Showing posts with label অশোকানন্দ রায়বর্ধন feature. Show all posts
Showing posts with label অশোকানন্দ রায়বর্ধন feature. Show all posts

Friday, April 13, 2018

দে দোল, দে দোল

আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি সর্বাধিক  প্রচলিত ৷ এটি মূলত রঙের উৎসব ৷ ঋতুর উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও এই হোলি ৷ কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷ প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা ৷

স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷  হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ৷ দাদার আদেশে ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয় ৷

এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জ্বা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধি করে সখীদের সঙ্গে অাবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলে ৷
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রম্ এ ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়কজন কবিও কাব্যে বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷

তাতে কিবা লাভ

তাতে কিবা লাভ হল আমার পিসির
আমি বাঙাল ৷ আমার পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গের কিংবা পুববাংলার ৷ আমার উত্তরপুরুষ পশ্চিমবঙ্গে কিংবা পশ্চিমবাংলায় ৷ আর আমার প্রিয় ফুটবল দল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ৷ এই ক্লাবের কদিন আগের সচিব কল্যাণ মজুমদার সম্পর্কে আমার কাকা হন ৷ এই কাকাকে আমি চোখে দেখিনি কোনদিন ৷ তিনিও পুববাংলার ৷ আমার পূর্ববঙ্গীয় বাবা বলে গেছেন, তাই আমি জানি উনি আমার কাকা ৷ আমার বাবা বলতেন, সুধীর কাকা তাঁর বাড়ির পাশে নিজেদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশ খানিকটা জায়গা বেশি রেখেছিলেন পুববাংলা থেকে তাঁর পরিজনরা আসবেন, পাশাপাশি বাড়ি করে থাকবেন ৷ পূর্ববঙ্গীয়দের টান এমনই ছিল সেদিন ৷ সেই সুবাদেই বোধহয় আমার অদেখা কাকার নাম ভাঙিয়ে উপকৃতও হয়েছি একবার ৷ সে বোধহয় গত শতকের আশি সাল ৷ আমরা পাঁচজন সহকর্মী ( আমি তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ) ভারত ভ্রমণে বেরুই ৷ ফেরার পথে আমার সহকর্মী দীপকদা দুম করে রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে বসলেন ৷ মুনমুন বৌদির পরিবারও পুববাংলার ৷ শিয়ালদার টাওয়ার হোটেলে থেকে অনাড়ম্বর বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয় ৷এই অধম আইনি সাক্ষী ৷ রাতের বেলা জানলাম হোটেল মালিকও পূর্ববঙ্গের ৷ নতুন বৌঠানকে নিয়ে আমরা সার্কুলার ট্যুর অনুযায়ী অসম হয়ে ট্রেনে ফিরব ৷ দীপকদার শ্বশুরমশাই একটা সিদ্ধান্ত দিলেন, বিয়েতে তো কিছু দিলেন না ৷ উদারচিন্তক দীপকদাও কোন কিছুর দেওয়া নেওয়ার ঘোর বিরোধী ৷ শুধু মেয়ে-জামাই ও আচমকা বরযাত্রীরা যদি প্লেনে যাই তবে আগরতলা- কোলকাতার টিকিটের টাকাটা তিনি দিতে চান ৷ দীপকদাকে নরম করানো যাচ্ছিল না কিছুতেই ৷শেষকালে টাওয়ার হোটেলের মালিক আমার ঠাকুরমার সূত্রে কোনো আত্মীয়তা রেশ ধরে মীমাংশা দিলেন ৷ দীপকদাকে বললেন, তুমি না হয় নিলে না ৷কিন্তু তোমার শ্বশুরমশাই তাঁর মেয়ের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্যে বোধহয় এ প্রস্তাব দিয়েছেন ৷ এই পূর্ববঙ্গীয় চালে আমার দাদাটি কুপোকাৎ হলেন ৷ টাকা তো দিলেন৷ কিন্তু দু এক দিনের মধ্যে টিকিট কোথায়? হোটেল মালিকসহ সবাই খোঁজখবর করলেন ৷ব্যবস্থা হল না ৷ আমরা ট্রেনেই ফিরব ৷ দেখা করতে গেলাম বালিগঞ্জে আমার কাকা কাকি ঠাম্মার সঙ্গে ৷ কথায় কথায় আমার মেজো কাকা জানলেন আমরা টিকিট পাচ্ছি না ৷ একটা চিরকুট লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ও তো আবার সাহিত্যিক ৷পড়ে দেখ তো আমার লেখায় ভুলটুল আছে কিনা ৷ এক কাজ করবি সোজা সিটি অফিস চলে যাবি ৷ ওখানে ডেপুটি ম্যানেজার কল্যাণ মজুমদার আছে ৷আমার নাম করে চিঠিটা দিবি ৷ হয়ে যাবে আশা করি ৷ সেখান থেকে ফিরে পরদিন চলে গেলাম সিটি অফিসে ৷ গিয়ে দেখি কল্যাণ কাকার চেম্বারের নেমপ্লেট কিন্তু দরজায় তালা ৷ আমার আশার গুড়ে কাঁকর ৷ যাক এসেছি যখন টিকিটের কাউন্টারে খোঁজটা নিয়ে যাই ৷ কাউন্টারে গিয়ে বললাম, আগরতলার টিকিট হবে? পাঁচখানা? কবেকার? কালই যেতে চাই ৷ কিসব দেখে টেখে কাউন্টারওয়ালা বললেন, সাতদিনের মধ্যে নেই ৷ ও হরি! আমতা আমতা করে কাকার চেম্বারের দিকে তাকিয়ে বললাম, কল্যাণ মজুমদার আছেন? ওদিক থেকে পাল্টা প্রশ্ন, কেন, কী দরকার? না, একটা চিঠি ছিল ওনার ৷ কাউন্টার কর্তা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, কখানা টিকিট লাগবে বললে? পাঁচখানা ৷ টাকা আছে? না টাকাতো আনিনি ৷খোঁজ নিতে এসছিলাম ৷ থাকো কোথায়? টাওয়ার হোটেলে ৷ আগরতলার লোকগুলোই ওরকম ৷ যাও, আধঘন্টার মধ্যে টাকা নিয়ে এস ৷আমি রাস্তায় নেমে ওপারে গিয়ে বড়োবজারের ভেতর দিয়ে সোজা টাওয়ার হোটেলে ৷ ফিরে এসে পাঁচখানা টিকিট নিয়ে বিশ্বজয় করে সুভদ্রাহরণ করলাম আমরা ৷ আমার সেই পূর্ববঙ্গীয় কল্যাণ কাকাকে আজো দেখি নি ৷ ইস্টবেঙ্গল ও বৈমানিক জীবন নিয়ে ভিন্নধর্মী লেখালেখির দৌলতে কোলকাতায় তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি আছে ৷
আজই জানলাম পূর্ববাংলা- পশ্চিমবাংলার, ঘটি-বাঙালের সেই নস্টালজিক ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যাবে ৷ পূর্ববাংলা তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে ৷ আর পশ্চিমবঙ্গও অগস্ত্যযাত্রার পথে শুধু বঙ্গ বা বাংলা রেখে যাবে ৷ এতো ভঙ্গ বঙ্গ তবু রঙ্গভরা ! আহা

সব লোকে কয় লালন কী জাত

আজ বারুণী স্নান ৷ জলদেবতা বরুণের নাম থেকে এর উৎস ৷ বারুণী স্নান তাই জলের উৎসব ৷ চৈত্রমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিথে এই উৎসব হয়ে থাকে ৷এদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নদীতে স্নান ও তর্পণ করে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করেন ৷ উদ্দেশ্য পূণ্যার্জন ও পাপমুক্তি ৷ এক কথায় প্রাচীন মানুষের পূর্বপুরুষ পূজারই একটি ধারা এটি ৷ এ ধরণের পিতৃতর্পণকর্ম মহালয়াতেও আচরিত হওয়ার বিধি আছে ৷ আবার কোনো কোনো সম্প্রদায়ের বিশেষ ধর্মীয় কারণেও এই পার্বনটিকে বিশেষ মান্যতা দেন ৷ যেমন মতুয়া সম্প্রদায়ভূক্তরা তাঁদের ধর্মীয়গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে, পশ্চিমবঙ্গে শ্যামনগরে এবং দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুমের পশ্চিমদিকের গ্রাম বড়খলাতে এই তিথিতে মেলার আয়োজন করেন ৷  ত্রিপুরারাজ্যের দক্ষিণের সীমান্ত শহর সাব্রুম  সংলগ্ন ফেনি নদীর পাড়েও প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে হয়ে থাকে বারুণী স্নান ও মেলা ৷ ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির বহু আগে থেকেই এই মেলা চলে আসছে ৷ ভারতভুক্তির পর যখন দুই দেশের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় তখন থেকেই এই মেলা এক মানবিক আবেদনের রূপ নেয় ৷ এই মেলাতেই দেখা দেশের বাড়িতে ফেলে আসা মানুষজনের সাথে এপাড়ে উঠে আসা মানুষের ৷ নদীর বুকে এদিন দুপারের আত্মীয় স্বজনের গলা জড়িয়ে কান্নার রোলে বাতাস ভারি হয়ে উঠত ৷ এই প্রতিবেদকেরও ওপারের আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্যে এই করুণ আবহের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ কালক্রমে বয়স্ক আত্মীয়স্বজনরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ৷ তাই এ দৃশ্য বর্তমান প্রায় বিরল ৷ পুরোণোদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেলেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যাঁরা এদেশে রয়ে গেছেন তাঁদের কেউ কেউ এদিনটাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ৷ তাছাড়া এখানকার ত্রিপুরি ও মগ জনজাতি অংশের মানুষের অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে দুপারে ৷ তাঁরাও এদিন মিলিত হওয়ার সুযোগ নেন ৷

সম্প্রতি সাব্রুমের বারুণী মেলা আগের চেয়ে অনেক বড়ো আকারের  আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে ৷ সেই ধর্মীয় বাধাবন্ধ আজ আর নেই ৷ কারণ বাঙালির রক্তেই আছে সম্প্রীতির বার্তা ৷ বাঙালিরই পূর্বসূরী চন্ডিদাস, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ৷ যাঁরা মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা বলেন ৷ সেই অসাম্প্রদায়িক বার্তা বুকে নিয়েই এদিন দুপারের হাজার হাজার লোক মিলিত হন ৷ নদী কোনো সীমানা হয় না ৷ কাঁটাতার কোন প্রতিবন্ধক হয় না ৷ ভূখন্ডের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ব্যবধান থাকে না ৷ দুই ভূখন্ডের মানুষ এক বন্ধনে বাঁধা পড়েন কিছুক্ষণের জন্যে ৷ কিছু ব্যবসায়িক বিষয়বুদ্ধিকে বাদ দিলে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যায় না এদিনের মহামিলনে ৷ শৃঙ্খলাটা যেন মানুষের মন থেকেই বেরিয়ে আসে ৷ কোনো জাতপাত ধর্মান্ধতা এখানে মাথা তুলতে পারে ৷ শুধু মানুষ আসে মানুষের কাছে আন্তরিকতা নিয়ে ৷ এবছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি ৷ বিরাটপুরুষ অন্তর্যামী অলক্ষ্যে হাসেন আনন্দে ৷ 'তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর ৷'

Sunday, April 1, 2018

এই কী তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ

বইমেলা ৷ আর দশটা মেলার মতো নয় এই মেলা ৷ সংবৎসর আর সব মেলা হয় যেখানে থাকে শুধু ব্যসনের সামগ্রী ৷ বৈভবের সমাহার ৷ বিত্তবাসনার নিবৃত্তির উপকরণ ৷ মনোহারী সব সরঞ্জামের সমাবেশ ৷ বইমেলা এসব থেকে পুরোটাই আলাদা ৷ হ্যাঁ বইমেলারও একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে ৷ এ টেনে নেয় গুণীজনকে ৷ মননশীলতাকে ৷ ঐতিহ্যের প্রতিও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে বইমেলা তার পারিপার্শ্বিকতায় ৷ বইয়ের প্রতি প্রণয় আত্মার আকর্ষণ ৷ বিশ্বকে আপন করে নেবার প্রক্রিয়ায় কালো অক্ষরের আনন্দযজ্ঞ ৷ বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বিশ্ব ইতিহাস সংস্কৃতিকে ভালোবাসা ৷ তার টানেই বইমেলায় সামিল হওয়া ৷ অজান্তেই মন বলে ওঠে- বইমেলা ‘ এই কী তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ? ‘

     তেমনি এক হার্দ্য বইমেলার নাম আগরতলা বইমেলা ৷ বিশ্বের বঙ্গভাষী অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা ৷ আজ ছত্রিশ বছরে পড়ল এই বইমেলা ৷ উনিশ শো একাশি সালের তিরিশে মার্চ মাত্র চব্বিশটি স্টল নিয়ে আগরতলা রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গনে শুরু হয়েছিল এই বইমেলা ৷ তারপর জুরি-দেও-মনু-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনির বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জলস্রোত ৷ শৈশব পেরিয়ে, কৈশোর অতিক্রম করে, যৌবনের শ্যামল গরিমায় পৌঁছে গেছে আগরতলা বইমেলা ৷ আজ বিশ্বের নানাপ্রান্তের মানুষ জেনে গেছে আগরতলা বইমেলার নামমাহাত্ম্য ৷ আজই যখন দিবসের দাবদাহ ক্রমশ শীতল হয়ে আসবে, চৈতালি হাওয়ার বাসন্তী আমেজে যখন অপরাহ্ণ ভরে উঠবে কোমল মায়ায়, সেইক্ষণে উদ্বোধন হবে আগরতলা বইমেলার ৷ রাজ্যের মননের উৎসবমালার প্রধান মন্ডপের ৷

বই মানুষের সভ্যতার অপরিহার্য জীবনবীজ ৷ মানব ইতিহাস, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ৷ বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষ পরস্পর মননের আনন্দ ভাগ করে নেন ৷ আগরতলা বইমেলাও সেজে উঠছে সেই নেশায় ৷ সেই আকর্ষণে ৷ রাতদিন খাটাখাটনির পর চলছে শেষ তুলির টান ৷ নির্মিয়মান স্থায়ী মঞ্চের অলঙ্করণ ৷ বইমেলাকে কেন্দ্র করে আগরতলা শহর জুড়ে শুরু হয় বইপ্রকাশের উন্মাদনা ৷ ইতিমধ্যে হৈ চৈ বাঁধিয়ে অনুষ্ঠান করে একঝাঁক বই প্রকাশ করে ফেলেছেন  নীহারিকা, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী,ভাষা, তুলসী পাবলিশিং হাউসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ৷ মফস্বল শহর কুমারঘাট থেকে এসে আগরতলা শহরে গ্রন্থপ্রকাশ উৎসব সেরে ফেলেছেন স্রোত প্রকাশনের মতো বনেদি প্রতিষ্ঠান ৷ কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বই প্রকাশ করছেন ৷ মেলা চলাকালীন হবে আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ৷

এই মননের আনন্দে বসে নেই আজকের তারুণ্যও ৷ সরকারী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্রছাত্রী ৷ তাঁরা হত কদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলপনায় আলপনায় দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন বইমেলার প্রবেশপথ ৷ আমাদের চিরন্তন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যে এ ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ ৷ সময় এগিয়ে গেলেও, চারদিকে বিশ্বায়ণের থাবা বিস্তৃত হলেও, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট রূপ নেওয়া সত্বেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে জাতির সংস্কৃতির গভীরে প্রবাহিত হয়, বইমেলার অভিমুখে এই পথশিল্প তারই ইঙ্গিতবাহী ৷ আগামী কদিন আগরতলা বইমেলা

জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনের পীঠভূমি হয়ে উঠুক ৷

Sunday, November 12, 2017

ভাষা শিক্ষা

একাধিক ভাষা জানা থাকলে ভাষাশিক্ষার্থীর সামনে পাঠদান খুবই সহজ হয় ৷ ভাষা জানার অভিজ্ঞতাকে আমি ক্লাসে ব্যবহার করে বেশ সুফল পেয়েছি ৷ বাংলা ও তার প্রতিবেশী দু তিনটে ভাষায় আমি মোটামুটি বলা, পড়া আর লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারি ৷ আর বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বাংলা আমি যথাযথ বাচনভঙ্গিতে অনায়াসে বলে যেতে সক্ষম ৷ বাংলা ব্যাকরণ পাঠদানের সময় বেশ কার্যকরী ভূমিকাও গ্রহণ করেছে ৷ বিশেষত ভাষাতত্ত্ব পাঠদানের সময় বাংলা বিভিন্ন উপভাষাসমূহের আলোচনার সময় সেগুলোর উচ্চারণ সহযোগে উদাহরণ উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সহজে বিষয়টা বুঝে নিতে পারে ৷
        শিক্ষার্থী বাংলার যে অঞ্চলের অধিবাসী হোক না কেন তাকে মান বাংলায় শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় ৷ ফলে বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থী বাঙালি হলেও তার বাংলা শব্দভান্ডার দুর্বল থাকে ৷ মান বাংলায় ব্যবহৃত কোন বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর অজানা হলে সেটা বোঝানোর জন্যে তার নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বাংলার শব্দভান্ডারের শরণাপন্ন হতে হয় এবং সেখান যথাযথ প্রতিশব্দ নিয়ে সমস্যা নিরসন সম্ভব হয় অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট শব্দ চেনানো বা বিষয় বোঝানো সহজ হয় ৷
     বাংলা ব্যাকরণে 'বর্ণের উচ্চারণ স্থান' নামে একটা অধ্যায় আছে ৷ সেখানে বাকযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে জিহ্বার স্পর্শানুযায়ী বিশেষ বিশেষ বর্ণের বিশেষ বিশেষ নাম রয়েছে ৷ সেই অনুযায়ী কন্ঠ্যবর্ণের উদাহরণ হিসেবে ক‌,খ,গ,ঘ, ঙ কে সহজেই চেনানো বোঝানো যেত ৷ কিন্তু তালব্যবর্ণ, মূর্ধ্যবর্ণকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হত ৷ দুটোর উচ্চারণ স্থানই আমাদের মুখগহ্বরের ওপরের দিকের শক্ত অংশ ৷ দন্ত্যমূলের পরে যে শক্ত অংশ সেখানে জিহ্বার স্পর্শ পেয়ে উচ্চারিত হয় চ,ছ, জ,ঝ,ঞ ৷ এগুলো তালব্যবর্ণ ৷ আর এই শক্ত অংশের পরে ওপরের দিকের শক্ত অংশে জিহ্বার স্পর্শে উচ্চারিত হয় ট,ঠ,ড,ঢ,ণ ৷ এগুলো মূর্ধ্য বর্ণ ৷কিন্তু পুরো শক্ত অংশ এলাকাকে মান বাংলায় বলা হয় তালু ৷ বিভাজন করলে সম্মুখ তালু ও পশ্চাৎ তালু ৷ কিন্ত সমস্যা হল এই যে, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলায় একে তালু বলে না ৷ আর তালু বলে এই অঞ্চলে অন্য তিনটি প্রত্যঙ্গ চিহ্নিত ৷ হাতের চেটো - তালু, পায়ের তলা- তালু আর মাথার ওপরের বহিঃত্বক ৷- তালু ৷ ফলে এ জায়গাটায় এসে শিক্ষারথীরা গুলিয়ে ফেলত ৷ তালব্য বর্ণটা যদিও বা কোনোরকমে বোঝানো যেত ৷ মূর্ধ্য বর্ণে এলে জটিলতা বেড়ে যেত ৷ এক্ষেত্রে আমি একটা মজার চুটকির আশ্রয় নিতাম ৷ গল্পটা এইরকম ৷ নতুন জামাই খেতে বসেছে ৷ শাশুড়ি শুরুতেই ভাতের সঙ্গে দিয়েছেন গরম আলুসেদ্ধ ৷ জামাই ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধটা মেখে প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতেই গরম আলুসেদ্ধ গিয়ে আটকাল মুখগহ্বরের উপরের অংশে ৷ যন্ত্রণায় জামাই বাবাজি  মুখ উপরে তুলে হাঁ করে ছনের ছাওয়া রান্নাঘরের বাঁশের কাঠামোর দিকে তাকিয়ে মুখে হাওয়া টানছে ৷ বুদ্ধিমতী শাশুড়ি বুঝতে পেরে মজা করে জামাইকে জিজ্ঞেস করছেন, উপরের দিকে কী চাইতাছো বাবা ৷ জামাইও সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়, না মা, দ্যাখতাছি  ইডি কোন ঝাড়ের বাঁশ ৷ শাশুড়িও মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিলেন, ইডি টাকরাপোড়া ঝাড়ের বাঁশ ৷ আমি বলতাম শিক্ষারথীদের, বুজছো নি ৷ এই টাকরাই হইলো মূর্ধা ৷ জিহ্বা এইখানে ছুঁইয়া যে বর্ণগুলি উচ্চারিত হয় সেগুলি মূর্ধ্য বর্ণ ৷ক্লাসশুদ্ধ হাসিতে ফেটে পড়ে জবাব দিত চিনছি স্যার ৷ সারাজীবনেও ভুলতাম না ৷

Saturday, July 15, 2017

এ শহর পাখিদের মুক্তাঞ্চল ৷ এ শহর ফুলেদের নাচঘর ৷ এখানের আকাশ উদোম কিশোর ৷ রাতের তারাদের অ্যাকোরিয়াম ৷ মাঠের ফসল লুটোপুটি খায় আত্মদানের আনন্দে ৷ মন্দিরময় এ শহর যেন সহজ মানুষের হরিবাসর ৷একমাত্র মসজিদটাকেও বুক দিয়ে আগলে রাখে , চিরাগ জ্বালায় এ শহরেরই সব ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ৷ প্রান্তিকনদী ফেনির ওপার থেকে দখিন সমীরণ বয়ে আনে ওপারের আজানধ্বনি ৷এপার থেকে সংকীর্তনসসুর উত্তুরে হাওয়ায় পাখা মেলে উড়াল দেয় ওপারে ৷ সীমান্তবর্তী হয়েও অসীমান্তিক এ শহর স্বচ্ছতার শহর ৷ মুক্তমনের শহর ৷ বুকের ভেতর স্বপ্ন লালন করে আছে এশহর ৷ কোনদিন উদার আহ্বান জানাবে, 'আজি দখিন দুয়ার খোলা' ৷ 'এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে' ৷ এক বিশ্বপ্রেমিক আত্মার বাসভূমি আমার শহর সাব্রুম ৷

Wednesday, June 28, 2017

রথযাত্রার উৎস

রথোত্সব বা রথযাত্রার সঙ্গে বহুবিধ লোকসাংষ্কৃতিক বিষয় জড়িয়ে রয়েছে । রথযাত্রা সূর্যপূজারও ইঙ্গিত করে ।সূর্যের সপ্তাশ্ববাহিত রথে পরিক্রমণের কথা মনে করায় । আদিম মানুষ সূর্যকে দেবজ্ঞানে ভক্তি ও পূজা করত । আদিম মানুষ লক্ষ করেছিল সূর্যালোক শস্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনীয় ।জলবর্ষী মেঘের স্রষ্টা এবং ঋতুচক্রের নিয়ন্তা হল সূর্য । শষ্যোত্পাদনের জন্যে আলো ও জল অপরিহার্য ।  সে হিসেবে রথযাত্রা উর্বরতাকৃষ্টির সঙ্গেও জড়িত । বর্ষার সমাগমে এই উত্সব কৃষিউত্সবেরও রূপভেদ । ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সূর্যের ভূমিকা প্রধান বলে আদিম মানুষ সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঋতুউত্সবের আয়োজন করত ।আদিম মানুষের ধারনা ছিল সূর্যকে রথে চড়িয়ে অয়ঃচক্রে পরিভ্রমণ করালে সারা বছর সূর্যের গতিপ্রকৃতি ঠিক থাকবে এবং ফলস্বরূপ কৃষিজ উত্পাদনের সহায়ক ঋতুচক্রের আবর্তনের নিয়মেও কোন হেরফের হবে না ।

Friday, May 26, 2017

তালুবন্দী

একাধিক ভাষা জানা থাকলে ভাষাশিক্ষার্থীর সামনে পাঠদান খুবই সহজ হয় ৷ ভাষা জানার অভিজ্ঞতাকে আমি ক্লাসে ব্যবহার করে বেশ সুফল পেয়েছি ৷ বাংলা ও তার প্রতিবেশী দু তিনটে ভাষায় আমি মোটামুটি বলা, পড়া আর লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারি ৷ আর বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বাংলা আমি যথাযথ বাচনভঙ্গিতে অনায়াসে বলে যেতে সক্ষম ৷ বাংলা ব্যাকরণ পাঠদানের সময় বেশ কার্যকরী ভূমিকাও গ্রহণ করেছে ৷ বিশেষত ভাষাতত্ত্ব পাঠদানের সময় বাংলা বিভিন্ন উপভাষাসমূহের আলোচনার সময় সেগুলোর উচ্চারণ সহযোগে উদাহরণ উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সহজে বিষয়টা বুঝে নিতে পারে ৷
        শিক্ষার্থী বাংলার যে অঞ্চলের অধিবাসী হোক না কেন তাকে মান বাংলায় শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় ৷ ফলে বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থী বাঙালি হলেও তার বাংলা শব্দভান্ডার দুর্বল থাকে ৷ মান বাংলায় ব্যবহৃত কোন বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর অজানা হলে সেটা বোঝানোর জন্যে তার নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বাংলার শব্দভান্ডারের শরণাপন্ন হতে হয় এবং সেখান যথাযথ প্রতিশব্দ নিয়ে সমস্যা নিরসন সম্ভব হয় অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট শব্দ চেনানো বা বিষয় বোঝানো সহজ হয় ৷
     বাংলা ব্যাকরণে 'বর্ণের উচ্চারণ স্থান' নামে একটা অধ্যায় আছে ৷ সেখানে বাকযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে জিহ্বার স্পর্শানুযায়ী বিশেষ বিশেষ বর্ণের বিশেষ বিশেষ নাম রয়েছে ৷ সেই অনুযায়ী কন্ঠ্যবর্ণের উদাহরণ হিসেবে ক‌,খ,গ,ঘ, ঙ কে সহজেই চেনানো বোঝানো যেত ৷ কিন্তু তালব্যবর্ণ, মূর্ধ্যবর্ণকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হত ৷ দুটোর উচ্চারণ স্থানই আমাদের মুখগহ্বরের ওপরের দিকের শক্ত অংশ ৷ দন্ত্যমূলের পরে যে শক্ত অংশ সেখানে জিহ্বার স্পর্শ পেয়ে উচ্চারিত হয় চ,ছ, জ,ঝ,ঞ ৷ এগুলো তালব্যবর্ণ ৷ আর এই শক্ত অংশের পরে ওপরের দিকের শক্ত অংশে জিহ্বার স্পর্শে উচ্চারিত হয় ট,ঠ,ড,ঢ,ণ ৷ এগুলো মূর্ধ্য বর্ণ ৷কিন্তু পুরো শক্ত অংশ এলাকাকে মান বাংলায় বলা হয় তালু ৷ বিভাজন করলে সম্মুখ তালু ও পশ্চাৎ তালু ৷ কিন্ত সমস্যা হল এই যে, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলায় একে তালু বলে না ৷ আর তালু বলে এই অঞ্চলে অন্য তিনটি প্রত্যঙ্গ চিহ্নিত ৷ হাতের চেটো - তালু, পায়ের তলা- তালু আর মাথার ওপরের বহিঃত্বক ৷- তালু ৷ ফলে এ জায়গাটায় এসে শিক্ষারথীরা গুলিয়ে ফেলত ৷ তালব্য বর্ণটা যদিও বা কোনোরকমে বোঝানো যেত ৷ মূর্ধ্য বর্ণে এলে জটিলতা বেড়ে যেত ৷ এক্ষেত্রে আমি একটা মজার চুটকির আশ্রয় নিতাম ৷ গল্পটা এইরকম ৷ নতুন জামাই খেতে বসেছে ৷ শাশুড়ি শুরুতেই ভাতের সঙ্গে দিয়েছেন গরম আলুসেদ্ধ ৷ জামাই ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধটা মেখে প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতেই গরম আলুসেদ্ধ গিয়ে আটকাল মুখগহ্বরের উপরের অংশে ৷ যন্ত্রণায় জামাই বাবাজি  মুখ উপরে তুলে হাঁ করে ছনের ছাওয়া রান্নাঘরের বাঁশের কাঠামোর দিকে তাকিয়ে মুখে হাওয়া টানছে ৷ বুদ্ধিমতী শাশুড়ি বুঝতে পেরে মজা করে জামাইকে জিজ্ঞেস করছেন, উপরের দিকে কী চাইতাছো বাবা ৷ জামাইও সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়, না মা, দ্যাখতাছি  ইডি কোন ঝাড়ের বাঁশ ৷ শাশুড়িও মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিলেন, ইডি টাকরাপোড়া ঝাড়ের বাঁশ ৷ আমি বলতাম শিক্ষারথীদের, বুজছো নি ৷ এই টাকরাই হইলো মূর্ধা ৷ জিহ্বা এইখানে ছুঁইয়া যে বর্ণগুলি উচ্চারিত হয় সেগুলি মূর্ধ্য বর্ণ ৷ক্লাসশুদ্ধ হাসিতে ফেটে পড়ে জবাব দিত চিনছি স্যার ৷ সারাজীবনেও ভুলতাম না ৷