বসন্তে মেধা ও মননের মেলা, বই মেলা
অশোকানন্দ রায় বর্ধন
বইমেলা । আর দশটা মেলার মতো নয় এই মেলা । সংবৎসর আর সব মেলা হয় যেখানে থাকে ব্যসনের সামগ্রী । বৈভবের সমাহার । বিত্ত বাসনা নিবৃত্তির উপকরণ । মনোহারি সব সরঞ্জামের সমাবেশ । বইমেলা এসব থেকে পুরোটাই আলাদা । হ্যাঁ বইমেলারও একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে । এ টেনে নেয় গুণীজনকে । মননশীলতাকে । ঐতিহ্যের প্রতিও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে বইমেলা তার পারিপার্শ্বিকতায় । বইয়ের প্রতি প্রণয় আত্মার আকর্ষণ । বিশ্বকে আপন করে নেবার প্রক্রিয়ায় কালো অক্ষরের আনন্দযজ্ঞ । ইতিহাস সংস্কৃতিকে ভালোবাসা । তার টানেই বইমেলায় সামিল হওয়া । অজান্তেই মন বলে ওঠে– বইমেলা, 'এই কি তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ ?' তেমনি এক হার্দ্য বইমেলার নাম আগরতলা বইমেলা । বিশ্বের বঙ্গভাষী অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা । আজ ছত্রিশ বছরে পড়ল এই বইমেলা । ১৯৮১ সালের তিরিশে মার্চ মাত্র ২৪ টি স্টল নিয়ে আগরতলা রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গনে শুরু হয়েছিল এই বইমেলা । তারপর জুরি-দেও-মনু-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জলস্রোত । শৈশব পেরিয়ে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের শ্যামল গরিমায় পৌঁছে গেছে আগরতলা বইমেলা । আজ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ জেনে গেছে আগরতলা বইমেলার নাম মাহাত্ম্য । আজই যখন দিবসের দাবদাহ ক্রমশ শীতল হয়ে আসবে, চৈতালি হওয়ার বাসন্তী আমেজে যখন অপরাহ্ন ভরে উঠবে কোমল মায়ায়, সেখানে উদ্বোধন হবে আগরতলা বইমেলার । রাজ্যের মননের উৎসবমালার প্রধান মন্ডপের ।
বই মানুষের সভ্যতার অপরিহার্য জীবনবীজ । মানব ইতিহাস সৃষ্টির ধারক ও বাহক । বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষ পরস্পর মননের আনন্দ ভাগ করে নেন । আগরতলা বইমেলাও সেজে উঠেছে সেই নেশায় । সেই আকর্ষণে । রাত দিন খাটাখাটনির পর চলছে শেষ তুলির টান । নির্মীয়মান অস্থায়ী মঞ্চের অলংকরণ । বইমেলাকে কেন্দ্র করে আগরতলা শহর জুড়ে বইপ্রকাশের উন্মাদনা । ইতোমধ্যে হইচই বাঁধিয়ে অনুষ্ঠান করে এক ঝাঁক বই প্রকাশ করে ফেলেছেন নীহারিকা, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, ভাষা, তুলসী পাবলিশিং হাউস এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো । মফস্বল শহর কুমারঘাট থেকে এসে আগরতলা শহরে গ্রন্থপ্রকাশ উৎসব সেরে ফেলেছেন স্রোত প্রকাশনীর মত বনেদি প্রতিষ্ঠান । কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বই প্রকাশ করছেন । মেলা চলাকালীন হবে আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বহিঃপ্রকাশ অনুষ্ঠান । এই মননের আনন্দে বসে নেই আজকের তারুণ্যও । সরকারি কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্র-ছাত্রী । তাঁরা কদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলপনায় আলপনায় দৃষ্টিনন্দন করে তুলছেন বইমেলার প্রবেশপথ । আমাদের চিরন্তন সাংস্কৃতি ঐতিহ্যের সঙ্গে যে 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি' । সময় এগিয়ে গেলেও, চারদিকে বিশ্বায়নের থাবা বিস্তৃত হলেও, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট রূপ নেওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে জাতির সংস্কৃতির গভীরে প্রবাহিত হয়, বইমেলার অভিমুখে এই পথশিল্প তারই ইঙ্গিতবাহী । আগামী কদিন আগরতলা বইমেলা জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালনের পীঠস্থান হয়ে উঠুক ।
স্যন্দন পত্রিকা, ২ এপ্রিল, ২০১৮
No comments:
Post a Comment