Sunday, January 26, 2025

দধীচি

দধীচি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জগত জুড়ে উদার সুরে প্রচার করলেও যুদ্ধ থামেনা ।
 রক্তাক্ত মহাকাব্য লেখা যেন মানুষের ধর্ম ।

বোধিবৃক্ষ তলে বসে শাক্যমুনি কার কথা বলেন ?
কাদের কান্না শুনে তিনি প্রাসাদে ছেড়েছেন ?

শাসকের ললাটের লেখা । যতক্ষণ তখতে থাকেন ততক্ষণ 
শিবিরে শিবিরে তার পতাকা ওড়ে । সিংহাসন ভেঙে গেলে ভিমরুলেরা  ঝাঁক বেঁধে নিশানা করে প্রণম্য বীরকেও ।

 তবুও যুদ্ধবিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে বহু সাধারণ নাগরিক 
দুধভাত না হোক, তবুও প্রতিবেশীসহ শান্তি চায় সবাই। 

হাজারো হৃদয়ের গভীর আওয়াজ, কুম্ভমুখী জনঢল 
সন্ত্রাস ও হিংসাকে পায়ে দলে খুঁজে ফেরে পূর্বজদের হাড় ।
যুগে যুগে দধীচিরা এ রেখে গেছেন পাহাড় প্রমান ।

Saturday, January 25, 2025

আমলিঘাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিংবদন্তী ও ইতিহাস

আমলিঘাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিংবদন্তী ও ইতিহাস 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আনুমানিক ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ শিক পরগনার কৈয়রা গ্রামে শমসের গাজীর জন্ম হয় । ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরারাজ্যের রাজধানী শমসের গাজির অধিকারভুক্ত হয় । তখন থেকে ১২ বছর তিনি ত্রিপুরারাজ্যের সর্বময় কর্তা ছিলেন । শমসের গাজির জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর মৃত্যুর পর শেখ মনুহর গাজি নামে এক পল্লীকবি রচনা করেন গাজীনামা । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালির সেরেস্তাদার মৌলবি খবির মুদ্রিত করেন এই গাজীনামা । ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত কাব্যগ্রন্থ গাজীনামায়  শমসের গাজির গড় জগন্নাথ-সোনাপুর গ্রামের বর্ণনায় পাই, 'দক্ষিনে ফেনী নন্দী / পূর্বে গিরি মুড়াবন্দি / উত্তরেতে এহেন জলধি । /  পশ্চিমে মলয়া পানি / তার মধ্যে ভদ্রাখানি / মধ্যে যেন খিরুদের দধি ।।

 এখানেও শমসের গাজীর গড়বন্দী গ্রামের সীমার উল্লেখ রয়েছে । ফেনীপাড়ের এই বিদ্রোহী বীরের উত্থানে সেদিন ত্রিপুরার রাজসিংহাসন কেঁপে উঠেছিল । ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শমসের গাজীর কিল্লা এবং বিশাল দিঘিটি আজও দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার পশ্চিম প্রান্তস্থ সীমান্ত গ্রাম আমলিঘাটে বিদ্যমান । আমলিঘাট থেকেই ফেনীনদীর নিম্নগতির শুরু এবং প্রশস্ত জলপ্রবাহের রূপ ধরে দক্ষিণাভিমুখী হয়ে বাংলাদেশের সমতল ক্ষেত্রে উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ।

ফেনী নদীপ্রবাহের ভারত ভূখণ্ডের শেষ প্রান্তিক জনপদ আমলিঘাট । সাব্রুম মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম । একসময় আমলিঘাট বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল । ত্রিপুরার প্রায় প্রতিটি নদীপ্রবাহের সীমান্ত অঞ্চলে রাজআমলে গড়ে উঠেছিল বনকর ঘাট । ফেনীনদীর ঘাটের ইজারার সুবাদে আমলিঘাটে গড়ে উঠেছিল ফেনীঘাট নামে বনকর ঘাট । আর তাকে কেন্দ্র করে তহশীল অফিস । ১৮৮৮ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ ও ত্রিপুরার যৌথ সরকারের তরফে একজন অফিসার এই ঘাটের তদারকি করতেন । বনজ সম্পদ আহরণের উপর ত্রিপুরার রাজা ও ব্রিটিশ সরকার ১০ আনা : ৬ আনা হারে কর আদায় করতেন । ১৮৭১ সালে ফেনীঘাটের ইজারা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ২০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২০০০ টাকা হয়েছিল । রিয়াং ও চাকমা গোষ্ঠীর লোকেরা তখন 'কোন্দা' এবং 'লং' নামে বিশেষ ধরনের নৌকা দিয়ে ফেনী ও গোমতী দিয়ে সমতল ত্রিপুরায় পণ্য পাঠাতেন । এসব কারণেই আমলিঘাটের গুরুত্ব ছিল । ১৯১৬ সালে সাব্রুম থেকে আমলিঘাটের রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয় ।

আমলীঘাট ও তার পার্শ্ববর্তী লোকালয় ঘিরে বেশ কিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও লোককাহিনি জড়িয়ে আছে । এখানে অবস্থিত শমসের গাজির দিঘি ও কেল্লাটি আজ জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে । দিঘির বৃহত্তর অংশই কাঁটাতারের ওপারে, যার একাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত । দিঘিটির তেমন সংস্কার নেই । পাড় কেটে অনেকে চাষের জমি বানিয়ে ফেলেছে । এই দিঘিকে কেন্দ্র করে লোককাহিনিও প্রচলিত ছিল একসময় লোকমুখে । দিঘির পাড়ে তালিকা রেখে মানত করলে নাকি বাসনকোশন পাওয়া যেত উৎসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণের কাজ সমাধা করার জন্য । দিঘির এক কোনা থেকে একটা সুড়ঙ্গপথ শমসের গাজির কেল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে যা এখন বনজঙ্গল ঘেরা এবং বাদুড়, চামচিকে, সরীসৃপের আবাসস্থল । লোকপ্রচলিত কথা আছে, এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে শমসের গাজির কেল্লার অভ্যন্তরের পর্দানশীন মহিলারা দিঘির জলে স্নান করতে যেতেন । 

শমশের গাজির এই দিঘিটির চারধারে যে উর্বর নিম্নসমভূমি রয়েছে এবং যা বর্তমানে বাংলাদেশের অংশের চাষের ভূখণ্ড তার নাম 'কালিদহ' । এই কালিদহকে কেন্দ্র করেও একটি পুরানো লোককথা প্রচলিত রয়েছে । সেই অনুযায়ী জানা যায় যে, এই কালিদহে নাকি চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা ডুবেছিল । বছর ৪০ এর আগেও এখানকার ভূমিতে প্রোথিত নৌকার গলুইয়ের মত কিছু একটার উর্ধ্বভাগ দেখা যেত। এটাকে ধারণা করা হত চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া নৌকার গলুইয়ের অংশবিশেষ । এই বস্তুটি ১৯৭৪ সালে এই প্রতিবেদক এবং ত্রিপুরার বিশিষ্ট লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে প্রত্যক্ষ করেছেন । গ্রাম্য ললনারা এখানে দীর্ঘদিন ধূপ দীপ জ্বালাতেন । পাশের বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত গ্রামটির নাম 'চম্পকনগর' ।  বলা হয় এখানে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি ছিল । আমলিঘাটের প্রায় এক দেড় কিলোমিটার দূরে ফেনীনদীর উজানের দিকে একটি গভীর খাত রয়েছে । এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জলঘূর্ণির সৃষ্টি হয় । জলের এই পাকের মধ্যে কিছু এসে পড়লে কুন্ডলি পাকিয়ে জল তা অনেক দূরে নিয়ে ফেলে । এই স্থানটিতে জলের গভীরতাও প্রচুর । ৫০-৬০ হাত লম্বা বাঁশ ফেলেও ঠাঁই পাওয়া যায় না । এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বলে মৎস্যশিকারিদের জন্য লোভনীয় স্থান এটি । এই জায়গাটির নাম 'মেরুকুম' । সন্নিহিত জনপদের নাম মেরুপাড়া ।  ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্তের শেষ ভূখন্ড বলেই হয়তো ভৌগোলিক 'মেরু' শব্দটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে । এখানে বিস্তৃত চরভূমি রয়েছে । মেরুকুমের এই চরভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখা বিকেলবেলা সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত নয়নমুগ্ধকর । লোকশ্রুতি আছে, এখানেই নাকি মনসামঙ্গল খ্যাত বেহুলার বাবা সায়বেনের বাড়ি ছিল। একসময় এই মেরুকুম পর্যন্ত সমুদ্রের জোয়ারের জল আসত । ফেনীনদীর বাঁকে অবস্থিতএই মেরুকুম-আমলিঘাট-কালিদহ-চম্পকনগর ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে সত্যিই মনসামঙ্গলে বর্ণিত কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । এই আমলীঘাটের পাশেই ফেনীনদীর পাড়ে একটি নাতিউচ্চ পাহাড়ে রয়েছে একটি প্রাচীন শিবমন্দির । এই পাহাড়টিকে বলা হয় সন্ন্যাসী টিলা । বহুকাল আগে এই টিলাতে একজন সন্ন্যাসী একাকী বাস করতেন বলে এর নাম সন্ন্যাসী টিলা হয়েছে । এখানকার শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করেও রয়েছে মিথ । কথিত আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের বিখ্যাত শৈবতীর্থে যাওয়ার আগে ভক্তরা এখানে বিশ্রাম করতেন । এই পাহাড়টায় প্রচুর বেলগাছ রয়েছে । বলা হয় এই বেলগাছ আপনাতেই গজায় । কেউ লাগাতে হয় না । কেউ কেউ বলেন, এখানে শিবপার্বতী বিশ্রাম করেন । প্রতিবছর শিবচতুর্দশীতে এখানে বিরাট মেলা বসে । এটিও চন্দ্রনাথ শিবতীর্থের ক্ষুদ্র রূপ । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্য দ্বিজ রতিদেবের 'মৃগলুব্ধ'তে যে শিকারির কাহিনি রয়েছে তাতে উল্লেখিত রঘুনন্দন পাহাড়ের শেষ প্রান্ত হল এই সন্ন্যাসী টিলা । মৃগলুব্ধ কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী এই সন্ন্যাসী টিলার সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া যায় । কালের গ্রাসে বহু কিছু হারিয়ে গেছে । হয়তো দ্বিজ রতিদেব কোন কারণে এই অঞ্চল পরিভ্রমণ করে গিয়ে তাঁর মৃগলুব্ধ কাব্য লিখে থাকবেন । সে দিক দিয়েও এ স্থানটির মাহাত্ম্য রয়েছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও আমলিঘাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । এক কথায় আমলিঘাটকে ঘিরে পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে । সরকার এ ব্যাপারে সহৃদয় দৃষ্টি দিতে পারেন ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস–কৈলাস চন্দ্র সিংহ
    ২. গাজিনামা–শেখ মনোহর গাজী
     ৩. ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. জগদীশগণ চৌধুরী
     ৪. ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম–ড. রঞ্জিত দে
      ৫. ত্রিপুরার লোক সাহিত্য ও জনজীবন–ড. রঞ্জিত দে 
      ৬. ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
      ৭. সাব্রুমের ইতিহাস ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
      ৮. মানিক্যশাসনাধীন ত্রিপুরা–নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী

Saturday, January 18, 2025

কার্বন

কার্বন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

একাকী পতাকা উড়ছে আকাশে
 পাতাহারানো বাতাসের দীন শরীর
 তারপরেও শহরে গলিতে গলিতে দাঁড়ায় 
কিন্ডারগার্টেনের গাড়িগুলো জানলায় জাল লাগিয়ে 

জীবনের সামনে কিছু নেই অন্ধকার ছাড়া 
তবু সে ঠেলে দেয় নিয়মিত সামনের দিকে 
আর ক্রমশ  রঙ বদলে যায় জনতার মাঠ 
ধীরে ধীরে জঙ্গলাকীর্ণ সে মাঠে শেয়াল ঢুকে যায় 

যেসব স্বপ্ন দেখতাম, যে আকাশ মাথার উপরে ছিল 
এখন সব কালোরাতে হারিয়ে যায়
 ফেলে দেওয়া কার্বনপেপার দেখি সর্বত্র ।

Sunday, January 12, 2025

এসো শান্তি, এসো মঙ্গল

এসো শান্তি, এসো মঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সর্বেষাং স্বস্তির্ভবতু ।
সর্বেষাং শান্তিরভবতু ।।
 সর্বেষাং পূর্ণং ভবতু ।
সর্বষাং মঙ্গলং ভবতু ।।

 আমাদের কোন জমিজিরেত ছিল না । বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন । তাই পরিযায়ী জীবনটাই দেখেছি বহুবছর । তারপরও আমাদের জন্য এসেছে বারো মাসে তেরো পার্বণ । কৃষি জীবনের পাশাপাশি আমাদের জীবন । কৃষক পরিবার নবান্নের দিনে আমাদের 'নিতা' না দিয়ে তাঁদের অন্ন গ্রহণ করেননি । অন্ততপক্ষে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন চাল-ডাল-আনাজ-মসলাপাতি ভর্তি এক ডালা 'সিধা' । প্রতিবেশীর প্রতি মর্মবোধে । প্রতিবেশীর সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে । প্রতিবেশীর মুখে আনন্দ না থাকলে গৃহস্থের আনন্দে ও তৃপ্তি আসে না । শান্তি পাওয়া যায় না । লোকাচার পালিত হলেও মনটা থাকে ভারাক্রান্ত । গৃহস্থ চান প্রতিবেশী ও শান্তিতে থাকুন । আনন্দে থাকুন । আমাদের উপনিষদ সেই স্বস্তির কথাই বলে । সেই শান্তির কথাই বলে । সেই পূর্ণত্বের কথা বলে । বলে সকলের মঙ্গলের কথা ।

৪৩-তম আগরতলা বইমেলায় এই ভূখণ্ডের প্রতিবেশীরা যখন পরস্পর আরো আরো বেশি বেশি করে পরস্পরকে বেঁধে বেঁধে রাখতে চাইছেন, যখন বাংলা প্রকাশনার পাশাপাশি ককবরক ও অন্যান্য প্রকাশনা সুশোভিত হয়ে উঠছে, সংখ্যার দিক থেকে এক অংক থেকে দুই অংকের পথে পা বাড়াচ্ছে, তখনই অনুভব হয় ঘরোয়া প্রতিবেশীর সৃজনসম্ভবনার, শ্রীবৃদ্ধির । সকলের নিশ্চিন্তির । সকলের শান্তির ।‌ আবার এ ব্যথা ও জাগে মনে যে, এবার তো আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিবেশীকে 'এসো আমার ঘরে এসো' বলে উদাত্ত আহ্বান জানাতে পারলাম না । পারলাম না একই রংয়ের রক্তের দোসরকে কাছে পেতে । সেই প্রতিবেশীর ঘরে আজ স্বস্তি নেই । শান্তি সেখানে বিঘ্নিত । অমঙ্গলের বিষবাষ্প, বিদ্বেষকলুষ আকাশে বাতাসে । পরস্পর থেকে আমরা ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছি । আমরা যেন অপরিচিত হয়ে যাচ্ছি একে অন্যের কাছে । এবারের বইমেলায় কাব্যজনের উচ্চারণে, সারস্বতজনের ভাষণে, শিল্পীর কন্ঠে প্রতিটি শৈল্পিক গলিতে, প্রতিটি মঞ্চে একই উৎকণ্ঠা আমাদের সেই প্রতিবেশীর জন্যে । সবারই আশা, এই মেঘ কেটে যাবে । এ অন্ধকার অপসারিত হবে একদিন । আবার আমরা কাছাকাছি আসব । পাশাপাশি বসব । 'প্রাণ জুড়াবে তায়' ।

এই সময়ের আর এক যন্ত্রণা, আর এক অস্বস্তি তারুণ্যকে নিয়ে । কেমন অদ্ভুত নেশার কবলে ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে আজকের প্রজন্ম । এ সমাজের আগামীর প্রতিনিধি তারা । অথচ দলে দলে জাটিংগার পাখির মতো ঝাঁপ দিয়ে চলেছে বিষাক্ত জতুগৃহে । তাদের স্বপ্নিল চোখে দুনিয়াকে দেখা, তাদের প্রেম, বিরহ ও সৃষ্টিশীলতা আজ এক শূন্যতার মাঝে সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে  তাদের মায়াবোধ । এই অশনিকাল থেকে উত্তরণেরও এক নিদান বই এবং বই । এক নির্বাক বান্ধব । বেপথুমান প্রজন্মটাকে দিশায় আনতে গেল বইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে এদের । বইও হতে পারে দুঃসময়ের মৃতসঞ্জীবনী । তাই এই পথহারাদের বইয়ের ভিড়ে মিশিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি । সচেতন মহল থেকে জোরালো হয়ে উঠে আসছে সে দাবি । সুস্থতার বোধনের যজ্ঞশালা হোক বইমেলার মাঠ । বইয়ের বুকে কান পেতে শুনুক ওরা জাগরণের গান ।

বইমেলা প্রবেশপথের সুদৃশ্য তোরণে স্থাপিত যাবতীয় মুদ্রাসমূহ আর সর্বশীর্ষে  শোভিত তথাগত বুদ্ধের প্রতীকী বিগ্রহ বিশ্বমৈত্রী, শান্তি আর করুণার বার্তাকে বহন করে । এই দুঃসময়ে প্রতিবেশীর রণোন্মাদনা, বিচ্ছিন্নতার উস্কানি, সীমান্তে গোলাবারুদের শংকা, আকাশে বোমারু বিমানের আসন্ন গর্জনভীতির মাঝেই আমাদের দেশ 'বহুজন হিতায় বহু জন সুখায়' নিরব নিশ্চল ও অচঞ্চল । শান্তির বার্তা ভারতাত্মার মর্মবাণী । এই বইমেলাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে সেই আত্মস্তব । প্রতিদিন কত কত গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে এই শান্তিবনে । তরুণ কবির উচ্চারণে, লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভেলিয়ানে জমাটি আড্ডায় ভালোবাসার কথা আর গান । মঙ্গলাচরণ । সর্বতো মঙ্গলে । এই বইমেলার অপরাহ্ণের নরম আলোয় যখন সদ্যবিবাহিত দম্পতি গলির মোড়ে পরস্পর মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে ফটোশ্যুট করেন তখন আমি তাঁদের অন্তরের ভেতরটা পড়ে ফেলি । সেখানে দেখি, তাঁরাও চান 'সমুখে শান্তির পারাবার' হোক । তাঁদের স্বপ্ন জানিয়ে দেয় যেন, আমরা চিরদিনই বলে যাব জ্ঞান, বিবেক, ও সংহতির অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত হোক সবার অন্তরে । তার সঙ্গে আরো আরো প্রার্থনা–
 সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ ।
সর্বে সন্ত নিরাময়াঃ ।। 
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু । 
মা কশ্চিৎ  দুঃখমাপ্নুয়াত ।।