Friday, August 12, 2022

আজ আবার নতুন করে....

আজ আবার নতুন করে....

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আজ সারাদিন উৎকন্ঠায় ছিলাম । কি জানি কি হয় । ১০৩২৩ শিক্ষকরা আজ বিদ্যালয়ে গেছেন । এ ব্যাপারে তারা আগেই ঘোষণা দিয়েছেন । যেহেতু এই বঞ্চিত শিক্ষকগোষ্ঠীর উপর নানাভাবে দীর্ঘদিন যাবত আক্রমণ চলে আসছিল, আজ না জানি কি ঘটে । কিন্তু না সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে আজ শিক্ষক-শিক্ষিকারা পূর্বতন বিদ্যালয়ে গেছেন পুনরায় যোগদানের জন্য । যতটুকু জানা গেছে, দু একটা জায়গায় অতি উৎসাহী ও উটকো উজবুকদের আক্রমণ আর অতি চালাক কিছু প্রধান শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি ছাড়া এইসব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কোথাও খুব একটা বাধা পেতে হয়নি । 

মধ্যাহ্নের আকাশে নেমে আসা কালো মেঘ তুমুল বর্ষণের পর যখন সরে যায়, তখন চারদিক অনেক বেশি উজ্জ্বল হতে দেখা যায় । দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলন করেও যখন দপ্তর বা মন্ত্রিসভাকে টলানো যাচ্ছিল না কিছুতেই, সেই সময়ে খড়কুটো ধরে অথৈ সমুদ্রে বেঁচে থাকার শেষ আশায় শিক্ষক মহাশয়দের তথ্য জানার অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট যে উত্তর দিয়েছেন তা জগদ্দল পাথর টাকে মনে হয় কিছুটা নাড়া দিতে পেরেছে । শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পুনরায় কাজে যোগদানের ব্যাপারটায় তাদের ভূমিকা অনেকটা নমনীয় মনে হয়েছে আজ । যারা কাজে যোগ দিয়েছেন, সবাইকে যথাযথ মর্যাদায় সুযোগ করে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধানগণ। এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী অতি দ্রুত তার রিপোর্ট দপ্তরের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন । 

দীর্ঘদিন পরে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বিদ‍্যালয়ে বিদ্যালয়ে কাজে যোগদান করার জন্য আজ মার্জিত ও বর্ণাঢ্য পোশাক পরে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন । দেখামাত্র শিক্ষার্থীরা দৌড়ে চলে এসেছে তাদের প্রিয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে । সর্বত্রই সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চিরন্তন আবেগঘন পরিবেশ ।

 ভুক্তভোগী ছাড়া জানবে না এই কবছরে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার হাল কি হয়েছে । তার উপর গেছে কোভিড মহামারী । অভিভাবকরা শিক্ষার্থী সন্তানদের মানুষ করার জন্য কত টাকা ব্যয় করেছেন প্রাইভেট পড়ানোর জন্য । বিষয় শিক্ষকের অভাবে ও শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সন্তানকে নিয়ে ঘুরেছেন এই স্কুল থেকে সেই স্কুল । আর এই ডামাডোলে এবং করোনাকালীন সময়ে দেদার পাশের ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো জায়গায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগও হারিয়েছে । পাশ করা শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না । 'করোনা পাশ' বলে তাদের দেগে দেওয়া হচ্ছে ।

 যাইহোক, এর মধ্যেই আজ ১০৩২৩ শিক্ষক শিক্ষিকাদের স্কুল চত্বরে দেখে শিক্ষার্থীরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে । শিক্ষক সংকটে রাজ্যের শিক্ষার্থীদের যে কি ক্ষতি হয়েছে তা শিক্ষার্থীরা ছাড়া আর কে বেশি বুঝবে ?  'বুঝিবে সে কিসে / কভু আশীবিষে / দংশেনি যারে' ? দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে জুরি-মনু-ধলাই-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনীর স্রোতধারার সঙ্গে । অনেক যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাণ চলে গেছে অনন্তের পাঠশালায় । আর দেরি নয় । দপ্তরের শুভ বোধ জাগুক । মন্ত্রিসভা সজাগ হোন । পড়ে দেখুন এইসব 'হাতে মসি, মুখে মসি, মেঘে ঢাকা শিশুশশীদের চোখ মুখের ভাষা । আর রাজনীতি নয় । এবার চাই সহানুভূতি ।

 'আজ আবার নতুন করে / ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না / হারানো স্বপন চোখে এঁকো না' । ১০৩২৩ নামে তাঁরা যেন আর চিহ্নিত না হন । তাঁদের দুঃস্বপ্নের রাতগুলো যেন আর ফিরে না আসে । তাঁরা যেন আবার মূলস্রোতে মিশে যেতে পারেন । 'আমাদের গেছে যে দিন / একেবারেই কি গেছে / কিছুই কি নেই বাকি' ।  না । না । আছে । 'রাতের সব তারাই আছে / দিনের আলোর গভীরে' । আসুন সবাই মিলে রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে দিনের আলো খুঁজে বেড়াই । শুভস‍্য শীঘ্রম ।

১২.০৮.২০২২.

Wednesday, August 10, 2022

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা । এই ঘটনা একদিকে যেমন আনন্দের । অন্যদিকে অত্যন্ত বেদনার । আনন্দের হল এই যে ১৯ ৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তিলাভ করে । প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজকে ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে হয় । তারা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । ঘোষণা করতে হয় স্বাধীন রাষ্ট্রের । কিন্তু ইংরেজরা তাদের কূটকৌশল ব্যবহার করে দেশটাকে ভাগ করে দিয়ে যায় । শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশটি ভারত ও পাকিস্তান দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

 ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন । কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বঙ্গ ও অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে দুটি নির্ধারণ কমিশন গঠন করেন । উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্যার শেরিল রেডক্লিফ । ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা তার নাম অনুসারে 'রেডক্লিফ লাইন' নামে পরিচিত । তাঁর সৃষ্ট বিভাজন অনুযায়ী সিন্ধু, বেলুচিস্থান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় । ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারত স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে । ভারতের আকাশে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ে । আর বেদনাজনক ঘটনাটি হল, এই দেশভাগকে কেন্দ্র করে তার কিছু আগেও পরে দেশব্যাপী ব‍্যাপক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অত্যাচারে সেখানকার হিন্দু শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয় ও ছিন্নমূল হয়ে দলে দলে ভারতের অন্তর্গত পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্ত হয়ে আশ্রয় নেয় । অন্যদিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখদের অত্যাচারে দলে দলে মুসলমান পশ্চিম পাঞ্জাবে আশ্রয় গ্রহণ করে । অন্যদিকে দেশের পূর্বাঞ্চল বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা  দিতেই সেখানে ব্যাপক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । 

১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংগঠিত হয় ভয়ংকর দাঙ্গা । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে 1946 সালের 29 শে জুলাই বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের অধিবেশনে যেভাবে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে-,"The Muslim Nation to resort to Direct Action to achieve Pakistan and the consequent fixing of August 16th as Direct Day." { Letter of Sir F. Burrows ( bengal ) to Field Marshal Viscount Wavell, Calcutta, 22 August,1946, Letter No. 197 T. P. Vol-VIII } মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শুক্রবারে সারা ভারতবর্ষে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয় । তার প্রস্তুতি হিসেবে প্ররোচনামূলক লক্ষাধিক পুস্তিকা বিতরণ করা হয় । এই ঘোষণার পর থেকেই  দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল । দেশভাগকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল 1946 সালের "The great Calcutta killing" । উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য এবং মুসলমানদের নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবিতে তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ১৬ আগস্ট কে Direct Action Day হিসেবে নির্ধারণ করে  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, "What we have done today ( the day when League Council passed the Direct Action resolution ) is the most heroic act in our history. Never have we...none anything except ...By constitutional methods." ( The Dawn, 30 August 1946 ) ১৬ আগস্ট তারিখ সকাল থেকে কলকাতার বুকে নেমে আসে এক বিভীষিকার কালো রাত । মানিকতলা, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মৌলালী, শোভাবাজার, মেছুয়াবাজার, ট‍্যাংরা, টালিগঞ্জ, টেরেটিবাজার, বেলগাছিয়া এবং অন্যান্য হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়ে যায় । এই সময় তোলা বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, এই দিন ময়দানে মুসলিম লীগের সভায় উপস্থিত জনতা লাঠি তরবারি ছুরি ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয় । এই সভায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেয় এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আহ্বান করে মিছিলফেরত উত্তেজিত জনতা হিন্দু দোকানগুলিতে লুটপাট ও নির্বিচারে হিন্দু নিধন ও নারীর ধর্ষণ চালাতে থাকে । মুখ‍্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন । এর প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে । যদিও ১৭ আগস্ট শান্তি রক্ষার্থে সব দলের নেতাদের সম্মিলিত আবেদন প্রচারিত হয়:–

ভাইসব,

 ভাই ভাইয়ের মধ্যে এই যুদ্ধ অবিলম্বে থামাইবার জন্য আমরা আপনাদের নিকট আবেদন জানাইতেছি । যাহা ঘটিয়াছে তাহা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক । আসুন এই কাহিনী আমরা ভুলে যাই । কে দোষি আর কে নির্দোষ সেই তর্ক করিতে থাকিলে আরও জীবন ও ধনসম্পত্তি নষ্ট হইবে । যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে এখানেই তাহার শেষ হউক । এই মারামারি এখন যেমন করিয়াই হউক বন্ধ করিতেই হইবে ।

 প্রত্যেক ভাইকে আমাদের অনুরোধ, আপনারা আমাদের পরামর্শ শুনুন । ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে । লাঠি বা অস্ত্র লইয়া চলাফেরা করিলে জীবন বিপন্ন বা গ্রেফতার হইবার আশঙ্কা ।

 আপনারা যে যাহার মহল্লায় থাকুন, অপরের মহল্লায় বা পাড়ায় অনধিকার প্রবেশ করিবেন না । সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি লইয়া মহল্লা শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করুন এবং সম্মিলিতভাবে শান্তি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করুন ।

নিবেদক―স্বাক্ষর 

শরৎচন্দ্র বসু,  এইচ এম সোহরাবর্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, দেবীপ্রসাদ খৈতান, কিরণ শঙ্কর রায়, ভূপেশ গুপ্ত, মোহম্মদ আকরাম খাঁ, নিহারেন্দু দত্ত মজুমদার মোহর সিং জ্ঞানী, পাঁচুগোপাল ভাদুড়ী, সামসুদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসিম, ভবানী সেন, খাজা নুরুদ্দিন, হামিদুল হক চৌধুরী
( কলিকাতা ১৭ই আগস্ট ১৯৪৬ ) ( অমলেন্দু সেনগুপ্ত―উত্তাল চল্লিশ : অসমাপ্ত বিপ্লব, পাল পাবলিশার্স, ১৯৯১, কলকাতা, পৃষ্ঠা–১৪৭ ) । ১৮ তারিখ হিন্দুরা মুসলমান অঞ্চল গুলিতে ভয়াবহ আক্রমণ চালায় । ১৮ আগস্ট সকালে বাস ও ট্যাক্সি ভর্তি হিন্দু ও শিখ তরোয়াল, লোহার রড, এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহযোগে প্রতিরোধ আক্রমণ শুরু করে । মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরের চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় । প্রায় এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন । এদিকে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রায় এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল । 

কোলকাতা দাঙ্গার ঠিক সাত সপ্তাহ পরে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় একই রকম ভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মূলত কলকাতার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা জেলায় ছোট বড় দাঙ্গা ঘটে গেলেও ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বকোণে নোয়াখালী ত্রিপুরা কুমিল্লা ও সন্দীপ এলাকায় একতরফা হিন্দু নিধন ও উৎপাদন শুরু হয় । এবং প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় স্থানীয় মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুদের উপর সংগঠিত হয় গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট, হিন্দু মন্দির ধ্বংস বা অপবিত্র করা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা । লিগ সরকার প্রায় এক সপ্তাহ এ খবর প্রকাশ করতে দেননি । এই দাঙ্গায়  কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার হিন্দু হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয় । তাছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দু নারীপুরুষকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় । ব‍্যাপক বাস্তুত‍্যাগেরও ঘটনা ঘটে । এই সময় উপদ্রুত এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৭৫ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্ত্রীপুরুষ শিশুসহ কুমিল্লা চাঁদপুর আগরতলা ইত্যাদি স্থানের ত্রাণ কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শেষ দিকে মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী সফর ও গ্রামে গ্রামে পরিদর্শন হয়তো হিন্দুদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । ফলে উত্তরোত্তর সন্ত্রাসের তাড়নায় আবারো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন । এই দুই নারকীয় ঘটনাই ভারত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে ‌। কবি জীবনানন্দ দাশের ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় রাজনীতির আড়ালে সৃষ্ট এই ধর্মীয় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে–


মানুষ মেরেছি আমি তার রক্তে আমার শরীর / ভরে গেছে পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার / ভাই আমি আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু / হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর / কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে / বধ করে ঘুমাতেছি ..../ যদি ডাকি রক্তের নদী থেকে কল্লোলিত হয়ে / বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি, / হানিফ মোহাম্মদ মকবুল করিম আজিজ / আর তুমি আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে / চোখ তুলে শুধাবে সে, রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে / বলে যাবে গগন বিপিন শশী পাথুরেঘাটার ; / মানিকতলার শ্যামবাজারের গ্যালারি স্ট্রিটের এন্টালির । (১৯৪৬-৪৭ জীবনানন্দ দাশ )

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয় । কলকাতার গণহত্যা ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পর ৩০ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বরের মধ্যে ঘটা এই দাঙ্গার ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে । ২৫ থেকে ২৮ অক্টোবর এর মধ্যে ছাপরা ও সরণ জেলায় মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে । অতি দ্রুত পাটনা মুঙ্গের এবং ভাগলপুর মারাত্মক সহিংসতার জায়গায় পরিণত হয় । ১৯৪৬ এর শেষ দিকে এবং ১৯৪৭ এর গোড়ার দিকে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রদেশেও দাঙ্গা হয়েছিল । দাঙ্গা যেমন দুই বাংলাতেই সংঘটিত হয়েছে তেমনি প্রতিরোধও হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রয়াসে । কোলকাতায় যেমন বহু হিন্দু বাঙালিরা আতংকিত মুসলমানদের লুকিয়ে রেখেছেন, ঠাঁই দিয়েছেন নিজেদের ঘরে তেমনি পুববাংলায়ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানগণ এগিয়ে এসেছিলেন হিন্দুদের জীবন ও ধনসম্পদ রক্ষায় ।  রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন হিন্দু অধ‍্যুষিত পাড়াগুলোতে । অপারগ হয়ে উঠলে গোপনে এগিয়ে দিয়ে এসেছেন সীমান্ত পর্যন্ত । হিংসার বহ্ন‍্যুৎসবের মধ‍্যেও স্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিন মানবিকতা ।

এই দাঙ্গার ফলেই সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ লাভ করে অগণিত উদ্বাস্তুর স্রোত । দেশভাগের ফলে শুধু হিন্দু বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি । তার বলি হয়েছে মুসলমানরাও । তারাও দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে । এই দেশভাগ ও তার যন্ত্রণা আমাদের ইতিহাস চর্চার সামনে বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় । স্বাধীনতা ও দেশভাগ আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সামনে এক অলঙ্ঘনীয় লক্ষণরেখা টেনে আনে । সেই ইতিহাস চর্চা শুধুমাত্র সরকারি তথ্যনির্ভর থাকেনি । আর্কাইভনির্ভর খাতে প্রবাহিত হয়নি । প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতার কথাও উঠে এসেছে । যারা দেশভাগের শিকার হয়েছেন, ধর্মীয় সহিংসতায় সবকিছু থেকে উৎখাত হয়ে ভাসমান জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদের থেকেও তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে । অনেকে সে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন পার করে দিয়েছেন । অনেকে আজও বেঁচে আছেন সেই দগ্ধ অন্ধকার দিনের চিতানলকে বুকে নিয়ে । তাদের স্মৃতিতে ঠাসা হয়ে আছে অনেক যন্ত্রণা । অনেক বেদনা । আর স্মৃতি তো চিরকাল অমলিন থাকে না দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও অব্যক্ত স্মৃতিও একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় । আজও হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক স্মৃতি । স্মরণ ও বিস্মরণ এবং উত্তরপ্রজন্মের অভিজ্ঞতা যা আছে তা তুলে নেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে আবার । 

হয়তো অনেকে বলবেন– 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালবাসে?'  না, এ বেদনা জাগাতে হবে । এই বেদনা একটা জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস । এ বেদনার অভ্যন্তরে রয়েছে দেশভাগের বিষবৃক্ষটি । তাকে চিহ্নিত করতে হবে । তাকে উৎখাত করতে হবে, যাতে এই জাতীয় পরিস্থিতি যেন আর সৃষ্টি না হয় । জানাতে হবে । জাগাতে হবে উত্তর প্রজন্মকে । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার উদ্বাস্তু কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন–

            আমরা সবাই উদ্বাস্তু 
            কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
             কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে । ( উদ্বাস্তু-অচিন্ত‍্যকুমার সেনগুপ্ত )

আদর্শ থেকে উৎখাত হয়ে গেলে একটা জাতির আর কিছু থাকে না । আদর্শের ভিত্তিটাকে দৃঢ় করার জন্য, পারস্পরিক সম্প্রীতির বাতাবরণকে সুদৃঢ় করার জন্য, 'আজাদী কা অমৃত মহোৎসব'-এ দেশভাগের অভ্যন্তরে নিহিত তীব্র ধর্মীয় দ্বেষ নামক গরলটাকে মন্থন করে তুলে ফেলতে হবে । তাতেই রক্ষা হবে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব ।

Friday, August 5, 2022

MY PENSION FROM JULY–2022

Pension up to Jun-23 : BP = 40500 = DA =  1215 ( 5% ) REC = 0 COMM = 0 DIS = 0 IR = 0 OLD = 0 FMA = 500 TDS = 0 NET = 35915

Pension from Jul-23 : BP = 40500 = DA =  3240 ( 8% ) REC = 0 COMM = 0 DIS = 0 IR = 0 OLD = 0 FMA = 500 TDS = 0 NET = 37440

Sunday, July 31, 2022

মায়াতাঁতের অসমাপ্ত বয়নশিল্পী

মায়াতাঁতের অসমাপ্ত বয়নশিল্পী

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

'আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোকসভা না হয় প্রদীপ,
 অবনমিত মেধার শহর ছেড়ে অভিমানে কেউ কেউ 
রাতারাতি চলে গেছে কুয়াশাবৃত শীতের পাহাড়ি স্টেশনে। ( ইচ্ছাপত্র–প্রবুদ্ধসুন্দর কর )

 না, প্রবুদ্ধ কোন কৃষ্ণপথ রেখে যান নি শোক প্রস্তাবের জন্য । পার্থিবপ্রস্থানের আগে ছিল তাঁর ছিল আশাময় পুলওভার । হাসপাতালের  বিছানায় শুয়ে অনুভব করেন, 'আরোগ‍্যের পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তাটুকু বেহেশ্ ত । নিজেকে যিনি তাঁরই দেহসচিব বলে আমৃত্যু ঘোষণা দিয়ে গেছেন তিনি তাঁর চিকিৎসাশয্যায় স্বনাম নিয়ে করছেন রসিকতা । লিখেছেন– 'আমি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নই । আমি গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ৬৫২ এ । প্রচন্ড নৈসর্গিক বিশ্বাস রেখেছেন তার শল‍্যচিকিৎসকের উপর যার ছুরি জাদুবিভায় মৃত্যু কেটে ফালা ফালা করে জীবন ছিনিয়ে আনবে । জন্মছকের বিশ্লেষণের প্রতিও তাঁর একসাগর আস্থা জীবনের উপরেই তো আলো ফেলে হে কবি ! পার্থিব পরিমণ্ডল আর এই আলো হাওয়ার বাউন্ডুলে পরিক্রমণের আর্তিই প্রতীক হয়ে আসে বারংবার । কিন্তু যে আত্মশবরক্ষক, সেই বুঝতে পারে এক রিক্ততার আলোকবর্ষের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তাকে মহাজগতের চক্রবালের আলোপ্রান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে । ক্রমশ সরে যাচ্ছে প্রিয়জনের যৌথস্বর,  কবিতার কোলাহল । সামনে শুধু নীল উপত্যকা । পায়ে পায়ে উড়ছে ডার্করুম মঘানক্ষত্র, ইন্দ্রজাল কমিকস, মায়াতাঁত, নৈশশিস, আত্মবিষ, যক্ষের প্রতিভূমিকা, অসুস্থ শহর থেকে,এসিড বাল্ব আর স্বনির্বাচিত কবিতার পাতা ।

কফি হাউসের সেই আড্ডা থেকে উঠে আসা 'রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর'ই জানান দিয়েছে শিরোনামে যাকে ধরেছ সেই শিরোপা ধারণ করবে আগত কবিতাকনভোকেশনে । 'বাংলাকবিতা' যার জন্মদানের জন্য উন্মুখ হয়েছিল বহুকাল । তীক্ষ্ণ শ্লেষ আর আত্মকশা, সুতীব্র নাগরিক বয়ান যার, তার সমূহ উচ্চারণ অমোঘ হয়ে ওঠে বাংলাকবিতায় । প্রবুদ্ধসুন্দরকে নিয়ে বারবার আত্মরতিতে মাতেন কবি প্রবুদ্ধসুন্দর । 

পিতৃসত্বা তাঁর জীবনজিন ।তিনি বলেন, ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার / শুনেছি বাবার দৌড় এটুকুই ছিল । / আমি ঢাকা অব্দি গেছি । / বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরন / এ জীবনে আর কিছু নেই । ( উদাহরণ ) । ছিন্নমূল বাবার জীবনসংগ্রামকে দেখেছেন অন্তর দিয়ে । 'উনিশ শো একান্ন সালে যে গাছটি/ আখাউড়া স্টেশন পেরিয়ে প‍্যারীবাবুর বাগানের / সামনের রাস্তা ধ‍রে হেঁটে এসেছিল / সেই গাছটি আমার বাবা । / আজও মূলত্রাণ উল্টে ধরলে দেখা যায় / বাবা পায়ের পাতায় ম‍রা রক্ত জমে / কেমন কালচে হয়ে আছে । আর যে আশ্রয়ভূখন্ডে বাবার স্থিতিবাসনা তাকে নিয়েই গর্বে তিনি উচ্চারণ করেন 'দূরদর্শনের টাওয়ারটি আমাদের আইফেল / বটতলা শ্মশানটি আমাদের মহানিমতলা / পাশে বয়ে যাওয়া নদী সেই গ্রিক পুরাণের লিথি / ধলেশ্বরে্য মিশনই আমাদের বেলূড়ের মঠ / জম্পুই হিলসই আমাদের ছোটো ভূস্বর্গ কাশ্মীর / সর্বোচ্চ বেতলিংসিব আমাদের শৃঙ্গ এভারেস্ট' ( শ্লাঘা ) । এক মর্মসচেতন রসানুভূতি রেখেই কবি অনায়াসে বলে যান– 'যে পা গুলো একদিন প্রণামের যোগ্য মনে হয়েছিল/সেগুলো শয়তানের খুর হয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে  ( জ্যোতিষবচন ) । সৃজনের পরও যেন তৃপ্ত নন কবি । এজন্মের অসম্পূর্ণ প্রণয়ের সংক্ষোভে বলেন, 'পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু হয় / সমুদ্রমন্থন শেষে রাহুর কবন্ধ আমি / অমরত্ব নয়, চাই, চাঁদের প্রণয় ( পরজন্ম ) । চন্দ্রলুব্ধ কাঙ্খায় ভরে আছে কবির পরজন্মের স্বপ্ন । স্বপ্ন নিয়েই অন্তরার পথে এগোতে এগোতে কবি জীবনের কাছে আহ্বান জানান–'শুধু এগিয়ে দেয়ার পথে নিচু স্বরে বোলো / দরজা ভেজানো থাকবে / টোকা দেওয়ার দরকার নেই / আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে ( দরজা ) ।
 জীবন ও অতিজীবনের মাঝখানে কবিতার তাঁবুতে যাপন আপনার । অবাধ বিচরণ না হলে এই গোষ্ঠের কী অনুপুঙ্খ বর্ণনাসফল  হয় হে 'নীল উপত‍্যকার রাখাল' ! আপনিই পেরেছেন মায়াবি পরিভ্রমণের ধারাভাষ‍্যে তুলে দিতে 'সন্ধ‍্যার সেই শান্ত উপহার' । আপনার পর্যবেক্ষণে ও বাচনবিভঙ্গে সমগ্র কাব‍্যজগৎ রক্তেপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে জোছনার আলোছায়া গড়ে । সীমান্তবর্তী এই পার্বতীভূগোলের কবিতায় এক অত‍্যুজ্জ্বল বাঁক আপনি যা কালের মানচিত্রে চিহ্নিত হয়ে গেছে । অমরত্বের পথিক কবি আপনি তবু বলেন–
আমার মৃত্যুর পর যেন কোন শোক সভা না হয়, পল্লব 
আমি চাই না,পাপেট ও বামন, শিরদাঁড়াহীন সুশীলেরা সভায় বলুক এসে মূলস্রোতে নয়,আত্মহননের পথ
 বেছে নিয়েছিল প্রবুদ্ধসুন্দর ( ইচ্ছাপত্র ) ।

 তাইতো কবি, আপনার অনির্দেশ যাত্রার পথে আমরা থামাবো না আপনার অনন্তরথ । কোন শোকসভাও নয় । শুধু আপনার শব্দের বিছানার এক প্রান্তে রেখে যাব এক স্বয়ংক্রিয় নির্দেশশলাকা । যার সংকেতে 'সন্ধ‍্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে উঠে একটি নক্ষত্র / বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ / কোনও একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে /  বোঝা যাবে সেই নক্ষত্রের আলো /  পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে সামান্য আগে ( আলো ) ।

Monday, July 25, 2022

তোমার ঘরে...

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা

বিসমিল্লার মানে তোরে বলবো কী । বীজে তে বিসমিল্লা আছে শুনেছি সাধুর মুখে সাধুর মুখে । বীজরূপে দেহে বিসমিল্লা বসত করেন । সে বড়ো আজব কুদরতি । আঠারো মোকামের মাঝে জ্বলছে এক রূপের বাতি । এই বাতিই আমার পরমেশ্বর । আত্মারাম । বাতিরূপ বিসমিল্লার নূর অর্থাৎ পরমেশ্বরের আলোতে আমি আলোকিত । জগৎও আলোকিত । এই না দেহে আছে রে মন গোলোক বৃন্দাবন । আর বৃন্দাবনে  বিহার করেন গোলোকবিহারী অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ । বড়ো কঠিন তত্বকথা । দেহতত্বের সার কথা এটি ।

Wednesday, June 15, 2022

সাত্তাই বা হাত্তাই ব্রত

'সাত্তাই' বা 'হাত্তাই' পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিশেষ ব্রত বা বর্ত । জৈষ্ঠ‍্যমাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন এই বর্ত পালন করা হয় । এই বর্তের মূল উপাদান ছাতু । এই ছাতু তৈরি হয় চালভাজা, খই, বিভিন্ন রকমের ডাল ইত‍্যাদির মিহি গুড়ো দিয়ে । সেকালে ঢেঁকিতে কুটে এসব গুড়ো করা হত । মূলত এদিনটি এই ছাতু খাওয়ারই অনুষ্ঠান ‌। সকালবেলা মায়েরা স্নান সেরে আলতাসিঁদুর পরে এই বর্ত করতে বসতেন । বর্তের সময় ছাইতরানি/ছাইত্তানি মতান্তরে ছাতুকুমারীর নামে একটি জলপূর্ণ ঘট আম্রপল্লবসহ বসানো হত । পুজোর জন‍্যে কোনো বৈদিকবিধি নেই । নৈবেদ‍্যের উপকরণ হিসেবেও থাকত ছাতু , কলা ও কাঁচা দুধ । ভোগ নিবেদনের পর ব্রতীদের একজন পূর্বোক্ত লৌকিক দেবীর ব্রতকথা বলতেন ‌। অন‍্য ব্রতীগণ গলবস্ত্র হয়ে ব্রতকথাটি শুনতেন । ব্রতকথা সমাপ্তির পর উলুধ্বনির মাধ‍্যমেই ব্রতসাঙ্গ হত । প্রণামের সময় ব্রতীগণ বাংলা ছড়ার ঢংএ দেবীর কাছে বলবুদ্ধি বৃদ্ধি, আয়ু বৃদ্ধি,ছিরি বৃদ্ধির কামনা করতেন । তারপর ছাতুসহ পুজোর অন‍্যান‍্য উপকরণ প্রসাদ হিসাবে সবার মধ‍্যে বিলি করা হত । তবে শিশুদের মধ‍্যে সর্বাগ্রে প্রসাদ বিতরণ করার নিয়ম ছিল ।
 এই বর্ত প্রাচীন কৌম জনগোষ্ঠীর উর্বরতাকৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত । ছাতুর মূল উপাদান হল বীজ । বীজের রয়েছে সৃজনক্ষমতা । এই বীজ সরাসরি গ্রহণের চিন্তার মধ‍্য দিয়ে আদিম মানুষ নিজেকে উর্বর করার বা উৎপাদন করার জাদুবিশ্বাসে প্রভাবিত হতেন । সংস্কৃত 'শক্তু' শব্দ থেকে এসেছে ছাতু । ছাতুর সঙ্গে নামসাদৃশ‍্যে শক্ত ও শত্রুর একটা সম্পর্ক রয়েছে । ছাতুভক্ষণের মধ‍্য দিয়ে শক্ত হওয়া ও নিজদেহে শক্তিধারণের কৌমচেতনায় সমৃদ্ধ হতেন আদিম মানুষ ।  সেসময়ে শত্রুকে প্রতিহত করার জন‍্য দৈহিক শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজন ছিল মানুষের । হাত্তাইর দিন আর একটি আচার পালন করত শিশুকিশোররা । এদিন তারা লাটিম বা লাডুমখেলা বা লাডুমঘুরানিতে মেতে উঠত । লাডুম দিয়ে পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা হত । এই লোকক্রীড়াও শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার একটা প্রতীকী অনুষ্ঠান। এদিন স্নান করে উপুড় হয়ে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে পেছনের দিকে ছাতু উড়িয়ে দেওয়ার মাধ‍্যমে শত্রুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার চেতনা কাজ করে । পায়ের তলা দিয়ে উড়ানো মানে শত্রুকে একেবারে তাচ্ছিল্য করার প্রতীক ।
 হাত্তাই বা সাত্তাই এককথায় কৌমজনগণের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিক শক্তি অর্জনের অনুষ্ঠান । কারণ আদিমজীবনে গোষ্ঠীসংঘর্ষ ছিল নিত‍্যদিনের ঘটনা ।

Tuesday, June 14, 2022

ভাবনা

সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই তো আপডেট হয় । কুশপুতুল দহনের পর কুশপুতুল পদাঘাত । ভাবনার উন্নয়ন ঐতিহাসিক ঘটনা । গিনেস বুকে তোলার মতো । এরপরে হয়তো আসবে কুশপুতুলে মলত‍্যাগ । কার ভাগ‍্যে আছে জানিনা । বোধহয় সেটাও অচিরেই দেখা যাবে । দহন, পদাঘাতকে মান‍্যতা দিলে এই সংযোজনকেও মানতেই হবে ।