ত্রিপুরারাজ্যে দেবীভাবনা ও দুর্গাপূজার প্রাচীনতা : লোকপুরাণ ও প্রামাণ্য তথ্য
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে অম্ভৃণি ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । এমনকি ত্রিপুরার রাজাগণ একসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগেও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন । খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজা ছেংথুমফা বা নামান্তরে কীর্তিধর মেহেরকুল ( প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটিকারা রাজ্য ) জয় করেছিলেন । তিনি ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী কোনো এক রাজাকে পরাজিত করে মেঘনানদ পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন । মহারাজা বিজয়মানিক্য বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তী সমগ্র সুহ্মদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল ও বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমসাময়িক বাংলায় যে ধর্মধারার প্রচলন ছিল তার প্রভাব ত্রিপুরার উপরও পড়ে । প্রাচীন বাংলাদেশের মানচিত্রে ত্রিপুরা কখনও বঙ্গ, কখনও সমতট, কখনও হরিকেল প্রভৃতি নামের ভূখন্ডের সঙ্গে মিশে ছিল । ফলে এই বিস্তীর্ণ প্রাচীন অঞ্চলের সঙ্গে ত্রিপুরার নিবিড় যোগাযোগ ছিল । মানুষজনের আসা-যাওয়া ছিল । রাজসভাসদদের মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষেরই প্রাধান্য ছিল । তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে ত্রিপুরার সেই সময়ের শাসকবৃন্দ ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীপূজার প্রচলন করেন ।
ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস অনুধাবন করলে জানা যায় যে, ডাঙ্গরফার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নফা গৌড়ের নবাবের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করেন । কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি গৌড়ের নবাবকে একশ হাতিসহ একটি মণি উপহার দেন । গৌড়েশ্বর তাঁকে মানিক্য উপাধি প্রদান করেন । সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা মানিক্য উপাধি ব্যবহার শুরু করেন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে রত্নমানিক্য ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা সিংহাসন দখল করলেও আগরতলার মিউজিয়ামের রক্ষিত রত্নমানিক্যের যে মুদ্রা দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের ও অন্যটি ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী রত্নমানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয় । কারণ, পরবর্তীকালে রাজা মুকুট মানিক্যের ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া যায় । রত্নমানিক্যই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার অন্যান্য রাজারাও মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । এইসব মুদ্রা ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি । ভাষা সংস্কৃত হলেও হরফ ছিল বাংলা । ব্যবহৃত অব্দ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শকাব্দ ও পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরাব্দ । এই মুদ্রাগুলিতে পুরুষদেবতার সঙ্গে স্ত্রীদেবতার প্রতীকও অঙ্কিত থাকত । শিবদুর্গা, হরপার্বতী, লক্ষীনারায়ন ইত্যাদি দেবদেবী ও প্রতীক হিসাবে দেবীবাহন সিংহ, ত্রিশূলও মুদ্রাতে উৎকীর্ণ থাকত ।
দ্বিতীয় রত্নমানিক্যের ( ১৬৮৫–১৭৭২ ) কীর্তি হলো প্রাচীন কৈলাগড় বা কসবা দুর্গে মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা, ভগবতীর মূর্তি স্থাপন । এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিকগণের মতে কল্যাণ মানিক্য কসবায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন রত্নমানিক্য । এই সম্পর্কে প্রাচীন রাজমালায় আছে—
" কসবাতে কালী মূর্তি করিল স্থাপন
দশভূজা ভগবতীর পতিত তারণ ।"
দশভুজা দেবীমূর্তি হলেও এটি সাধারণ্যে জয়কালী মন্দির বা কসবা কালীবাড়ি নামে পরিচিত । ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এই মূর্তিটির ব্যতিক্রমী রূপ বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । এই রত্নমানিক্য বারানসী থেকে মূর্তি এনে কুমিল্লায় রাজরাজেশ্বরী বিগ্রহকে স্থাপন করেন । এই প্রসঙ্গে ত্রিপুর বংশাবলিতে আছে—
"মহারাজ রত্ন মানিক্য বাহাদুর
কাশীধাম হইতে কালী আনিল সত্ত্বর
সেই কালি কুমিল্লা নগরের স্থাপিল
রাজরাজেশ্বরী বলি নামকরণ দিল ।"
ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মানিক্যের কীর্তি ত্রিপুরার আরেকটি মন্দির উদয়পুরের মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির । এটি ৫১ পীঠের একপীঠ বলা হয় । এখানে দেবীর দক্ষিণপদ পড়েছিল । পীঠমালা তন্ত্রে উল্লেখ আছে–
ত্রিপুরায়াং দক্ষিণপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বভিষ্ট ফলপ্রদঃ ।
কথিত আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া অমরপুরে অমরসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে মঙ্গলচন্ডীর মন্দির । অমরপুরের গভীর অরণ্যে গোমতী নদীর তীরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা দেবীমূর্তি রয়েছে । স্থানটিকে ছবিমুড়া বলা হয় । পিলাকের প্রত্নক্ষেত্রেও দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে । আগরতলা শহরে রয়েছে লক্ষীনারায়ণ মন্দির । দিঘির পূর্ব পাড়ে উমামহেশ্বর মন্দির অবস্থিত । ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মহকুমা সদরে কিম্বা মহকুমার মধ্যে বহু দেবীমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । তার মধ্যে সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়াকালী বাড়ি, মুহুরীপুরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, কমলপুরে কমলেশ্বরী, কুমারঘাটে ভুবনেশ্বরী মন্দির, ধর্মনগরের কালিবাড়ি বিখ্যাত । একদিকে বাংলার শক্তিপীঠসমূহ অন্যদিকে আসামের শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দিরের প্রভাবে ত্রিপুরাও শক্তি আরাধনার একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সুবাদে ত্রিপুরা রাজ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে কালিকাপূজা ও দুর্গাপূজা প্রচলন রয়েছে । রাজন্য প্রতিষ্ঠিত দুর্গাবাড়ি ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায় প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে । এখানে নিয়মিত দেবীর পূজার্চনা হয় । এখানে দেবীবিগ্রহের হাত দশটি নয় । দুটি । এপ্রসঙ্গে একটি প্রচলিত মিথ রয়েছে । ত্রিপুরারাজের জনৈক মহারানি নাকি দেবীর দশহাত দেখে মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিলেন । তাই রাজাদেশে এখানে দেবীর দশহাতের পরিবর্তে দুহাতের প্রচলন করা হয় ।
ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন প্রামাণ্য তথ্য এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব ।
রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৪ ) ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি ১৬৩২ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( জুন-জুলাই ১৭১০ ) খ্রিস্টাব্দ রত্নমানিক্যের আমলে রত্নকন্দলি ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূতকে ত্রিপুরার রাজধানী রাঙামাটিতে ( বর্তমান উদয়পুর ) পাঠিয়েছিলেন । সেই ভ্রমণকাহিনির উপর ভিত্তি করে অহমিয়া ভাষায় লেখা হয়েছিল "ত্রিপুরা দেশের কথা" । এটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরচন্দ্র সেন । এই ভ্রমণ বিবরণীতে সেকালের ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে । এই বিবরণীটির সপ্তম অধ্যায়ে ত্রিপুরার দূতগণের দুর্গোৎসব দর্শনের বর্ণনা রয়েছে–
"ত্রিপুরার দুতগণের বিদায় দেওয়া হইয়া গেলে পর দুর্গোৎসবের কাল আসিল । তখন মহারাজা বড়বড়ুয়াকে দিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তাহারা সেখানের দুর্গাপূজা দেখিতে ইচ্ছা করে কিনা ।' এই কথা শুনিয়া ত্রিপুরার দূতগণ বলিলেন, 'বড়বড়ুয়া, নবাবের অনুগ্রহে যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করিতে পাই ; ঠাকুরানীর দর্শন করিতে পাই তবে আমাদের পরম ভাগ্য বলিতে হইবে ।" এরপর মহারাজের আদেশে এই দূতদ্বয়কে অষ্টমীর দিন সূর্য, গণেশ, নারায়ণসহ দুর্গাপূজার জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেবী দুর্গাকে দর্শন করানো হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুপ্রাচীনকালেও ত্রিপুরারাজ্যে দেবীদুর্গা পূজার প্রচলন ছিল । এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীভাবনা ও দেবীপূজার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে স্থানাভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না ।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. শ্রী রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
২. ত্রিপুরা রাজমালা–পুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী
৪. ত্রিপুরার ইতিহাস–ডক্টর জগদীশ পণ চৌধুরী
৫.ত্রিপুরার ইতিহাস–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. শতাব্দীর ত্রিপুরা–সম্পা. নির্মল দাস রামপ্রসাদ দত্ত
৭. ত্রিপুরার স্মৃতি–শ্রী সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন
৮. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৯. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
No comments:
Post a Comment