Friday, June 21, 2019

কেন চেয়ে আছো গো মা

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তর ৷ সে কী স্বপ্ন দেখ ছিল ! স্বপ্ন কী এতো স্পষ্ট হয় ৷ বয়স্কা এক আদিবাসী মহিলা যেন  ৷ যাকে বলে লোলচর্ম ৷ ঠিক ততোটা না হলেও সারামুখে স্পষ্ট বলিরেখায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ৷ হলে কী হবে কালো চাদরে প্রায় আধেকঢাকা শরীর দেখে বোঝা যায় এখনও ভেঙে পড়েনি একসময়ের কর্মজীবী দেহ ৷ একদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মুখে এক ঐশ্বরিক হাসি ৷ কোনোদিন একে দেখেছে বলেও মনে হয়না ৷ এমনিতে এটা পার্বত্য এলাকা ৷ ছোটো ছোটো টিলার উপরে ছড়ানো ছিটানো সব টংঘর ৷ কাল বিকেলে এখানে এসেই কাছাকাছি একটু ঘুরে দেখেছে ৷ রাত্তিরের আশ্রয়টা নিয়েছে এই ফরেস্ট বাংলোতে ৷ কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কিছু কিছু তথ্য ৷ ত্রিপুরি এবং মগ জনগোষ্ঠীর মানুষজন এখানে পাশাপাশি বাস করে ৷ ত্রিপুরিরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ৷ মগরা বৌদ্ধ ৷ তবে এই জায়গাটা সম্বন্ধে তার একটা পূর্ব ধারণা ছিল ৷  তার বাবাও সাতের দশকের শেষ দিকে  এখানকার রামরতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছেন ৷ আশি সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তাঁকে রাতারাতি এলাকা ছেড়ে আসতে হয় ৷ যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সে বাড়ির লোকেরাই রাতের অন্ধকারে বনের পথ ধরে আসাম-আগরতলা সড়কে উঠিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তিনি আর এগ্রামে আসেননি কোনোদিন ৷ মাঝেমাঝে তিনি গল্প করতেন ৷ এই জায়গার কথা ৷ এখানকার লোকজনের কথা ৷ পাহাড়ের উপরের প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরের কথা ৷ ভাবতে ভাবতে আর ঘুম এলোনা ৷ বাংলোর পাশের গাছগাছালিতে পাখিদের বৃন্দগান শুরু হয়েছে ৷ স্বপ্নটা দেখার পর আর ঘুম আসেনি ৷ উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে দূরে কুয়াশাঢাকা পাহাড়ের মাথায় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে লালচে আভা ছড়াচ্ছে ৷

মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বেরোনোর পরপরই চাকরিটা পেয়ে যায় ৷ পোস্টিংও এই তাকমপাড়াতেই ৷ কদিন আগেই বাবা চলে গেছেন ৷ ক্যান্সারটা থার্ড স্টেজে ধরা পড়ে ৷ দীপ্তদের আর কিছু করার তেমন সুযোগ ছিলনা ৷ মা কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন ৷ ছেলেকে কাছে কোথাও পোস্টিং হয় কিনা চেষ্টা করতে বললেন ৷ কিন্তু দীপ্ত জানে সরকারি সুযোগ নিয়ে এমডি করতে গেলে অন্তত তিনবছর গ্রামীন এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৷ তাই সে মাকে রাজি করিয়ে এখানে পোস্টিং নেয় ৷ ধীরে ধীরে এলাকায় একটা পরিচিতিও হয়ে যায় তার ৷ হৃদয়বান চিকিৎসক হিসেবেও ৷ গরীব ও বয়স্ক রোগীদের সঙ্গে মা-মাসি, কাকা-জেঠু বলে ডেকে অসুবিধার কথা জেনে নিত ৷ চিকিৎসা করত ৷

একদিন বিকেলের শিফটে আউটডোরে বসেছে অর্ক ৷ সারিতে রোগী তেমন নেই ৷ মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে বারো থেকে চোদ্দোজন হবে ৷ রোগি দেখতে দেখতে সে সারিবদ্ধ রোগিদের দিকে তাকাচ্ছিল ৷ পরিচিতির সুবাদে দুএকজনের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করাসহ কুশলও জেনে নিচ্ছিল ৷ সে লক্ষ করছিল একেবারে শেষের দিকের একজন বয়স্ক মহিলা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই রয়েছে ৷ আর হাসছে মিটিমিটি ৷ শেষসময় যখন সে এগিয়ে এল দীপ্তর মনে হল একে যেন সে কোথাও দেখেছে আগে ৷ কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা ৷ বুড়িকে জিজ্ঞেস করল , তামঅ অংখা নিনি আমা ৷ মা তোমার কী অইছে? ইতোমধ্যে স্থানীয় ভাষাও শিখে নিয়েছে সে ৷
—কী আর আর অইবো ৷ লুমজাক ৷ জ্বর হইছে ৷
দীপ্র গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুড়ির প্রচন্ড জ্বর ৷ এটা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা ৷ কনফার্ম না হয়ে চিকিৎসা করা ঠিক হবেনা ৷ দুটো পাঁচশো এমজি প্যারাসিটামোল দিয়ে বলল, রাত্রে একটা খাইয়া লাইও খাইবার পরে ৷ জ্বর থাকলে সকালে আর একটা খাইবা  ৷ সকালে এখানে আইয়া রক্ত পরীক্ষা কইরা যাবে ৷ তারপর দরকার অইলে অষুধ দিব ৷
বুড়ি যেন দীপ্রর কথা শুনছেইনা ৷ অপলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ৷ হাসিটি লেগে রয়েছে মুখে ৷
—কি অইছে বুঝছেনি?
—ইঁ ৷ সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় বুড়ি ৷ দাক্তর, তুই কী অসিত মাসতর পোলা নি?  আচমকা প্রশ্ন করে বসে বুড়ি ৷ দীপ্রও হতচকিত হয়ে যায় ৷ তার বাবার নাম কী করে জানল বুড়ি? 
দীপ্রও জবাব দেয়, হ ৷ তুমি আমার বাবার নাম কী কইরা জানলা?
—জানে জানে ৷ নিজের মানুর নাম জানতো লাগে ৷ আমার তো ভুল অইছেনা তাইলে ৷ তুমার বাবা ভালা আছেনি?
—না ৷ তাইনে তো মারা গেছে কয়েকমাস আগে ৷
অ..অ.. ৷ লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর দেখা হইলনা ৷ খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল বুড়ি ৷ দীপ্র লক্ষ্য করল যে হাসিমুখ নিয়ে সে এতোক্ষণ দীপ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল সেই মুখশ্রী যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ৷ চোখজোড়া ছলছল ৷ দুটো অশ্রুবিন্দু দুগাল বেয়ে নেমে আসছে ৷ বাইরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে ৷ সে আঁধার যেন জীবনের শেষবেলায় উত্তীর্ণ এই বয়স্ক মহিলার মুখটাকেও ঢেকে ফেলছে ৷
—হক্কলে আমারে থকাইলো ৷ হক্কলে ৷ বলতে বলতে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধা ৷ দীপ্র হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সেদিকে ৷
ডাকবাংলোর বারান্দায় একাকী বসে রয়েছে দীপ্র ৷ সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ৷ দূরে টিলার উপরে কিছু দূরে দূরে ক্ষীণ আলোর সারি ৷ ওগুলো পার্বত্যপল্লীর টংঘরগুলোর আলো ৷ কতো দূরে অথচ কত উজ্জ্বল ৷  আজ বিকেলের ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা বারবার তার মনে উঁকি দিচ্ছে ৷ ভাবছে কাল বুড়ি রক্তপরীক্ষা করতে এলে ভালো করে জেনে নেবে সব ৷ এরমধ্যেই কেয়ারটেকার কুসুমকুমার কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ৷
—স্যার আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?  বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
—না ৷ ওসব কিছুনা ৷ বসো ৷ বলছি ৷ বৃদ্ধার চেহারা বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি চেন এই মহিলাকে?  হ্যাঁ বাবু ৷ ওতো আমাদের তিরুপতি আমা ৷ ওই যে  আলো জ্বলছে দূরে ৷ রামরতন পাড়া ৷ ওখানেই থাকে ৷ তিনকুলে কেউ নেই তার ৷ বিয়েও করেনি ৷ গ্রামের মানুষই সাহায্য সহায়তা ৷ সামান্য লেখাপড়া জানে ৷ গ্রামে ট্যুইশানি করে যা পায় তা দিয়ে চালিয়ে নেয় ৷ শুনেছি দাঙ্গার সময় তাদের বাড়িতে এক মাস্টার থাকত ৷ সে তাকে পড়াত ৷ তাদের মধ্যে একটা ভাবও হয়েছিল ৷ কিন্তু সমাজ মেনে নিতে চাইছিলনা ৷ দাঙ্গার সময় একরাতে উগ্রপন্থীরা মাস্টারকে তুলে  নিয়ে যায় ৷ তারপর আর মাস্টারের খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷ তিরুপতি আমা আর বিয়ে থা করেনি ৷ চলুন আপনার খাবার দিই ৷
— হ্যাঁ, চলো ৷

মাঝরাতে আবার স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল ৷ সেই প্রথম রাতে দেখা সেই মুখ সেই পোষাক ৷ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ আজ মনে করতে পারল তিরুপতি আমাকে কেন চেনা চেনা লাগছিল ৷ সেই তো স্বপ্নে দেখা দ্য়েছিল সেদিন ৷ আজও আবার ৷ চমকে উঠল সে একই স্বপ্ন আবার দেখে ৷
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল ৷ রাত গভীর ৷ চারদিক সুনসান ৷ গাঢ় রাতের দরজা ভেঙে একটা করুণ পাহাড়ি বিলাপ রামরতনপাড়ার অন্ধকার আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে ৷

No comments:

Post a Comment