Showing posts with label আলোচনা. Show all posts
Showing posts with label আলোচনা. Show all posts

Monday, March 17, 2025

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

গতকাল বামুটিয়া কালিবাজার সংলগ্ন পাতাবাজারে নবোন্মেষ ও সমতট সাহিত্যপত্রের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত উৎসব । অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে রঙে রঙে রাঙিয়ে বনভূমিবেষ্টিত এই নির্জন পল্লীতে রাজ্যের প্রায় ৩০০ জন গুণী ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, সংগীতশিল্পীর সম্মিলিত সমাবেশে এই মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় । প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই অনুষ্ঠান ও মধ্যাহ্নের আহার্য খিচুড়ি ও সবজি সবাইকে মনে প্রাণে তৃপ্তি দেয় । আয়োজকদের প্রত্যেকের অকুন্ঠ আতিথেয়তায় সবাই অভিভূত। আলোচনা, নৃত্য পরিবেশন কবিতাপাঠে গোটা অনুষ্ঠান ছিল প্রাণবন্ত । এ জাতীয় অনুষ্ঠানে শুধু সৃজনশীলতার চর্চাই হয় না । ভাবের আদান-প্রদানসহ আন্তরিক সম্পর্কও তৈরি করে । 

অনুষ্ঠানের একটা পর্বে ছিল রাজ্যর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কুমার কমলের আকর্ষণীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, যা সকলের মন জয় করে । কুমার কমলকে হোলির গান গাওয়ার জন্য জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাঁর অপারগতার কথা অকপটে স্বীকার করেন । কিন্তু তিনি শেষদিকে উপস্থিত গুণীজনের জন্যে একটা প্রশ্ন রেখে যান । তাঁর কাছে নাকি পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে । এবং তিনি নাকি সেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছেন । তিনি নাকি বেদ-পুরান-ভাগবতের কোথাও 'রাধা' শব্দটি পাননি । উপস্থিত গুণীজনদের কাছে তিনি তার ব্যাখ্যা চেয়েছেন । এ নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে প্রশ্ন ও কিঞ্চিৎ গুঞ্জন সৃষ্টি হয় । দু-একজন আমার কাছে বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন । আমার শাস্ত্রগ্রন্থাদির তেমন পাঠ নেই । কিন্তু বাংলাসাহিত্যের দীন ছাত্র হিসেবে যে সমস্ত গ্রন্থ সামান্য পাঠ করেছি কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য সেখানে কিন্তু 'রাধা' নাম আমি পেয়েছি । এমনিতেই অনুষ্ঠানটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল না তাই আমি আরও সময় নষ্ট করে ব্যাখ্যায় যাইনি ।

সবার অবগতির জন্য আমি আমার সামান্য জ্ঞান থেকে এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি কোথায় কোথায় 'রাধা' নামের কিরূপ অবস্থান রয়েছে । এবিষয়ে যাঁরা নিবিড় চর্চা করেন তাঁরা আরও  বিস্তৃত বিশ্লেষণ করতে পারবেন । জয়দেবের 'গীতগোবিন্দম্' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের মিলন, বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, হর্ষোল্লাস তথা পুনর্মিলনের কাহিনি মধুর লালিত্যমন্ডিত পদ দ্বারা সংবদ্ধিত হয়েছে । কাব্যের শেষে ভগবানরূপী শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার চরণযুগল মস্তকে ধারণের প্রার্থনা করেছেন 'দেহি পদপল্লবমুদারম' বলে । আমাদের পাঠ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটিও রাধাকৃষ্ণের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট । সেখানে 'রাধাবিরহ' নামে একটা ছিন্ন খন্ড রয়েছে। এছাড়া বাংলার কাব্য, সাহিত্য, গীতিকা, পদাবলী বা বৈষ্ণবকবিতা, বৈষ্ণবাচার্যদের টীকা-টিপ্পনীসমূহে তো বহুভাবে  রাধাপ্রসঙ্গের  উল্লেখ রয়েছে । পুরাণের মধ্যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও পদ্মপুরাণ এর নানা স্থানে রাধা নামের উল্লেখ রয়েছে । মৎস্যপুরাণে 'রুক্মিণী দ্বারাবত্যাং তু রাধা বৃন্দাবনে ।' বায়ুপুরাণে  'রাধা বিলাস রসিকং' । বরাহপুরাণে  'তস্য রাধা সমাশ্লিষ্য ' রয়েছে । ঋকবেদেও ১/২২/৭-৮ এবং ৮/৪৫/২৮ সূক্তে 'রাধা' 'রাধস' 'গোপি' শব্দের উল্লেখ আছে সামবেদে শ্রীরাধার সহস্র নাম আছে । তার মধ্যে ষোড়শ নাম প্রধান । অথর্ববেদ এবং অথর্ববেদের অন্তর্গত পুরুষবোধিনী শ্রুতি ( রাধা যস্যা ), গোপালতাপনী শ্রুতি, গৌতমীয় তন্ত্র ( রাধিকা পরদেবতা ) তৈত্তরীয় উপনিষদ, রাধাতন্ত্র এবং নারদপঞ্চরাত্রতেও ( জগন্মাতা চ রাধিকা ) রাধা নাম উল্লেখিত আছে । শ্রীমৎ ভাগবত গীতা হল শ্রী ভগবানের বাণী । এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের পারস্পরিক সংলাপে অন্য কোন চরিত্রের উপস্থিতি অস্বাভাবিক । বিষয়বস্তু ও আলাদা । রাধার উপস্থিতিও অপ্রাসঙ্গিক । এখানে একটি দর্শনকে উপস্থাপন করা হয়েছে ।

শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে প্রকাশ্যে রাধা নাম না থাকলেও রাধাকৃষ্ণকে নিয়েই এই গ্রন্থ । প্রাণবিহীন যেমন দেহের অর্থ নেই । প্রাণই দেহের মূল । তেমনি শ্রীরাধা ভাগবতের প্রাণ । শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের প্রাণ । শ্রীল শুকদেব গোস্বামী শ্রীরাধিকার প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণে বৈষ্ণবীয় বিনম্রতায় ভাগবতে রাধা নাম উল্লেখ করেননি । শুকদেব কেন শ্রীমতি রাধারানি নাম উচ্চারণ করেননি সেই প্রসঙ্গে সনাতন গোস্বামীর ব্যাখ্যায় রয়েছে–

 "গোপীনাং বিততিদ্ভুতস্ফুটতর নামপ্রেমানলার্চিশ্চটাদগ্ধানাং কিল নাম কীর্তনকৃতাত্তাসাং স্পর্শেন সদ্যো মহাবৈকল্যং 
স ভজন কদাপি ন মুখে নামানি কর্তুং প্রভুঃ ।" 

অনুবাদ:– 'শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতকথা, কীর্তন করার সময় গোপীদের কারো নাম উচ্চারণ করতে সমর্থ হননি । তার কারণ গোপীদের নাম উচ্চারণ করলে তিনি ভাবাবেগে আত্মবিহ্বল হয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন । যার ফলে তিনি আর ভাগবতের কথা বলতে পারতেন না । ফলে মহারাজ পরীক্ষিতের ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ ব্যাহত হয়ে পড়ে । তাই শুকদেব গোস্বামী এখানে কৌশল অবলম্বন করেন । ভাগবতের রাসলীলা বর্ণনায় একজন ভাগ্যশালিনী গোপিনী প্রিয়তমা গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তরালে বিবিধ বিলাস করার বর্ণনা রয়েছে । আসলে অন্যতমা এই গোপিনী শ্রীকৃষ্ণের বক্ষবিলাসিনী শ্রীমতী রাধাঠাকুরানি । ভাগবতের 'অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরী' এই শ্লোকের 'অনয়ারাধিত'  শব্দে রাধা নাম আছে । টীকাকার শ্রীসনাতন গোস্বামী বলেছেন, 'আরাধিত' শব্দের মাধ্যমে এখানে রাধা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এই বাক্যের মাধ্যমে  শুকদেব গোস্বামী রাধাকে দর্শন করেছেন। 'রাধেতি  নামকরঞ্চ দর্শিতং ।' ব্যাসদেব রচিত হরিবংশেও 'যুবতী গোপ কন্যাশ্চ' শব্দের মাধ্যমে রাধিকাকে বোঝানো হয়েছে । ভাগবতের ন্যায় শ্রীমতি রাধিকা এখানেও লুক্কায়িত । কিন্তু যেখানে রাস আছে সেখানেই রাসেশ্বরী শ্রীমতি রাধাঠাকুরানি আছেন । ভগবানের শক্তির তিনটি ভাব আছে । একটি সদ্ভাব ( সন্ধিনী শক্তি ), দ্বিতীয় চিৎ ভাব ( সম্বিৎশক্তি ), তৃতীয়টি আনন্দ ভাব ( হ্লাদিনী শক্তি ) । এই হ্লাদিনী শক্তি ভগবানের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত স্বরূপ-আনন্দ শক্তি । ইনি নিত্য-বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীমতি রাধারানী ।

কবিরাজ কৃষ্ণ দাস গোস্বামী তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে রাধা নামের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন । তিনি তার গ্রন্থের মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে রায় রামানন্দ  সাক্ষাৎ করলে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণের বিবিধ বিলাসতত্ত্ব ও সাধ্যসাধন তত্ত্বকে তুলে ধরেন । সেখানে কান্তাপ্রেমের ব্যাখ্যায় বলেছেন কান্তভাব প্রেম সর্বসাধ্য সার অর্থাৎ পরম পুরুষ ভগবানের সঙ্গে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক স্থাপন হল ভক্তিপূর্ণ জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় একমাত্র গোপীগণ ও শ্রীমতি রাধারানী তা সম্ভব করে তোলেন । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন–
 
রাধা কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি । 
অন্যোন্যে বিলশে রস আস্বাদন করি ।। 
সেই দুই এক এবি চৈতন্য গোঁসাঞি 
ভাব-আস্বাদিতে দোঁহে হইল এক ঠাঁই ।

অর্থাৎ রাধা ও কৃষ্ণ এক আত্মা । রাধাকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি । 

হ্লাদিনী সার 'প্রেম' প্রেম সার 'ভাব' ।
 ভাবের পরমকাষ্ঠা নাম মহাভাব ।।
মহাভাব স্বরূপা শ্রীরাধা ঠাকুরানি ।
 সর্বগুণখনি কৃষ্ণ কান্তা শিরোমণি ।।

শক্তি ও শক্তিমানের অভেদের কারণে রাধা কৃষ্ণ স্বরূপত এক ও অভিন্ন । তবু লীলারস আস্বাদন করার জন্য ভিন্ন দেহ ধারণ করে লীলা-বিলাস করেছেন কিন্তু পুনরায় এই রস আস্বাদন করার জন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ শ্রীচৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন । কবি চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের মুখ্য কারণটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কিদৃশো বানয়ৈবা 
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুত মধুরিমা কিদৃশো বা মদীয় ।
 সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কী দৃশং বেতি লোভা
 তদ্ভাবাঢ়্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ ।

অর্থাৎ, শ্রীরাধার প্রেমমাহাত্ম্য কেমন এই প্রেমের দ্বারা রাধাকৃষ্ণ যে অদ্ভুত মাধুর্যরস আস্বাদন করেন, রাধা যে সুখ পান সেই সুখই বা কেমন, এই সমস্ত বিষয়ে জানার ইচ্ছার কারণেই রাধার ভাব গ্রহণ করে কৃষ্ণ শচীগর্ভে চৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন ।

বৃন্দাবনে গোপিগণের প্রেম ছিল কামগন্ধহীন । কবিরাজ গোস্বামী কাম ও প্রেমের বিভাজন করেছেন–

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা তারে বলি কাম ।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ।।

গোপীদের মধ্যে রাধারানি শ্রেষ্ঠ । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন– 
সেই গোপিগণ মধ্যে উত্তম রাধিকা ।
 রূপেগুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্বাধিকা ।।

বাংলার সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলি ও অন্যান্য বৈষ্ণবসাহিত্যের কেন্দ্রভূমিতেই রয়েছেন শ্রীরাধিকা ।

ভারতের সমস্ত মহান ভক্তিশাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে । যাঁরা রাধানাম অস্বীকার করেন তাঁরাই এই ধরনের প্রশ্ন তোলেন এবং শ্রীরাধার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশ করেন । যথাযথ গ্রন্থের নিবিড় অধ্যয়নের মাধ্যমে এই সংশয় দূর করা যাবে । ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে এমন বহু প্রশ্নই থেকে যায় বা রাখা যায় ।
সতেরো, তিন, দুহাজার পঁচিশ ।

Wednesday, December 13, 2023

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

টিংকুরঞ্জন দাস। ত্রিপুরার একজন সুপরিচিত কবি । প্রেমপ্রবণতা, নিসর্গচেতনার সঙ্গে সমাজভাবনা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে এক ভিন্নতর মাধুর্য দান করেছে । কবির অপর ভাবনার কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন 'ভিন্নপথের পথিক' ।  কবি তো পথিকই । জীবন ও সমাজ প্রকৃতির আলপথে বিচরণই তাঁর কাজ । এই পথের দুপাশে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় বৈচিত্র্য ফুটে উঠে, আর সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যায় । কবি বাস্তবজীবনে দায়িত্বপূর্ণপদ সামলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত । ফলে জীবনকে ভিন্ন রূপে দেখার সুযোগ রয়েছে তাঁর । রয়েছে দেখার চোখও—

স্কুলছুট কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিত ছেলে মেয়েদের ধরে আনতে 
বেরিয়ে পড়ি প্রায় সকালেই পাড়ার বাড়ি বাড়ি 
দুঃখ হলেও হাসিমুখে সব দোষ করি স্বীকার 
তবুও যেন ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে রেগুলার 
তারপরও শুনি পথে ঘাটে,
 ও, সে তো সাধারণ এক স্কুল টিচার
 কাজকর্ম ফেলে রেখে সারাদিন ঝাড়ে শুধু চক ডাস্টার ।'

চিরায়ত শিক্ষকমননজাত প্রেরণা থেকে জীবনের এক ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মুখ দেখবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর । তাঁর মধ্যে তাই রয়েছে এক তন্ময়তার ভাব। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, জীবনের কঠোর-কর্কশ, সুন্দর-অসুন্দর পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা । মানুষের কল্যাণবোধ ও মঙ্গলভাবনা তাঁর কাব্যের উপজীব্য । সমকালের রাজনীতির সঙ্গে তিনি পরিচিত । দেখছেন রাজনীতির অস্থিরতা, রাজনীতির বাণিজ্য । কিন্তু হৃদয়ের বাণীই তাঁর কাব্যের প্রধান শর্ত । সেখানেই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা—

তাই এবার আর মৌ নয়,
 এসো, একে অন্যের মুখে তুলে দেই এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন 
বিবস্ত্র মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিই সামান্য ভালোবাসার চিহ্ন 
একবার অন্তত বাঁচি 
সেই সব বিবস্ত্র অভুক্ত মানুষের জন্য ।

কবি টিংকুরঞ্জন দাসের কবিতার নিবিড় পাঠের মধ্যে যে কাব্যসূত্র সমূহ প্রকট হয়ে ওঠে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজালে পাই—

ক) কবির হৃদয়ের মধ্যে কল্পনাচারিতা রয়েছে । তবে সেই কল্পনা বাস্তববিচ্যুত নয় । তার মনের মধ্যে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার যে স্বচ্ছতা রয়েছে তা তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেন ।

খ) কবির হৃদয়ে যে চিন্তা বা চেতনার বিস্তার ঘটে তা শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার জগতে নয় । বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তার প্রকাশে বলিষ্ঠতা রয়েছে ।

গ) তাঁর কবিতার বাকভঙ্গিমা আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত না হলেও তাঁর কাব্যরচনার একটা নিজস্ব ক্ষমতা বা স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে ।

ঘ) বাস্তবক্ষেত্রে কবি বা সাহিত্যিকরা স্বাধীনচেতা হন । সে কারণেই নিজেকে কাব্যবেষ্টনীর মধ্যে না রেখে প্রকাশের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন এই কবি ।

কবি তাঁর কাব্যের উপাদান তাঁর পরিচিত নিসর্গ ও সমাজপারিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করেছেন । সেকারণেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয়নিঃসৃত ও স্বচ্ছ । তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না । ভাষা ও ভাবে কৃত্রিমতা থাকলে তা কখনোই প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা । পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতাময় এই সময়ে মানুষ, মানবতা ও সময়ের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত কবির হৃদয়ের ভাষা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় । পাঠকচিত্তকে  অবশ্যই এক অন্যতর ভুবনে নিয়ে যাবে এই কাব্যগ্রন্থটি ।
                        অশোকানন্দ রায়বর্ধন

   দার্জিলিং টিলা, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা
          ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ    ।                    

Sunday, August 6, 2023

সৈয়দ মুজতবা আলি

শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী । ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুজতবা আলির শেষ দেখা হয় । রবীন্দ্রনাথ সেদিন পরিহাস ছলে আলি সাহেবকে 'বরোদার মহারাজা' বলে সম্বোধন করেছিলেন । তিনি বিষন্নবদনে সেদিন বলেছিলেন, 'তোদের আমি গড়ে তুলেছি । এখন আমার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোদের প্রয়োজন । গোখলে, শুক্ল, তোরা সব এখন থেকে আমাকে সাহায্য করবি । কিন্তু তোদের আনবার সামর্থ্য আমার কোথায় ? মুজতবা আলি উত্তরে বলেছিলেন, 'বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আমি আসব । যা দেবেন হাত পেতে নেব । রবীন্দ্রনাথ তখন এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন, 'বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে?' মুস্তাফা আলি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, 'মহাপুরুষ তো আসবেন শঙ্খ,চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে । কাঁচি হাতে করে?' রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'হ্যাঁ,হ্যাঁ  । কাঁচি হাতে নিয়ে । সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পিছনের টিকিট কেটে দেবেন । হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন আলাদা থাকবে ?' সেদিন মুসলমান এক কৃতি ছাত্রকে গুরুদেব পরম স্নেহে এই কথাগুলো বলেছিলেন । সম্ভবত এই ছিল তাদের শেষ কথোপকথন । রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলির আদর্শ

Monday, October 10, 2022

ধ্বংসের মুখে ফেনী নদী

ধ্বংসের মুখে ফেনী

দক্ষিণের সীমান্তনদী ফেনীকে বাঁচাতে হলে একেবারে উজানের দিক থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে । ফেনীর উৎস থেকে আমলিঘাট পর্যন্ত দুপারে দুদেশের সীমা নির্দেশ করে । এই অংশটাতে এখন নাব‍্যতাই নেই । অথচ একসময় শিলাছড়ি-ঘোড়াকাপা, অযোধ‍্যা-দেওয়ানবাজার, সাব্রুম-রামগড়, রানিগঞ্জবাজার-বাগানবাজার, আমলিঘাট ইত‍্যাদি দুপারের গঞ্জ ও ব‍্যবসাকেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো নৌকা ভিড়ত । কিন্তু এখন আর নদীতে বর্ষাকালেও তেমন জল থাকে না । নৌকা চলাচল তো দুরস্ত । উভয়তীরেরই পাহাড়ে যথেচ্ছ মাটি কেটে নেওয়া, বৃক্ষছেদন ও বনধ্বংসের ফলে পাহাড় জলধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে । বছরের বেশির ভাগ সময় নদীতে জল থাকে না । নদীর বুকে চড়া পড়ে গেছে । এই সমস‍্যা নিরসনের ক্ষেত্রে দূই রাষ্ট্রের তরফ থেকে যৌথভাবে কর্মসূচি নিতে হবে । মুহুরী প্রকল্পের ফলে ভাটির দিক উন্নত হয়েছে সত‍্য কিন্তু উজানের মানুষের কাছে ফেনী নদীর মাছ কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে । অথচ ফেনীনদী একসময় রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউস, বাইলা, চিড়িং, চেলস, কাঁডা ইচা, ইলিশ ইত‍্যাদি নানারকম মাছের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল । হালদা নদীর মতো ফেনীনদীও ছিল নানা প্রজাতির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র । আজ সব ধ্বংস হয়ে গেছে । এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। নদীর দুইতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মনমুগ্ধকর । নাব‍্যতার উপযোগী করা গেলে এই নৌকাভ্রমণের মাধ‍্যমে পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটানো যেত । নৌপরিবহনের মাধ‍্যমে দুদেশের মধ‍্যে স্বল্পব‍্যয়ের বাণিজ‍্যসম্ভাবনাও সৃষ্টি করা যেত ।

Wednesday, August 24, 2022

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল পালক

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল সাদা পালক

সুমন পাটারি ত্রিপুরার সন্তান । আমার গর্বের দক্ষিণ জেলার । রাজ‍্যের জন‍্যে দিয়েছে গর্বের পুরস্কার । যুব সাহিত‍্য একাডেমি সম্মান - ২০২২  ।  তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাইখোরাতে একটি সাহিত‍্যানুষ্ঠানে । আমাকে বাইখোরা বাজার থেকে বাইকে তুলে সোজা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায় । তরুণ সৈনিকের মতো একহারা দৃপ্ত চেহারা । সুমনের কবিতায়ও সেইরকমের তীব্র ঋজুতার ছাপ । তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ভদ্র, নম্র ও চলাফেরায় একদম সাদাসিধে । কিন্ত জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অত‍্যন্ত সংবেদনশীল । একবার আমরা একসঙ্গে রাজ‍্যের বাইরেও গেছি । একদম কাছে থেকে দেখেছি সুমনকে । এই যাত্রাপথে সুমন আমাকে সন্তানসুলভ দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিল । আমার খাওয়া দাওয়া সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুতেই ওর লক্ষ‍্য ছিল । আমার কষ্ট হলেই সুমন তৎপর হয়ে উঠত আমার অসুবিধা দূর করার জন‍্য ।

 নিষ্পাপ শিশুর মতো সুমনকে নাগরিক জটিলতায় আচ্ছন্ন করেনি । সুমন একদিন সকালবেলায়  এসে আমাকে বলল তার সদ‍্য লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা । সে ময়দানের সামনের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল । তার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ এসে আব্দার যে, লোকটার টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছে । সুমন যদি কিছু টাকা দেয় তাহলে লোকটা বাড়ি যেতে পারবে । সুমন তাকে পঞ্চাশ টাকা দেয় । লোকটা তখনকার মতো চলে যায় । কিছুক্ষণ পরে সুমন লক্ষ করে লোকটা আবার এসে পাশের লোকটার কাছ থেকে একই কায়দায় টাকা চাইছে । শহুরে তঞ্চকতায় বেকুফ হয়ে যায় সুমন । সুমনের ভাষায় তার 'বাবার বয়সী' লোকটার আচরণে সে বিস্মিত । এতোটাই স্বচ্ছ সুমন ।

কর্ম বা ভাগ‍্য বিষয়টাকে বিশ্বাস না করলেও জীবনের উত্থান ও বিপর্যয়কে গতিমুখের নির্ণায়ক বলে মেনে নিতেই হয় । সুমনের বাবা সংসারের কর্তা । তাঁর পরিশ্রমের আয়ের উপরই চলছিল তার পড়াশুনা । ত্রিপুরা রাজ‍্যের ইকফাই ইউনিভার্সিটি থেকে বিসিএতে দুর্দান্ত ফল করে রাজ‍্যের বাইরে পড়তে যায় এমসিএ । কিন্তু বিধি যে সুমনের দিকে অলক্ষ‍্যে চেয়ে হাসছিল কে জানে ! বাইখোরা বাজারে সুমনের বাবার  ধান চালের ব‍্যবসা । হঠাৎ একদিন স্তুপ করে রাখা বস্তার সারি থেকে একটা এক কুইন্টাল ওজনের ধানের বস্তা পেছন থেকে ছিটকে পড়ে গদিতে বসে থাকা সুমনের বাবার পিঠে । ঘাড়ে ও মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর । উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা ছেড়ে সুমনকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে । বাবার চিকিৎসা ও সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে সুমনের কাঁধেই । বাবার চিকিৎসার জন‍্যে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করেও বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি আর । এরপর নানারকম ছুটকো পেশা, প্রাইভেট পড়ানো ইত‍্যাদি করে চলতে থাকে সুমনের জীবনযুদ্ধ । বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের পাঠ নিতে থাকে সুমন । সেইসঙ্গে কবিতাযাপনও সমানে চলে । সেকারণেই সুমনের কবিতাও প্রাত‍্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার স্পষ্টতায় উজ্জ্বল । আমি সুমন পাটারির প্রথম কাব‍্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করার ও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন । একদম জোরালো কব্জিতে তোলা ভাষাই সুমনের কবিতা ।

 কার্যকারণে অনেকদিন দেখা হয়না । কিছুদিন আগে সেলিমদা ধর্মনগর থেকে 'পাখি সব করে রব'-র বিশেষ সংখ‍্যা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে । দক্ষিণ ত্রিপূরার কয়েকজন কবির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন‍্যে । সুমনের কপিও ছিল । কিন্তু আমি যেদিন বাইখোরা যাই সেদিন ও বিশেষ কাজে ব‍্যস্ত থাকায় আর দেখা হয়নি । ওর কপিটা কবি তারাপ্রসাদ বনিকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম ।

নোয়াখালি অ্যাকসেন্ট থাকে সুমনের কথাবার্তায় । মনে হবে আনস্মার্ট এক গ্রাম‍্য যুবক । সুমনের ইংরেজি উচ্চারণ ও অনর্গল কনভার্সেশন শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন । বাহ‍্যিক দর্শনে রাজ‍্যের মেধাবী ও গুণী এই তরুণকে চিনতে অনেকেই ভুল করবেন । সুমন যদি তার উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারত তবে আজ সে একজন নামজাদা আইটিয়ান হতে পারত । অথবা বড়ো কোনো মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন থাকত ।

যাই হোক, লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতরের রজতকাঞ্চনের ভান্ডার হাতে না এলেও সরস্বতীর বীণাতন্ত্রীতে ঝংকার তুলে তার শব্দকথা  বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, আমার সন্তানপ্রতিম রাজ‍্যের গর্ব সুমন পাটারি । তোমাকে স্নেহ ও আদর হে কবি !

অশোকানন্দ
২৫. ৮. ২০২২.

Sunday, July 31, 2022

মায়াতাঁতের অসমাপ্ত বয়নশিল্পী

মায়াতাঁতের অসমাপ্ত বয়নশিল্পী

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

'আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোকসভা না হয় প্রদীপ,
 অবনমিত মেধার শহর ছেড়ে অভিমানে কেউ কেউ 
রাতারাতি চলে গেছে কুয়াশাবৃত শীতের পাহাড়ি স্টেশনে। ( ইচ্ছাপত্র–প্রবুদ্ধসুন্দর কর )

 না, প্রবুদ্ধ কোন কৃষ্ণপথ রেখে যান নি শোক প্রস্তাবের জন্য । পার্থিবপ্রস্থানের আগে ছিল তাঁর ছিল আশাময় পুলওভার । হাসপাতালের  বিছানায় শুয়ে অনুভব করেন, 'আরোগ‍্যের পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তাটুকু বেহেশ্ ত । নিজেকে যিনি তাঁরই দেহসচিব বলে আমৃত্যু ঘোষণা দিয়ে গেছেন তিনি তাঁর চিকিৎসাশয্যায় স্বনাম নিয়ে করছেন রসিকতা । লিখেছেন– 'আমি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নই । আমি গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ৬৫২ এ । প্রচন্ড নৈসর্গিক বিশ্বাস রেখেছেন তার শল‍্যচিকিৎসকের উপর যার ছুরি জাদুবিভায় মৃত্যু কেটে ফালা ফালা করে জীবন ছিনিয়ে আনবে । জন্মছকের বিশ্লেষণের প্রতিও তাঁর একসাগর আস্থা জীবনের উপরেই তো আলো ফেলে হে কবি ! পার্থিব পরিমণ্ডল আর এই আলো হাওয়ার বাউন্ডুলে পরিক্রমণের আর্তিই প্রতীক হয়ে আসে বারংবার । কিন্তু যে আত্মশবরক্ষক, সেই বুঝতে পারে এক রিক্ততার আলোকবর্ষের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তাকে মহাজগতের চক্রবালের আলোপ্রান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে । ক্রমশ সরে যাচ্ছে প্রিয়জনের যৌথস্বর,  কবিতার কোলাহল । সামনে শুধু নীল উপত্যকা । পায়ে পায়ে উড়ছে ডার্করুম মঘানক্ষত্র, ইন্দ্রজাল কমিকস, মায়াতাঁত, নৈশশিস, আত্মবিষ, যক্ষের প্রতিভূমিকা, অসুস্থ শহর থেকে,এসিড বাল্ব আর স্বনির্বাচিত কবিতার পাতা ।

কফি হাউসের সেই আড্ডা থেকে উঠে আসা 'রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর'ই জানান দিয়েছে শিরোনামে যাকে ধরেছ সেই শিরোপা ধারণ করবে আগত কবিতাকনভোকেশনে । 'বাংলাকবিতা' যার জন্মদানের জন্য উন্মুখ হয়েছিল বহুকাল । তীক্ষ্ণ শ্লেষ আর আত্মকশা, সুতীব্র নাগরিক বয়ান যার, তার সমূহ উচ্চারণ অমোঘ হয়ে ওঠে বাংলাকবিতায় । প্রবুদ্ধসুন্দরকে নিয়ে বারবার আত্মরতিতে মাতেন কবি প্রবুদ্ধসুন্দর । 

পিতৃসত্বা তাঁর জীবনজিন ।তিনি বলেন, ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার / শুনেছি বাবার দৌড় এটুকুই ছিল । / আমি ঢাকা অব্দি গেছি । / বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরন / এ জীবনে আর কিছু নেই । ( উদাহরণ ) । ছিন্নমূল বাবার জীবনসংগ্রামকে দেখেছেন অন্তর দিয়ে । 'উনিশ শো একান্ন সালে যে গাছটি/ আখাউড়া স্টেশন পেরিয়ে প‍্যারীবাবুর বাগানের / সামনের রাস্তা ধ‍রে হেঁটে এসেছিল / সেই গাছটি আমার বাবা । / আজও মূলত্রাণ উল্টে ধরলে দেখা যায় / বাবা পায়ের পাতায় ম‍রা রক্ত জমে / কেমন কালচে হয়ে আছে । আর যে আশ্রয়ভূখন্ডে বাবার স্থিতিবাসনা তাকে নিয়েই গর্বে তিনি উচ্চারণ করেন 'দূরদর্শনের টাওয়ারটি আমাদের আইফেল / বটতলা শ্মশানটি আমাদের মহানিমতলা / পাশে বয়ে যাওয়া নদী সেই গ্রিক পুরাণের লিথি / ধলেশ্বরে্য মিশনই আমাদের বেলূড়ের মঠ / জম্পুই হিলসই আমাদের ছোটো ভূস্বর্গ কাশ্মীর / সর্বোচ্চ বেতলিংসিব আমাদের শৃঙ্গ এভারেস্ট' ( শ্লাঘা ) । এক মর্মসচেতন রসানুভূতি রেখেই কবি অনায়াসে বলে যান– 'যে পা গুলো একদিন প্রণামের যোগ্য মনে হয়েছিল/সেগুলো শয়তানের খুর হয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে  ( জ্যোতিষবচন ) । সৃজনের পরও যেন তৃপ্ত নন কবি । এজন্মের অসম্পূর্ণ প্রণয়ের সংক্ষোভে বলেন, 'পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু হয় / সমুদ্রমন্থন শেষে রাহুর কবন্ধ আমি / অমরত্ব নয়, চাই, চাঁদের প্রণয় ( পরজন্ম ) । চন্দ্রলুব্ধ কাঙ্খায় ভরে আছে কবির পরজন্মের স্বপ্ন । স্বপ্ন নিয়েই অন্তরার পথে এগোতে এগোতে কবি জীবনের কাছে আহ্বান জানান–'শুধু এগিয়ে দেয়ার পথে নিচু স্বরে বোলো / দরজা ভেজানো থাকবে / টোকা দেওয়ার দরকার নেই / আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে ( দরজা ) ।
 জীবন ও অতিজীবনের মাঝখানে কবিতার তাঁবুতে যাপন আপনার । অবাধ বিচরণ না হলে এই গোষ্ঠের কী অনুপুঙ্খ বর্ণনাসফল  হয় হে 'নীল উপত‍্যকার রাখাল' ! আপনিই পেরেছেন মায়াবি পরিভ্রমণের ধারাভাষ‍্যে তুলে দিতে 'সন্ধ‍্যার সেই শান্ত উপহার' । আপনার পর্যবেক্ষণে ও বাচনবিভঙ্গে সমগ্র কাব‍্যজগৎ রক্তেপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে জোছনার আলোছায়া গড়ে । সীমান্তবর্তী এই পার্বতীভূগোলের কবিতায় এক অত‍্যুজ্জ্বল বাঁক আপনি যা কালের মানচিত্রে চিহ্নিত হয়ে গেছে । অমরত্বের পথিক কবি আপনি তবু বলেন–
আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোক সভা না হয়, পল্লব 
আমি চাই না,পাপেট ও বামন, শিরদাঁড়াহীন সুশীলেরা সভায় বলুক এসে মূলস্রোতে নয়,আত্মহননের পথ
 বেছে নিয়েছিল প্রবুদ্ধসুন্দর ( ইচ্ছাপত্র ) ।

 তাইতো কবি, আপনার অনির্দেশ যাত্রার পথে আমরা থামাবো না আপনার অনন্তরথ । কোন শোকসভাও নয় । শুধু আপনার শব্দের বিছানার এক প্রান্তে রেখে যাব এক স্বয়ংক্রিয় নির্দেশশলাকা । যার সংকেতে 'সন্ধ‍্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে উঠে একটি নক্ষত্র / বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ / কোনও একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে /  বোঝা যাবে সেই নক্ষত্রের আলো /  পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে সামান্য আগে ( আলো ) ।

Thursday, October 21, 2021

দুর্গাপুজো

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক  ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে  অম্ভৃণ ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাচ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেনমল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷

Sunday, July 4, 2021

ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন উৎসব—2018

ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব- 2018  : একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনসমুহের চলমান সংকট ও সমস্যার পর্যালোচনা করার জন্যে, নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে একটা প্ল্যাটফরমের প্রয়োজন অনুভব হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে ৷  সেই লক্ষে প্রাথমিকভাবে বার্তা ছড়ানোর জন্যে গঠন করা হয় ছোটো একটা অস্থায়ী কমিটি ৷ এই কমিটি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোটোখাটো সভা করার মধ্য দিয়ে একটা উৎসব করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ৷ ভিতরে একটা বেদনাও ছিল ৷ উত্তর-পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের তিনসুকিয়ার অনুষ্ঠানে আগরতলায় পরবর্তী সম্মেলন করার সিদ্ধান্তে স্বীকৃতি দানের পর ত্রিপুরায় এসে পরবর্তী একবছরেও সেই অনুষ্ঠান করা যায়নি উদ্যোগের অভাবে, পরনির্ভরতায় ও অকারণে ৷ আসলে যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা উত্তর পূর্বাঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিনের মেজাজটাই ধরতে পারেননি ৷লিটল ম্যাগাজিনের সৈনিক যে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে লড়াই করেনা তা তাঁরা অনুমানই করতে পারেননি ৷ সমালোচনা হলেও বলতে হচ্ছে, দাদা কখন কাঁধ পেতে দেবেন সেই আশায় অপেক্ষা করতে করতে  সুবর্ণ সময়টা হারিয়ে গেল ৷ সেই বেদনায়ও এই উৎসব করার তাগিদ বোধহয় রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের ৷ সিদ্ধান্ত হয় উৎসব করার ৷  চারিদিকে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের কাছে ৷ সোস্যাল মিডিয়ায়ও পোস্ট দিলেন গোবিন্দ ধর, সঞ্জীব দে, গোপাল দাস, অপাংশু দেবনাথ প্রমুখ কবি ও সম্পাদকবৃন্দ ৷ কিন্তু তেমন বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি ৷ একটা নীরব শীতলতা লক্ষ করা যায় ৷ ফলে উৎসবের প্রচেষ্টা সংকটের মুখে এসে দাঁড়ায় ৷ আর্থিক সাশ্রয় এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজনে কুমারঘাটকেই বেছে নেওয়া হয় সম্মেলনের স্থান হিসেবে ৷ দায়িত্ব বর্তায়  রাজ্যের শক্তিমান সাহিত্যসংগঠক , কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধরের উপর ৷ স্রোত প্রকাশনার কর্ণধার গোবিন্দ ধরের এই ধরণের বড়ো অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ সহযোগী আছেন কবি ও সম্পাদক গোপাল দাস ৷ আর আছেন মাথার উপর ছাতা ধরে রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি ও  সপ্তপর্ণা সাহিত্যপত্রের সম্পাদক নিয়তি রায়বর্মন,  কবি ও পূর্বমেঘ সম্পাদক রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কবি দিলীপ দাস , কবি ও জলজ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক সন্তোষ রায়, উত্তরপূর্বের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক দেবব্রত দেব, কবি ও গল্পকার রণজিৎ রায় প্রমুখ ৷ এনারা যদি স্নেহের পরশ রাখেন তাহলে রাজ্যের যে কোনো প্রান্তেই সাহিত্য সংস্কৃতিতে ঝড় বইয়ে দেওয়া যায় ৷ তাঁরা প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহচর্য দিয়ে গেছেন ৷কাজেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিদীপ্ত নীরবতা লক্ষ করা গেলেও কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি ৷ গত দোসরা সেপ্টেম্বর বিশেষ আলোচনসভা ডাকা হল ৷ দেশের ও দেশের বাইরের অতিথিদের আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল ৷  আরো দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ৷ সাবেক সমগ্র উত্তর ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ৷ গোবিন্দ ধরের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই সাহিত্য-সংস্কৃতির মহীরুহের এক একটি ডালপালা ৷ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন সপরিবারে গোপাল দাস এবং রণজিৎ চক্রবর্তী ৷ সবাই মিলে তাঁরা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন ৷ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বাংলাদেশের অগ্রণী কথাসাহিত্যিকেরও দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি ৷ 
তেইশ সেপ্টেম্বর কুমারঘাটে হয়ে গেল 'ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব—2018 এতদিনের কী হয়! কী হয় উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে সেদিন ৷ কুমারঘাটের 'মাঙ্গলিক'এ আছড়ে পড়ে ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ঢেউ ৷ কবিরা সাহিত্যসেবীরা মঙ্লচিন্তাই তো করেন ৷ জগতের মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল, যাপনে মঙ্গল ৷ তাই এদিন মাঙ্গলিকে মিশেছিল সমস্ত শুভচেতনারা ৷ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, কোনো দাদার শ্রীপাদুকা ছাড়া, কোনো রাজপুরুষের কাঠিছোঁয়া ছাড়া শুধুমাত্র সংহতিচেতনার অবগাহনে এতোবড়ো একটা অনুষ্ঠান করা যায় তা এদিন দেখা গেল কুমারঘাটে ৷আর্থিক দৈন্যে হয়তো সম্মানিত অতিথিদের যথাযোগ্য মর্যাদায় আপ্যায়ণ করা যায়নি কিন্তু আন্তরিকতায় খাদ ছিলনা ৷ গোবিন্দ ধর, গোপাল দাস, রণজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁদের গৃহকে রীতিমতো অতিথিশালা বানিয়ে ফেলেন ৷
সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আসেন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, কবি জয়দুল হোসেন, প্রাবন্ধিক মানবর্ধন পাল ও কবি দেবব্রত সেন ৷ 
কথায়, কবিতায়, গানে, আলোচনায় টানটান ছিল অনুষ্ঠান ৷ লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে বিজ্ঞাপন নীতি নিয়ে দাবি ওঠে উৎসবে ৷ একশো জনেরও অধিক কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এই উৎসবে যোগ দেন ৷ ত্রিশটিরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উত্তরবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের কুড়িটির বেশি এক ফর্মার কবিতাসংকলন প্রকাশিত হয় ৷ 
 অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে কবি হারাধন বৈরাগি ও ছড়াকার অমলকান্তি চন্দ জানালেন আগামী উৎসব জম্পুই পাহাড়ের পাদদেশে কাঞ্চনপুরে অনুষ্ঠিত হতে হবে ৷
     এতোবড়ো সাফল্যের পরেও কথা থেকে যায় লিটল ম্যাগাজিনের পরিচয়জনিত যে দুর্বলতা,   ছোটো করে রাখার যে প্রবণতা  তাকে কাটিয়ে উঠতে হলে তাহলে আরো বেশি সাংগঠনিক শক্ত দরকার ৷ আরো বেশি নিবিড় হওয়া দরকার পারস্পরিক সম্পর্ক ৷ এই বার্তাই দেন উদ্বোধক কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস ৷

Monday, May 17, 2021

এই কথাটি মনে রেখো রবীন্দ্রসংগীতের রচনাকাল

খুব ভালো লাগল তথ‍্যসমৃদ্ধ এই লেখাটি পড়ে । আমি এখানে বিনীতভাবে কিঞ্চিৎ সংযোজন করতে চাইছি ।১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন । 'এবং জগন্নাথ হলের বার্ষিকী বাসন্তিকার জন‍্যে তাঁর 'এই কথাটি মনে রেখো' ( পরে গান হিসাবে যা জনপ্রিয় হয় ) কবিতাটি লিখে দেন ।' এই গানটির ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায় যে, রাগ-খাম্বাজ, তাল-দাদরার এই গানটির রচনাকাল-১৩২৮ বঙ্গাব্দ/১৯২১ খ্রিস্টাব্দ । এর রচনাকাস্থান- শান্তিনিকেতন ।স্বরলিপিকার ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মানে রবীন্দ্রনাথ গানটি ঢাকায় এসে রচনা করেননি । এটি পূর্বে রচিত । এদিন অনুষ্ঠানের জন‍্যে কপি করে দিয়েছিলেন । ভালো থাকবেন স‍্যর ।

Monday, July 22, 2019

'চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে' গানটির ব‍্যাখ‍্যা

এই গানে গল্পের ছলে সংখ্যা ব্যবহার করে বাউলতত্ত্বের বেশ কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে ৷ জীবাত্মা-পরমাত্মার অভেদতত্ত্বের উল্লেখসহ ৷ প্রথম পংক্তি 'চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে কী'র সাধারণ মানে শ্যামচাঁদ আর রাইচাঁদের যুগলমিলন হয়েছে ৷ এই যুগনদ্ধ রূপ দেখে অধীন ভক্ত বিস্ময়াকুল হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারেন ৷ বাকি বুঝ জন যে জান সন্ধান ৷ মুখোমুখি আলোচনা ছাড়া সবটা ব্যাখ্যা সম্ভব নয় ৷
এ এক অপূর্ব মানবদর্শন—আত্মদর্শনের এমন দুর্বোধ্যতম গান অন্তত বাংলাসাহিত্যে নেই। আমার যা মনে হয় :
চাঁদ : চাঁদ যৌবন। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা—রজরূপ চাঁদ উদিত হ‌ওয়া।
ছয় মাসের কন্যা : আত্মতত্ত্বের ৬ রিপু।
ঝি : জীবনের স্থূল আকার।
তিন সন্তান : দেহতত্ত্বের তিন ধারা।
নয় মাসের গর্ভবতী : মানবদেহের ৯টি দ্বার।
এগারো মাস : এগারো রুদ্র (দেহের ১১টি দ্বার !)
মাকে ছুঁলে ছেলে মরে : শিশ্ন ছেলে, শুক্রপাত মরণ।
ঘর : মাতৃজঠর।
আমার মনে হয় বাউল আধ্মাতিকতা অতি মাত্রায় সাংখ্য দর্শনের পূরুষ ও প্রকৃতি তত্বের ওপর ভিত্তি করে উঠেছে।পুরুষ এবং প্রকৃতি যখন নিজেদের আত্মদহন করে প্রেমের মাধ্যমে স্বরূপ বোধে স্থিতি লাভ করে রস অর্থাৎ আনন্দের সৃষ্টি করে তখন পরোক্ষানুভূতি সম্পন্ন সাধারন যোগীর মনের বেদনার প্রকাশক এই গান ।