্থল ৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুথিশালায় সংরক্ষিত রাজমালার একখানি প্রাচীন পুথিতে ( নং 2259) আছে—’লোমাই নামেতে তান অন্য পুত্র ছিল / বরগলের সিমা করি তাকে রাজা কৈল’ ৷ এই বরগল বর্তমানে কোন জায়গা তা নির্ণয় করা যায়না ৷
এছাড়া পিলাক সন্নিহিত মুহুরীপুরের কাছাকাছি ‘বলির দিঘি’ নামে একটি বৃহৎ জলাশয় রয়েছে ৷এই দিঘি যাঁর নামে সেই বলিভীম নারায়ণও ছিলেন রাজপুরুষ ৷ তিনি মহারাজ রত্নমাণিক্যের (1682,1685-1722খ্রি) মাতুল ৷ তিনি জোলাইবাড়ি, পিলাক অঞ্চলকে সাজিয়েছিলেন ৷ এই পর্বতবেষ্টিত জনপদে দিঘি,দেবালয় বাসভবন ইত্যাদি নির্মান করেছিলেন ৷ রাজধানী উদয়পুরের উপর মোগলদের শ্যেনদৃষ্টি ছিল ৷ সেকারণে তিনি এই নিভৃত স্থানটি বেছে নিয়ে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন ৷ তাঁর সম্বন্ধে সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মা লিখেছেন, “ ত্রিপুররাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তবর্তী বিলোনিয়া উপবিভাগে ‘পিলাক-পাথর’ নামে খ্যাত এক প্রাচীন গ্রাম আছে ৷ এই জনপদ উক্ত রাজ্যের পুরাতন রাজধানী উদয়পুরের দক্ষিণদিকে ন্যূনাতিরেক দ্বাদশ ক্রোশ দূরস্থ পর্বতমালার বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থিত ৷
উল্লিখিত গ্রামের উত্তরদিকে প্রবাহিত মুহুরী নদীর সন্নিহিত বলিভীম নারায়ণের নাম সমন্বিত একটি দীর্ঘিকা আছে ৷ এই স্থান নিবাসী জনসাধারণ কর্তৃক কথিত হয় যে, ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দ মাণিক্যের তনয় নৃপাল রাম মাণিক্যের শ্যালক বলিভীম নারায়ণ এই স্থানে বাস করিবার সময় দীর্ঘিকাটি খনন করাইয়াছিলেন ৷”(ত্রিপুরার স্মৃতি-সমরেন্দ্র দেববর্মা,পৃষ্ঠা-71) ৷
পিলাকের সংলগ্ন আর একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ মুহুরীপুর ৷ মুহুরী নদীর দুই পার ঘেঁষে এই জনপদ একটি সমৃদ্ধ শস্যভান্ডার ৷ মুহুরী নদীর সঙ্গে বাহিত পলিমাটিতে উর্বর এখানকার চরভূমি ও নিম্ন সমতল অঞ্চল ৷ এই ভূমিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয় ৷ এখানকার সব্জী দক্ষিণ ত্রিপুরার জনজীবনের দৈনন্দিন চাহিদার এক বৃহৎ অংশ পূরণ করে থাকে ৷ এই জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও নয়নমুগ্ধকর ৷ মুহুরীপুরের প্রাচীন নাম ‘লুংথুং’ ৷ ত্রিপুরার মহারাজারা এর নাম পরিবর্তন করে মুহুরীপুর রাখেন ( সূত্র: পিলাকসভ্যতা, আশিসকুমার বৈদ্য, পৃষ্ঠা-4) ৷ তবে কোন রাজা এই লুংথুং নাম পরিবর্তন করে মুহুরীপুর রাখেন সে বিষয়ে গবেষক আশিসকুমার বৈদ্য কোনো ইঙ্গিত দেননি ৷
এবারে আসা যাক মুহুরীপুরের আদিনাম লুংথুং প্রসঙ্গে ৷ এই প্রবন্ধের শুরুতে পিলাক সংক্রান্ত আলোচনা ও তার নামের ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে অনুমান করা গিয়েছিল যে, এই অঞ্চলে অতীতে মগ জনজাতির লোকজন বসবাস করত ৷ সেই হিসেবে এও অনুমান করা যায় যে, পিলাক থেকে সামান্য দূরের গ্রাম মুহুরীপুরেও অবশ্যই মগরা বসবস করতেন ৷ সেই হিসেবে লুংথুং নামের পেছনে মগ জনজাতির ভাষার প্রভাব থাকতে পারে ৷ মগ জনজাতির প্রতিনিধি প্রধান শিক্ষক এবং সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শ্রী থৈলাও মগ মহোদয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায় যে, মগজাতির ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায় ৷ ফলে উচ্চারণের সামান্য তারতম্যের কারণে এক জনগোষ্ঠীর কাছে একধরণের অর্থ বয়ে নিয়ে আসতে পারে ৷ ফলে লুংথুং শব্দটি মগ জনগোষ্ঠীর ভাষার শব্দ কিনা সে বিষয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি ৷ অন্যদিকে এই জনগোষ্ঠীর আর একজন প্রতিনিধি এবং মগ ভাষা ও সংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ও লেখিকা, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা ক্রইরী মগ চৌধুরী এই শব্দটি যে মগভাষা থেকে এসেছে সে ব্যাপারে জোরালো দাবি করেন ৷ তিনি জানান যে, লুংথুং শব্দের অর্থ “আবাদ করা বাসস্থান বা আবাসভূমি”৷
লুংথুং শব্দটির প্রতি ঔৎসুক্য বশত এই প্রাবন্ধিক আধুনিক সোস্যাল মিডিয়ার সুযোগ নিয়ে অতিসম্প্রতি জাপানে কর্মরত বনকুলের তরুণ মেধাবী যুবক ক্য চি নু মগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ৷ তিনিও লুংথুং শব্দটি যে মগভাষার শব্দ সে বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ৷ তিনি জানান, মগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের ‘লু’ বলে পরিচয় দেন ৷ আর ‘থং’ শব্দের অর্থ ‘বাসস্থান’ ৷ দুটি শব্দ একত্রে বোঝায় মানুষের বাসস্থান বা মগজাতির বাসস্থান ৷ এরকম প্রত্যেক জনজাতির একটা নিজস্ব পরিচয়সূচক নাম রয়েছে ৷ যেমন ত্রিপরিরা নিজেদের ‘বরক’ বলে পরিচয় দেন ৷ রিয়াংরা বলেন ‘ব্রু’ ৷ গারোরা বলেন ‘মান্দি’ বা ‘আচিক মান্দি’ ৷ মণিপুরিরা নিজের ‘মিতেই’ বলে পরিচয় দেন ৷ কালক্রমে উচ্চারণের বিকৃতির ফলে ‘লু থং’ নামটি ‘লুংথুং’ হয়েছে বলে ক্য চি নু মহোদয় মনে করেন ৷ এই ‘লুথং’ বা ‘লুংথুং’ নামক জনপদটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম মুহুরী ৷ এটিও মগ শব্দজাত বলে গবেষকগণ মনে করেন ৷ মগরা এই নদীকে ‘মুরি খ্যঙ’ বলে থাকেন ৷ তাঁরা বলেন ‘মু’ মানে বৃষ্টি এবং ‘রি’ হল জল ৷ এই দুটি শব্দ একসঙ্গে উচ্চারণ করলে হয় ‘মুরি’ অর্থাৎ এটি ‘বৃষ্টিজলবিধৌত নদী’ ৷ ক্রমশ বঙ্গজনগোষ্ঠীর প্রভাবে মুহুরীতে পরিণত হয়েছে ৷ আর মহারাজ কর্তৃক স্থাননাম পরিবর্তনের কথা তো গবেষকই উল্লেখ করেছেন ৷ আবার মগ জনজাতির বসবাসের ক্ষেত্রে অধিক ঘনত্বের কারণেও নাকি এই স্থানের লু থু নাম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন ৷ লু থু থেকেও লুংথুং হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না ৷ মগরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার নাম নিজেদের নির্ধারিত নামে চিহ্নিত করেন ৷ যেমন, দেবদারুকে বলেন নে-আরু ( দেবতার ছবি বা মূর্তি) , জোলাইবাড়ি> জোলাজি ইত্যাদি ৷ পিলাককে তাঁরা বলেন পা-লাঙ ৷ সাব্রুম মহকুমার বৈষ্ণবপুরকে বলেন পালাঙ-ওয়া ৷ ওয়া মানে যার সম্মুখ দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করে ৷ সেই হিসেবে ধরে নেওয়া যায় পা-লাঙ-ওয়া বা বৈষ্ণবপুর দিয়ে একসময় মগ জনজাতির লোকেরা প্রবেশ করে পিলাক অঞ্চলে যেত ৷ এই নামের মধ্য দিয়ে একটি ঐতিহাসিক সত্যতাও পাওয়া যায় ৷ এছাড়া রাজমালা অনুযায়ী জানা যায় যে, এই অঞ্চলে একসময় কুকিরা বাস করত ৷ কুকিদের ব্যবহৃত শব্দও এই অঞ্চলের স্থাননামের সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কুকিরা নোয়াখালির খন্ডল পরগনায় আক্রমণ করে হত্যা লুঠতরাজ সংঘটিত করেছিল ৷ তারা টাক্কা-তুলসী পাহাড়ে অবস্থান করত এবং সেখান থেকে সমতল ত্রিপুরায় আক্রমণ শানাত ৷ মতাই থেকে মুহুরীপুর অব্দি কুকিদের ব্যবহৃত একটি প্রাচীন পার্বত্যপথও ছিল ৷ এছাড়া পিলাক থেকে উদয়পুর অব্দি একটি পায়ে হাঁটা পথ ছিল ৷ মগ লোকসঙ্গীত ‘কাইপ্যাতে এই রাস্তাটিকে ‘পাইন্দা মঙ জাঙ্খা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷
দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়ামহকুমার বিভিন্ন জনপদ যেএককালে ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা অনস্বীকার্য ৷ অষ্টাদশ শতকের একজন বিদ্রোহী নেতা সমসের গাজি বিলোনিয়া অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করে ত্রিপুরার রাজাদের আক্রমণ করেন ৷ মগরাও বিভিন্ন সময়ে এই মহকুমার বিভিন্ন জনপদের উপর দিয়ে গিয়ে উদয়পুরের রাজধানী আক্রমণ করত ৷ রিয়াং বিদ্রোহের নায়ক রতনমণি রিয়াং এর কর্মতৎপরতা ছিল বিলোনিয়া মহকুমার এই অঞ্চলেই ৷ বিলোনিয়ার বিভিন্ন জনপদের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, “ লাউগঙ্গা মুহুরী নদীতে পতিত হইয়াছে ৷ মতাই বা মোতাই নামক স্থানে এখনও তহশিল কাছারি আছে এই স্থানে উচ্চ পাড় বিশিষ্ট একটি পুরাতন জলাশয় আছে ৷ এই জলাশয়ের একটি অংশ দিয়াই আধুনিক শালিসী সীমানার লাইন গিয়াছে ৷ মতাই হইয়া লুংথুং এলাকায় যাতায়াতের সুবিধাজনক পার্বত্য রাস্তা আছে এবং এই রাস্তায়ই কুকিগণ পর্বতাভ্যন্তর হইতে আসিয়া মুনসির খিল প্রভৃতি স্থানে ভীষণ অত্যাচার করিয়াছিল ৷ কুকির অত্যাচারের কাহিনিগুলি গ্রাম্য কবির বিরচিত কতকগুলি কবিতায় বর্ণিত আছে “( ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিশ বছর- বিলেনিয়া বিভাগ) ৷
পিলাক একটি বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র ৷ এই এলাকা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ গবেষকগণ ও ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, এখানে একসময় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল ৷ পিলাকে প্রাপ্ত প্রাচীন মূর্তিগুলি তার সাক্ষ্য বহন করে৷ পিলাকে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোতে যেমন পাল যুগের (8ম—12শ শতাব্দী) বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় তেমনি বর্মন (1080—1150খ্রি.) ও সেনযুগের ( 1070—1230খ্রি.)হিন্দু রীতির ভাষ্কর্যের প্রমাণও রয়েছে এখানে ৷ পিলাককে কেন্দ্র করে এই জনপদে সাংস্কৃতিক ও চেতনা বিকাশের চর্চা এ অঞ্চলে শুরু হয়েছিল পাল ও সেন যুগে ৷
পিলাক অঞ্চল যে একসময় সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ছিল তা ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করেন ৷ পিলাকের একটা অংশের নাম সাগর ঢেবা তারই ক্ষীণ সূত্র ধরে রেখেছে ৷ একসময় নৌপথে এই অঞ্চলের সঙ্গে পট্টিকেরা সমতটের নিবিড় যোগাযোগ ছিল ৷ এছাড়া শ্রীহট্ট থেকে শুরু করে কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও আরাকানের কিছু অংশ নিয়ে ছিল হরিকেল সাম্রাজ্য বা হরিকেল মন্ডল ৷ খ্রিস্টিয় দশম শতকের দিকে ছিল এই হরিকেল মন্ডল ৷ ফলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পিলাকের সঙ্গে সে যুগে আরাকানেরও যোগাযোগ ছিল ৷ পিলাকে প্রাচীন হরিকেল মুদ্রা পাওয়া যায় ৷ ফলে বোঝা যায় যে হরিকেল মন্ডলের সঙ্গে পিলাকের যোগাযোগ ছিল ৷ এ প্রসঙ্গে রাজ্যের বর্ষিয়ান গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী উল্লেখ করেন, “ Archaeologically, Tripura is not very old, but it is not devoid of any importance. In the south-western portion of tripura inhabitated in the past by buddhist Mogs, there were several Vihars which might have close link with Pattikera, Lalmai and Maynamati. The remain of rock-cut images of buddha and hindu deities are still extent in certain places. Natural and human agencies have destroyed many of them. Pilak is such a locally famous site.”(An anthropology Of Tripura-Dr. J. C. Ganchoudhury).
পিলাক নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেছেন দীপক ভট্টাচার্য ৷ তিনিও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন ৷ অধিকন্তু প্রাচীন আরাকানের সঙ্গে যে এই অঞ্চলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল সেই বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন ৷ তিনি বলেন,” এখানকার মানুষের মানসিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে ৷ শুধুমাত্র বঙ্গ, সমতট নয় পিলাকের ভৌগোলিক অবস্থান ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এখানকার মানুষের মধ্যে আরাকান, বার্মার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ছাপ নজরে পড়ে ৷ তাদের জীবনযাত্রা আচার-আচরণে এই সাদৃশ্য লক্ষ করার মতো ৷ শুধু জীবনযাত্রায় নয়, এমনকি স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যেও বিশেষ অঞ্চলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় ৷ ত্রিপুরার মন্দিরসমূহ সাংস্কৃতিক মিশ্রণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৷ বৌদ্ধ স্তুপশীর্ষ ও বাংলার আটচালাবিশিষ্ট নির্মানশৈলী অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক নতুন স্থাপত্যশৈলী যা ধর্মীয় সহাবস্থান ও সহনশীলতার বাণীই প্রচার করে ৷” ( পিলাক কথা-দীপক ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা-55) ৷
সেযুগে পিলাকের নাম যে সুদূর আরাকানে গিয়ে পৌঁছেছিল তারও নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন প্রত্ন উপাদানে ৷ আরাকানের ম্রোহং অঞ্চলের সিত্থাউং প্যাগোডায় রক্ষিত আনন্দচন্দ্রের উৎসর্গীকৃত অষ্টম শতকের একটি স্তম্ভে উৎকীর্ণ লেখায় ‘পিলাক্ক-বনক’ শব্দটি পাওয়া যায় ৷ এই ‘পিলাক্ক’ থেকে পিলাক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে ৷
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ একসময় এই বিশাল জনপদ জনকোলাহলে পূর্ণ ছিল ৷ কালের প্রবাহে কোনো রাজনৈতিক কারণে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই জনপদ তার অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল ৷ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের সূত্র ধরেই আবার জেগে ওঠে এই জনপদসমূহ ৷ মানুষজনের বাস শুরু হয় ৷ কিন্তু প্রাগুক্ত দীর্ঘ অতীত ইতিহাস কালগর্ভে হারিয়ে যায় ৷ তার ক্ষীণ কিছু উপাদানই এই অঞ্চলের প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷ সমগ্র ইতিহাস আজও অনালোচিত, অনালোকিত ৷ নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে সেই ইতিহাস উন্মোচিত হতে পারে ৷ প্রজন্মই পারে সময়ের দাবিকে পূরণ করতে ৷
No comments:
Post a Comment