বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে অম্ভৃণ ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাচ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেনমল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷
No comments:
Post a Comment