আমার বয়স পঁয়ষট্টি ৷ কিন্তু তেমন চাপ অনুভব করিনা ৷ আমার সমবয়সী অনেক বন্ধুবান্ধব ইতোমধ্যে এজগৎ পেরিয়ে গেছে ৷ কিন্তু আমি যেতে পারছিনা ৷ চাইলেই কী আর যাওয়া যায় ৷ নরম মনের মানুষেরা বলেন সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছে ৷ আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, কবে আমিও পেরিয়ে যাব দিগন্তরেখা ৷ আমার শরীরে মনে তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি ৷ আজ অব্দি ৷ না, জ্বরজারিও হয়না আমার ৷ রোজ সকালে দিব্যি সাত-আট কিলোমিটার ঘুরে আসি প্রাতঃভ্রমণ করে ৷ খুব ভোরেই উঠি ৷ সবাই বারণ করে এতো ভোরে বেরুতে ৷ এসময় নাকি অশরীরীরা বিচরণ করেন ৷ তাঁদের খপ্পরে পড়লে প্রাণটা খোয়াতে হতে পারে ৷ এঁদেরই নাকি ভূত বলা হয় ৷ সবাই সমীহ করেই কথাগুলো বলেন ৷ আমি পাত্তা দিই না ৷ বলি, ধরে নাও আমি ভবিষ্যতের ভূত ৷ আমি কী করি বলা যায়না ৷ বরং তোমরা সাবধানে থেকো ৷
আমার একটা লালরঙের বাইক আছে ৷ এটা নিয়েই আমি এখনও বহু দূরদূরান্তে পাড়ি দিই ৷ বাইক-রাইডিং আমার শখ ৷ নেশাও বলা যেতে পারে ৷ আগে আমার প্রান্তিক শহরটা থেকে রাজধানী চলে যেতাম ৷ পরম হিতৈষী শুভংকরদা ধমকানোর পর থেকে সেটা বন্ধ করেছি ৷ তবুও এখনও জেলাশহর পর্যন্ত যাই ৷
তা কদিন আগে ফিরছিলাম জেলাশহর থেকেই ৷ সন্ধ্যের একটু আগে রওনা দিয়েছি ৷ আগেরদিন পূর্ণিমা গেছে ৷ জোছনা একটু দেরিতে উঠেছে ৷ পিলাকপাথর পৌঁছুতেই সারামাঠ জুড়ে ঢালাও বিছানার মতো ফরসা জোছনা পাতা ৷ এমনিতে জায়গাটা প্রত্নক্ষেত্র ৷ পুরোণো মূর্তি, অট্টালিকার অবশেষ রয়েছে ৷ জায়গাটা নিয়ে অনেক গল্প ৷ অনেক মিথ রয়েছে ৷ জায়গাটা নির্জনও ৷ একটা বাঁক পেরিয়ে এসেছি ৷ খোলা মাঠের মাঝখান দিয়ে গেছে রাস্তাটা ৷ কিছুদূর গিয়ে জাতীয় সড়কে পড়বে ৷ আমাকেও জাতীয় সড়কে এসে ডানদিকে যেতে হবে ৷ খোলামেলা হওয়ায় অনেকদূর দেখা যায় স্পষ্ট ৷ বাইকও চালাচ্ছি ষাট-পঁয়ষট্টি বেগে ৷ বাইকে উঠলে গতি সম্বন্ধে আমার হুঁশ থাকেনা ৷ এজন্যে প্রিয়জনদের কাছে বহুবার ধমক খেয়েছি ৷ বাইকের চাবিও বাজেয়াপ্ত করেছে বন্ধুরা কয়েকবার ৷
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ডানদিকের জমির আল ধরে একজন ছুটতে ছুটতে রাস্তার দিকে আসছে আর চিৎকার করে কিছু বলছে ৷ বাইকের গতির কারণে আমি ওকে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় ৷ বিশ্বাস করবেননা ৷ লোকটা যেন তিনলাফে মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় আমার বাইকের সামনে এসে পড়ল ৷ খুব জোরে ডিস্কব্রেকসহ চেপে বাইক থামালাম ৷ ধমক লাগালাম ওকে, আর একটু হলেই তো চাপা পড়তেন ৷ লোকটা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কাতরকন্ঠে বলে উঠল, মহাশয়, দয়া করিয়া আপনি যদি আমাকে আপনার যানে উঠাইয়া লন তবে বিশেষ উপকৃত হইব ৷ বড় সড়কে পৌঁছাইলেই চলিবে ৷ তথা হইতে আমি অন্য যান পাইয়া যাইব ৷
কোথায় যাবেন আপনি?
মহাত্মন, আমি শাকবাড়ি যাইব ৷ সেখানে উপজাতি পল্লীতে আমার নিবাস ৷
এ দেখছি সবকথা সাধুভাষায় বলছে ৷ শাকবাড়ির কথা বলায় আমি একটু ভাবছি ৷ জায়গাটা আমার যাত্রাপথেই পড়ে ৷ ওকে বড়ো রাস্তায় না নামিয়ে আমার সঙ্গেই নিতে পারি ৷ তবে জায়গাটা সম্বন্ধে দুর্নাম আছে ৷ একটু রাত হলে পথচারীর উপর আক্রমণ হয় ৷ টাকা পয়সা ছিনতাই হয় ৷ মার্ডার হয়েছে কয়েকটা ৷ ভেবেছিলাম জায়গাটা দ্রুত পেরিয়ে যাব ৷ ভালোই হল একজন সঙ্গী পাওয়া গেল ৷ কথাবার্তা বলতে বলতে যাওয়া যাবে ৷ আমি বললাম, আমি তো শাকবাড়ির ওপর দিয়েই যাব ৷ চলুন একসঙ্গে কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে ৷ তাহা হইলে তো অতি উত্তম হয় ৷ লোকটা বলল ৷
বাইক গতিতেই চালাচ্ছি ৷ কথাও বলছি ৷ তা আপনি খেতের মাঝখান দিয়ে কোথা থেকে আসছিলেন?
মধ্যপিলাক হইতে ৷ তথায় একটি চারু ও কারুশিল্প শিক্ষাকেন্দ্র রহিয়াছে ৷ আমি তথায় অধ্যাপনা করি ৷
আমি বললাম, ও আপনি শিল্পী ৷ আমিও একটু আধটু শিল্পচর্চা করি ৷ আমি ছবি আঁকি ৷
বুঝলাম একারণেই তিনি বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলছেন ৷
তিনি নিজে নিজেই বলছেন, আমার জীবন সংশয়াপন্ন ৷ আমাকে আত্মগোপন করিতে হইবে ৷ তাই রাত্রিবেলা বাহির হইয়া পড়িয়াছি ৷ গ্রামে আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্র রহিয়াছে ৷ তাহাদের দর্শন করিয়াই পুনরায় অনির্দেশের পথে পাড়ি দিব ৷
ভাবলাম কোনো রাজনৈতিক কারণ কিনা ৷ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিরোধী শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছে ৷ কিন্তু শিল্পী বলছেন আজব কথা ৷ রাজা তাঁর নামে হুলিয়া জারি করেছেন ৷ মাথার দাম ঘোষণা করেছেন দশহাজার সুবর্ণমুদ্রা ৷ কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম৷
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজা কোথায়? নাকি শিল্পী মানুষ ৷ হেঁয়ালিতে কথা বলছেন ৷
কথা শুনতে শুনতে বাইক চালাচ্ছি ৷ হঠাৎ সামনের চাকাটা একটা গর্তে পড়ে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল ৷ লোকটা লাফিয়ে উঠে আমার পিঠের উপর পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল ৷ যেন আস্ত একটা সিমেন্টের বস্তা আমার পিঠে চেপে বসল ৷ শিল্পীর হাতদুটো এতো ঠান্ডা ৷ বরফের মতো ৷ মানুষের হাত এতো শীতল হয়না ৷ হাতদুটো আস্তে আস্তে আমার গলা পেঁচিয়ে চেপে বসতে লাগল ৷ আমি বাইকের গতি বাড়িয়ে দিলাম ৷ আরো জোরে বাইকের গতি ৷ আরো জোরে চেপে বসছে হাত ৷ শিল্পী বলছে, সম্মুখের বাঁক অতিক্রম করিলেই আমাকে অবতরণ করিতে হইবে ৷ রাজার সৈনিকগণ আমাকে এইস্থানেই ৷
কে কে আপনি? বলুনতো সত্যি করে ৷ আপনি কী আসলেই শিল্পী? অতি কষ্টে গলা দিয়ে স্বর বের করে বললাম ৷
হ্যাঁ, আমি শিল্পী ৷ তবে আজি আর নহি ৷ অদ্য আমি অশরীরী ৷ ভূত ৷ রাজার সৈন্যগণ আমাকে এইখানে হত্যা করিয়া পুঁতিয়া ফেলিয়াছিল ৷
আমার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে ৷ অশরীরীর হাতের চাপে দমবন্ধ হয়ে আসছে ৷
আপনি হয়তো জানেননা ৷ সেই সৈন্যদলে আপনিও একজন সৈনিক ছিলেন ৷ আপনার পূর্বজন্মের কথা বিস্মরণ হইয়াছে ৷ অদ্য আমি আপনার উপর প্রতিশোধ লইব ৷ আপনি হইবেন ভবিষ্যতের ভূত ৷
বাইকটা বিকট শব্দ করে রাস্তার পাশে একটা গাছে গিয়ে লাগল ৷ আমিআর কিছু বলতে পারবনা ৷
Sunday, April 7, 2019
ভ বি ষ্য তে র ভূ ত
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment