মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা ও অপারেশন জ্যাকপট
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । এই এক নম্বর সেক্টর থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন । এই সেক্টর থেকে ২২ হাজারের উপর মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা । এখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী নেমে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ । সমগ্র চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, থেকে ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম । ফলে প্রথমদিকে বেশ কিছুটা সময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাক হানাদাররা তাদের দখলদারী কায়েম করতে পারেনি । এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রথমে রামগড় ও পরে হরিণায় স্যাটেলাইট ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছিল । রামগড় পাক বাহিনীর দখলে চলে গেলে সাব্রুমের হরিণা হয়ে ওঠে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার । এখানে মেজর রফিকুল ইসলামের দায়িত্বে ছিলেন গেরিলা যোদ্ধারা । এবং একসময় তিনি এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন । তাঁকে তখন সাহায্য করতেন ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া । মেজর জিয়ার দায়িত্বে ছিল জেড ফোর্স । এই জেড ফোর্সের নিজস্ব হাইড আউট ছিল পোয়াংবাড়ির কাছে মামাভাগিনা টিলার নিচে ত্রিপুরার কোনো এক রাজার পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে । ১৯৭১ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেক্টর গঠন করা হলে হরিণাতে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার করা হয় । এক নম্বর সেক্টটরের ছিল পাঁচটি সাবসেক্টর । এগুলো হলো— ঋষ্যমুখ সাবসেক্টর, শ্রীনগর সাবসেক্টর, মনুঘাট সাবসেক্টর, তবলছড়ি সাবসেক্টর ও ডিমাগিরি সাব সেক্টর।
এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা থেকে যে সমস্ত স্মরণযোগ্য অপারেশন চালানো হয় তার মধ্যে নৌবাহিনীর প্রথম ও সফল অভিযান হল 'অপারেশন জ্যাকপট' । মুক্তিযুদ্ধের ১০ নম্বর সেক্টর ছিল নৌবাহিনী । এই নৌবাহিনী ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখ এক দুঃসাহসিক ও সফল অভিযান চালিয়েছিল । বিশ্বের সমরশাস্ত্র বিষয়ক পাঠ্যসূচিতে আজও এই অভিযান তথা 'অপারেশন জ্যাকপট' এর কথা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । এই অপারেশনে সেদিন একযোগে চট্টগ্রাম ও মংলা দুটি সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ এই দুটি নদীবন্দরে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অস্ত্র-খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল । চট্টগ্রাম বন্দরের আক্রমণটি সানানো হয়েছিল একনম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তথা হরিনা ক্যাম্প থেকে ।
১৯৭১ সালের ২৩শে মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয় । এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল C2P । জুন মাসের প্রথমদিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা শক্তসমর্থ, সাহসী এবং ভালো সাঁতারু ৩০০ জনের একটি দল C2P ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন । নৌকমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার কমান্ডার এম এন সামানত । ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জি এম মর্টিশ । এঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও ২০জন ভারতীয় প্রশিক্ষক এবং পাকিস্তান নৌ বাহিনীর দলত্যাগী ৮জন বাঙালি সদস্য । ট্রেনিং এর প্রথম অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থলযুদ্ধের কৌশল শেখানো হয় । তার মধ্যে ছিল—গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরক ব্যবহার, স্টেনগান, রিভলবার চালানো এবং খালি হাতে যুদ্ধ করা ইত্যাদি । দ্বিতীয় ভাগে জলযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে ছিল—৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাঁতার, জলের উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার, শীত ও বর্ষায় একটানা জলে থাকার অভ্যাস, সাঁতরে গিয়ে কিম্বা ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন বাঁধা ইত্যাদি । প্রায় টানা তিন মাস ট্রেনিং করার পর অগাস্টের প্রথম সপ্তাহের দিকে তাঁদের ট্রেনিং পর্ব শেষ হয় । টানা তিনমাস খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে ট্রেনিং করার পর বিমানে করে তাঁরা আগরতলায় আসেন ।
জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ভারতীয় বাহিনীর ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এর সঙ্গে চট্টগ্রামের বন্দরে নৌঅভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের জন্য ৬০ জনের একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হয় । এই দলের নেতা ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী । তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিনার হিসেবে ফ্রান্সে থাকা অবস্থায় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রামের অপারেশনে নেতৃত্ব দেন তিনি । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একসঙ্গে বীর উত্তম ও বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয় তাঁকে । প্রতিজন নৌ কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন, আর কিছু বিস্ফোরক ও শুকনো খাবার দেওয়া হয় । প্রতি তিনজনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং এই দলের নেতা সাবমেরিনার ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও । চারটি বন্দরে একযোগে আক্রমণের লক্ষ্যে কমান্ডরদের নির্দেশের জন্য রেডিওতে একটি প্রস্তুতি সংগীত বাজানোর কথা জানানো হয় । সংগীতটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান / তার বদলে আমি চাইনি কোন দান ।' এই গানটির অর্থ ছিল আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে । অন্য গানটি ছিল একশন সংগীত । গানটি ছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুরবাড়ি' । এই গানটির অর্থ ছিল আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ করুন । এই গানগুলো সম্প্রচারের ওয়েভলেংথ এবং ফ্রিকোয়েন্সি কমান্ডারকে জানিয়ে দেওয়া হয় ।
১৩ই আগস্ট ৬০ জনের এই দলটি আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিণা ক্যাম্পে এসে পৌঁছান । হরিনা ক্যাম্প থেকে যাত্রা করার পর তিনি ৬০ জনের এই দলটিকে ২০ জন করে তিনটি ছোট দলে বিভক্ত করেন । প্রশিক্ষিত ২০ জন করে তিনটি ছোট দলের কমান্ডাররা ছিলেন মাজহার উল্লাহ ( বীরোত্তম ) ডা. শাহ আলম ( বীরোত্তম ) এবং আব্দুল রশিদ । তিনটি দলের সার্বিক কমান্ডার ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী । ১৪ আগস্ট রাতে রশিদ গ্রুপ রামগড় এর পথে, শাহ আলম এবং মাজহার উল্লাহ গ্রুপ বিভূঁইয়া ঘাট দিয়ে এগোতে লাগলেন । এদিকে আব্দুর রশিদ গ্রুপের পথের খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদারেরা । রশিদ ভেবেছিলেন হানাদারেরা সংখ্যায় কম । তাই লোহারপুলের কাছাকাছি উঁচু পুকুরপাড় থেকে এলএনজিতে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন । ঘন্টাখানে প্রচন্ড গোলাগুলি চলল । তারপর ফিরে এলেন আবুল কাশেমের বাড়িতে । এতে অপারেশন জ্যাকপট থেকে রশিদের গ্রুপ পিছিয়ে পড়ে । অন্য দুটি দল ভোরে পৌঁছালেন মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারে । তারপর খানিকটা জিরিয়ে সমিতির হাটের দিকে যাত্রা করেন । সমিতির হাটে যখন তারা পৌছালেন তখনই বেজে উঠলো প্রথম গান— 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান / তার বদলে আমি চাই না কোন দান ।' তারপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাঁরা । তারপর কৌশলে পাক আর্মিদের চোখ এড়িয়ে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের হাজিপাড়া সেন্টার, নাসিরাবাদ, কাকলি বিল্ডিংসহ কয়েকটি শেল্টারে পৌঁছান । মীরসরাই থেকে মাইন ও অস্ত্রের চালান চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শেল্টারে পৌঁছানো হয় । এ কাজে মুক্তিযোদ্ধা জানে আলমের বিশাল ভূমিকা ছিল । তিনি একটি গাড়িতে তরকারি বোঝাই গাড়ির মতো সাজিয়ে তাতে মাইনসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পরিবহন করেছিলেন । তিনি ও তাঁর সহযোগী পাইকারি বিক্রেতা সাজেন এবং শহরে ঢোকার মুখে পাক সেনার জেরায় নিজেদের তরকারি বিক্রেতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন ও পার পেয়ে যান । দুটি দল যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছালেও তৃতীয় দলটি সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি ফলে আক্রমণকারী কমান্ডো সংখ্যা ৪০ এ দাঁড়ায় । ১৪ আগস্ট রাতে প্রথম গানটির সংকেত শোনার পর আব্দুল ওয়াহেদ, মাজহার উল্লাহ, ডা. শাহ আলমের নেতৃত্বে ৩৯ জনের দলটি কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর আনোয়ারার লাক্ষার চরে অবস্থান নেন । সব প্রস্তুতি সেরে নেওয়া হলেও বৃষ্টির জন্য শেষ পর্যন্ত ১৪ আগস্ট এর অপারেশন বাতিল করা হয় । ১৫ আগস্ট সকালে ২ নম্বর জেটি থেকে ১৬ নম্বর যেটি পর্যন্ত অবস্থানরত টার্গেট গুলোকে তাঁরা পরিদর্শন করেন ।
১৫ আগস্ট রাতে প্রত্যেক যোদ্ধার বুকে সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটি করে লিম পেড মাইন বেঁধে দেওয়া হয় । একটি করে ছুরিও দেওয়া হয় । জাহাজের গায়ের শ্যাওলা পরিষ্কার করার জন্য । সবার পায়ে সাঁতার সহায়ক হিনস পরিয়ে দেওয়া হয় । রাত বারোটা বাজলো । রেডিওতে বেজে উঠল, 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি ।' অন্ধকার নিস্তব্ধ কর্ণফুলীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল যোদ্ধারা । একে একে সকলে পাকসেনাদের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে যার যার টার্গেট জাহাজে মাইন বসিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছায় । ১৫ই আগস্ট রাত ১টা ৪০মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে । বিকট শব্দে মাইনগুলো পরপর বিস্ফোরিত হতে শুরু করে । চট্টগ্রাম বন্দরে এই সময় এম. ভি. হরমুজ এবং এম. ভি. আল আব্বাস দুটি জাহাজ নোঙর করা ছিল । এগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র বহন করা হয়েছিল । প্রথমটিতে ৯৯৯০ টন এবং দ্বিতীয়টিতে ১০৪১৮ টন সমরসম্ভার ছিল । এছাড়া বন্দরে ফিস হারবার জেটির সামনে ৬২৭৬ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ওরিয়েন্ট বার্জ নামে আরেকটি জাহাজ অবস্থান করছিল । অন্যান্য জেটিতেও কিছু জাহাজ ও বার্জ নেভাল জেটিতে দুটি গান বোট এবং একটি বার্জ বাঁধা ছিল । অপারেশনের ফলে সরাসরি সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ডুবে যায় । পাশাপাশি ওই একই সময়ে অন্য তিনটি বন্দরে ও বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায় ।
এই অভিযান সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও বহির বিশ্বে ব্যাপক প্রচার লাভ করে ছিল । বিদেশি এতগুলো জাহাজ ধ্বংস হওয়ার ফলে যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয় তখন পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম চলছে না, সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে ্ বলে অপপ্রচারের ফানুসটিও ফুটো হয়ে যায় । সর্বোপরি এই আত্মঘাতী গেরিলা যুদ্ধে একজনও মুক্তিযোদ্ধা আহত বা নিহত হয়নি কিংবা পাক বাহিনীর হাতে বন্দিও হয়নি । মুক্তিযুদ্ধের দামাল নৌকমান্ডো বাহিনীর বিজয়ের সঙ্গে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনার নামও স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকবে ।
সহায়ক বইপত্র :
১. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস–মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২. লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে–রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম
৩. মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান–খলিলুর রহমান
No comments:
Post a Comment