Monday, February 20, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে মণিপুরিদের আগমন ও মণিপুরি সংস্কৃতির প্রসার

ত্রিপুরারারাজ্যে মণিপুরিদের আগমন ও মণিপুরি সংস্কৃতির প্রসার

একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির ক্ষেত্রে অপর কোন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, ভাষা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠে । ফলে এর মধ্যে একটি সমৃদ্ধ একাত্মবোধ গড়ে ওঠে এবং সেখানে সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে এরকম ভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির আগমন আদান-প্রদান এবং মেলবন্ধন ঘটেছে । ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইরূপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে ত্রিপুরারাজ্য হয়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য । ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতেই হয় যে, রত্নফা যখন মানিক্য উপাধি নিয়ে ত্রিপুরায় ফিরে এলেন তখন তার সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের । যাদের সহযোগে সেদিন ত্রিপুরায় গড়ে উঠেছিল এক মিশ্রসংস্কৃতির বাতাবরণ । যেহেতু পণ্ডিতদের দ্বারা আমদানি হয় সংস্কৃত সাহিত্য ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির । সঙ্গে সঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের ত্রিপুরায় সে সময় সীমানা ছিল ব্রহ্মদেশের প্রান্ত সীমা থেকে শ্রেষ্ঠ ঢাকার কিছু অংশ চট্টগ্রাম নোয়াখালী নিয়ে । তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ত্রিপুরাতে হিন্দু বৌদ্ধ শৈব ও শাক্ত সংস্কৃতি নিদর্শন পাওয়া যায় ।  এককথায় ত্রিপুরার সংস্কৃতিতেও 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' পরিবেশ যথেষ্টই রয়েছে ।

ত্রিপুরার রাজারা সংস্কৃতিবান, বিদ্যোৎসাহী, উদার মনোভাবাপন্ন এবং গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় সতত সচেষ্ট হিসেবে সর্বজনবিদিত । নৃত্য ও গীতের সুধাসাগরে মহারাজারা শুধু নিজেরাই নিমজ্জিত ছিলেন না, রাজ অন্দরে পুরনারীদের সংগীত ও অন্যান্য চারুকলার চর্চায় প্রচন্ড উৎসাহ প্রদান করতেন । ত্রিপুরার  রাজাদের ইতিহাস কালিপ্রসন্ন সেন সম্পাদিত 'শ্রীরাজমালা'য় উল্লেখ রয়েছে–
 'ত্রিহুত দেশ হ ইতে নৃত্যগীত আনি ।
 রাজ্যতে শিখায় গীত নিত্য নৃপমণি ।।
 ত্রিপুর সকলে সেই গীত ক্রমে গায় ।
 ছাগ অন্তে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।
অর্থাৎ মহারাজা ধন্যমাণিক্য মিথিলা বা তিরহুত দেশ থেকে শিল্পী এনে রাজ্যে নৃত্যগীতের প্রচলন করেছিলেন ।

ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ হলো মনিপুরী জনগণ রাজ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মনিপুরী গণ রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের ন্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধির পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যা হল ----------- আর তার মধ্যে ----------- মনিপুরী । রাজ্যের ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলপুর, খোয়াই ও সদর মহকুমাতে মনিপুরীগণ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।

 মনিপুরীরা মূলত মনিপুরের অধিবাসী । সাধারণত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা সাংস্কৃতিক বিনিময়ে এবং রোগ মহামারীর আক্রমণ কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য স্থানে বা অন্য রাজ্যে অভিবাসনে বাধ্য করে ত্রিপুরা রাজ্যের মনিপুরীতে প্রথম অভিবাসন উপরোক্ত কোন একটি কারণের ফলে হয়েছে । রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মনিপুরিগণ দেশ ত্যাগ করে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮২৪ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরূপে মনিপুরের এক প্রাক্তন রাজার আমরা সন্ধান পাই । ১৭৬২ সালে কৃষ্ণ মানিকের আমলে চট্টগ্রামের রেসিডেন্ট মি. ভেরেলিস্টের পত্র থেকে জানা যায় যে মনিপুর রাজ বিখ্যাত গরীবনওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র জগত সাই সিংহাসন থেকে  বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে ভেরেলিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনরায় ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসন দখল করার জন্য । কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের তৎপরতায় তিনি সফল হননি কিন্তু জগৎসাই সম্ভবত কসবা অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন কেননা পরবর্তীকালে ভাগ্যচন্দ্রের আগরতলা আগমন কালে কসবাতে জগৎশাই ভাগ্যচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন বলে জানা যায় । তারপরে অবশ্য জগতসাইয়ের আর কোন সংবাদ জানা যায় না এবং তার বংশধর বা পরিবার-পরিজন এর ত্রিপুরায় পাই না । রোগ মহামারী বা অর্থনৈতিক কারণের জন্য মনিপুরীদের ত্রিপুরার অভিবাসনের কোন সংকেত ইতিহাস আমাদের দেয় না ।

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । ত্রিপুরার অনেক রাজা মণিপুরের রাজকন্যা বিবাহ করেছেন দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য মনিপুরাধিপতি ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিবাহ করেন । কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছেন, ''মণিপুরের রাজবংশের শহীদ ত্রিপুরার রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ ।" এই উক্তি পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না । কেননা আমরা দেখি যে ত্রিপুর বংশধর তইদাক্ষিণের পুত্র দাক্ষিণ মেখলি রাজকন্যা বিবাহ করেন অবশ্যই এই বিবাহ বর্তমান ত্রিপুরার রাজনৈতিক সীমার মধ্যে ঘটেনি । বরঞ্চ বলা চলে ত্রিপুরার মানিক্য রাজাদের সঙ্গে মনিপুর রাজবংশের প্রথম সম্বন্ধ হয় রাজধরমানিক্যের সঙ্গে । এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা । কেহ কেহ মনে করেন কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী মণিপুরের রাজদুহিতা । কৈলাস চন্দ্র জাহ্নবীদেবীর অপর নাম 'রানী তম্পা' বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু কমলজিৎ সিংহ উল্লেখ করেছেন যে জাহ্নবী দেবীর অপর নাম 'সিজা তম্ফা' ।এই নামীয় কোন মহিলা মনিপুরী ভিন্ন অপরকেও হতে পারে না । কৈলাস চন্দ্রের রাজমালা তে সিজাতমফার উল্লেখ নেই । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরাতন রাজমালা শ্রীরাজমালার মুল পাঠে এবং 'দেশীয় রাজা'তে কৃষ্ণমানিক্যের পত্নীর নাম জাহ্নবী দেবী লেখা আছে কিন্তু  আখাউড়া স্টেশনের নিকটে রাধানগর গ্রামে অবস্থিত রাধামাধব মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী । মুদ্রার সাক্ষ্যেও আমরা তার নাম জাহ্নবী দেবী পাই । কর্নেল দেববর্মা মহাশয় তাকে অসূর্যম্পশ্যা একজন ত্রিপুরী রমনী বলে তার অনেক গুণের উপর আলোকপাত করেছেন । অন্য প্রমাণাভাবে কমলজিৎ সিংহ এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছেন । কৃষ্ণ মানিক্য ( ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩খ্রিস্টাব্দ ) শমসের গাজীর উপদ্রবে সিংহাসন দখল করতে না পেরে অনেকদিন কাছাড় ও মনিপুরের রাজসভায় সাহায্য লাভের আশায়রাজ্যত্যাগ করেছিলেন ।

ইতিহাসের এই সমস্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এভাবেই খুব সম্ভবত রানী হরিশেশ্বরীর স্বজন, সেবক ও সেবিকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম মনিপুরী অভিবাসন কেন্দ্র । রাজধানীর পাশে মেখলিপাড়া গ্রামে । কমপক্ষে চারটি বিভিন্ন বংশের মনিপুরিগণ এখানে বসবাস করছেন । এরা হলেন মরুংবম, হনজবম, খুমনথেম, লাইপুবমনা নামক বংশের উত্তরপুরুষ । রাজকীয় বহরের অন্তর্ভুক্ত না হলে একসঙ্গে একই স্থানে চারটি বংশের মানুষ সমবেত হয়ে বসবাস করতে পারত না । রাজমালা পাঠে জানা যায় যে,বৈবাহিক সূত্রে মনিপুর রাজবংশের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কিত হন রাজধর মানিক্য ( ১৬১১ খ্রি.)।  তিনি ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রথম রাজধর মানিক্য । সেই সূত্রে তিনি নিজে ত্রিপুরার নৃপতিদের মধ্যে প্রথম বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি সার্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ নামে পরম বৈষ্ণব পুরোহিত ও ২০০ জন ভট্টাচার্য বৈষ্ণবের সঙ্গে সর্বদা ভাগবত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতেন । 
এভাবেই রাজঅন্তপুরে মণিপুরী মহিলাদের আগমনের ফলে মনিপুরী কৃষ্টি সংস্কৃতি ও মণিপুরি নৃত্যধারার  বিস্তার লাভ করে । ত্রিপুরারাজ্যের রাজ অন্তঃপুরের বাইরেও প্রসারলাভ করে মণিপুরি নৃত্যশৈলী ।  মহারাজগণের উৎসাহে রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা রাজবাড়ির অঙ্গনের মধ্যেই নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করতেন ।  রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে হোলি এবং ঝুলন উপলক্ষে দুইদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত । প্রতিটি নৃত্যই মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হত । মণিপুরি নৃত্যগুরুগণ বিভিন্ন সময়ে  রাজকমারীদের নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন ।বিশেষ করে রাসোৎসব উপলক্ষে রাজপরিবারের মেয়েরা মণিপুরি 'মহারাস' নৃত্য পরিবেশন করতেন । এককথায় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে  সেকালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ও ধ্রুপদী নৃত্যের পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল ।

Friday, February 10, 2023

রাবণরাজা কৌপিন পরে সীতাহরণ করেন
কিল মারবার গোঁসাইজি ভাতের থালা ধরেন
ভোট এলে আজব দেশে গজবের গজল শুনি
টাকলা মাথায় পরচুলা পরে লম্বা বিনুনি

কাঁচা কাঁচা পাকা পাকা রঙ ধরেছে পাকা পাকা
চার্ডার্ড বিমান ভর্তি করে আসছে কোটি টাকা
আলখাল্লা হাওলাত নিয়ে সাজছে ভোটের বাউল
এই বাজারে ল্যাঙ্গি মারলেও হয়নাকো ফাউল

শক্তিশালী যে এই লেখাটা বুকের ভেতর আওয়াজ পাই
সন্ন্যাস নেবার যে বার্তা পেলাম সেও বুঝি আরেক 'থকাই' ।
ধাপে ধাপে ঠকে গেলে একটা জাতি বাঁচে কি ভাই ?
খুড়োর কলের পেছনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে 'থ' খাই ।

Sunday, January 29, 2023

সান্ধ্যবার্তা

+~+ সান্ধ্যবার্তা +~+

অশোকানন্দ রায়বর্ধন
-----------------------------------------
আর কঘন্টা অতিক্রমণের পর আমার বানপ্রস্থের নোটিশ কার্যকর হয়ে যাবে ৷ এতোকাল বাণীর অঙ্গনে কুড়িয়ে ফিরেছি নুড়ি ও নূর ৷ এ সন্ধ্যা আমার জন্যে বয়ে আনবে মাঘমিছিলের হিমপ্রবাহ ৷ তারপর থেকে আমি শুধু বাতিল ক্যালেন্ডার ৷ প্রভুপাদের করুণায় প্রদেয় মাধুকরী আমার বরাদ্দ রসদ হয়ে যাবে ৷ এও এক জাদুময় রসিকতা, যার চটুল উল্লাসের স্ট্যাম্পছাপ নিয়ে গড়াতে গড়াতে পেরিয়ে আগত প্রতিটি পল ও দিবানিশি ৷ কোনো পুষ্পস্তবক নেই, কোনো সনদও বরাদ্দ নেই আমার জন্যে ৷শুধু এই যান্ত্রিক পিঠের উপর কতো পদচিহ্ন চুম্বন করে ওপরে চলে গেছে তার অগণিত বেদনায় আমার প্রহর পেরোবে নিভৃতে হে ৷
সালতামামি লিখে লিখে আমি হাওয়ায় উড়িয়ে সমস্ত কাগজকুচি ৷যদি সুযোগ হয়, কুড়িয়ে নিয়ে জাদুঘরে রেখে দিও সংরক্ষিত কোটরে ৷ এই শেষ অভিপ্রায় পূর্বপর্বের সতীর্থ শ্রদ্ধাস্পদের কাছে ৷ অশোক ও আনন্দকে আলিঙ্গনের আগে অতিক্রান্ত সন্ধ্যার শুভ উপহার ৷

Saturday, January 21, 2023

নবম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন ( ৭-৮ জানু. ২০২৩ ) : কিছু আবেগ, কিছু অভিজ্ঞতা

*নবম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন : কিছু আবেগ, কিছু অভিজ্ঞতা* 

 *অশোকানন্দ রায়বর্ধন* 

 *উত্তরপূর্বের* বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লিটল ম‍্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে আসছে নিয়মিত ও অনিয়মিত । নিজেদের লেখালেখির সঙ্গে পরস্পর পরিচিত হওয়া, নিজেদের মধ‍্যে মনন,চিন্তার ভাব বিনিময় করা, এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির চর্চাকে অব‍্যাহত রাখা, লেখালেখির শৈল্পিক উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি এই অঞ্চলের বাংলাভাষা চর্চার সংকট, সমস‍্যা ও প্রতিবন্ধকতা ইত‍্যাদির প্রকৃত স্বরূপ নির্ধারণ এবং নিরসনে প্রয়াসের ভাবনা বিনিময়ের মাধ‍্যমে এই অঞ্চলের বাংলা ভাষা সাহিত‍্য-সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ‍্যে আজ বেশ কিছু বছর ধরে এই অঞ্চলের লিটল ম‍্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের উদ্যোগে  উদারবন্ধ, কৈলাশহর, শিলং, শিলচর, গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া আগরতলাসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলব‍্যাপী তাঁদের প্রয়াসকে বিস্তৃত করার লক্ষ‍্যে তাঁদের প্রয়াসকে নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন । লিটল ম‍্যাগাজিন আন্দোলনের এই লড়াকু সৈনিকদের কোনো স্থায়ী সংগঠন না থাকলেও তাঁরা এক একটি প্রকল্প হাতে নিলে একডাকে সবাই সামিল হয়ে যান । ইতোমধ‍্যে তাঁরা উত্তরপূর্বের বিভিন্ন স্থানে নয়টি ফলপ্রসূ সম্মেলন সম্পন্ন করে ফেলেছেন । স্থায়ী কোনো ঠিকানা বা কমিটি না থাকলেও এই সংগঠনকে আজ আর অবহেলা করা যাবে না । কারণ এই সংগঠনের মাথার উপরে ছাতার মতো রয়েছেন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ সন্দীপ দত্ত ( তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি । বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য, কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ( তিনিও কার্যকারণে এবারের সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি । ) এবং কবি দিলীপ দাস ও প্রসূন বর্মন প্রমুখগণ ।

গত সাত এবং আট জানুয়ারি শিলচরে হয়ে গেল নবম উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় লিটল ম‍্যাগাজিন সম্মেলন । শিলচর শহরের প্রাণকেন্দ্র ক্লাব রোড,দেবদূত মোড় কাছাড় নেটিভ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিস প্রাঙ্গনে । এই প্রতিষ্ঠানের জন্মেরও এক গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে । যেসময়ে ইংরেজ ব‍্যবসায়ীরা সারা উত্তরবঙ্গ, সিলেট ও আসামে চাশিল্পকে কেন্দ্র করে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তার করে চলেছে সেই সময়ে প্রতিস্পর্ধী বাঙালি উদ‍্যোক্তা হিসেবে চাশিল্পে পদার্পন করেন দুজন বাঙালি উদ‍্যোক্তা । দীননাথ  দত্ত ও  বৈকুন্ঠচন্দ্র গুপ্ত মিলে ১৮৭৬ সালে গড়ে তোলেন এই প্রতিষ্ঠান । সেসময়ে সারা বাংলাদেশেই দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠার একটা আন্দোলন চলছিল । আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের 'বেঙ্গল ক‍্যামিকেল' তার উদাহরণ । তেমনি শিলচরের এটিও বাঙালিসৃষ্ট পাবলিক লিমিটেড চাশিল্প কোম্পানী । এই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত নেটিভ শব্দটি তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবেই রেখে দিয়েছেন । ইংরেজরা যে নেটিভ শব্দটি দিয়ে এদেশীয়দের কলঙ্কিত করেছে । এই বাঙালি প্রতিষ্ঠান  এধরনের দেশীয় উদ্যোগে  শিল্পের  প্রতিষ্ঠা করার স্পরধা দেখিয়ে সেই কলঙ্ককে গর্বের বিষয় করে তুলেছেন । এতটাই ছিল তাঁদের জাতীয়তাবোধ । সেদিনের সেই দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান আজকের প্রতিষ্ঠান । দুদিন ব‍্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন বরাক উপত্যকা নন্দিনী সাহিত‍্য ও পাঠচক্র । যার মধ‍্যমণি হলেন এই প্রতিষ্ঠানের অন‍্যতম প্রতিষ্ঠাতা দীননাথ দত্ত মহোদয়ের দুই উত্তরসূরী শর্মিলা দত্ত ও চন্দ্রিমা দত্ত । শত ব্যস্ততার মধ্যেও সমস্ত কর্মকান্ডের উপর তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁদের । এই দুদিনের সম্মেলনে উপস্থিত প্রত্যেককেই আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন তাঁরা । ( এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাপুরুষ দীননাথ দত্ত তাঁদের প্রপিতামহ ) । সমগ্র অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিচালনায় আমাদের চিরন্তনী মাতৃশক্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন রাখেন তাঁরা । সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিটি সদস‍্য তাঁদের এই প্রয়াসে অভিভূত হয়ে গেছেন । উচ্চারিত হোক কিংবা অনুচ্চার, উপস্থিত প্রত‍্যেকেই আন্তরিকভাবে অনুভব করেছেন এই সর্বাঙ্গসফল এই প্রয়াসকে ।

সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ত্রিপুরা থেকে লিটল ম‍্যাগাজিনের লেখক সাহিত‍্যিকদের ও লিটল ম‍্যাগাজিন সম্পাদকদের একটা বড়ো অংশ শিলচরের উদ্দেশ‍্যে রওনা হন । বর্তমানে ট্রেনের সুবিধা থাকায় যে যার মতো করে জনশতাব্দী কিংবা আগরতলা-শিলচর এক্সপ্রেসে চড়েছেন । এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ‍্যেশ‍্যে ত্রিপরার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখাকর্মী ও সম্পাদকদের মধ‍্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন দিলীপ দাস ( সংসপ্তক ), দেবব্রত দেব ( মুখাবয়ব ), দেবাশিস চক্রবর্তী ( দেয়া ), জ‍্যোতির্ময় রায় ( প্রজন্ম চত্বর ),   সুচিত্রা দাস( গিরিপথে হাওড়া ), খোকন সাহা ( ফোটামাটি ), বিপ্লব ওরাং ( উত্তরবার্তা ), অপাংশু দেবনাথ, সঞ্জীব দে ( বিজয়া ), জহরলাল দাস ( ভুবনডাঙা ), চন্দন পাল,সস্ত্রীক ( দেবদীপ ), রাহুল শীল, নবীনকিশোর রায়, সস্ত্রীক ( সময় সংকেত ), গোপালচন্দ্র দাস ( মনুতট ),  দিব‍্যেন্দু নাথ ( দোপাতা ), অভীককুমার দে ( সমভূমি ), অমলকান্তি চন্দ ( রসমালাই ), রাজেশচন্দ্র দেবনাথ ( দৈনিক বজ্রকন্ঠ ),  সঙ্গীতা দেওয়ানজী, সুচিত্রা দাস ( অনুস্বর ), সুস্মিতা দাস ( প্রতিভাস ), শ্রীমান দাস ( সৃষ্টি ), চয়ন সাহা ( ত্রিধারা ), অধ‍্যাপক, শৌভিক বাগচী, শান্তনু মজুমদার, শম্ভুশংকর চক্রবর্তী, গোপেশ চক্রবর্তী, অশোকানন্দ রায়বর্ধন ( জলীয় সংবাদ ) । এছাড়া বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কবি সেলিম মুস্তাফার 'পাখিসব করে রব' ধর্মনগরের কথা ও কবিতা গোষ্ঠীর  'জঠর'সহ আরো কয়েকটি  লিটল ম‍্যাগাজিনের সম্পাদকসহ কবি সাহিত‍্যিকগণ । যার যার সুবিধামতো আসায় সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি  সম্ভব হয়ে ওঠেনি । তবে সব মিলিয়ে পঁচিশটির মতো লিটল ম‍্যাগাজিন ও ত্রিশোর্ধ লেখক-লেখিকা, সাহিত‍্যকর্মী এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন । এই প্রতিবেদকের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল জলীয় সংবাদের সম্পাদক গোপেশ চক্রবর্তীর আন্তরিক উদ‍্যোগ ও সৌজন‍্যে । বিজয়া সম্পাদক ও কবি সঞ্জীব নিজ উদ‍্যোগ নিয়ে আমাদের অনেকের জন‍্যে আগরতলা- শিলচর এক্সপ্রেসে আগাম টিকিট সংগ্রহ করে রাখায় একসঙ্গে হৈ হৈ করে যাওয়া-আসার ফলে এক্সপ্রেস ডিগ্রিধারী লজঝরে ট্রেনেও কোনো ক্লান্তি অনুভব হয়নি । ট্রেনে যাওয়া আসার সময় আমাদের কেবিনগুলোতে চলে জমাটি আড্ডা গান । আসার সময় আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন সস্ত্রীক কবি চন্দন পাল । চন্দনগিন্নি তাঁর স্বভাবসুলভ মমতায় ট্রেনে সবার জন‍্যে টিফিন কিনে আনেন । বিলোনিয়া গিয়ে তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেননি এমন ঘটনা বিরল । অতিথিবৎসল এই ব‍্যস্ত গৃহিনী এই দুদিন খুবই আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন । আমাদের সাহিত‍্যচর্চা, যাপন, রাজনীতি, সময় ইত‍্যাদিকে কেন্দ্র করে । ট্রেন যেখানেই থামে সেখানেই হৈ হৈ করে ট্রেন থেকে নেমে সেলফি তোলার ধুম পড়ে যায় । তারপর সোস‍্যাল মিডিয়ায় জানান দেওয়া । ছড়া কেটে যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা । এককথায় সাহিত‍্যমনস্কতাপুষ্ট হয়েই আমাদের ভাষাশহিদের শহর শিলচরে প্রবেশ ঘটে । শিলচর স্টেশন থেকে দেবদূত মোড়ের সন্নিকটে হোটেল কল্পতরুতে টুকটুকে চড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিলেন প্রজন্ম চত্বর সম্পাদক জ‍্যোতির্ময় রায়দা ।

কল্পতরু হোটেলে পৌঁছেই আমরা দেখি উদ‍্যোক্তারা পূর্বাহ্নেই আমাদের প্রত‍্যেকের জন‍্যে রুম বুক করে রেখেছেন । আমি ও টনিলাল পাঁড়ে ২৩২নং রুমে জায়গা পেলাম । টনিলাল পাঁড়ে আমাদের রাজ‍্যের একজন শক্তিশালী কথাসাহিত‍্যিক প্রয়াত জয়া গোয়ালার স্বামী । জয়া আমাকে দাদা ডাকত । সে হিসেবে আমার বোনাই তিনি । তিনিও বিপ্লব ওরাং নামে ত্রিপুরার চাবাগান অঞ্চলে প্রচলিত 'ছিলোমিলো' ভাষায় সাহিত‍্যচর্চা করছেন । তাঁর কবিতা ইতোমধ‍্যে উত্তরপূর্বসহ সমগ্র বাংলাভুবনে পরিচিত হয়ে গেছে । এবারের সম্মেলনেও এই কবিকে নিয়ে অনেককে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা গেছে । তাঁর সঙ্গে দুটোদিন একসঙ্গে নাওয়া-খাওয়া, আলোচনা, ঘোরাঘুরি করেছি । কর্মজীবনে তিনি ত্রিপুরা রাজ‍্যসরকারের ইন্টেলিজেন্স দপ্তরের কর্মী ছিলেন । তাঁকে চিনলেও পুলিশের লোক বলে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতাম । কিন্তু এই দুদিনের সান্নিধ‍্যে মানুষ টনিদা কবি বিপ্লব ওরাংকে চিনতে পেরেছি ভালোভাবে । এত সহজ, সরল, সাদামাটা ভালোমানুষ খুব কমই হয় । তাঁর কবিতার ভাষাও তেমনি সরল এবং সরল মানুষজন নিয়েই তাঁর কবিতা । হোটেলে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিচে নেমেই আমরা গেলাম একটু দূরের আমাদের সম্মেলনস্থলে । ভেতরে ঢুকেই অভিভূত হয়ে গেছি চত্বরটার সজ্জা দেখে । 'হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে' যেন প্রবেশ করলাম আমরা । গোটা চত্বরের আলোআঁধারির সৌন্দর্য একটা মায়াময় পরিবেশ ।মঞ্চে, গাছে গাছে, খুঁটিগুলোর গায়ে গায়ে ঝুলছে অজস্র নানারঙের ঘুড়ি । মনে হল, লিটল ম‍্যাগাজিনকে ঘিরে হাজারো সাহিত‍্যসম্ভাবনা আকাশে উড়তে চায় এই ঘুড়িগুলোর মতো । রয়েছে নানারকম বাঁশ-বেতের তৈরি ডালা-কুলো-ডুলা ইত‍্যাদি গৃহস্থঘরের নানা কৃষিসরঞ্জাম । বাঙালির লোকজীবনের উপকরণ । সম্মেলনের প্রধান উদ‍্যোক্তা শর্মিলাদির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে এই বাঁশ-বেতের নিপুণ কাজগুলো গ্রামীন শিল্পীরা করেছেন । আমরা সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পর রাতের খাবার এবং রাত্রিবাসের জন‍্যে হোটেলে ফিরে এলাম । 

পরদিন সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের সময়সূচী ছিল সকাল দশটায় । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হতে প্রায় দেড়ঘন্টা দেরি হয়ে যায় । ফলে এইদিনের সমস্ত কার্যক্রমের উপর তার প্রভাব পড়ে । তবুও উদ্বোধন পর্বটি ছিল অভিনব ও অর্থবহ । সম্মেলনের প্রবেশদ্বারের সামনেই একটি ডালায় কিছু ধান রাখা ছিল । সবাই এই ডালার তিনদিক ঘিরে দাঁড়ানোর পর বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অধ‍্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য্য, সাহিত্যিক প্রতিভা সরকার ও বিশিষ্ট কথাসাহিত‍্যিক নলিনী বেরার হাত দিয়ে ধানগুলোকে ভাগ করে দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন । আসলে এটা একটা প্রতীকী সূচনা । বাঙালির লোকজীবনে ধানই ধন ।  ধানই সংবৎসরের রসদ । ধানই জীবনের চালিকাশক্তি । রক্ত ও রস । ধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত  আমাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি । আমরা ধান ফলাই সম্মিলিত শ্রমে । আর ধানফসল ভাগ করে নিই সবাই । ওঁ সহনাববতু । সহনৌ ভুনক্তু । সহ বীর্যং করবাবহৈ । তেজস্বীনাবধীতমস্তু । মা বিদ্বিষাবহৈ । ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ । (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ৩/১ ) । যার শেষ কথা আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি । ধান ভাগ হলেও প্রাণ ভাগ হবে না ।  প্রাণে প্রাণে মেলার বার্তা নিয়ে শুরু হল নবম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন । দুদিনের আনন্দযাপন ।  এরপরই অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে কুটির আকৃতির প্রতীকী নির্মানের দেওয়ালে ফুলের মতো ছড়ানো ছিল প্রাচীর পত্রিকার বিভিন্ন লেখা ।  এই প্রাচীর পত্রিকা ঢাকা ছিল বাঙালির লোকউপকরণ গামছা । এই গামছাগুলোকে দুপাশে সরিয়ে প্রাচীর পত্রিকা 'প্রাচীর ফুল'-র আবরণ উন্মোচন হয় । জানা যায় এই প্রাচীর পত্রিকার সমস্ত  লেখা  অনুলিপি করে সাজিয়েছেন মঞ্জরী হীরামণি রায় স্বয়ং । লেখার সঙ্গে সমস্ত ছবি এঁকেছে নবম শ্রেণির একটি ছাত্র । সম্মেলনস্থলের সমস্ত রঙিন ঘুড়িগুলো তৈরি করেছে স্থানীয় একটি বিদ‍্যালয়ের ছাত্ররা ।  তারপর সম্মেলনে আগত প্রতিটি লিটল ম‍্যাগাজিনের নাম লেখা রঙিন বেলুন সম্মিলিতভাবে সব সম্পাদকেরা আকাশে উড়িয়ে দেন । 

অনুষ্ঠানে উদ্বোধন পর্বে অনেকগুলো বিষয় সংযোজিত হওয়ার ফলে পরবর্তী পর্বগুলো খুব দ্রুত শেষ করতে হয় । প্রথম পর্বে অতিথিবরণ, স্বাগত বক্তব‍্য,  সম্মানিত অতিথিদের শুভেচ্ছা বক্তব‍্য, গ্রন্থ উন্মোচন ও নির্দিষ্ট বক্তাগণের আলোচনা ছিল । মধ‍্যাহ্ন ভোজনের পরে প্রতিনিধিস্থানীয় গল্পকারগণ  গল্পপাঠ করেন । গল্পকার দেবব্রত দেব ত্রিপুরার প্রতিনিধিত্ব করেন । মধ‍্যাহ্নভোজের পর ছিল কবিতাপাঠের আসর । কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কবি দিলীপ দাস । সন্ধ‍্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ।  কোম্পানির অফিসপ্রাঙ্গণ ঘিরে বসে উত্তরপূর্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লিটল ম‍্যাগাজিনের মেলা । বরাক নন্দিনীরা ঘুরে ঘুরে সবার সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ‍্য রাখছেন । আড্ডা দিচ্ছেন । সবার জন‍্যে জলযোগের ,খাবার ব‍্যবস্থা করছেন । আবার অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বও পালন করছেন । তাঁদের নিরলস কর্মকান্ডে আমাদের চিরন্তনী মাতৃমূর্তি দশভুজার কথাই মনে করিয়ে দেয় । শুধু তাঁরাই নন । শিলচরের সব মানুষের মধ‍্যেই  যেন আন্তরিকতার একটা ঘরানা । কবি বিপ্লব ওরাং পানগ্রামের বড়সিঙ্গা চাবাগানে কবি-প্রাবন্ধিক কাজল দেমতার সঙ্গে দেখা করার  যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাদের হোটেলের উল্টোদিকের পা দোকানদার যুবকটি নিজে আগ্রহ নি অত‍্যন্ত সূন্দরভাবে যাত্রাপথ বুঝিয়ে দেন । অটোচালকও অত‍্যন্ত সুন্দর ব‍্যবহার করেন । আমাদের রাজ‍্যের মতো দুর্ব‍্যবহার করা বা অচেনা যাত্রীকে ঠকানো মানসিকতা তাঁদের নেই । আমরা আরো বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে যাই আসার দিনের একটি ঘটনায় । সকালবেলা আমি, গোপেশ ও টনিদা স্বর্গদ্বার মহাশ্মশানে এগারো ভাষাশহিদের স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন‍্যে আমরা রওনা হই । একসময়ে শিলং পট্টিতে গিয়ে আমরা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের মূর্তির কাছাকাছি গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলি । সেই সাতসকালে বিমান গোস্বামী নামে এক ভদ্রলোক তাঁর গাড়িতে করে আমাদের শ্মশানের সামনে পৌঁছে দেন এবং ফেরার রাস্তারও স্পষ্ট ধারণা দিয়ে দেন । এই ভদ্রতা তাঁদের জীবনধারার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ।

দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান । এরপর বিশিষ্ট বক্তাগণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন । মধ‍্যাহ্নভোজনের পরেই শুরু হয় সম্পাদকের বৈঠক । নামে সম্পাদকের বৈঠক হলেও সম্পাদকদের আলোচনার সুযোগ মোটেই ছিলনা । শুধু প্রত‍্যেকে নিজ নিজ পরিচয়টুকুই দিতে পেরেছেন । সঞ্চালক বক্তাদের জন‍্যে কয়েক সেকেন্ড বরাদ্দ করেছেন অথচ নিজে অনেক সময় নষ্ট করেছেন কথা বলে । তাছাড়া তারস্বরে সঞ্চালনা অনুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত হয়নি । এরপর অনুষ্ঠিত হয় জমজমাট বিতর্কসভা । বিতর্কের বিষয় ছিল 'সামাজিক মাধ‍্যম লিটল ম‍্যাগাজিনের সংকট ডেকে আনছে' । পক্ষে ও বিপক্ষে চারজন করে প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন পক্ষে অংশগ্রহণ করেন সুজয় রায়, খোকন সাহা, রজতকান্তি দাস ও দোলনচাঁপা দাস পাল । বিপক্ষে বক্তব‍্য রাখেন জয়দীপ ভট্টাচার্য, বাসব রায়, চয়ন সাহা ও অধ‍্যাপক তিমির দে। প্রত‍্যেকেই স্ব স্ব পক্ষে জোরালো বক্তব‍্য রেখে বিতর্কের আসর সরগরম করে তোলেন । বিতর্কের পক্ষে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেন দোলনচাঁপা দাস পাল এবং বিপক্ষে আলোচনায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার লাভ করেন বাসব রায় । দলগতভাবে বিপক্ষে আলোচক দল ( ১৮৭/১৪৭ ) বিজয়ী বলে ঘোষিত হয় । এই বিতর্কসভার বিচারক ছিলেন এই প্রতিবেদক ও শাশ্বতী ভট্টাচার্য । সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কবি সুজিত দাস । এদিন সন্ধ‍্যার আগে শুরু হয় কবিতাপাঠ । এই পর্বে সঞ্চালনা করেন কবি অপাংশু দেবনাথ ও দোলনচাঁপা দাস পাল । সবশেষে আলোচনার মাধ‍্যমে স্থির হয় যে, উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম‍্যাগাজিনের আগামী সম্মেলন নাগাল‍্যন্ডের কোথাও অনুষ্ঠিত হবে । রাতে ধামাইল নৃত‍্য সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ‍্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে । রাতের খাওয়ার পর্বে ছিল বরাক অঞ্চলে বিশিষ্ট 'চুঙ্গাপিঠা' ও ক্ষীর । চুঙ্গাপিঠা অনেকটা ত্রিপুরার 'বাঙ্গুই'র মতো । তবে প্রস্তুতপ্রণালী আলাদা । বিরৈন ( বিন্নি ) চালের এইপিঠা ক্ষির সহযোগে মধুরেন সমাপয়েৎ বহুদিন মনে থাকবে । গোটা সম্মেলনেই যেন লোকসাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে ধ্রুবপদের মতো জড়িয়ে দিয়েছেন বরাক নন্দিনীরা । এই সম্মেলন এ অঞ্চলে ভীষণ সাড়া জাগিয়েছে । সম্মেলনস্থলে  লিটল ম‍্যাগাজিন বিষয়ে প্রজেক্ট তৈরি করার জন‍্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌসুমী বৈষ্ণব, রাখি চক্রবর্তীসহ একদল ছাত্রী । সম্মেলনে আকৃষ্ট হয়ে 'কথা-বিকল্প নামে সংসথার মন্দিরা নাথ, দীপ ভট্টাচার্য ও রাজদীপ দাস প্রত‍্যেক লিটল ম‍্যাগাজিন সম্পাককে একটি করে ক‍্যালাঞ্চু ফুলের চারা ও এক প‍্যাকেট 'বিরৈন' চাল উপহার দিয়েছে ।

এক একটি সম্মেলন আমাদের সমৃদ্ধ করে । সম্মেলন থেকে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি । নবম সম্মেলনও  আগামীদিনের জন‍্য অবশ‍্যই দিশারী হয়ে উঠেছে । উত্তর পূর্বের বিভিন্ন অংশে বাংলাভাষা ও সাহিত‍্যের চর্চার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ‍্যে কাজ করে যাচ্ছে যে সংগঠন সেই উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম‍্যাগাজিনের কোনো স্থায়ী সংগঠন নেই । ফলে বেশ কিছু সময়ের ব‍্যবধানে এই সম্মেলন হয়ে থাকে । কখনো কখনো স্থানীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে বৎসরান্তেও সম্মেলন করা সম্ভব হয় না । সেকারণে কোনো সম্মেলন করার প্রাক্কালে সঠিক সময়সূচী অনুসরণ করার জন‍্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করা দরকার ।  অনুষ্ঠানসূচীতে লিটল ম‍্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনার পরিধি আরো বাড়ানো দরকার । কারণ এই অঞ্চলে লিটল ম‍্যাগাজিন প্রকাশনার সমস‍্যা, সংকট, লেখালেখির গতিপ্রকৃতি, বিপনন ইত‍্যাদির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা দরকার । 'সম্পাদকের বৈঠক' শুধু মঞ্চে উপস্থিতি জাহির করা নয় । নিজেদের সমস‍্যা, সংকট ও নিরসনের উপায় নির্ধারণেও  খোলামেলা ভাব বিনিময়ের ব‍্যবস্থা করা দরকার । গল্পপাঠের ক্ষেত্রেও প্রতিনিধিস্থানীয় কবিদের রাখলে সময়ের সাশ্রয় হয় । এক্ষেত্রে অগ্রজ কবিদের তুলনায় তরুণ কবিদের বেশি করে সুযোগ দেওয়া দরকার । এর ফলে সময়টাকেঝঞ যথাযথ ব‍্যবহার করে লিটল ম‍্যাগাজিনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব । পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে এই সংগঠনের স্থায়ী কোনো কমিটি নেই । এবারের সম্মেলনে আলোচনাকালে কবি দিলীপ দাস একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন । এই প্রস্তাবকে নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে । এই কমিটির সদস‍্যরা দূরদূরান্তে থাকলেও বর্তমান তথ‍্য-প্রযুক্তির যুগে ভার্চুয়াল মোডেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন । কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । নির্দিষ্ট সময়ান্তরে সম্মেলন সাপেক্ষে বিভিন্ন রাজ‍্যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনাচক্র, গল্প-কবিতপাঠের আসর করা যায় । প্রতিবেশী রাজ‍্যের প্রতিনিধিদেরও রাখা যায় । এভাবে কম খরচে লিটল ম‍্যাগাজিন চর্চার জারি রাখা যায় । এছাড়া ওয়েবিনারের মাধ‍্যমেও তা করা । তার জন‍্যে শুধু একটা ভার্চুয়াল প্ল‍্যাটফরম দরকার । এব‍্যাপারে অধ‍্যাপক সুশান্ত করসহ আরো অনেক অভিজ্ঞজন রয়েছেন । তাঁরা সাহায‍্য করতে পারেন । লিটল ম‍্যাগাজিন সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখন্ডের কবি-সাহিত‍্যিকদের যেমন আমন্ত্রণ জানানো হয় তেমনি পূর্বোত্তরের আসাম সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ থেকেও প্রতিনিধিস্থানীয়দের আমন্ত্রণ করা যেতে পারে । এভাবেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও রূপায়ণের মাধ‍্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করার সাথে এই লেখালেখিরও আরও উৎকর্ষ সাধন সম্ভব ।

Saturday, January 14, 2023

মায়াবয়ন

মায়াবয়ন
———---———————
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
—————————————
জমানো পাতাগুলো উল্টে যেতেই হয় সামনের দিকে
ট্রাফিকনিয়মে দাঁড়ালেও থেমে থাকা যায় না
পেছনে নিঃশ্বাস ফেলে অগুনতি দ্রুত আরোহী
ফেলে আসা পথের ধুলো কখন হাওয়ায় উড়েছে
মুছে যায় সমস্ত মায়াচিহ্ন ফেরা তো যায় না

পেছনে মুছে গেছে আমার পায়ের কোমল দাগ
সমানে সামনে পা ফেলে আমি নিজেকেই হারাব 
 একদিন ৷ যেদিনের সংকেত জানা নেই আদৌ ৷

Tuesday, January 10, 2023

শ্রীমান ও শ্রীমতী

শ্রীমান ও শ্রীমতী

Chayan Saha বাংলা নামের আগে সৌন্দর্যসূচক 'শ্রী' ব্যবহার করা হয় । শ্রী যোগ করা হয় তাই শ্রীযুক্ত । আর এই শ্রী ব্যবহারের মধ্যেও একটা স্তরবিন্যাস রয়েছে । বয়স্কদের ক্ষেত্রে 'শ্রীযুক্ত' ( পুং ), 'শ্রীযুক্তা' ( স্ত্রী ) ব্যবহার করা হয় । সন্তানসম/সমাদের ক্ষেত্রে 'শ্রীমান' ( পুং ), শ্রীমতী ( স্ত্রী ) ব্যবহার করা হয় । পরবর্তীকালে এই 'শ্রীমতী' ব্যবহারের মধ্যে পরিবর্তন আসে । একমাত্র বিবাহিত কন্যা বা মহিলার ক্ষেত্রে 'শ্রীমতী' শব্দটি ব্যবহার হতে থাকে । মূলত অর্থসংকোচের ফলে এই ব্যাপারটি ঘটে । আর অবিবাহিত কন্যা বা মহিলার নামের আগে 'কুমারী' ব্যবহারের রেওয়াজ চলে আসে । কিন্তু অবিবাহিত ছেলে বা পুরুষের বেলায় 'কুমার' বসে না । বলে রাখা ভালো, সব মা-বাবার কাছে সন্তান বুড়ো হয়ে গেলেও সে শিশু । তাই বয়স্করা তাঁদের সন্তানসম বয়স্ক পুরুষকে 'শ্রীমান' অমুক বলেই পরিচয় দেন । শৌভিক স্যর তোমাকে 'শ্রীমান চয়ন' বলেই পরিচয় দেবেন  আরো বহুবছর পরেও । মোদ্দা কথা হল কিশোর বয়সীর ক্ষেত্রে 'শ্রীমান' ও কিশোরীর ক্ষেত্রে 'শ্রীমতী' হবে । তাই তো  আমাদের সাহিত্যের চিরন্তনী নায়িকা ষোড়শী রাইকিশোরী 'শ্রীমতী' রাধিকা । সম্ভবত ভুলটার শুরু এখানেই । ষোড়শী কিশোরী শ্রীমতী রাধারানি বিবাহিতা হওয়ায় কেউ হয়তো ভেবে ফেলেছিলেন শুধুমাত্র বিবাহিতা হলেই নামের আগে 'শ্রীমতী' বসবে । ব্যাকরণগত ভুলটা খেয়াল করেননি । সেটাই প্রচলিত হয়ে গেল ।

Friday, December 30, 2022

খেজুরগাছের হাঁড়ি বাঁধো মন

খেজুরগাছে হা‍ঁড়ি বাঁধো মন....


অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছয়ঋতুর লীলাবিলাসের মধ‍্য দিয়েই গড়িয়ে যায় মানবজীবন । এই চক্রেরই একটা ঋতু শীতকাল । শীতকালে দরিদ্র মানুষের জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় । প্রতিটি হিমের রাত তাদের জন‍্যে যন্ত্রণা বয়ে আনে ।  কিন্তু তার বিপরীতে শীতের ইতিবাচক দিকও রয়েছে । শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম সব্জীতে কৃষিক্ষেত্র উপচে পড়ে ।  শীতের আর একটা আকর্ষণ হল খেজুরের রস । গ্রামজীবনে শীতের সঙ্গে খেজুরের রসের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । শীতের মরসুমেই গ্রামে গ্রামে ভোরবেলা গৃহস্থের ঘরে ঘরে বাংলার গৌরবের আর ঐতিহ‍্যের প্রতীক  খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের ধুম পড়ে যায় । এই মধুবৃক্ষের রস দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পায়েস, পিঠেপুলি, নলেনগুড় ইত‍্যাদি ।

একসময় অভিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরা ছিল খেজুর রসের ভান্ডার । সেসময়ে প্রায় প্রত‍্যেক বাড়িতেই দুচারটে খেজুরগাছ তো অবশ‍্যই ছিল । প্রায় বাড়ির সীমানা এলাকায়, খেতের আলের উপর খেজুরগাছ অবশ‍্যই শোভা পেত । আসাম-আগরতলা জাতীয় সড়কের প্রায় সবটাতেই রাস্তার দুপাশের ঢালগুলোতে একসময় খেজুরগাছ দেখতে পাওয়া যেত । বিশেষ করে দক্ষিণ দিক থেকে বাসে করে যাওয়ার সময় মাতাবাড়ি পেরুলে উদয়পুর শহরে প্রবেশের আগে রাস্তার বাঁদিকে শুকসাগর জলা । বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ । এই মাঠে প্রচুর খেজুরগাছ দূর থেকে দেখা যেত । কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজ‍্যের প্রায় সর্বত্রই খেজুরগাছ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেছে ।

  খেজুররসের একটা মিস্টি গন্ধ একসময় সকালসন্ধ‍্যা গ্রামের পরিবেশ মাতিয়ে রাখত । গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই খেজুরের রসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ত । ঘরে তৈরি নানারকম পিঠেপুলি খেজুরের রসে ডুবিয়ে খাওয়া হত মহানন্দে । খেজুরের রস একটি জনপ্রিয় পানীয় । সন্ধ‍্যাবেলা আর ভোরবেলার কাঁচা রস খাওয়ার আগ্রহ ছিল প্রত‍্যেকের । বিশেষ করে 'সন্ধ‍্যারস'র স্বাদ ছিল অনবদ‍্য । খেজুরের রস থেকে ঝোলাগুড়, দানাগুড়, পাটালি বা নলেনগুড় তৈরি হয় । আজ সে আনন্দ হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরগাছের অভাবে এবং খেজুর রস সংগ্রহের দক্ষ শ্রমিক বা গাছির অভাবে ।

খেজুরগাছ প্রায় পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে শুরু করে পঁচিশ ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দিয়ে থাকে । গাছ যত পুরোনো হয় গাছের রস দেওয়ার ক্ষমতা তত কমে আসে । তবে পুরোনো গাছের রস তুলনামূলকভাবে বেশি মিস্টি হয় । সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি থেকে খেজুরগাছ কাটা শুরু হয় এবং এই গাছকাটা পর্ব ফাল্গুনমাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে । বলাবাহুল‍্য শীত যত বাড়ে খেজুরগাছ থেকে রস তত বেশি ঝরে । রসের স্বাদও মিস্টি হয় । এই শীতকালের মধ‍্যে যেদিনের আকাশ মেঘলা থাকে সেদিনের রস ঘোলাটে হয় । রস ঝরেও কম । রসের স্বাদওততটা ভালো হয় না । মূলত পৌষ ও মাঘ মাস খেজুরের রসের ভরা মরসুম ।

খেজুরগাছ থেকে রসসংগ্রহ অত‍্যন্ত দক্ষ শ্রমিকদের কাজ । গ্রামদেশে এই শ্রমিকদের 'গাছি' বলা হয় । কোথাও কোথাও এদের 'শিউলি'ও বলা হয়ে থাকে ।  রস সংগ্রহের মরসুম আসার প্রাকমুহূর্তে এই গাছিরা ছেনি, বাটালি, বাঁশের নলি, কাঠি, হাঁড়ি, দড়ি ইত‍্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । অত‍্যন্ত ধারালো ছেনি-বাটালি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে খেজুরগাছের পাতাযুক্ত ডালাগুলো কেটে ছেঁটে পরিষ্কার করে কান্ডের একটা অংশ রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলেন । এই কাজটাকে বলা হয় 'গাছ ছোলানো' । এই গাছ ছোলার সময় একটা দিক লক্ষ‍্য রাখেন দক্ষ গাছিরা । গাছ এমনভাবে ছোলা হয় যাতে গাছের কাটা অংশে ভালোভাবে রোদ পড়ে । তারজন‍্যে গাছের পূর্ব ও পশ্চিমদিকে পর্যায়ক্রমে কাটা হয় । খেজুরগাছ কেটে তা থেকে রস সংগ্রহ কয়েকটি পর্যায়ের মধ‍্য দিয়ে চলে । গাছ ছোলার পর প্রথম কয়েকদিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় না ।কাটা অংশে রোদ লাগানো হয় । তারপরে কাটা অংশের দুধার ধরে  ইংরেজি 'V' অক্ষরের মতো সরু নালির মতো করে কেটে নিচের দিকে এক জায়গায় মিলিয়ে দেওয়া হয় । সেখানে সরু বাঁশের টুকরো নলের মতো করে গেঁথে দেওয়া হয় । ওপরে গাছের ডগায় কলসিতে বাঁধা দড়ি আটকিয়ে নিচে কলসি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় । সারারাত গাছ থেকে চুয়ানো রস নল বেয়ে হাঁড়ির ভেতর জমা হয় । সকালবেলা সেই রস সংগ্রহ করা হয় । পর্যায়ক্রমে সংগৃহীত এই রসের কয়েকটা নাম রয়েছে । প্রথমদিনের রস 'জিরান্তিরস' বা 'জিরানকাটার রস' , দ্বিতীয়দিনের রস 'দোকাটা' । তৃতীয়দিনের রস 'তেকাটা' । পরপর তিনচারদিন রস সংগ্রহের পর দু-তিনদিনদিন গাছ শুকানোর জন‍্য গাছকাটা বন্ধ রাখা হয় । এই পর্যায়কে 'জিরান্তি' বলা হয় । তারপর আবার কাটা শুরু হয় । 'জিরান্তিরস' বা 'জিরানকাটার রস' খুবই সুস্বাদু হয় ।

খেজুরের রসকে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় গুড় । খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার ফলে এক পর্যায়ে রস ঘন হয়ে পাওয়া যায় ঝোলাগুড় । অঞ্চলভেদে একে 'লালি' বা 'রাব'ও বলা হয় । ঝোলাগুড়কে আরো কিছুসময় জ্বাল দেওয়ার পর পাওয়া যায় 'দানাগুড়' । এই দানাগুড়কে আরো কিছুসময় জ্বাল দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান ঘন করে নেওয়ার পর নানা আকৃতির পাত্রে সংগ্রহ করা হয় বা বিভিন্ন রকম ছাঁচে ঢেলে নেওয়া হয় । একে বলে 'পাটালি' বা 'নলেন গুড়' । একসময় গাঁঘরে এই গুড় তৈরি ক্ষুদ্র শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল । ত্রিপুরার উদয়পুর-বিলোনিয়া-সাব্রুমের প্রায় প্রতি ঘরে খেজুরের গুড় তৈরি হয় শীতকালে । বিশেষ করে উদয়পুরের জামজুরি ও খিলপাড়ার খেজুরগুড় ছিল রাজ‍্যে বিখ‍্যাত । স্থানীয় এটি প্রবাদ রয়েছে–'জামজুরির যশ । খাজুরের রস' ।

খেজুর, খেজুরের রস আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে । লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় খেজুর, খেজুরের রসের উপস্থিতি রয়েছে । খেজুর গাছ কাটা নিয়ে আঞ্চলিক গান রয়েছে― 'ঠিলে ধুয়ে দেরে বউ গাছ কাটতে যাব/সন্ধ‍্যের রস ঝাড়ে আনে জাউ রান্ধে খাব' । বাংলা প্রবাদ-প্রবচনেও আমরা খেজুর বিষয়টি পাই । যেধরনের আলাপ প্রাসঙ্গিক নয় । শ্রোতাদের বিরক্তির উৎপাদন করে, মিথ‍্যা, অবান্তর এবং হাস‍্যরসাত্মক মনে হয় সেজাতীয় আলাপকে 'খেজুরে আলাপ' বা 'খাজুইরগা আলাপ' বলা হয় । চূড়ান্ত অলস বোঝাতে 'গোঁফ-খেজুরে' প্রবচনটি ব‍্যবহার করা হয় । খেজুর গাছের তলায় শুয়ে থাকা ব‍্যক্তিটির গোঁফের উপর পাকা খেজুর পড়েছে, কিন্তু সে এত অলস যে ভাবছে সেটাও মুখে চিবিয়ে খেতে হবে । কত কষ্টকর বিষয় । কতটা পরিশ্রমের ! বাংলা লোকসাহিত‍্যে আর একটা অমূল‍্য সম্পদ ধাঁধায় ও খেজুর গাছের প্রসঙ্গ রয়েছে । 'মাইট্টা গোয়াল কাঠের গাই/বাছুর ছাড়া দুধ পাই' অথবা 'মাটির হাঁড়ি কাঠের গাই/বছর বছর দোয়াইয়া খাই' ।–( খেজুর গাছ ) । এমনি নোয়াখালির একটি ছদ্ম-অশ্লীল ধাঁধায় পাই–'দোম্বাই যাই জাপটাই ধরি/করে টানাটানি/মৈদ্দ আনে খিলি মাইচ্ছে/ভিৎরে হড়ে হানি' ।–( খেজুর গাছ থেকে রস পড়া ) । আমাদের নানা স্থাননামেও খেজুরপ্রসঙ্গ রয়েছে । খেজুরগাছের প্রাচুর্যের কারণে স্থানের নাম রয়েছে―খেজুরি (পশ্চিমবঙ্গ ), খাজুরা (যশোহর, বাংলাদেশ ), খেজুরবাগান ( আগরতলা, ত্রিপুরা ) । বিয়ের গানে রঙ্গরসিকতায় খেজুরকাঁটার উল্লেখ পাওয়া যায়–'বেয়াইরে বইতো দিয়ুম কি/খাজুর কাঁডার মোড়া বানাইয়ের/ বেয়াই বইতে লজ্জা কি ?/এমন মোড়াৎ বেয়াই/ কনদিন বইতা হাইরছনি ?' 

  খেজুরগুড় লোকঔষধরূপেও প্রচলিত । খেজুরগুড় হজমে সাহায‍্য করে । আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে । ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে । সর্দি-কাশি ও ভাইরাল জ্বরের হাত থেকে রক্ষা করে । দেহে হরমোনের সমতা বজায় রাখে । খেজুর গুড় প্রাকৃতিক চিনি বা ন‍্যাচারাল সুগার । আজকাল চিনির ব‍্যবহারের ক্ষতিকর দিক এড়ানোর জন‍্য প্রাকৃতিক চিনি বা স্টেভিয়া ইত‍্যাদির ব‍্যবহার চলছে । সেইক্ষেত্রে খেজুরের গুড়ের এই স্থান নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও  তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে । একসময় কাঁচা খেজুরের বিচি পানের সঙ্গে সুপারির বিকল্প হিসেবে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল । 

এছাড়া খেজূরের বিচি শিশুদের খেলার সামগ্রীও । তেমনি পাতা দিয়ে নানা খেলনা ও শিল্পোপকরণও তৈরি হয় ।  খেজুরগাছ পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান । বন‍্য ও গৃহপালিত পশুর হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন‍্য খেজুর পাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া হয় ।

খেজুর, খেজুরগাছ, খেজুরের রস কবিদের ও নজর এড়ায়নি । কবির ভাষায় পাই–'খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে/সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন জুড়াই সুবাসে' কিংবা 'এমন শীতল মিস্টি কোথায় আছে নীর/পানমাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর' । রস সবার আকাঙ্ক্ষার বিষয় । শীতের রস যেমন গ্রামজীবনে সবার মনে রসসঞ্চার করে তেমনি সাহিত‍্য ও সংস্কৃতিতেও 'রস' একটি বিশেষ নান্দনিক বিষয় । বৈষ্ণবশাস্ত্রে আমরা পঞ্চরসের সন্ধান পাই । শান্ত,সখ‍্য, দাস‍্য, বাৎসল‍্য ও মধুর বা উজ্জ্বলরস । তেমনি নাট‍্যশাস্ত্রেও রয়েছে নবরস । শৃঙ্গার, হাস‍্য, করুণ, রুদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্তরস । তেমনি বাংলার বাউলদের গূঢ় সাধনায়ও রয়েছে রসপর্যায় । বাউলদের সাধনা রসের সাধনা । দেহকে কেন্দ্র করে বাউলদের সেই গোপন সাধনা । নারীকে নিয়ে তাঁদের সাধনপদ্ধতি এগিয়ে যায় । বাউলদের মতে রজ, বীর্য ও রসের কারণে এই দেহের সৃষ্টি । এগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেই তার দেহসাধনা ।সেটাকে বাউলরা বলেন 'বস্তুরক্ষা' । বস্তুরক্ষা তাঁদের ধর্ম । বাউলদের হেঁয়ালিপূর্ণ গানেও রস শব্দটি পাওয়া যায় প্রায়শই । 'রস' তাদের পরিভাষা । বাউলদের গান বুঝতে হলে তাদের পরিভাষা বুঝতে হয় । পরিভাষা ব‍্যবহার করে বাউলদের গানের মধ‍্যে তাদের সাধনপদ্ধতির গোপন ইঙ্গিত থাকে । খেজুরগাছ, খেজুররস তাদের গানের মধ‍্যে তাই ব‍্যবহৃত হয় । ভবা পাগলার গানে পাই–
 খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/ও গাছে জোয়ার আসিলে/ও গাছ কাটো কুশলে/কোনার দড়ি যেন পড়ে না তলে/কত গ‍্যাছো গ‍্যাছে মারা/নীচে পড়ে হয় মরন ।
আর একটি বাউল গানে আছে–
আমার গোঁসাইরে নি দেখছ খাজুর গাছতলায়/গোঁসাই ল‍্যাজ লাড়ে আর খাজুর খায়।
আবার অন‍্যত্র পাই–
যদি রস খাবি মন নলিন দানা/গাছে ভাঁড় বেঁধে দেনা বেঁধে দেনা ।

বাংলা কথাসাহিত‍্যের অসাধারণ রূপকার কথাসাহিত‍্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি অসাধারণ ছোটোগল্প 'রস' । খেজুরের রস ও গুড় তৈরির পেশায় নিযুক্ত গাছি মোতালেবের প্রেম ও দাম্পত‍্যজীবনকে ঘিরে অন্তর্দ্বন্দ্বময় জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে এই গল্পে । একটি সাধারণ ঘটনা সাহিত‍্যিকের কলমের যাদুতে কিভাবে রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে এ গল্প তার উজ্জ্বল উদাহরণ । এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র  গাছি  মোতালেব । তার নারীভোলানোর অসীম ক্ষমতা । এই গুণের কারণে সে সফল প্রেমিক । তার ছলনায় ধরা দেয় ফুলবানু-মাজু । এই দুই নারীকে ঘিরে তার পেশাগত জীবন ও জৈবিক তাড়না আবর্তিত হয়েছে । লেখক সময়ের প্রবাহে তুলে ধরেছেন খেজুরের রস, মোতালেব-ফুলবানু-মাজুর সংসারযাপন, কল্পনা-কামনা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ইত‍্যাদি । সমাজের এক নিবিড় ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কলমের ছোঁয়ায় ।

 এই গল্পটিকে হিন্দি চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়েছে । সেখানে অমিতাভ বচ্চন অসাধারণ অভিনয় করেছেন ।

একসময় গ্রামের যত্রতত্র বিনা পরিচর্যায় বেড়ে উঠত এই মূল‍্যবান খেজুরগাছ । বলা হয়ে থাকে, এই খেজুরগাছের জন্ম আরবে । তা সত্ত্বেও কালক্রমে বাংলা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ হয়ে ওঠে এটি । কিনতু বর্তমানে নানাকারণে এই মধুবৃক্ষ দিনদিন কমে আসছে । তার পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ‍্যে প্রধান হল–

ক ) পরিবেশ দূষণ ও নগরায়ণের ফলে ভূমির গঠনগত পরিবর্তন
খ) রাস্তাঘাট প্রশস্ত করতে গিয়ে নির্বিচারে খেজুরগাছ কেটে ফেলা
গ) জ্বালানি হিসাবে খেজুরগাছ কেটে ব‍্যবহার
ঙ ) মানুষের নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মানের ফলে খেজুরগাছ কাটা
চ ) দক্ষ গাছির অভাব ও বর্তমান গাছিদেরও রস সংগ্রহে আগ্রহের অভাব 
ছ) খেজুরের রস সংগ্রহের সময় বাদুড়, চামচিকেজাতীয় প্রাণী খেয়ে যাওয়ার ফলে নিপা ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হবার ভয় ইত‍্যাদি ।

কিন্তু এই বৃক্ষটি বৈজ্ঞানিকভাবে চাষ ও পরিচর্যা করলে তার উৎপাদিত ফসল গ্রামীন অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে । এ ব‍্যাপারে সরকারের বন ও উদ‍্যান দপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প এবং সামাজিক বনায়ণ কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করা যেতে পারে ।