আবে জমজম ও গঙ্গার জল : মিথের সমন্বয়
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
গত ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ঢাকায় বিশ্ব বাঙালি সংসদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য যাই । কুড়ি তারিখ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ২১ তারিখ আমার সহযাত্রী ত্রিপুরার বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রকাশক বিল্লাল হোসেনের এক দাদার বাড়ি মোহাম্মদপুরে যাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে । বিল্লালের দাদা মোঃ এমরান ঢাকা জগন্নাথ কলেজের মাস্টার্স করা যুবক বর্তমানে ডেভেলাপার । বড়ো ব্যবসা রয়েছে তাঁর । তিনি একা বাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । আমরা যাওয়ার পর তিনি তাঁর আতিথেয়তায় কোন ত্রুটি রাখেননি । আমরা বারবার উঠতে চাইলেও তিনি আমাদের উঠত দিচ্ছিলেন না । আমাদের সঙ্গে জমাটি আড্ডায় মজে ছিলেন সারাক্ষণ । দুপুরে তাঁর পরিপাটি আয়োজনে আতিথেয়তা গ্রহণ করে আমরা যখন বিকেলের দিকে ফিরে আসছিলাম তখন তিনি বিল্লালের হাতে দুই শিশি 'জমজমের পানি' তুলে দেন । একটি আমার জন্যে । আসার পথে আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম আমার তো ছোটোবেলা থেকে 'আবে জমজমে'র প্রতি একটা আগ্রহ ছিল । বাবার স্বাস্থ্যদপ্তরে সরকারী চাকুরীসূত্রে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটে ছিল ধলাইয়ের কুলাইতে । সেখানে চিকিৎসক ছিলেন ডা. কাজী আবদুল মান্নান । তাঁর এক ছোটোভাই কাজী কামাল উদ্দিন আমার সহপাঠী ছিল । একবার আমার ডাক্তারকাকুর বড়োভাই কাজী আব্দুল ওয়াহাব কুলাইতে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগের গোলানন্দপুর গ্রাম থেকে আসেন । তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন 'আবে জমজম' এবং আরবের খেজুর । সেই থেকেই আবে জমজমের এবং আরবের খেজুরের প্রতি আমার একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল । আবে জমজম কখনো না দেখলেও আমার বড় শ্রীমানের এক বন্ধুর আরবে চাকরি করার সুবাদে সেখানকার খেজুরের আস্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ আমি পেয়েছি । একবার বিল্লাল হোসেনকেও বলেছিলাম আবে জমজমের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা । আর সেটা আজ সত্যিই পরিণত হল । আসলে একটা প্রবাদ আছে, যে যারে চায়, ভজিলে সে পায় । আমার ভাগ্যে এভাবেই এ প্রাপ্তিটা লেখা ছিল বোধহয় ।
মুসলমানদের পবিত্র স্থান কাবা শরীফ । পবিত্র কাবা শরীফের কাবাঘর থেকে মাত্র ২১ মিটার দক্ষিণপূর্বে 'জমজম' নামে একটি কূপের অবস্থান । ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই জমজমের জল অত্যন্ত পবিত্র । তাঁদের বিশ্বাস, জমজমের পানি শুধুমাত্র তৃষ্ণা নিবারণ করে না । এই পানি পানের মাধ্যমে ক্ষুধা দূর হয় এবং রোগবালাই থেকেও নিস্তার পাওয়া যায় । ঠিক আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেমন গঙ্গার জলকে পবিত্র মনে করি । রোগ নিরাময়ের উপায় হিসেবে গঙ্গার জল পান করি । গঙ্গাজল ছিটিয়ে কোনো স্থানকে পবিত্র করি । এমনকি মৃত্যু পথযাত্রীর মুখে ও শেষ বারিবিন্দু হিসেবে গঙ্গার জল তুলে দিই ।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কপিল মুনির শাপে ভস্মীভূত সগর রাজার ষাটহাজার পুত্রদের আত্মার মুক্তির জন্য ভগীরথ শিবের কাছ থেকে প্রার্থনা করে গঙ্গাকে মর্তে নিয়ে এসেছিলেন ও পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে তাঁর ষাটহাজার পূর্বপুরুষের আত্মার শ্রাদ্ধকর্মাদি সম্পাদন করে তাঁদের আত্মাকে মুক্ত করেছিলেন । ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের মিথের মতো ইসলামিক মিথেও রয়েছে জমজম কূপ সৃষ্টির কথা । সেখান থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় চারহাজার বছর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম আল্লাহর আদেশে তাঁর স্ত্রী হাজেরা বিবি ও শিশু পুত্র ইসমাইলকে মক্কার জনমানবহীন পাহাড়ের পাদদেশে নির্বাসন দেন । হযরত ইব্রাহিমের রেখে যাওয়া খুব সামান্য খাদ্যদ্রব্য ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে শিশুপুত্র ইসমাইল একসময় ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকে । এতে মায়ের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে । নিরুপায় হয়ে বিবি হাজেরা তাঁর শিশুসন্তানের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণের জন্য জলের খোঁজে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করতে শুরু করেন । বিবি হাজেরা জলের খোঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত সাতবার চক্কর কেটে ফেলেও ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত শরীরে আবার শিশুপুত্রের কাছে ফিরে আসেন । সেখানে এসে তিনি দেখতে পান তাঁর শিশুপুত্র ইব্রাহিমের পায়ের গোড়ালির ঘষায় মাটিতে যেটুকু গর্ত হয়েছে সেখানে মাটির নিচ থেকে জল উঠছে এবং সেখানে একটি ঝরনার সৃষ্টি হয়েছে । এই ঝরনাটি পরবর্তী সময়ে 'জমজমে'র কূপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা জমজমের জলকে আল্লাহ তায়ালার বিস্ময়কর কুদরত বলে মনে করেন । হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা দেশে ফেরার পথে পরিবার-পরিজনদের জন্য এই জমজমের পানি নিয়ে আসেন । ঠিক আমরা যেমন আনি গঙ্গাজল তীর্থপর্যটনে গেলে ।
অতীতকালে মানুষ প্রকৃতির উপাসক ছিলেন । প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের শক্তি সম্বন্ধে অজ্ঞতা হেতু মানুষ তাঁদের পূজা করতেন । সেই হিসেবে সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, জল, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্র,বিদ্যুৎ ইত্যাদি মানুষের উপাসনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় । অতীতকাল থেকে মানুষের জল সম্বন্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল । জলের জীবনদায়ী ক্ষমতা যেমন মানুষের জীবন রক্ষা করত তেমনি তার কৃষিজ সম্পদকে ফুলেও ফসলে ভরিয়ে দিত । আবার অতিরিক্ত জল প্লাবনের সৃষ্টি করত । তার এই ক্ষমতাকে নিয়ে সুন্দর বুননে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর নানা অংশের মানুষের মধ্যে নানা মিথ । এভাবেই অনেক আদিম লোকপুরাণ, লোকাচার ও লোকবিশ্বাস কালক্রমে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় । হিন্দু-মুসলমান ছাড়া খ্রিস্টান ও ইহুদীদের পবিত্র নদী জর্ডান । তার জলও পবিত্র । সারা বিশ্ব থেকে মানুষ এখনো জর্ডান নদীতে ব্যাপ্টিজম নিতে আসে । জলের পবিত্রতার ভাবনা তারই উদাহরণ । বিশ্বের প্রতিটি ধর্মেই তাই জলের গুরুত্ব ও পবিত্রতার অনুভূতি রয়েছে । আজকের বিশ্বব্যাপী পানীয় জলের যে সংকট সে ক্ষেত্রেও জলের গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আমাদের । হাজার হাজার বছর আগের মানুষের মনে জল সমন্ধে লোকসাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পবিত্র অনুভব আজকের দিনেও আমাদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ।
No comments:
Post a Comment