ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে পুণ্যার্থীর লাঞ্ছনা ও প্রতিবিধানের পদক্ষেপ
হিন্দুদের তীর্থস্থানে পান্ডা ও ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য নতুন কোনো ঘটনা নয় ৷ আসামের কামাখ্যাতীর্থ, পুরীর জগন্নাথধাম, কালীঘাটের মায়ের মন্দির, মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে তীর্থ করতে গিয়ে পান্ডা ও সংশ্লিষ্টদের হাতে নাজেহাল হননি এমন তীর্থযাত্রী কমই আছেন ৷ এইসব তীর্থক্ষেত্রের মধ্যে দুর্নামের দিকে শিরোপার অধিকারী অবশ্যই গয়াধাম ৷ গয়ার পান্ডার অত্যাচার ভুবনবিদিত ৷ বিভিন্ন মন্দিরে পুণ্যকর্মসমূহ সম্পাদনের জন্য পুরুষানুক্রমে নির্ধারিত পুরোহিত তথা পান্ডার সাহচর্য নিতে হয় ৷ এটাই রীতিরেওয়াজ ৷ কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এইসব তীর্থস্থানের পান্ডা ও সংশ্লিষ্টরা পুণ্যার্থীদের উপর একরকম জোরজবরদস্তি করে থাকে ৷ এদের খপ্পরে পড়ে নিরীহ তীর্থযাত্রীরা অনেকসময় সর্বস্বান্ত হন ৷ এমনকী কখনও কখনও প্রাণসংশয়ও হয় ৷
পান্ডাদের অত্যাচার যে কতোটা অসহনীয় তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন ৷ কবিপক্ষে প্রাসঙ্গিকভাবে তাঁর উদ্ধৃতিটি স্মরণ করছি ৷ বিশ্বকবি তাঁর 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতার এক জায়গায় লিখেছেন, 'নামিনু শ্রীধামে দক্ষিণে ও বামে পিছনে সমুখে যত/ লাগিল পান্ডা নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত ৷' তীর্থক্ষেত্রে নামার সঙ্গে সঙ্গে পান্ডা ও তাদের দালালরা শিকার ধরার মতো পুণ্যার্থীকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ৷ শুধু রবীন্দ্রনাথই নন ৷ এইসময়ের সাহিত্যিক তথা আমাদের রাজ্যের কথাসাহিত্যিক এল. বীরমঙ্গলের 'পিন্ডদান' গল্পেও এইধরনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে ৷ সেখানে অবশ্য মণিপুরি পান্ডার জুলুমের কথা রয়েছে ৷ অনেক কায়দাকানুন করে গল্পের দুই মণিপুরি ভাইকে পরলোকগত পিতার পিন্ডদানকর্ম শেষ করে বেরিয়ে আসতে হয়েছে ৷
আমাদের রাজ্যের প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র মাতাবাড়ির ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির ৷ কথিত আছে সতীর দেহাংশ পড়েছিল এইস্থানে ৷ তাই এটি একান্ন পীঠের এক পীঠ ৷ বলাবাহুল্য অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের তুলনায় কিছুটা কম হলেও এই তীর্থক্ষেত্রেও পান্ডা ও সংশ্লিষ্টদের জুলুম বিদ্যমান ৷মন্দিরে পুজো দেওয়া, দোকান থেকে পেঁড়া কেনা, ভোগ দেওয়া, ভোগসংগ্রহ, বলিদান, একটু অসময়ে যানবাহনে যাত্রীভাড়া ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রায়শই এখানে ঝুটঝামেলা হয় ৷ অনেকে অন্নপ্রাশন ও বিবাহানুষ্ঠানও এই মন্দিরপ্রাঙ্গনে সারেন ৷ আর্থিক দৈন্যতার কারণে, বিনা পণে বা প্রণয়ঘটিত কারণে অনেকে এই মন্দিরে বিবাহানুষ্ঠানও সম্পন্ন করেন ৷ তারজন্যে সরকারি তরফে নির্ধারিত ফি নেওয়া, রসিদ দেওয়া ও সইসাবুদের ব্যবস্থাও রয়েছে ৷ কিন্তু এজাতীয় অনুষ্ঠানে মন্দিরের পুরোহিত ও সংশ্লিষ্ট সকলে কাল্পনিক অনৈতিকতার গন্ধ পান ৷ এতে তাদের পোয়াবারো ৷ এক্ষেত্রে তারা উদার না হয়ে বরং বর ও কনেপক্ষের উপর আর্থিক জোরজুলুম করেন ৷ তাদের দাবিমতো টাকাপয়সা না ছাড়লে মানসম্মান নিয়ে মন্দিরচত্বর থেকে বেরোনো দুস্কর হয়ে দাঁড়ায় ৷ এক্ষেত্রে এখানে অবস্থানরত দায়িত্বপ্রাপ্ত আরক্ষাকর্মীরাও ভক্ষক হয়ে ওঠেন ৷ এছাড়া রাজ্যের বাইরে থেকে এখানে মানতরক্ষার জন্যে কেউ এলে তাদের অপরিচিতির সুযোগে জোরজুলুম করার অভিযোগ বহু রয়েছে ৷ বহির্রাজ্যের পুণ্যার্থীরা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই এখান থেকে যান ৷
সম্প্রতি মাতাবাড়িতে পুণ্যার্থীর এমনই এক লাঞ্ছনা ও প্রশাসনের পদক্ষেপের ঘটনায় সকলের টনক নড়ে যায় ৷ সংবাদে প্রকাশ গত পাঁচ মে গোমতীজেলার উদয়পুর মহকুমার গাথালং এলাকার বাসিন্দা পাতালকুমার নোয়াতিয়া স্বপরিবারে মাতাবাড়িতে পুজো দেওয়ার জন্য যান ৷ তাঁরা গাড়ি করে কল্যাণদিঘির পাড়ে পৌঁছাতেই কয়েকটি পেঁড়া দোকানের কর্মীরা তাঁদের ঘিরে ধরে প্রত্যেকেই তাদের দোকান থেকে পেঁড়া কেনার জন্যে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করে ৷ এতে পাতালবাবুর পরনের পোষাক পর্যন্ত ছিঁড়ে যায় ৷ লাঞ্ছিত ও ক্ষুব্ধ পাতালবাবু সুবিচার চেয়ে বিষয়টি মন্দিরের সেবাইত তথা গোমতীজেলার জেলাশাসকের গোচরে নেন ৷ অভিযোগ পেয়ে জেলাশাসক সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার সরেজমিনে তদন্ত করেন ৷ তদন্তের পর তিনি তিনটি পেঁড়ার দোকানমালিককে শোকজ নোটিশ দেন ৷ নির্দিষ্টসময়ের মধ্যে অভিযুক্ত পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে জেলাশাসক তিনটি দোকানকে দশ মে থেকে একমাসের জন্যে দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন ৷
লক্ষ্যণীয়, এদের ঔদ্ধত্যের মাত্রা এতো বেশি যে তারা মন্দিরের প্রধান সেবাইত তথা জেলাশাসকের নির্দেশকেও গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি ৷ এদিকে জেলাশাসকের গৃহীত পদক্ষেপে সর্বত্র একটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে ৷ সম্প্রতি রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম হওয়ার ফলে এই মন্দিরে পুণ্যার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে দিনকে দিন ৷ ফলে অচিরেই এইসব নানাধরনের অসভ্যতা ও দৌরাত্ম্য ঠেকানোর জন্য প্রশাসনিক নির্দেশিকা যেমন জরুরি তেমনি এই নির্দেশিকা ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা তাও দেখা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সকলমহল মনে করছেন ৷ পাতালবাবুর নিগ্রহের ঘটনা সেইদিকেই নির্দেশ করছে ৷
No comments:
Post a Comment