ডাঅর লাইগজে, ডাঅর
আষাঢ় মাসের এই অঝোর বর্ষণকে লক্ষ্য করে আমার মা একটা প্রবাদ বলতেন-দশরথের দশদিন/দেবতা করে রাইত দিন । আষাঢ় মাসের এই লাগাতর বর্ষণদিনগুলোর কয়েকটা নাম আছে । এগুলোর এক একটাকে ' ডঅর' বা 'ডাঅর' বলা হয় নোয়াখালি ভাষায় । এভাবে আষাঢ়ের প্রথম দশদিন 'দশরথের ডাঅর' ,রথযাত্রায় তিনদিনের 'রথের ডাঅর', 'অম্বুবাচীর ডাঅর' ইত্যাদি । এখনকার বৌ ঝিরা এসব লোকসাংস্কৃতিক বিষয় জানে কী ? না জানারই কথা ৷ কারণ এখন বর্ষাকালের সেই মেজাজ এবং চরিত্র হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ এখন আর সেই 'ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিন' আর দেখাই যায়না ৷ সেতার বা সরোদবাদকের নিমগ্ন দীর্ঘবাদনের মতো লাগাতর বর্ষণ তো বিলোপের পথে ৷ জলে ভেজা শরীরে লেপ্টে থাকা ততোধিক ভেজা কাপড় নিয়ে পুকুরঘাট থেকে উঠে আসা তরুণীর মতো মনে হত চারধারের গাছগাছালিকে ৷ মনে হত পবিত্র অবগাহনের শেষে প্রকৃতির বন্দনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সমস্ত চরাচর ৷
সেসময়ে লাগাতর বর্ষা হলে ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে সকল পরিবারে অন্নাভাব দেখা দিত ৷ মাঠেঘাটে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষিশ্রমিকের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হত ৷ গৃহস্থের গোলায় ধান থাকলেও 'কোথা হা হন্ত'! একদিন দুদিনের বেশি তৈরি চাল ঘরে থাকতনা ৷ কারণ তখনকার সময়ে চালকল ছিলনা ৷ কাজেই মিলে ভাঙানো চালের প্রশ্নই ওঠেনা ৷ প্রায় গৃহস্থবাড়িতে ছিল ঢেঁকির প্রচলন ৷ 'বুদ্ধির ঢেঁকি' বলে প্রবাদে রসিকতা করা হলেও গৃহস্থের ধানভানার মুশকিল আসান ছিল এই ঢেঁকি ৷ 'ধান ভানো রে ভানো রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া' গাইতে গাইতে তরুণী বৌ-ঝিরা ওক্তের চাল ওক্তে তৈরি করে নিত আর দশটা কাজের ফাঁকে ৷ ঢেঁকিতে চাল কুটার আগে ধান ভেজানো, ধান সেদ্ধ করা, রৌদ্রে শুকানো ইত্যাদি অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ঢেঁকির পর্যায়ে আসত ৷ দীর্ঘবর্ষা হলে এইসব ধারাবাহিক পর্যায়ে ছন্দপতন ঘটত ৷ ফলে বর্ধিষ্ণু কৃষকের ঘরেও অন্ন থেকেও নেই অবস্থা হত ৷ পটু গৃহিনী আবার আবার গ্রামীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্নপূর্ণার দায়িত্ব পালন করতেন ৷ কষ্ট করে পরিবারের সবার মুখে অন্ন তুলে দিতেন ৷ জলে ভিজিয়ে সেদ্ধকরা ধান রৌদ্রে দেওয়া যাচ্ছেনা লাগাতর বৃষ্টির জন্যে ৷ গিন্নি বসে গেলেন ঢেঁকির পাশে করে স্থায়ী মাটির উনুনে আগুন দিয়ে কড়াই বসিয়ে ৷ উনুনে আঁচে কড়াইতে ধান গরম করে জল শুকিয়ে নিয়ে ঢেঁকিতে ফেলে কুটে নিচ্ছেন ৷ তাঁর পরিশ্রমের অন্নে পরিবারের দশজনের উদরপূর্তি ঘটছে ৷ শুধু তাই নয় ৷ এই পদ্ধতিতে ধার-উধার, সাহায্য-সহায়তার মাধ্যমে প্রতিবেশীর মুখেও হাসি ফুটতে দেখা গেছে বর্ষণসিক্ত বনবাদাড়ের নাম জানা-অজানা ফুলগুলোর মতো ৷ অভাবের মধ্যেও বর্ষাদেবী দুখিমানুষদের কেমন সম্প্রীতির বাঁধনে ও মমতায় পরস্পরকে কাছে টানত ৷
আজ বর্ষার সেই অপরূপ রূপমাধুরীও নেই ৷ সেই কান্নাঝরা মায়া কিংবা করুণাও নেই ৷ প্রকৃতির নির্মম রোষে আজ সব হারিয়ে যাচ্ছে ৷ ইট-কাঠ-পাথরের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কোমল সুষমা ৷ প্রকৃতি যেমন কোমল মাধুর্য হারিয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে তেমনি প্রকৃতির সন্তান মানুষের অন্তরও হয়ে উঠছে নির্মম ও নিষ্ঠুর ৷ প্রকৃতিকে হারিয়ে আমরাও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠছি ক্রমশ ৷ এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব ৷
Tuesday, June 18, 2019
ডা অ র
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment