সাব্রুমের আইসিপি ও স্থলবন্দর : সম্ভাবনা সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরার দক্ষিণ অংশের প্রান্তিক শহর সাব্রুম । এটি দক্ষিণ ত্রিপুরার একটি মহকুমা শহর । শহরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে ফেনী নদী । এই নদী ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানা নির্দেশ করে । ফেনী নদীর ওপারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা সদর রামগড় । সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে । দুদেশের সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ এই সেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু–১ ।
এই সেতুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সেতু সংলগ্ন স্থানে ভারতীয় ভূখন্ডে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট স্থাপনের প্রক্রিয়া জোর কদমে চলছে । এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ফেনী নদীকে ব্যবহার করে দুপারে যাতায়াতের ইতিহাস রয়েছে । এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । বিশেষত ত্রিপুরারাজ্যের তিনদিকেই বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত । দক্ষিণ ত্রিপুরার এই অংশ দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ASEAN-ভুক্ত একটি দেশ মায়ানমারের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপনের সুযোগ রয়েছে । ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর এবং মিজোরামের সঙ্গে মায়ানমারের সীমানা রয়েছে । কিন্তু সেগুলো খুবই দুর্গম অঞ্চল । সেই তুলনায় বাংলাদেশের সঙ্গে টেকনাফে নাফ নদীপথে যোগাযোগ অনেক সহজ এবং দীর্ঘদিন যাবত এই যোগাযোগ রয়েছে । সাব্রুমে নবনির্মিত মৈত্রীসেতুর মাধ্যমে এই যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় করা সম্ভব ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : সাব্রুমের মৈত্রীসেতু এবং আইসিপিকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যপথ বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তা শুধুমাত্র ইদানিং কালের ঘটনা নয় । এর একটা সুদূর অতীত ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরার রাজআমলে মায়ানমারের ( তদানীন্তন আরাকান ) সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক তো ছিলই । খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ত্রিপুরায় অবস্থিত পিলাক ছিল নামকরা শিক্ষা কেন্দ্র । সে সময়ে মায়ানমার তথা পূর্বতন আরাকান থেকে ছাত্ররা পড়াশোনা করার জন্য পিলাকে আসত । এছাড়া সে সময়ের পিলাক ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র । ফলে আরাকান থেকে বহু বৌদ্ধ ধর্ম পিপাসুরাও এখানে আসতেন । মায়ানমার বা অতীত আরাকান থেকে মানুষজন এই পথেই চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে এসে ফেনী নদী পেরিয়ে পিলাকে যেতেন ।
এছাড়া 1857 সালে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল তার ঢেউ চট্টগ্রামেও আছড়ে পড়েছিল । সে বছরের ১৮ এবং ১৯ শে নভেম্বর হাবিলদার রজব আলী খানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল সেই বিদ্রোহী সেনারা কোষাগার থেকে অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে এই পথ দিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন । চট্টগ্রাম শহরে সে সময়ে ক্যাপ্টেন P H K Dewool ছিলেন ৩৪ নম্বর রেজিমেন্ট এর প্রধান । তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ জানিয়ে ১৮ নভেম্বরের এক সপ্তাহ পরে 24 নভেম্বর একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J Hearsey K C B- কাছে যিনি প্রেসিডেন্টি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন সেই দুর্লভ চিঠিতে আছে—" I have been informed by a native named Thakur bux formally jemadar of Chittagong provincial battalion, whom the mutineerse forced to go some distance with them, that the pay-habilder of number-4 company named Rujab Ali Khan, has assumed command of the detectment, which we here has crossed the Feny river and entire the territories of Rajah of Tiperah. ( Orlich Leopold Von ( 1858 )- The Mutiny of India : Its Origin and Its Result, T and W boone, 29 newbond Street ). তিনি এই পত্রে উল্লেখ করেন যে, বিদ্রোহীরা ফেনী নদী পেরিয়ে ত্রিপুরার রাজার রাজ্যে প্রবেশ করেছে । এতে করে সাব্রুমের সীমান্ত অঞ্চলকেই বোঝায় । অর্থাৎ এই বিদ্রোহীরা রাজন্য ত্রিপুরার সাব্রুমের উপর দিয়েই সিলেট হয়ে মণিপুরের দিকে পলায়ন করেছেন । এছাড়া, সে সময়ের অন্যান্য সরকারি নথিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাওয়ার জন্য বিদ্রোহী সিপাহীরা সীতাকুণ্ড ফটিকছড়ি রামগড় হয়ে ফেনী নদী অতিক্রম করেছিলেন ( চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান প্রথম খন্ড )।
আর সাম্প্রতিককালের ঘটনা তো অনেকেরই স্মরণে আছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকেই । এবং চট্টগ্রাম থেকেই মূল সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল । সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রামগড় হয়ে ফেনীনদী পেরিয়েই ভারতের সাব্রুমে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং সাব্রুমের হরিনাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একনম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ইতিহাস তো সবারই জানা ।
অবস্থানগত সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : সাব্রুমে আইসিটি স্থাপনের ফলে সাব্রুমের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন শহর রামগড়ও এই অঞ্চলের বাণিজ্য মানচিত্রে চলে এসেছে । ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই আইসিপির কার্যকলাপের সুফল হিসাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সাব্রুম আইসিপি থেকে সড়কপথে ও রেলপথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্রুত যাওয়া সম্ভব হবে । এখনো সাব্রুম থেকে রামগড় পৌঁছানোর পর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই বারইয়ারহাট হয়ে বিশ্ব রোডের মাধ্যমে সে দেশের অভ্যন্তরে যে কোন জায়গায় যাওয়া যায় । সাব্রুমে আইসিপি স্থাপন হওয়ার ফলে সাব্রুম থেকে বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্র ও নদী বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে । চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দর । এটি সাব্রুম থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । সেইসঙ্গে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চতুর্থ সমুদ্র বন্দরও ব্যবহার করা সম্ভব হবে । এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে খুলনা বিভাগে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দ্বিতীয় ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর মংলা বন্দরকেও ব্যবহার করা যাবে । বন্দরটি পশুর নদী ও মংলা নদীর বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী সংযোগস্থলে অবস্থিত । এটি সে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সমূহ ও খুলনা নগরীর মাধ্যমে সারাদেশের সাথে রেলপথে সংযুক্ত । এছাড়া সাব্রুম আইসিপির পশ্চাদভূমি হিসাবে বাংলাদেশের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকেও যুক্ত করা যাবে । চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে মাত্র তিন ঘন্টায় ট্রান্সক্রিপমেন্টের পণ্য আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা সম্ভব । এখান থেকে সড়ক ও রেল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আটটি রাজ্যে সরাসরি পণ্য প্রেরণ করা সম্ভব হবে । ফলে এ অঞ্চলের পাঁচকোটির বেশি মানুষ উপকৃত হবেন । বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য কলকাতা বন্দর থেকে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে ১২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয় । চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করে সাব্রুম আইসিপি দিয়ে এ দেশে পণ্য আনা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে প্রেরণের সুযোগের ফলে যেমন দূরত্ব কমে যাবে তেমনি সময়ও কম লাগবে । পরিবহন ব্যয় কম হবে ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে । এছাড়া বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ে অল্প দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এদেশের মাটিতে পণ্য নিয়ে আসার ফলে সেদেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার যে কর দিতে হবে তাও আনুপাতিক হারে কম লাগবে । পণ্য পরিবহন পথের দূরত্ব কম হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা স্বল্প ব্যয়ের পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারবেন । এছাড়া আইসিপি সন্নিহিত ল্যান্ডপোর্টে কারগো বিল্ডিং এর সুবিধা থাকায় সেখানে তাদের পণ্য মজুদও রাখতে পারবেন ।
আরেকটি লক্ষনীয় বিষয় যে, প্রায় প্রতিবছরই বর্ষার সময় পাহাড়ের ধ্বস নামার ফলে ত্রিপুরা মিজোরাম ও আসামের বরাক উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ফলে বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থায় সেই সময়ে এই অঞ্চলে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । সাব্রুম আইসিপি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হলে এই দুরবস্থার চিরস্থায়ী সমাধান হবে । সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের রামগড় হয়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরের সড়ক পথ ও রেলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারও ত্রিপুরার খোয়াই, কমলপুর, কৈলাশহর ও আসামের কাছাড়ের করিমগঞ্জের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহের মধ্যে পণ্য পরিবহন করতে পারবে । আমাদের দেশের অভ্যন্তরের উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল বাংলাদেশও গ্রহণ করতে পারবে । এছাড়া চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সে দেশের রেললাইন সম্প্রসারিত হলে এবং তা সাব্রুমের আইসিটি পর্যন্ত এগিয়ে আনা হলে এই পরিবহন ব্যবস্থা আরো সময় সাশ্রয়ী সুগম ও কম দূরত্বের হবে । টেকনাফ হয়ে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা থাকার ফলে সাবরুম আইসিপির শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক করিডোর হিসেবে প্রাধান্য লাভ করবে এই আইসিপির মাধ্যমে শুধু চট্টগ্রাম নৌবন্দর নয় এখান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন শহরে যাওয়া যাবে । পাশাপাশি সে দেশের মানুষ সাবরুম আইসিপি দিয়ে এসে মাত্র ৩০ টাকা ব্যায়ে আগরতলার মহারাজা বীর বিক্রম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরও সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে । প্রসঙ্গতা উল্লেখ্য যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু যে নদীটির উপর নির্মিত সেই ফেনী নদীতে যদি ড্রেজিং করে তার নাব্য্যতা বাড়ানো হয় তাহলে এই জলপথটিও পণ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যাবে এবং এই আইসিপিকে কেন্দ্র করে সাব্রুমে একটি নদীবন্দর গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে । এক সময়ে এই ফেনী নদীতে নৌযান চলাচল করত । নৌকা করে পণ্য পরিবহন চালু ছিল বহুদিন । এই নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপি থেকে বা সাব্রুম আইসিপিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পণ্য সুলভে পরিবহনের এই মাধ্যমকে আবার শুরু করা যেতে পারে ।
সাব্রুমের সম্ভাবনাময় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ( Special Economic Zone ) প্রস্তুতি ও সুবিধা : সাব্রুমের পশ্চিম জলেফায় আইসিপি ও রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ জোর কদমে চলছে । এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প, চা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বাঁশশিল্প, বস্ত্রশিল্প, রাবারভিত্তিক শিল্প, হস্ত-কারু ও ছোটো ছোটো কুটির শিল্প গড়ে তোলা হবে । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে ত্রিপুরা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই স্পেশাল ইকোনমিক জোনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য সাবরুম আইসিপিও স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ি ও মংলা ও বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভোক্তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যাবে ।
সাব্রুম আই সি পি ও স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি সম্ভাবনা : সাব্রুম আইসিটি ও স্থলবন্দর এর মাধ্যমে দুই ধরনের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে প্রথমত পণ্য আদান-প্রদান এবং দ্বিতীয়টি হল পরিষেবা বিষয়ক আদান-প্রদান । পণ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাবারের কথা । এই অঞ্চলে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের রাবার উৎপন্ন হয় । সাব্রুমে বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ফলে এখানে রাবার ভিত্তিক শিল্প কেন্দ্রে উৎপাদিত পণ্য এই পথ দিয়ে সরাসরি পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপণনের ব্যবস্থা করা যাবে । ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরেকটি বিশেষ অর্থকরী ফসল হলো চা । ত্রিপুরার চা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের । ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরায় উৎপন্ন চা চট্টগ্রামের চা-বাজারে তোলার উদাহরণ রয়েছে । পরবর্তী সময়ে দেশভাগের ফলে এই কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বর্তমানে এই উদ্যোগটিকে আবার পুনর্জীবিত করা যায় । ত্রিপুরার অন্যতম বাগিচা ফসল আনারস বিখ্যাত । ইতোমধ্যে আনারস আরব আমিরশাহীতে রপ্তানি হচ্ছে । সাব্রুম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেন্দ্রে আনারস ও অন্যান্য স্থানীয় ফল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এর বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়া যেতে পারে । এছাড়া নানারকমের মশলা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্য বিশেষ ধরনের পাথর ও এই আই সি পি ও স্থলবন্দরের এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রেরণ করা যেতে পারে ।
সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তৈরি পোশাক, মাছ ও শুটকি ইত্যাদি আনা যেতে পারে । উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের মাছ ও শুটকির খাদ্যাভ্যাস রয়েছে হলে এই পণ্য গুলির ব্যাপক আমদানির সুযোগ রয়েছে এছাড়া বাংলাদেশ থেকে সুলভে ইট সিমেন্ট ও প্রসাধন সামগ্রী ইত্যাদি আনা যাবে ।
সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে পরিষেবা মূলক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প, উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার প্রসার ঘটানো যাবে । উত্তর-পূর্ব থেকে সমুদ্র সৈকতে দেখতে হলে আমাদের দিঘা কিংবা পুরীতে যেতে হয় বহু পথ পাড়ি দিয়ে । অথচ এই রাস্তা দিয়ে অতি সহজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যাওয়া যায় । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় হিন্দু জনগণেরও পরিভ্রমণ করার মতো অনেকগুলো তীর্থক্ষেত্র রয়েছে সেই তীর্থ ভ্রমণ করা যাবে এই আইসিপি দিয়ে । বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুরাও অতি অল্প সময়ে সাব্রুম আইসিপি পেরিয়ে সড়ক ও রেলপথে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের জন্য যেতে পারেন । পাশাপাশি বিত্তবান মানুষেরা এই পথ দিয়ে আগরতলায় গিয়ে বিমান যাত্রার সুযোগ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারেন । প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বহু রোগি চিকিৎসার জন্য কলকাতা চেন্নাই ব্যাঙ্গালোর ও হায়দ্রাবাদ যান । সাধারণত বাংলাদেশের বিত্তবান লোকেরাই এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন । নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পক্ষে তা অধরাই থেকে যায় । সাব্রুম আইসিপির অদূরে কিংবা ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরে কোথাও বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি হলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ রোগী অত্যন্ত কম ব্যয়ে এখানে এসে চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারবেন । তাছাড়া এই অঞ্চলে দুপারের মানুষজনের ভাষা একই রকম হওয়ায় তারা চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার সময় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন । উভয় অঞ্চলে একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস থাকায় সে ক্ষেত্রেও কোন অসুবিধা হবে না । সর্বোপরি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষজনের পক্ষে এই সুযোগ ব্যয়বহুল বলে মনে হবে না । পর্যটন ও চিকিৎসা পরিষেবাকে কেন্দ্র করে এখানে অন্যান্য পণ্যাদির ব্যবসার পাশাপাশি হোটেল, লজ, ঔষধ এর দোকান ইত্যাদি ঘিরে করে প্রচুর কর্মসংস্থানের ও সুযোগ সৃষ্টি হবে ।
সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর পুরোদমে চালু হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা : ২০১৫ সালে মৈত্রীসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে প্রকল্পটি শেষ করে ২০২১ সালের ৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও সম্মেলনের মাধ্যমে ৪১২ মিটার দীর্ঘ ও ১৪'৮০ মিটার প্রস্থ ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটির উদ্বোধন করেন । উদ্বোধন হওয়ার পর প্রায় দু বছর হতে চলল কিন্তু মৈত্রী সেতুর উপর দিয়ে চলাচলের পথ এখনো উন্মোচিত হয়নি । পাশাপাশি সময়ে স্থল বন্দরের কাজ শুরু হলেও আজ অবধি তার শেষ হয়নি । লক্ষ্য করা গেছে, এই নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতি ও খুব ধীর । এছাড়া মৈত্রীসেতু সংলগ্ন আইসিপিতে নিজস্ব ঘরসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাবে অন্তত মানুষজন পারাপারের ব্যবস্থাটিও আজ পর্যন্ত চালু করা যায়নি ।
অন্যদিকে মৈত্রী সেতুর অপর প্রান্তে বাংলাদেশেও আই সি পি স্থাপনের কাজে তেমন কোন অগ্রগতির লক্ষণও নেই । গত নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে সে দেশে মৈত্রীসেতুসংলগ্ন স্থানে শুধুমাত্র প্যাসেঞ্জার টার্মিনালটির উদ্বোধন করা হয়েছে । এটিও এদেশের মত এখনো চালু করা হয়নি । রামগড়ের স্থলবন্দরের মূল কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে বলে সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে । এছাড়া নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত বাংলাদেশের রেলপথ সম্প্রসারণের বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । কবে তা শুরু হবে তাও জানা যাচ্ছে না । যতদিন পর্যন্ত দু দেশের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমাধা না হয় ততদিন পর্যন্ত যতই আকাশচুম্বী স্বপ্ন থাকুক এই আইসিপি ও স্থলবন্দরের সুফলের শুরুটাও দেখা যাবে না । এক্ষেত্রে দু'দেশের কর্তৃপক্ষের দ্রুত যৌথ বৈঠক করে সামগ্রিক কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সীমানা সংক্রান্ত কোনো প্রোটকল থাকলে সে ক্ষেত্রে দুই দেশেই নরম মনোভাব গ্রহণ করে নিঃস্বার্থে এর সরলীকরণ করা দরকার । এই মৈত্রী সেতু ভারত-বাংলাদেশের জনগণের আবেগের বিষয় । সে কারণেই দু পারের স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে দাবি উঠছে, স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়া সাপেক্ষে যেন দুপারের মানুষজন আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি অন্তত ত্বরান্বিত করা হয় । এতে যেমন দুপারের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তেমনি দুদেশের মানুষজনের পণ্যের চাহিদার বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে আসবে ।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীসেতুকে কেন্দ্র করে সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর নির্মাণের যে বিশাল কর্মকান্ড চলছে, এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাব্রুম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য গুলির বাণিজ্যিক রাজধানী যে হয়ে উঠবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই । সেই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেবে । পাশাপাশি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি সম্পর্ক ও সুদৃঢ় হবে । কোনো অঞ্চলের জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হলেই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায় । আসলে, এই কাজটা যতটা ত্বরান্বিত হবে তত শীঘ্রই এই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবেন ।
( লেখক ত্রিপুরার একজন সমাজ-সংস্কৃতিক ও লোকগবেষক । গত ৬ জানুয়ারি ২০২৪ ভারত সরকারের গবেষণা সংস্থা ASIAN Confluence-এর আমন্ত্রণে সাব্রুম আইসিপিতে আয়োজিত 'Technical Consultation On Upcoming ICP in Sabroom : Prospects, Opportunities and Challenges'-এ এই গবেষণাপত্রটি পেশ করেন ) ।
No comments:
Post a Comment