হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সমতট এবং নবোন্মেষ সাহিত্যপত্রিকার শারদসংখ্যার আবরণ উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা, কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গতকাল গিয়েছিলাম বামুটিয়ার জঙ্গলমহল পাতার বাজারে । আসন্ন শারদোৎসব উপলক্ষে নির্মিত দুর্গামন্ডপে আয়োজন করা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানের । শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা এক নিভৃত আরণ্যক ভূমিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম । চারিদিকে সবুজে ঘেরা এক নিঃশব্দ নিধুবন এই জায়গাটি । মনে হয় যেন বৈষ্ণবীয় বনবিহারের এক উপযুক্ত স্থল । এই পরিবেশে গিয়ে উপস্থিত হলে নিমেষে মন এবং প্রাণ উদাস হয়ে ওঠে । আবছা অন্ধকার উপরে ছায়া ঘেরা আকাশ একেবারে তাপদগ্ধ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির, অভিভূত হওয়ার মতো স্থল এটি ।
রাজন্য ত্রিপুরার প্রাচীন জনপদ এই বামুটিয়া । এই জনপদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লোহর নদী অনেক ঘটনার সাক্ষী । বড়মুড়া পাহাড় থেকে নেমে এসে এই নদী বয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিতাসের বুকে মিলনের জন্য । যে তিতাসকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে গেছেন তিতাসপাড়েরই গোকর্ণঘাটের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম'র মাধ্যমে । এই নদীর একদিন ভরা যৌবন ছিল । ছিল তার নাব্যতা । নদী বেয়ে আসত পালতোলা নৌকা কিংবা বড়ো গহনা নৌকা । ছোটখাটো নৌবন্দরের মত এই নদীঘাট সব সময় কর্মব্যস্ত থাকত । পণ্য উঠানামা চলত । মুটে-মজুর ও পরিশ্রমী মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিল এই ভূখণ্ড । বামুটিয়া নামের সঙ্গে যে মিথ জড়িত তার সঙ্গে এই পরিশ্রমী মানুষদের নাম জড়িয়ে আছে । মুটেদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'মুইট্যা' । কথিত আছে ত্রিপুরার জনৈক রাজা এখানকার মানুষজনের পেশার কথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠেছিলেন 'বাহ ! মুইট্যা' । তাদের পেশাকে সোল্লাসে সম্মান জানিয়ে ছিলেন তিনি । তাদের অবস্থানের জন্য জনবসতি গড়ে দেন রাজা । শোনা যায় সেই থেকে এই মুইট্যাদের জনপদ বামুইট্যা বা বামুটিয়া নামে পরিচিত । বলাবাহুল্য এই বামুটিয়াতে মণিপুরিদেরও প্রাচীন জনবসতি রয়েছে ।
রাজন্য আমলে ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারি ছিল চাকলা রোশনাবাদ পরগনা । শ্রীহট্টের দক্ষিণাঞ্চল থেকে শুরু করে নোয়াখালির ফেনী তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছিল এই চাকলা রোশনাবাদের বিস্তৃতি । চাকলা রোশনাবাদের ছিল অনেকগুলি পরগনা । আজকের বামুটিয়াও ছিল সেরকম একটি পরগনা । দেশভাগের ফলে ভারত ভূখণ্ডে পড়েছে এই বামুটিয়া পরগনার বৃহৎ অংশ । এই পরগনার কিছু অংশ বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত । চাকলা রোশনাবাদের এই সমভূমি অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল কখনো এটি কমলাঙ্ক, কখনো হরিকেল, কখনো বা সমতট । এ কারণেই পুরনো ইতিহাসকে স্মরণ করার লক্ষ্যেই আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক একটি সাহিত্যপত্রের নাম 'সমতট' ।
এমন ইতিহাস বিজড়িত প্রাচীন জনপদের আজকের আয়োজিত স্থানটিতে এক সময় ছিল রাজ্যের বিখ্যাত বিড়িপাতার বাজার । এই বিড়িপাতাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'কুম্ভিরা' বা 'কুমিরা' পাতা । ত্রিপুরার অরণ্যে এক সময় এই পাতা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত । রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের বাজার থেকে এই বিড়ির পাতা সংগ্রহ করে বামুটিয়ার এই পাতার বাজারে মজুদ করা হত ভাটির দেশে রপ্তানির জন্য । এছাড়া বাঁশ ছন ইত্যাদি বনজ সম্পদ ও তিল, কার্পাস, সরিষা, ধান ইত্যাদি কৃষিজ সম্পদও নদীপথে পরিবহন করা হত । হান্টারের সার্ভে রিপোর্টেও সেসময়ের চাকলা রোশনাবাদের বাজারের তালিকায় বামুটিয়া বাজারেরও উল্লেখ রয়েছে । একসময় বনদপ্তরের কড়াকড়িতে ও ক্রমাগত বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এই বিড়ির পাতা ও তাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় গরিব মানুষের জীবিকাটি হারিয়ে যায় । এখান থেকে লৌহর নদী বেয়ে এই পাতা চলে যেত ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও দেশের নানা প্রান্তে । আজ সেসব ইতিহাস ।
ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে গতকাল আয়োজন করা হয়েছিল দীর্ঘদিন মনে রাখার মত সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠান । রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে দুই পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার এবং ডাক্তার খোকন রায়ের আন্তরিক আমন্ত্রণে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন এখানে । রাজ্যের অন্যতম বলিষ্ঠ কবি নকুল রায়ের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানমঞ্চে ছিলেন পশ্চিম জেলাধিপতি ও সুকবি হরিদুলাল আচার্য । ছিলেন অধ্যাপক ড. নির্মল ভদ্র, ড. সৌভিক বাগচী, কবি সঙ্গীতা দেওয়ানজি, স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ড. উত্তম সাহাসহ আরো অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব । প্রত্যেক বক্তা তাঁদের আলোচনাতেই সাহিত্য-সমকাল-সৃজনচর্চা বিষয়ে মনোজ্ঞ অনুভব ব্যক্ত করেছেন । আকস্মিক আহুত হয়ে দর্শক আসন থেকে উঠে গিয়ে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমিও সামান্য কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম এদিন । আমাকে মঞ্চে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন রাজ্যের এই প্রজন্মের একজন সুঅভিনেতা, বাচিকশিল্পী এবং প্রাণচঞ্চল সংস্কৃতিপ্রেমী শিশির অধিকারী Sisir Adhikari ও এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নবোন্মেষ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার Gouranga Sarkar । আপ্যায়ণ, আলোচনা, নাচ, গান, কবিতাপাঠ, ভালো খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে একটা প্রাণের ছোঁয়া ছিল গোটা অনুষ্ঠানটাকে ঘিরে ।
No comments:
Post a Comment