আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি সর্বাধিক প্রচলিত ৷ এটি মূলত রঙের উৎসব ৷ ঋতুর উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও এই হোলি ৷ কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷ প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা ৷
স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷ হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ৷ দাদার আদেশে ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয় ৷
এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জ্বা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধি করে সখীদের সঙ্গে অাবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলে ৷
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রম্ এ ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়কজন কবিও কাব্যে বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷
No comments:
Post a Comment