চাঁদমঙ্গল
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !
আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।
সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।
No comments:
Post a Comment