হালখাতা বা গদিসাইদ : হারিয়ে যাওয়া বাণিজ্য সংস্কৃতি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
চৈত্র সংক্রান্তির পরদিন শুরু হয় নববর্ষ । নতুন বছরের সূচনালগ্নে প্রতিটি বাঙালি পরিবারে ভালো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়ে থাকে । আমাদের খাদ্যকেন্দ্রিক সমস্ত সংস্কৃতিই কৃষিভিত্তিক জীবনের নিদর্শন । একদিন বাঙালির গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ছিল । আর ছিল গৃহপালিত পশুপাখি ও নানারকম বাগিচা ফসল । অতীতের বাঙালির যৌথপরিবার ভাঙতে ভাঙতে আজ পায়রার খোপের মত ফ্ল্যাটবাসী হয়ে গেছে । সেই বিস্তীর্ণ-জমিজিরেত কবেই হারিয়ে গেছে । সর্বশেষ প্রজন্ম নিজের ভদ্রাসনটুকুও প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছে নগদ কিছু অর্থ আর একটি বা দুটি ফ্ল্যাট বাড়তি প্রাপ্তির হাতছানিতে । এ যুগে বিশাল ভূখণ্ড সামলানো যেমন দুরূহ তেমনি ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরে ছোটো পরিবারের কিছুটা হলেও নিরাপত্তা আসে । এত শত পরিবর্তনের মাঝেও বাঙালি তার সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচতে চায় । যতটা সম্ভব লোকাচার পালন করে । জোমাটো ও স্যুইগির হাতছানি থাকলেও অন্তত এই দিনটিতে নিজের মত করে খাবার তৈরিতে মনোযোগ দেয় । মর্যাদা দেয় বাঙালিয়ানাকে ।
কৃষিকেন্দ্রিক জীবনের কারণে এককালে বাঙালির বাণিজ্য কৃষিজ পণ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল । বাংলার বণিকেরা কৃষিজ পণ্য ও উপজাত দ্রব্য নিয়ে বাণিজ্যে যেতেন । আমাদের মধ্যযুগীয় কাব্য ও পুঁথিসাহিত্যে সাহিত্যে বাঙালি বণিকদের বাণিজ্যযাত্রার বহু নিদর্শন পাওয়া যায় । চাঁদ সওদাগর, ধনপতি প্রমুখ বণিকেরা মধুকর কিংবা চোদ্দো ডিঙা সাজিয়ে নৌ-বাণিজ্যের মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য দেশে-বিদেশে নানা স্থানে নিয়ে যেতেন । কি অন্তর্দেশীয়, কি বহির্দেশীয়, উভয় প্রকার বাণিজ্যে সেকালে বাঙালি বণিকদের একটা শক্ত ভিত্তি ছিল । এই সময়ে বাংলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষিজ সম্পদ । বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন থেকেই তাঁদের বাণিজ্য শুরু হত । বাণিজ্যের হিসাবপত্র খাতায় সংরক্ষণের ব্যবস্থাটিও শুরু হত এদিন থেকেই । প্রাচীন রাজা-জমিদাররাও এদিন তাঁদের রাজকোষ বা কাছারিবাড়িতে সংবৎসরের আদায়কৃত খাজনা লিপিবদ্ধ করতেন । এইদিন প্রজাদের নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করা হত । আগেরদিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষদিন প্রজারা রাজকোষে সারাবছরের খাজনা জমা দিত ও রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িতে অবস্থান করত । পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ রাজা-জমিদারগণ প্রজাদের ভুরিভোজে আপ্যায়ন করতেন । এই দিনটিকে বলা হত 'পুণ্যাহ' । তদ্রূপ এদিন ব্যবসায়ীরা তাঁদের নতুন খাতা মহরত করতেন । এটাকে বলা হত 'হালখাতা' । এদিন ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা নিয়ে কোন দেবমন্দিরে গিয়ে দেবতার পাদস্পর্শ করিয়ে আনতেন । তাঁদের ব্যবসাকেন্দ্রও এদিন সুন্দর করে সাজানো হত । ব্যবসাকেন্দ্রে বা ব্যবসায়ীর গদিতে সিদ্ধিদাতা গণেশের পূজো এবং লক্ষ্মীপূজো করা হত । খাতার ভেতর আশীর্বাদী ফুল দূর্বা রাখা হত । প্রাচীন মোহর বা রূপার টাকায় সিঁদুর,হলুদ, চন্দন মাখিয়ে তার ছাপ পর পর খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় রাখা হত । সিঁদুর দিয়ে আঁকা হত পবিত্র স্বস্তিক চিহ্ন । ব্যবসায়ীর ব্যবসাকেন্দ্র বা গদিতে এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার পালন করা হত বলে একে 'গদিসাইদ' ও বলা হত । 'সাইদ' একটি আরবি শব্দ । তার অর্থ সৌভাগ্যবান বা মহান । গদিসাইদের মাধ্যমে সৌভাগ্যের সূচনা করাহয় । 'গদিসাইদ' উপলক্ষে এদিন অপরাহ্নে ব্যবসায়ীরা তাঁদের গ্রাহকদের নেমন্তন্ন করতেন এবং মিষ্টিমুখ করাতেন । গ্রাহকও মিষ্টিমুখের পর পুরোনো হিসাব নিকাশ শেষ করতেন এবং নতুন বছরের হিসেবের খাতায় তার নাম উঠিয়ে নিতেন । নতুন খাতায় হালনাগাদ বা বউনি করার নামই হলো 'গদিসাইদ' ।
হালখাতা শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে আমরা দুটি ভাষাতাত্ত্বিক সূত্র পাই । সংস্কৃত 'হল' শব্দ থেকে 'হাল' শব্দটির সৃষ্টি বলে অনুমান করা হয়। 'হল' বা 'হাল' হল আদিম কৃষিযন্ত্র । জমির মাটি কৃষিউপযোগী করে তোলার জন্য হালের ব্যবহার করা হয় । হাল বা 'লাঙ্গল কাঁধে কৃষক'কে বলা হয় হলধর । হালচাষের মাধ্যমে উৎপন্ন পন্য ক্রয়বিক্রয়ের হিসেব যে খাতায় রাখা হয় তাই 'হালখাতা' । আবার ফারসি 'হাল' শব্দের অর্থ 'বর্তমান সময়' । যেমন– হাল আমল, হাল ফ্যাশন, হাল-হকিকত, হালনাগাদ, হালসন ইত্যাদি । হাল সনের হিসেবের যে খাতা তাই 'হালখাতা' । এই হালখাতা উপলক্ষে অনেক ব্যবসায়ী আমন্ত্রণপত্র ও তৈরি করতেন । গ্রাহকদের মধ্যে সেই আমন্ত্রণপত্র বিলি করা হত । এই হালখাতা বা গদিসাইদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও ক্রেতার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বাইরেও একটা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হত । কোন কোন ব্যবসায়ী আবার অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এই অনুষ্ঠান পালন করতেন । আগরতলা শহরে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের গদিতে রামনবমী তিথিতে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয় । মফস্বল থেকে ব্যবসায়ীরা এদিন তাঁদের গদিতে গিয়ে বউনি করেন । বাংলা নববর্ষ এভাবেই একদিন বাঙালি ব্যবসায়ীদেরও সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । আজ আর ততটা দেখা যায় না । শপিং মল আর অনলাইন ব্যবসার দৌলতে এই সংস্কৃতিও হারিয়ে যেতে বসেছে ।
No comments:
Post a Comment