চৈতপরবের পাঁচন : লোকচিকিৎসার পাঠ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বৈশাখ থেকে চৈত্র । এই বারোমাস নিয়ে বাঙালির বর্ষচক্র । তাকে ঘিরে রয়েছে নানা উৎসব । নানা পার্বণ । বাঙালির যাপনের উৎসে রয়েছে কৃষিকর্ম । তাই প্রতিটি পূজাপার্বণ, উৎসবে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি ভাবনা । হলকর্ষণ, বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ ও নতুন ফসলের প্রথম আস্বাদগ্রহণ, এই প্রক্রিয়াগুলোর প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে এক একটি বিশেষ বিশেষ আচার অনুষ্ঠান। বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষত, দুই মাসের মধ্যবর্তী সময়ে সংক্রান্তিতে কিংবা বর্ষারম্ভ ও বর্ষশেষে পালন করা হয় এইসব অনুষ্ঠান । সব অনুষ্ঠানেই কৃষিজ ফসল, ফলমূল, শাকসবজিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় । পরিবারের বা সমাজে কৃষিজ বা প্রকৃতি থেকে সহজলভ্য লতাপাতা, ফলমূল বিশেষ বিশেষ দিনে খাওয়ার রীতি বাঙালি সমাজে বহুদিন যাবত প্রচলিত । এগুলো নানা অঞ্চলে নানা নামে পরিচিত । যেদিনের যে ফল বা যে ফসল পাওয়া যায়, তা আনুষ্ঠানিকভাবে খাওয়ার মাধ্যমে সেই বস্তুটির গুণাগুণ উপলব্ধি করার বার্তা নিহিত থাকে । এই ফলমূল, ফসল ভক্ষণের অনুষ্ঠান বাংলা ও বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত । শ্রীহট্টীয় অঞ্চলে তার নাম 'আটআনাজ' । ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ত্রিপুরায় 'অন্নকূট' । নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ ত্রিপুরায় 'পাঁচন' ইত্যাদি । ঐতিহাসিক কারণে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও তার সংস্কৃতি সে সঙ্গে বয়ে নিয়ে গেছে ।
সেই সুবাদে নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত দক্ষিণ ত্রিপুরার মানুষের সংস্কৃতিতে বর্ষশেষের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষদিনের শিবের গাজনোৎসব চড়কপূজার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করার রীতি রেওয়াজও রয়েছে । তার মধ্যে খাদ্য সংক্রান্ত উৎসবও রয়েছে । এদিন প্রতি ঘরে পাঁচন রান্না করা হয় । মূল 'পঞ্চব্যঞ্জন' শব্দ থেকে এসেছে পাঁচন শব্দটি । প্রতি বাড়িতে মুড়ি, চিড়া, খই, খইয়ের সাথে দই, ছাতুর নাড়ু ইত্যাদি ঘটা করে খাওয়া হয় । মূলত, এইসব উপাদানের প্রত্যেকটিই মূল কৃষিজ ফসল ধান থেকে প্রস্তুত করা হয় । বেশ কদিন আগে থেকে বাড়িঘরে মুড়ি, চিড়া, খই, খইয়ের ছাতু, সেই ছাতু দিয়ে নাড়ু অর্থাৎ লাবণ বানানোর প্রস্তুতি চলতে থাকে । কৃষিজ বীজ থেকে প্রস্তুত দ্রব্য ভক্ষণের মধ্যে আদিম প্রজননচিন্তা কাজ করে । বীজভক্ষণের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে প্রজননক্ষম করার লোকবিশ্বাস বহন করে । তাছাড়া, এই বীজ উৎপাদন করতে গেলে গোষ্ঠীসদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তঃসংহতিরও প্রয়োজন পড়ে । উর্বরতাকৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয় সংহতিচেতনাও । দক্ষিণ ত্রিপুরা অঞ্চলে এই যাদুবিশ্বাসজনিত কারণে নাড়ু বা লাবণ বাঁধার সময় গৃহস্থ বন্ধুরা লৌকিক ছড়া আওড়ে থাকেন– 'টেঁআ বান্ধিয়ের, হ ইসা বান্ধিয়ের, ধন বান্ধিয়ের, জন বান্ধিয়ের........' ইত্যাদি নানাকিছু বন্ধনের কথা বলে । 'জন বান্ধিয়ের' মানে গোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে সংহতির বন্ধন সৃষ্টির কথাই বলা হয় । আবার আভিচারিক ক্রিয়ার 'বন্ধন' মন্ত্রের মাধ্যমে অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার আচারের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় ।
কৃষিজ ফসলের পাশাপাশি নানাবিধ সবজির একটি ঘন্ট তৈরি ও খাওয়ার রেওয়াজ আছে এদিন । এই ঘন্টর মূল উপাদান এঁচোড় । তার সঙ্গে নানাবিধ কৃষিজ ফসল শাক, লতাপাতা, ডাঁটা,মূল, তেতো, বুনো লতাগুল্ম, ছোলা, মটর, সিমের বীজ, কন্দ ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি হয় এই পাঁচন । আসলে পঞ্চব্যঞ্জনের কথা থাকলেও মা-বোনেরা বনবাদাড় ঢুঁড়ে সংগ্রহ করেন শতাধিক রকমের উপাদান । চৈত্রসংক্রান্তির প্রস্তুতি আগের দিন থেকেই শুরু হয় । সংক্রান্তির আগের দিনকে বলা হয় 'ফুলবিষু' । এদিন ভোরবেলা উঠেই সংগ্রহ করা হয় ফুল, ফুলের কলি । এগুলো দিয়ে বিকেলের দিকে মালা তৈরি করা হয় । বিকেলের শেষভাগে সন্ধ্যার প্রাকমুহূর্তে বাড়ির উঠোনে বিশকাটালি, বেলকাঁটা, কুলের কাঁটা, মনকাঁটা, শিয়ালমুত্রা গাছ, দ্রোণফুলের গাছ ইত্যাদি রাস্তার, ঝোপঝাড়ের পাশে গজানো বিভিন্ন আগাছা একত্রিত করে তাতে আগুন ধরিয়ে সেই তাপ ও ধোঁয়া শরীরে নেওয়া হয় । লোকবিশ্বাস এর ফলে শরীরে চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগব্যাধি আক্রমণ করতে পারে না । এই লোকাচারটিকে 'জাগ পোড়ানো' বলা হয় । ঠিক একই রকম লোকাচার বাড়ির দেউড়ির বাইরে করা হয় ।এগুলো পোড়ানোর সময় আগের দিন সন্ধ্যাবেলা শিশুবৃদ্ধ সবাই মিলে সুর করে ছড়া কাটেন–'জাগ রে জাগ, টেঁআ জাগ, হইসা জাগ, ধন জাগ, জন জাগ' ইত্যাদি বলে । আর সংক্রান্তির দিন ভোরের ছড়া হল– দূর অ রে দূর অ । মাথা বেদনা, গা বেদনা দূর অ । মহামারী দূর অ । ওলাওঠা দূর অ । জ্বরজারি দূর অ ইত্যাদি । তারপর স্নান সেরে বাড়ির গৃহপালিত পশুদেরও স্নান করানো হয় । তারপর আগেরদিন গেঁথে রাখা মালাগুলো বাড়ির সদর দরজায়, গৃহপালিত পশুদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় । এককথায় পরিবারের সকল সদস্যদের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুদেরও কল্যাণকামনা করা হয় এদিন । চৈত্রসংক্রান্তির দিন নিমপাতা, হলুদ, গিলে ইত্যাদি ভেষজ উপাদান বেটে গায়ে মেখে স্নান করার পর বাড়ির সদর দরজায় কচি আমের উপর খইয়ের ছাতু ছড়িয়ে দিয়ে আম বলি দেওয়ার রীতি রয়েছে । একে 'শত্তুর ওড়ানো' বা 'শত্তুর কাটা' বলা হয় । লোকবিশ্বাস এতে অশুভশক্তির দমন হয় । এরপরেই মুড়ি, চিড়া, খই, দই, কলা, খইয়ের ছাতু ইত্যাদি সহযোগে ফলাহারের পালা । মধ্যাহ্নে আহার্য হিসেবে নেওয়া হয় বহুবিধ সবজির ঘন্ট অর্থাৎ পাঁচন । এই পাঁচন তৈরি হয় বহুবিধ ভেষজ উপাদান দিয়ে । এই ভেষজ উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার বিষয়টি নিহিত থাকে । তার মানে এই নয় যে, বছরে একদিন পাঁচন খেলে সারা বছর সুস্থ থাকা যাবে । এর মূল অর্থ, প্রতিটি শাক, লতাপাতা একদিন রান্না করে বাড়ির বয়স্ক মায়েরা তাঁদের উত্তরসূরীদের এগুলোর ভেষজ গুণ সম্বন্ধে পাঠ দিয়ে থাকেন । শারীরিক প্রয়োজনে বছরের অন্য সময়ও যাতে তা ব্যবহারের কথা স্মরণে আসে । আজকের দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে 'আমার স্বাস্থ্য আমার অধিকার' বলে যে ভাবনা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা যে সুদূর অতীতেও আমাদের পল্লীজীবনে নিহিত ছিল তা স্পষ্টই বোঝা যায় । এভাবেই আগেকার দিনে স্বাস্থ্যসচেতনতা গড়ে তোলা হত ।
No comments:
Post a Comment