Sunday, December 30, 2018

কুম্বলা/কুম্বুলা, একটি লৌকিক শব্দ

রান্নাঘরের একপাশে জলের কলসি রখার স্থান ৷ মূল শব্দ 'কুম্ভস্থল' ৷ কুম্ভস্থল>কুম্ভথল>কুম্ভঅল>কুম্ভল>কুম্বল>কুম্বলা/কুম্বুলা এইভাবে পরিবর্তিত হয়েছে শব্দটি ৷ গ্রামাঞ্চলে এখনও রান্নাঘরের একপাশে এই জিনিসটি দেখা যায় ৷ এটি মাটির তৈরি উঁচু বেদীবিশেষ ৷ অনেকটা তুলসীবেদীর মতো ৷ তবে ধারের দিকে কোনো ধাপ থাকেনা ৷ সরাসরি উপরের দিকে উঠে যায় ৷ বেদীর গোড়ার দিক থেকে উপরের দিকটা কিঞ্চিৎ সরু ৷ উপরিতলটা দেখতে অনেকটা উল্টো করে রাখা জলচৌকির  চারটে পায়ার মতো খাঁজ করা ৷ পর পর গড়ে তোলা লম্বা বেদীর এই খাঁজগুলোতে কলসি সাজিয়ে রাখা হয় ৷ একসময় এই মাটির বেদীর দেয়ালে নক্সা করেও রাখা হত ৷ উল্লেখ্য এই কুম্ভস্থল নোয়াখালি, চট্টগ্রাম অধ্যুষিত জনপদেই পরিলক্ষিত হয় ৷ বর্তমানে এই ব্যবস্থা অবলুপ্তির পথে ৷ এটাও আমাদের লৌকিক ঐতিহ্যের নিদর্শন ৷

Wednesday, December 26, 2018

আঙুল

আঙুল কেটে কলম বানিয়ে যে রক্তের আখর লিখেছো প্রান্তিক কবি
তার পাঠ হবে কোন পাঠশালায়
কবে আর সেই পাঠ নিয়ে ভূমধ্যরেখার দুই পাশে বানাবো বিনম্র বাগান ৷ যেখান থেকে ফোটা ফুলের সৌরভ ছড়াবে দশদিগন্তের
পাতার কুটির থেকে আকাশমিনারে

কবির আঙুল কবে যে নির্দেশক হয়ে উঠবে প্রেমের পদাবলিতে

Monday, December 24, 2018

সময় গেলে সাধন

অভিমানী পাখি উড়াল দেওয়ার পর
মুর্শিদ  খাঁচার খোলা ঝাঁপের সামনে দাঁড়িয়ে ময়নাতদন্ত করেন

মুর্শিদ তত্ত্বকথা ঘেঁটে দৈবশব্দ নিঃসরণ করেন, খাঁচাটা সোনার ছিলনা ৷

আহা, কী কী অপূর্ব কথন
'মহিম বাতাস কর' ৷

Friday, December 14, 2018

হটিকীর্তন

শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে শ্রাদ্ধবাসরে গীত যমকীর্তন আর আমাদের হটিকীর্তন দুটোরই পরিবেশন প্রক্রিয়া ভিন্ন ৷ কিন্তু একই উদ্দেশ্য ফল্গুধারার মতো অলক্ষ্যে প্রবাহিত ৷ গোষ্টলীলার বিষয়বস্তুতে যেমন মায়ের সঙ্গে সন্তানের ক্ষণিক বিচ্ছেদবেদনার আবহ রয়েছে তেমনি নিমাইয়ের সন্ন্যাসযাত্রাও এক বিচ্ছেদবিধূর কাহিনি ৷ তেমনি ভাগ্যদোষে রাজা হরিশ্চন্দ্রেরও স্ত্রীপুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্মশানচন্ডালের জীবিকায় দিনযাপনও বেদনাঘন ৷ শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এই পালাগুলো নির্বাচনের মধ্যেও অনির্দেশের পথে চলে যাওয়া প্রিয়জনের জন্যে বেদনার সুরটিই ধ্বনিত ৷ সেই বেদনার প্রকাশের প্রতীকী রূপ এই জাতীয় সংগীত ৷ স্থান ভেদে প্রকাশভঙ্গি হয়তো আলাদা কিন্তু অভিপ্রায় এক ৷

Thursday, December 13, 2018

দুটি কবিতা

হিমঘর
-------------------------------------
অঘ্রাণবিধূর কুয়াশাপিয়ানো,  তোমার করুণ মূর্ছনায় আমাকে কাঁদিও ৷

কোমল ঝরনার স্বচ্ছ গভীরের নুড়ির চলন যেন দিকভুল
করে থমকে যায়

নোঙর
-------------------------------------------

সামনে খ্রিস্টমাস ৷
দিঘল ছায়ার গীর্জা মূক হয়ে আছে
ঝাউবনের পাশে ৷
বাতাস হিমস্নান মিশিয়ে পথ খুলে রেখেছে
কুমারী মেরির জন্যে ৷

ভালোবাসাভর্তি একটা নৌকো
সহসাই নোঙর করার কথা

দুখি মানুষ সব, পারে এসে দাঁড়াও

Wednesday, December 12, 2018

সাপকথা


সাপ অথবা সাপিনী  সকলেই গহ্বরগামী
সকলেই রোদে পিঠ দিয়ে রামধনু রঙ ঠিকরে দেয়
মনে হয় ওদের ঈর্ষা আর ক্রোধ ক্রমাগত
থেমে আসে শীতের হিমকাতর ঋতুচুমুতে

আগাম হিমের সংকেত বোঝে এইসব সরীসৃপ
তাই কন্দরের সন্ধানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে
যেহেতু ছলম পাল্টাবার পর শরীর নাবাল হয়
অস্ফুট বাগদান সেরে নেয় উষ্ণ ভূতাপে

আগামী বসন্তে যুগনদ্ধ হবার সাধ লালন করে পরস্পর

Thursday, December 6, 2018

আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে ৷ বিলোনিয়াতে ট্রেনে চড়ার ৷ উনিশ শো তিয়াত্তর সাল ৷ আমি তখন বিলোনিয়া কলেজে পড়ি ৷ মাত্র কদিন আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৷ একদিন আমরা কলেজের প্রায় ত্রিশ জন ছাত্র কলেজ ফাঁকি দিয়ে এপারের বিলোনিয়া সীমান্ত পেরিয়ে ওপারের বিলোনিয়া স্টেশনে পৌঁছাই ৷ সেখানে একটা বড়ো কুলগাছ ছিল ৷ সবাই মিলে গাছের কুল ধ্বংস করার পর  রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে ফুলগাজি বাজারে গিয়ে উঠি ৷ আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন মানিকদা, মানিক মুহুরী ( চৌধুরী) ৷ তাঁর তখন খুব জনপ্রিয়তা ৷ বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনি এপারের যুবশক্তির আইকন  ৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন নানাভাবে ৷ ফলে ওপারের লিডারদের তিনি শ্রদ্ধা ও স্নেহের পাত্র ছিলেন ৷ আমরা যখন দল বেঁধে মানিকদার সঙ্গে পরশুরাম বাজারে পৌঁছাই তখন সেখানকার আওয়ামি লিগের নেতারা মানিকদা ও আমাদের দারুণভাবে আপ্যায়ণ করেন ৷ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা ট্রেনে চড়ে আমাদের সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের বিলোনিয়া স্টেশনে এসে নামি ৷ তখন ট্রেনের ইঞ্জিনটা সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ড ঘেঁষে থামত ৷ আমরা এপারের বাঁধের উপর থেকে এ দৃশ্য দেখতাম ৷ তার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত ট্রেন এখানে আসত ৷

Wednesday, November 28, 2018

স্বপ্ন

এটিএমের কিউমুখী কবিতা
হাঁপিয়ে উঠলে হাওয়ামিঠাই
রঙচঙে ও লোভনীয় হয়ে ওঠে

যেমন ব্রেক আপ মিটমাট হলে
জলদাপাড়া কিংবা কাজিরাঙা
যেখানেই যাই ঝালাই মিস্ত্রিরা
বখশিসের হাত বাড়িয়েই রাখে ৷

Tuesday, November 6, 2018

বিলোপ

এভাবেই মুছে যাই, মুছে যেতে হয়
যারা ভালোবাসে আর কাছে টেনে নেয়
তাদেরই কেউ কেউ মুছে ফেলে আমাকে
আর অন্য যারা ভাসমান দোনামনায় আছে
তারাও অবসরবিনোদনের কালে পাঁজিপুথি দেখে
খুঁজছে মাহেন্দ্র কিংবা অমৃতযোগ
কখন ছেঁটে ফেলা যায় আমাকে

এইসব মোছামুছি আর ঘষাঘষির ফলে
আমার শরীরে এখন চুম্বনচিহ্নের মতো
শুধু ফ্যাকাশে ইরেজারের ঘষটানো দাগ

Saturday, October 27, 2018

নদীকথা

বহুদিন দেখিনা এই দৃশ্য ৷ একসময় ত্রিপুরার প্রতিটি নদীপথে এ ছিল নিত্য দিনচিত্র ৷ সাবেক উত্তর ত্রিপুরায় এই পদ্ধতিতে বাঁধা বাঁশের সারিকে বলা হত 'ছুরুঙ্গা' ৷ আগরতলা- উদয়পুর সন্নিহিত অঞ্চলে একে বলা হত 'চালি' ৷ আর দক্ষিণ ত্রিপুরায় বাঁশ পরিবহনের এই পদ্ধতিকে বলা হত 'খাতুনি' ৷

Friday, October 26, 2018

গান

বেদনাআসমান থেকে বিষন্ন তারারা আঁধাররাতের শিউলি হয়ে গেল ৷ ঝরাবেলার গান সন্ধ্যাসিঁদুরের স্বপ্নওমের জন্যে ডুকরে ওঠে ৷ ফুরন্ত সূর্যাস্তচরাচর দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে দেয় ব্যর্থচুমুর শেষদাগের আদলে ৷

যেখানে রেখেছ হৃদয় সে যেন প্রশ্রয়ে থাকে
চিরপদাবলি পুরাণপ্রত্যাশায় একা জেগে থাকে ৷

Friday, October 19, 2018

স্বীকার্য

উত্তরের কথা যদি বলো তুমি আমি যাবো দক্ষিণে 
জল যদি সামান্য গড়ায় আমি বসতে পারি না
জল যদি উঠোনে গড়ায় আমি দাঁড়াতে পারি না
জল যদি পথে গড়ায় পারি না আমি এগোতে
আর জল যদি ভূখন্ড ভাসায় আর
হৃদয়ে যদি নতুন বাঁক আনে গড়ানো জল
তখন কোথায় যাবো, বলো ফুলসই?

উত্তরের কথা বলো যদি তুমি আমি যাবো রাই দক্ষিণে ৷

Thursday, October 18, 2018

ইতিহাস ও কিংবদন্তীর আলোকে পিলাক ও সন্নিহিত প্রত্নক্ষেত্র

          অশোকানন্দ রায়বর্ধন

            ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ ত্রিপুরা অংশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ জনপদ ছিল ৷ সময়ে সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ত্রিপুরার রাজারা, রাজপরিবারের সদস্যরা কিংবা রাজা কর্তৃক নিয়োজিত বিভিন্ন রহ

রাজপুরুষগণ  বসতি স্থাপন করে রাজকার্য পরিচালনা করে গেছেন ৷ কোনো কোনো সময় মাণিক্য রাজারা ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠীর লোকজনও এখানে রাজত্ব করেছেন বা বসতি স্থাপন করেছেন ৷ বর্তমানে বিলোনিয়া, সাব্রুম ও শান্তিরবাজার নিয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা ৷ এই জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও  প্রচুর ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে ৷ যে ইতিহাস আজও উন্মোচিত হয়নি ৷ যাও সামান্য আলোচনায় এসেছে তাও সম্পূর্ণ নয় ৷ এখনও বহু অনালোচিত, অনালোকিত রয়ে গেছে ৷ কিছু কিছু ঐতিহাসিক উপাদানের ও প্রত্ননিদর্শনের উপর আলোচনা হয়েছে যা বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো ৷

             বিলোনিয়া মহকুমার বিস্তীর্ণ জনপদ দীর্ঘকাল যাবত অনেক বেশি সমৃদ্ধ ৷ মহকুমা শহর বিলোনিয়াকে কেন্দ্র করে তার তিনদিকে বিস্তীর্ণ জনপদ ছড়িয়ে রয়েছে ৷ পশ্চিম দিকে পশ্চিম পাহাড় ও দক্ষিণে বিস্তৃত নলুয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই মহকুমার বিস্তৃতি ৷ সম্প্রতি তার পূর্বাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে শান্তিরবাজার মহকুমা ৷ বিলোনিয়া ও শান্তিরবাজার মহকুমার মাঝ বরাবর ও সাব্রুম সীমান্তসংলগ্ন অংশ জুড়ে রয়েছে ‘টাক্কা তুলসী’ পাহাড় স্থানীয় ভাষায় ‘ তুলইস্সা টিলা’ ৷ এই টাক্কা তুলসী পাহাড়ে ও তার দুই পাশে ছিল প্রাচীন জনপদ ৷ ফলে এই পাহাড়ের এবং তার দুই পারে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থাকা অসম্ভব নয় ৷ রয়েছেও প্রচুর ৷ সমগ্র বিলোনিয়া বা শান্তিরবাজারকে নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করলে বিশাল তথ্যভান্ডার উন্মোচিত হতে পারে ৷

             বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা এই পাহাড়ের এবং তার দুই পাশের জনপদসমূহের প্রাচীনতা নিয়ে দুচারটি উদাহরণ তুলে ধরব ৷ ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে আমরা ত্রিপুরার প্রাচীন কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে  রাজমালা, শ্রেণীমালা, চম্পকবিজয়, কৃষ্ণমালা ও গাজীনামা ইত্যাদি গ্রন্থের আশ্রয় নিতে পারি ৷ এইসব প্রাচীন পুথিপত্রে মতাই, রাজনগর, মুহুরীনদী, লাউগাঙ, ফেনীনদীসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নাম পাই ৷ রাজন্য আমলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সোনামুড়া বিভাগের উপবিভাগ হিসেবে বিলোনিয়াতে রাজাদের একটি কার্যালয় গড়ে ওঠে ৷ এই সময় দক্ষিণের সাব্রুমসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিলোনিয়া উপবিভাগের অধীন ছিল ৷ পরবর্তী সময়ে উনিশশো দশ সালে সাব্রুমে আর একটি উপবিভাগ চালু হয় ৷

              ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ই়তিহাসে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যায় প্রাচীন রাজমালা গ্রন্থে ৷ এই গ্রন্থের শুরুতে কিছু পৌরাণিক অনুষঙ্গ দিয়ে ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের রাজত্বকালের প্রাচীনত্ব নিরূপনের প্রয়াস থাকলেও মোটামুটি মোগল শাসনামলের সময়কাল থেকে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় ৷ বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগের কাল থেকে পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বংলার সুলতানদের যুদ্ধবিগ্রহ,  সমঝোতা ইত্যাদির বিবরণ পাওয়া যায় ৷ পরবর্তী সময়ে ইংরেজ আমলের কথা ও ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসের তথ্য রাজমালায় রয়েছে ৷ পাশাপাশি প্রাচীন আরাকানের সাথে ত্রিপুরার রাজার সম্পর্ক, যুদ্ধবিগ্রহের কথাও এই গ্রন্থে পাওয়া যায় ৷

                  আশ্চর্যের বিষয় হল, মতাই, লাউগাঙ, ,মুহুরীনদী ইত্যাদি নাম রাজমালায় থাকলেও সন্নিহিত প্রাচীন জনপদ পিলাক সম্বন্ধে রাজ্যের প্রাচীন সাহিত্যসমূহ একেবারে নিশ্চুপ ৷ অথচ এখানে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজারা রাজত্ব করার কথা কোথাও কোথাও উল্লেখ রয়েছে পিলাক নামটি ব্যবহার না করে ৷ এটি একটি রহস্যময় ঘটনা ৷ অথচ দক্ষিণ ত্রিপুরার জোলাইবাড়ি সংলগ্ন ‘পিলাক’ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আকর ৷ একমাত্র ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণের ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্থে পিলাকের বিভিন্ন মূর্তি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে ৷ পরবর্তী সময়ে প্রিয়ব্রত ভট্টাচার্য, রত্না দাস, ড. জগদীশ গণচৌধুরী, ড. অনাদি ভট্টাচার্য,ড. রঞ্জিত দে, দীপক ভট্টাচার্য ও ড. আশিসকুমার বৈদ্য প্রমুখ গবেষকগণ পিলাকের উপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন ৷ দীপক ভট্টাচার্য লেখালেখির পাশাপাশি পিলাকের উপর একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্রও নির্মান করেন ৷ এর ফলে  আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় ৷ তারাও এই অঞ্চলে খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করেন ৷ একসময় রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এখানে পিলাক উৎসবেরও আয়োজন করা হয় ৷ পিলাক উৎসবের শুরুর সময় প্রকাশিত স্মরণিকায় এই প্রাবন্ধিকের ‘কিংবদন্তী ও স্থাননামে পিলাক প্রসঙ্গ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ৷ দুর্ভাগ্যবশত স্মরণিকার সেই সংখ্যাটি প্রাবন্ধিকের হাতে আসেনি ৷ সেই স্মরণিকাটি কোথাও সংরক্ষিত আছে কিনা তাও জানা যায়না ৷ সেই স্মরণিকায় বেশ কয়েকজন লেখকের বেশ কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ ছিল ৷ সেখানে এই প্রাবন্ধিক তাঁর সংগৃহীত একটি মগ কাপ্যা অর্থাৎ লোকসঙ্গীতের উল্লেখ করেছিলেন ৷ এই মগ লোকসঙ্গীতটিতে একটি করুণ লোককথা ছিল যা থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলে একসময় মগ জনগোষ্ঠীর ‘প্লেঙ’ শাখার রাজার বা গোষ্ঠীপতির রাজত্ব ছিল ৷ এই ‘প্লেঙ’ শব্দটির ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত রূপ— প্লেঙ> প্লেঙ্ক>পেলেক>পেলাক>পিলাক নামে পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে বলে এই প্রাবন্ধিক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ৷

             এই অঞ্চলের যে জনগোষ্ঠীকে ‘মগ’ বলে অভিহিত করা হয় তারা কিন্তু নিজেদের মগ পরিচয় অস্বীকার করেন ৷বরং তারা নিজেদের আরাকানি বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন ৷ এই আরাকনীদের বিভিন্ন গোত্র রয়েছে ৷ তার মধ্যে মূল আরাকানে যাঁরা বাস করেন তাঁরা নিজেদেরকে ‘রখঁইঙসা’ বা ‘রখঁইসা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন ৷ এই রখঁইঙসা’ বা ‘রখইঁসা’ থেকেই  রখঁই>রখঙ>রাহাঙ>রোসাঙ>রোহাঙ শব্দের উৎপত্তি ৷ আরাকানের প্রাচীন রাজবংশ ‘রোসাঙ’র নাম বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র মাত্রই জানেন ৷ এছাড়া তাঁদের আর একটি গোত্রের নাম ‘খিয়ঙসা’ বা ‘খ্যঙসা’ ৷ ‘খিয়ঙ’ বা ‘খ্যঙ’ শব্দের অর্থ হল নদী ৷ এবং ‘সা’ অর্থ সন্তান ৷ অর্থাৎ এই গোত্রের মানুষজন নদীতীরবাসী ৷ বিভিন্ন মগ জনপদে দেখা গেছে যে পাহাড়বেষ্টিত হলেও তাঁরা নদীতীরবর্তী অঞ্চলেই বসবাস করেন ৷ ফলে অনেকসময় নদীর নাম মিলিয়েই  তাঁদের গোত্র বিভাজন হয় ৷ এভাবে তাঁরা বিভিন্ন নদী-পর্বত ইত্যাদির নামে তাঁদের গোত্রের নাম রাখেন ৷

                    

                    বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলায় মগদের বিশাল জনপদ রয়েছে ৷ বাংলাদেশে তাঁরা মারমা ও রাখাইন নামে পরিচিত ৷ এই জেলায় বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে ৷ তার মধ্যে শঙ্খ ও মাতামুহুরী প্রধান ৷ মাতামুহুরী নদীকে মারমারা ‘মুহুরী সং’ বলেন ৷ শঙ্খ নদী উত্তর-আরাকান থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে বান্দরবন শহরের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ৷ শঙ্খনদীর উপরের অংশকে মারমারা ‘সাবক সঙ’ এবং বান্দরবন শহরের পার্শ্ববর্তী অংশকে ‘রাগ্রে সঙ’ বলেন ৷ বান্দরবন শহরের রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘রাগ্রেসা’ বলে পরিচয় দেন ৷ ‘রাগ্রে সঙ’ নদীর নামে ‘রাগ্রেসা’ ৷ ‘রাগ্রে সঙ’ মানে মারমাদের ভাষায় ‘স্বচ্ছ জলের নদী’ ৷ মারমারা যাকং ‘সঙ’ বলেন ( ক্ষ্যঙ>ক্ষঙ>ক্ সঙ>সঙ) তাকেই মগ জনগোষ্ঠী ‘খ্যঙ’ বলেন ৷  অঞ্চলভেদে উচ্চারণের পরিবর্তন সব ভাষাতেই লক্ষ করা যায় ৷ মগজাতির ইতিহাসে দেখা যায় যে, 1782 খ্রিস্টাব্দে মারাচি নামে জনৈক আরাকানি গোষ্ঠীপতি কয়েকশো সঙ্গীসাথী নিয়ে ‘প্লেঙ সঙ’ নামে নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে ব্রিটিশ অন্তর্ভুক্ত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন ৷ ‘প্লেঙ সং’ নামানুসারে খাগড়াছড়ি জেলার মারমা জনগোষ্ঠীর নাম হয়েছে ‘প্লেঙসা’ ৷ তাদের বসতি এলাকার নাম ‘প্লেঙ থঙ’ ৷ ‘থঙ’ বলতে মারমা বা মগরা আবাসস্থল বোঝেন ৷ উল্লেখ্য বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় শহর সংলগ্ন একটি ছড়া আছে ৷ যেই ছড়াটির নাম ‘পিলাক ছড়া’ ৷ এই তথ্যটি বাংলাদেশের অগ্রণী দৈনিক ইত্তেফাকের রামগড় প্রতিনিধি বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব নিজাম উদ্দীন লাভলু সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রতিবেদককে জানান ৷ পার্শ্ববর্তী দেশের একজন নাগরিকের এই মহানুভবতার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমাদের নেই ৷ এই তথ্যটি পাওয়ার ফলে এই প্রতিবেদক পিলাক সম্পর্কিত আলোচনায় নতুন দিশা পান ৷ কারণ ইতিপূর্বে গবেষকগণ পিলাক নামে আর কোনো স্থান নেই বলে তাঁদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন ৷ অন্যত্রও একটি স্থানের নামের অস্তিত্বের ফলে পূর্বতন বক্তব্যের সারবত্তা থাকেনা ৷ পিলাক নামটি যে মগ জনগোষ্ঠীর দেওয়া নাম সেবিষয়েও একটা দৃঢ়তা আসে ৷ লক্ষ্যণীয় যে মগ বা মারমা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘পিলাক’ ও ‘মুহুরী’ দুটি শব্দই পাওয়া যাচ্ছে ৷ দক্ষিণ ত্রিপুরায়ও পিলাক জনপদ, পিলাক ছড়া, মুহুরী নদী এবং ‘প্লেঙসা’ গোত্রের জনগণ রয়েছে ৷ ইতিহাসের অজ্ঞাত অতীতকালে হয়তো এখানে তাদের রাজধানী ছিল ৷ একটা ক্ষীণ সূত্রকে যদি এখানে আলোচনার জন্যে তুলে ধরা হয় তাহলে হয়তোবা একটু আলোকরেখা দেখা যেতে পারে ৷ রাজমালায় বর্ণিত আছে আনুমানিক 590 খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুররাজা হিমতি ফা বা যুঝারফা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ‘লিকা’ রাজাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী রাঙামাটি দখল করেন ৷

                রাঙামাটি দেশেতে যে লিকা রাজা ছিল ৷

                সহস্র দশেক সৈন্য তাহার আছিল ৷৷

                ত্রিপুর সৈন্য যুদ্ধ করে পরিপাটি ৷

                ভঙ্গ দিয়া সব লিকা গেল রাঙ্গামাটি ৷৷       

                    (শ্রীরাজমালা, প্রথম লহর যুঝার খন্ড)

তখন ‘লিকা’রা আরও দক্ষিণে সরে আসেন ৷ ঐতিহসিকগণ এই ‘লিকা’ জাতিকে মগ বলে চিহ্নিত করেন ৷ তাহলে এই মগরাই পশ্চাদপসরণ করে এই পিলাক অঞ্চলে তাদের নতুন বসতি স্থাপন করে ৷ যেহেতু এই যুদ্ধের ফলে মাণিক্য রাজাদের সঙ্গে, মগদের একটা শত্রুতা তৈরি হয়েছিল সেকারণেই ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস ও সাহিত্যে লিকা বা মগদের পরবর্তী রাজধানী পিলাকের নাম সচেতনভাবেই অনুল্লেখিত রয়ে গেছে ৷

                    আবার এই অঞ্চলে যে মাণিক্য রাজাদের কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে রাজধানী স্থাপন করে এই অঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনা করতেন তার নিদর্শনও রাজমালায় পাওয়া যায় ৷ যেমন—

                     জয়মাণিক্য মহারাজা পাত্রমিত্র লৈয়া ৷

                     উদয়পুরের দক্ষিণে মতাই রহে গিয়া ৷৷

                     মতাইতে রাজধানী করিল রাজন ৷

                     ত্রিপুর পাহাড় দক্ষিণ করয়ে শাসন ৷৷

        গোবিন্দ মাণিক্যের ভাই জগন্নাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র রুদ্রমণি সুবা জয়মাণিক্য নাম ধারণ করে আনুমানিক 1738-1744 খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন ৷রাজমালায় উল্লেখ আছে যে যুঝারফার পরবর্তী পঁচিশতম রাজা ডাঙ্গরফা নামে ত্রিপুরার একজন (আনুমানিক 1280-1300 খ্রি) প্রাচীন রাজা ছিলেন ৷ তাঁর রাজধানী ছিল রাঙামাটি (বর্তমান উদয়পুর) ৷ তিনি তাঁর আঠারোজন পুত্রের মধ্যে একমাত্র রত্নফা ছাড়া বাকি সতেরোজনকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে শাসনভার অর্পন করেন ৷ কালিপ্রসন্ন সেনের রাজমালায় তার উল্লেখ রয়েছে—

                     নিজ রাজ্যভূমি রাজা সকলি দেখিল ৷

                     সপ্তদশ পুত্রে রাজ্য ভাগ করি দিল ৷৷

                     লোমাই নামে পুত্র বড় শিষ্ট ছিল ৷

                     মুহুরী নদীর তীরে নৃপতি করিল ৷৷

                      লাউগঙ্গা মুহুরীগঙ্গা তথায় নদী বসে ৷

                      আর ভ্রাতৃসঙ্গে রাজা বসে সেই দেশে ৷৷

              অন্য আর একটি রাজমালাতে রয়েছে—

                       লোমাই নামে পুত বড় শিষ্ট হয় ৷

                       তার স্থান দিল রাজা মোহরী তীরয় ৷৷

                       লাউগঙ্গা মুহুরীগঙ্গা তাতে নদী আছে ৷

                       ভ্রাতৃর সহিত তানে দিলা সেই দেশে ৷৷

                  এখানে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, লাউগাঙ ও মুহুরী নদীর সঙ্গমস্থলের কাছাকাছি ত্রিপুরার রাজাদের রাজ্যপাট ছিল ৷ বর্তমান লাউগাঙ বাজারের অনতিদূরেই এই দুটি নদীর সঙ্গমস্থল ৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুথিশালায় সংরক্ষিত রাজমালার একখানি প্রাচীন পুথিতে ( নং 2259) আছে—’লোমাই নামেতে তান অন্য পুত্র ছিল / বরগলের সিমা করি তাকে রাজা কৈল’ ৷ এই বরগল বর্তমানে কোন জায়গা তা নির্ণয় করা যায়না ৷

               এছাড়া পিলাক সন্নিহিত মুহুরীপুরের কাছাকাছি ‘বলির দিঘি’ নামে একটি বৃহৎ জলাশয় রয়েছে ৷এই দিঘি যাঁর নামে সেই বলিভীম নারায়ণও ছিলেন রাজপুরুষ ৷ তিনি মহারাজ রত্নমাণিক্যের (1682,1685-1722খ্রি) মাতুল ৷ তিনি জোলাইবাড়ি, পিলাক অঞ্চলকে সাজিয়েছিলেন ৷ এই পর্বতবেষ্টিত জনপদে দিঘি,দেবালয় বাসভবন ইত্যাদি নির্মান করেছিলেন ৷ রাজধানী উদয়পুরের উপর মোগলদের শ্যেনদৃষ্টি ছিল ৷ সেকারণে তিনি এই নিভৃত স্থানটি বেছে নিয়ে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন ৷ তাঁর সম্বন্ধে সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মা লিখেছেন, “ ত্রিপুররাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তবর্তী  বিলোনিয়া উপবিভাগে ‘পিলাক-পাথর’ নামে খ্যাত এক প্রাচীন গ্রাম আছে ৷ এই জনপদ উক্ত রাজ্যের পুরাতন রাজধানী উদয়পুরের দক্ষিণদিকে ন্যূনাতিরেক দ্বাদশ ক্রোশ দূরস্থ পর্বতমালার বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থিত ৷

                       উল্লিখিত গ্রামের উত্তরদিকে প্রবাহিত মুহুরী নদীর সন্নিহিত বলিভীম নারায়ণের নাম সমন্বিত একটি দীর্ঘিকা আছে ৷ এই স্থান নিবাসী জনসাধারণ কর্তৃক কথিত হয় যে, ত্রিপুরাধিপতি গোবিন্দ মাণিক্যের তনয় নৃপাল রাম মাণিক্যের শ্যালক বলিভীম নারায়ণ এই স্থানে বাস করিবার সময় দীর্ঘিকাটি খনন করাইয়াছিলেন ৷”(ত্রিপুরার স্মৃতি-সমরেন্দ্র দেববর্মা,পৃষ্ঠা-71) ৷

                 পিলাকের সংলগ্ন আর একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ মুহুরীপুর ৷ মুহুরী নদীর দুই পার ঘেঁষে এই জনপদ একটি সমৃদ্ধ শস্যভান্ডার ৷ মুহুরী নদীর সঙ্গে বাহিত পলিমাটিতে উর্বর এখানকার চরভূমি ও নিম্ন সমতল অঞ্চল ৷ এই ভূমিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয় ৷ এখানকার সব্জী দক্ষিণ ত্রিপুরার জনজীবনের দৈনন্দিন চাহিদার এক বৃহৎ অংশ পূরণ করে থাকে ৷ এই জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও নয়নমুগ্ধকর ৷ মুহুরীপুরের প্রাচীন নাম ‘লুংথুং’ ৷ ত্রিপুরার মহারাজারা এর নাম পরিবর্তন করে  মুহুরীপুর রাখেন ( সূত্র: পিলাকসভ্যতা, আশিসকুমার বৈদ্য, পৃষ্ঠা-4) ৷ তবে কোন রাজা এই লুংথুং নাম পরিবর্তন করে মুহুরীপুর রাখেন সে বিষয়ে গবেষক আশিসকুমার বৈদ্য কোনো ইঙ্গিত দেননি ৷

               এবারে আসা যাক মুহুরীপুরের আদিনাম লুংথুং প্রসঙ্গে ৷ এই প্রবন্ধের শুরুতে পিলাক সংক্রান্ত আলোচনা ও তার নামের ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে অনুমান করা গিয়েছিল যে, এই অঞ্চলে অতীতে মগ জনজাতির লোকজন বসবাস করত ৷ সেই হিসেবে এও অনুমান করা যায় যে, পিলাক থেকে সামান্য দূরের গ্রাম মুহুরীপুরেও অবশ্যই মগরা বসবস করতেন ৷  সেই হিসেবে লুংথুং নামের পেছনে মগ জনজাতির ভাষার প্রভাব থাকতে পারে ৷ মগ জনজাতির প্রতিনিধি প্রধান শিক্ষক এবং সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শ্রী থৈলাও মগ মহোদয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায় যে, মগজাতির ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায় ৷ ফলে উচ্চারণের সামান্য তারতম্যের কারণে এক জনগোষ্ঠীর কাছে একধরণের অর্থ বয়ে নিয়ে আসতে পারে ৷ ফলে লুংথুং শব্দটি মগ জনগোষ্ঠীর ভাষার শব্দ কিনা সে বিষয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি ৷ অন্যদিকে এই জনগোষ্ঠীর আর একজন প্রতিনিধি এবং মগ ভাষা ও সংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ও লেখিকা, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা ক্রইরী মগ চৌধুরী এই শব্দটি যে মগভাষা থেকে এসেছে সে ব্যাপারে জোরালো দাবি করেন ৷ তিনি জানান যে, লুংথুং শব্দের অর্থ “আবাদ করা বাসস্থান বা আবাসভূমি”৷

         লুংথুং শব্দটির প্রতি ঔৎসুক্য বশত এই প্রাবন্ধিক আধুনিক সোস্যাল মিডিয়ার সুযোগ নিয়ে অতিসম্প্রতি  জাপানে কর্মরত বনকুলের তরুণ মেধাবী যুবক ক্য চি নু মগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ৷ তিনিও লুংথুং শব্দটি যে মগভাষার শব্দ সে বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ৷ তিনি জানান, মগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা  নিজেদের ‘লু’ বলে পরিচয় দেন ৷ আর ‘থং’ শব্দের অর্থ ‘বাসস্থান’ ৷ দুটি শব্দ একত্রে বোঝায় মানুষের বাসস্থান বা মগজাতির বাসস্থান ৷ এরকম প্রত্যেক জনজাতির একটা নিজস্ব পরিচয়সূচক নাম রয়েছে ৷ যেমন ত্রিপরিরা নিজেদের ‘বরক’ বলে পরিচয় দেন ৷ রিয়াংরা বলেন ‘ব্রু’ ৷ গারোরা বলেন ‘মান্দি’ বা ‘আচিক মান্দি’ ৷ মণিপুরিরা নিজের ‘মিতেই’ বলে পরিচয় দেন ৷ কালক্রমে উচ্চারণের বিকৃতির ফলে ‘লু থং’ নামটি ‘লুংথুং’ হয়েছে বলে ক্য চি নু মহোদয় মনে করেন ৷ এই ‘লুথং’ বা ‘লুংথুং’ নামক জনপদটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম মুহুরী ৷ এটিও মগ শব্দজাত বলে গবেষকগণ মনে করেন ৷ মগরা এই নদীকে ‘মুরি খ্যঙ’ বলে থাকেন ৷ তাঁরা বলেন ‘মু’ মানে বৃষ্টি এবং ‘রি’ হল জল ৷ এই দুটি শব্দ একসঙ্গে উচ্চারণ করলে হয় ‘মুরি’ অর্থাৎ এটি ‘বৃষ্টিজলবিধৌত নদী’ ৷ ক্রমশ বঙ্গজনগোষ্ঠীর প্রভাবে মুহুরীতে পরিণত হয়েছে ৷ আর মহারাজ কর্তৃক স্থাননাম পরিবর্তনের কথা তো গবেষকই উল্লেখ করেছেন ৷ আবার মগ জনজাতির বসবাসের ক্ষেত্রে অধিক ঘনত্বের কারণেও নাকি এই স্থানের লু থু নাম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন ৷ লু থু থেকেও লুংথুং হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না ৷ মগরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার নাম নিজেদের নির্ধারিত নামে চিহ্নিত করেন ৷ যেমন, দেবদারুকে বলেন নে-আরু ( দেবতার ছবি বা মূর্তি) , জোলাইবাড়ি> জোলাজি ইত্যাদি ৷ পিলাককে তাঁরা বলেন পা-লাঙ ৷ সাব্রুম মহকুমার বৈষ্ণবপুরকে বলেন পালাঙ-ওয়া ৷ ওয়া মানে যার সম্মুখ দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করে ৷ সেই হিসেবে ধরে নেওয়া যায় পা-লাঙ-ওয়া বা বৈষ্ণবপুর দিয়ে একসময় মগ জনজাতির লোকেরা প্রবেশ করে পিলাক অঞ্চলে যেত ৷ এই নামের মধ্য দিয়ে একটি ঐতিহাসিক সত্যতাও পাওয়া যায় ৷ এছাড়া রাজমালা অনুযায়ী জানা যায় যে,  এই অঞ্চলে একসময় কুকিরা বাস করত ৷ কুকিদের ব্যবহৃত শব্দও এই অঞ্চলের স্থাননামের সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কুকিরা নোয়াখালির খন্ডল পরগনায় আক্রমণ করে হত্যা লুঠতরাজ সংঘটিত করেছিল ৷ তারা টাক্কা-তুলসী পাহাড়ে অবস্থান করত এবং সেখান থেকে সমতল ত্রিপুরায় আক্রমণ শানাত ৷ মতাই থেকে মুহুরীপুর অব্দি কুকিদের ব্যবহৃত একটি প্রাচীন পার্বত্যপথও ছিল ৷ এছাড়া পিলাক থেকে উদয়পুর অব্দি একটি পায়ে হাঁটা পথ ছিল ৷ মগ লোকসঙ্গীত ‘কাইপ্যাতে এই রাস্তাটিকে ‘পাইন্দা মঙ জাঙ্খা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷

                  দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়ামহকুমার বিভিন্ন জনপদ যেএককালে ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা অনস্বীকার্য ৷ অষ্টাদশ শতকের একজন বিদ্রোহী নেতা সমসের গাজি বিলোনিয়া অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করে ত্রিপুরার রাজাদের আক্রমণ করেন ৷ মগরাও বিভিন্ন সময়ে এই মহকুমার বিভিন্ন জনপদের উপর দিয়ে গিয়ে উদয়পুরের রাজধানী আক্রমণ করত ৷ রিয়াং বিদ্রোহের নায়ক রতনমণি রিয়াং এর কর্মতৎপরতা ছিল বিলোনিয়া মহকুমার এই অঞ্চলেই ৷ বিলোনিয়ার বিভিন্ন জনপদের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, “ লাউগঙ্গা মুহুরী নদীতে পতিত হইয়াছে ৷ মতাই বা মোতাই  নামক স্থানে এখনও তহশিল কাছারি আছে এই স্থানে উচ্চ পাড় বিশিষ্ট একটি পুরাতন জলাশয় আছে ৷ এই জলাশয়ের একটি অংশ দিয়াই আধুনিক শালিসী সীমানার লাইন গিয়াছে ৷ মতাই হইয়া লুংথুং এলাকায় যাতায়াতের সুবিধাজনক পার্বত্য রাস্তা আছে এবং এই রাস্তায়ই কুকিগণ পর্বতাভ্যন্তর হইতে আসিয়া মুনসির খিল প্রভৃতি স্থানে ভীষণ অত্যাচার করিয়াছিল ৷ কুকির অত্যাচারের কাহিনিগুলি গ্রাম্য কবির বিরচিত কতকগুলি কবিতায় বর্ণিত আছে “( ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিশ বছর- বিলেনিয়া বিভাগ) ৷

             পিলাক একটি বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র ৷  এই এলাকা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ গবেষকগণ ও ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, এখানে একসময় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল ৷ পিলাকে প্রাপ্ত প্রাচীন মূর্তিগুলি তার সাক্ষ্য বহন করে৷ পিলাকে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোতে যেমন পাল যুগের (8ম—12শ শতাব্দী)  বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় তেমনি বর্মন (1080—1150খ্রি.) ও সেনযুগের ( 1070—1230খ্রি.)হিন্দু রীতির ভাষ্কর্যের প্রমাণও রয়েছে এখানে ৷ পিলাককে কেন্দ্র করে এই জনপদে সাংস্কৃতিক ও চেতনা বিকাশের চর্চা এ অঞ্চলে শুরু হয়েছিল পাল ও সেন যুগে ৷

             পিলাক অঞ্চল যে একসময় সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ছিল তা ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করেন ৷ পিলাকের একটা অংশের নাম সাগর ঢেবা তারই ক্ষীণ সূত্র ধরে রেখেছে ৷ একসময় নৌপথে এই অঞ্চলের সঙ্গে পট্টিকেরা সমতটের নিবিড় যোগাযোগ ছিল ৷  এছাড়া শ্রীহট্ট থেকে শুরু করে কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও আরাকানের কিছু অংশ নিয়ে ছিল হরিকেল সাম্রাজ্য বা হরিকেল মন্ডল ৷ খ্রিস্টিয় দশম শতকের দিকে ছিল এই হরিকেল মন্ডল ৷ ফলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পিলাকের সঙ্গে সে যুগে আরাকানেরও যোগাযোগ ছিল ৷ পিলাকে প্রাচীন হরিকেল মুদ্রা পাওয়া যায় ৷ ফলে বোঝা যায় যে হরিকেল মন্ডলের সঙ্গে পিলাকের যোগাযোগ ছিল ৷ এ প্রসঙ্গে রাজ্যের বর্ষিয়ান গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী উল্লেখ করেন, “  Archaeologically, Tripura is not very old, but it is not devoid of any importance. In the south-western portion of tripura inhabitated in the past by buddhist Mogs, there were several Vihars which might have close link with Pattikera, Lalmai and Maynamati. The remain of rock-cut images of buddha and hindu deities are still extent in certain places. Natural and human agencies have destroyed many of them. Pilak is such a locally famous site.”(An anthropology Of Tripura-Dr. J. C. Ganchoudhury).

                    পিলাক নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেছেন দীপক ভট্টাচার্য ৷ তিনিও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন ৷ অধিকন্তু প্রাচীন আরাকানের সঙ্গে যে এই অঞ্চলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল সেই বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন ৷ তিনি বলেন,” এখানকার মানুষের মানসিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে ৷ শুধুমাত্র বঙ্গ, সমতট নয় পিলাকের ভৌগোলিক অবস্থান ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এখানকার মানুষের মধ্যে আরাকান, বার্মার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ছাপ নজরে পড়ে ৷ তাদের জীবনযাত্রা আচার-আচরণে এই সাদৃশ্য লক্ষ করার মতো ৷ শুধু জীবনযাত্রায় নয়, এমনকি স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যেও বিশেষ অঞ্চলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় ৷ ত্রিপুরার মন্দিরসমূহ সাংস্কৃতিক মিশ্রণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৷ বৌদ্ধ স্তুপশীর্ষ ও বাংলার আটচালাবিশিষ্ট নির্মানশৈলী অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক নতুন স্থাপত্যশৈলী যা ধর্মীয় সহাবস্থান ও সহনশীলতার বাণীই প্রচার করে ৷” ( পিলাক কথা-দীপক ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা-55) ৷

                       সেযুগে পিলাকের নাম যে সুদূর আরাকানে গিয়ে পৌঁছেছিল তারও নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন প্রত্ন উপাদানে ৷ আরাকানের ম্রোহং অঞ্চলের সিত্থাউং প্যাগোডায় রক্ষিত আনন্দচন্দ্রের উৎসর্গীকৃত  অষ্টম শতকের একটি স্তম্ভে উৎকীর্ণ লেখায় ‘পিলাক্ক-বনক’ শব্দটি পাওয়া যায় ৷ এই ‘পিলাক্ক’ থেকে পিলাক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে ৷

                   আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ একসময় এই বিশাল জনপদ জনকোলাহলে পূর্ণ ছিল ৷ কালের প্রবাহে কোনো রাজনৈতিক কারণে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই জনপদ তার অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল ৷ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের সূত্র ধরেই আবার জেগে ওঠে এই জনপদসমূহ ৷ মানুষজনের বাস শুরু হয় ৷ কিন্তু প্রাগুক্ত দীর্ঘ অতীত ইতিহাস কালগর্ভে হারিয়ে যায় ৷ তার ক্ষীণ কিছু উপাদানই এই অঞ্চলের প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ৷ সমগ্র ইতিহাস আজও অনালোচিত, অনালোকিত ৷ নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে সেই ইতিহাস উন্মোচিত হতে পারে ৷ প্রজন্মই পারে সময়ের দাবিকে পূরণ করতে ৷